ইতিহাস ইতিহাস অনেক মহান মহান ব্যক্তিত্বদের কৃতকর্ম লিপি করে রেখেছে তার পাতায়। সেই পাতাগুলোতে কখনও ধুলো জমে যাবে নাহ্। ধুলো না জমা সেই পাতা থেকে আজ তুলে ধরছি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথা। যার সম্পর্কে লিখতে গেলে এই ফেইসবুকের পোস্টের শব্দের সীমানা পাড়ি দিয়ে দিবে। তারপরও বাকি থেকে যাবে অনেক কিছু। যতটুকু সম্ভব তুলে ধরলাম। আশা করি ভালো লাগবে আপনাদের। সুভাষচন্দ্র বসু, জন্ম: ২৩ জানুয়ারি, ১৮৯৭ – মৃত্যু: একটি রহস্য ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তি নেতা। তিনি নেতাজী নামে সমধিক পরিচিত। সুভাষচন্দ্র পরপর দু-বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন গান্ধিজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ ও সত্বর স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এগারো বার কারারুদ্ধ করেছিল। তাঁর বিখ্যাত উক্তি "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তাঁর মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতার সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করেন ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দান করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন; এমনকি কেউ কেউ তাঁকে নাৎসি মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে ভারতে অন্যান্যরা তাঁর ইস্তাহারকে রিয়েলপোলিটিক (নৈতিক বা আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ব্যবহারিক রাজনীতি)-এর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে তাঁর পথপ্রদর্শক সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেছেন। উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাঁকে সমর্থন করেন। শেষপর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি ও তাঁর জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র গান্ধি-আরউইন চুক্তি বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তাকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। মনে করা হয় ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। তবে তার এই তথাকথিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধ প্রমাণও বিদ্যমান। প্রথম জীবন: ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি, বর্তমান ওডিশা রাজ্যের কটক শহরে (ওডিয়া বাজার) জন্মগ্রহণ করেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন কটক-প্রবাসী বিশিষ্ট বাঙালি আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র একটি কটকের ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন; বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টুয়ার্ট স্কুল। এরপর তাকে ভর্তি করা হয় কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। সুভাষচন্দ্র ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতা থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিকসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভরতি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান। কিন্তু বিপ্লব-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে [নিজেকে] প্রত্যাহার করে নেওয়া"। এই সময় অমৃতসর হত্যাকাণ্ড ও ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ দমনমূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ভারতে ফিরে সুভাষচন্দ্র 'স্বরাজ' নামক সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন বাংলায় উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তার অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাকেও বন্দি করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। এখানে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তিনি ধ্যানে অনেক সময় অতিবাহিত করতেন। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি তার দেশপ্রেমিক সত্তার জন্য পরিচিত ছিলেন। কর্মজীবন ও রাজনীতিতে প্রবেশ: প্রায় বিশ বছরের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র মোট ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার প্রথম প্রেম এমিলি শেঙ্কল-এর সঙ্গে পরিচিত হন ভিয়েনাতে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তারা ব্যাড গ্যাস্টিনে বিয়ে করেন। তার পিতার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার তাকে শুধু মাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের উদ্দ্যেশে কিছুক্ষণের জন্য কলকাতায় আসার অনুমতি দেয়। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গান্ধির বিরোধিতার মুখে ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্বিতীয় বারের জন্য ত্রিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে গান্ধি পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন দেন; নির্বাচনের ফলাফল শোনার পর গান্ধি বলেন "পট্টভির হার আমার হার"। কিন্তু জয়যুক্ত হলেও তিনি সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারছিলেননা। গান্ধির অনুগামীরা তার কাজে বাধা সৃষ্টি করছিলেন। গোবিন্দ বল্লভ পন্থ এই সময় একটি প্রস্তাব পেশ করেন যে, "কার্যনির্বাহক পরিষদকে পুনর্গঠন করা হোক"। এভাবে সুভাষচন্দ্র বসু এই নির্বাচনে জয়লাভ করলেও গান্ধির বিরোধিতার ফলস্বরূপ তাকে বলা হয় পদত্যাগ পত্র পেশ করতে; নইলে কার্যনির্বাহী কমিটির সকল সদস্য পদত্যাগ করবে। এই কারণে তিনি নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেণ এবং অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় পরিকল্পনা পরিষদের প্রস্তাবনা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: সুভাষ চন্দ্র বসু প্রস্তাব করলেন, কবে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের স্বাধীনিতার অনুমোদন দেবে তার জন্য বসে না-থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সুবিধা নেওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নির্ভর করে অন্য দেশের রাজনৈতিক, সামরিক ও কুটনৈতিক সমর্থনের উপর। তাই তিনি ভারতের জন্য একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অন্তর্ধান পর্ব: ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে সুভাষচন্দ্র বসু খুশি ছিলেননা। তিনি সে সময় গৃহবন্দি ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ব্রিটিশরা তাকে যুদ্ধের আগে ছাড়বেনা। তাই তিনি দুটি মামলা বাকি থাকতেই আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আফগানিস্তানের পশতু ভাষা জানা না-থাকায় তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের উত্তর-পশ্চিম সিমান্ত প্রদেশের নেতা মিয়া আকবর শাহকে তার সঙ্গে নেন। যেহেতু তিনি পশতু ভাষা জানতেননা তাই তার ভয় ছিল, আফগানিস্তানবাসীরা তাকে ব্রিটিশ চর ভাবতে পারে। তাই মিয়া আকবর শাহের পরামর্শে তিনি অধিবাসীদের কাছে নিজেকে একজন কালা ও বোবা বলে পরিচিত করান। সেখান থেকে সুভাষ বসু মস্কো গমন করেন একজন ইতালির 'কাউন্ট অরল্যান্ডো মাজ্জোট্টা' নামক এক নাগরিকের পরিচয়ে। মস্কো থেকে রোম হয়ে তিনি জার্মানি পৌঁছান। তিনি বার্লিনে মুক্ত ভারতীয় কেন্দ্র (Free India Center) গড়ে তোলেন। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে হিটলারের উদাসিনতা তার মনোবল ভেঙে দেয়। ফলে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সুভাষ বসু জার্মান ত্যাগ করেণ। একটি জার্মান সাবমেরিন তাকে সমুদ্রের তলদেশে একটি জাপানি সাবমেরিনে পৌঁছে দেয়, সেখান থেকে তিনি জাপান পৌঁছান। এদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বীরত্বে হিটলার-তোজো-র মতো একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসীরাও তার সামনে মাথা অবনত করে মৈত্রীর দিকে হাত বাড়ান। ভারতের অরবিন্দ ঘোষ, সূর্য সেন, ভগৎ সিংয়ের মতো নেতারা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম'র মতো কবিরা তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। সমস্ত ভারতবাসীর নয়নমণি হয়ে উঠেন নেতাজি। ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী: ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রাসবিহারী বসু এই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সুভাষ চন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেণ । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট)সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ (পঁচাশি হাজার) সৈন্য ছিল। এই বাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার" (আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষ শক্তির ৯টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। আইএনএ-র সৈন্যরা জাপানিদের আরাকান ও মেইক্টিলার যুদ্ধে সাহায্য করে। সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আইএনএ-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে আইএনএ-তে যোগ দেবে। কিন্তু এই ব্যাপারটি তেমন ব্যাপকভাবে ঘটলনা। বিপরীতদিকে, যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। একই সময় জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আইএনএ আত্মসমর্পণ করে। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্মার (বর্তমান মায়ানমার) মান্দালয়ের জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় সুভাষচন্দ্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকার তাকে এক শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হন যে, ভারতের কোনো ভূখণ্ড না-ছুঁয়ে তিনি যদি বিদেশে কোথাও পাড়ি দেন তবে মুক্তি পাওয়া যাবে। সুভাষচন্দ্র ইউরোপে যাওয়া মনস্থ করেন ও ভিয়েনা পৌঁছান। দু-বছর চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে অবসরে তিনি দুটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন, তার আত্মজীবনী 'Indian Pilgrim' আর 'India's Struggle for Freedom'। সেই সময়ে তার পাণ্ডুলিপি টাইপ করার জন্যে এক অস্ট্রিয়ান মহিলা এমিলি শেংকেল তাকে সাহায্য করেন যিনি পরবর্তীকালে তার সচিবও হন। এই এমিলি শেংকেলের সঙ্গেই পরবর্তীকালে তার প্রণয় ও পরিণয়। তাদের এক কন্যাসন্তান অনিতা বসু পাফ। এমিলি শেংকেল কখনো ভারতে আসেননি, কিন্তু বৃহত্তর বসু পরিবার ও নেতাজির সহযোগীদের সঙ্গে তার চিরকাল যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক ছিল । ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রয়াত হন। অনিতা বসু পাফ তার পিতার দেশ ভারতে বহুবার এসেছেন। তিনি পেশায় অর্থনীতিবিদ, তার স্বামী মার্টিন পাফ জার্মান পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য। তাদের দুই পুত্র ও এক কন্যা। ভিয়েনায় যেভাবে বিদেশিনীর প্রেমে পড়েছিলেন সুভাষ বসু: ১৯৩৪ সালের কথা। নেতাজি হিসেবে পরিচিত সুভাষ চন্দ্র বসু সেসময় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে ছিলেন। তাঁর শরীর বেশ কিছুদিন ধরেই খারাপ হচ্ছিল। ১৯৩২-এর ফেব্রুয়ারী থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার সময় থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য সুভাষ বসুকে শেষমেশ ইউরোপে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার, তবে শর্ত চিকিৎসার খরচ তাঁর পরিবারকেই দিতে হবে। ভিয়েনায় চিকিৎসা করানোর সময়ই সুভাষচন্দ্র ঠিক করলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে ইউরোপে বসবাসরত ভারতীয় ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করা দরকার। এক ইউরোপীয় প্রকাশক ওই সময় তাঁকে 'দা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল' নামে একটা বই লেখার কাজ দেন। বইটি লেখার জন্য একজন সহকারীর প্রয়োজন হল, যিনি ইংরেজী আর টাইপিং - দুটোই ভালমতো জানবেন। সুভাষ চন্দ্রের বন্ধু ড. মাথুর দুজনের নাম সুপারিশ করে পাঠালেন। তার মধ্যে যাঁকে বেশী উপযুক্ত মনে হল - তাঁকে সাক্ষাতকারের জন্য ডেকে পাঠালেন সুভাষ। কিন্তু কথাবার্তা বলে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তখনই দ্বিতীয়জনের ডাক পড়ল। ২৩ বছর বয়সী এমিলি শেঙ্কল এসেছিলেন ইন্টারভিউ দিতে। সুন্দরী অস্ট্রিয়ান ওই যুবতীকেই সহকারী হিসাবে কাজে নিয়োগ করলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৩৪ সালের জুন মাস। সুভাষ চন্দ্রে বয়স তখন ৩৭ বছর। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল কী করে ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতকে স্বাধীন করা যায় তার ওপর। মিজ. শেঙ্কলের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ধারণাও করতে পারেন নি যে ওই অস্ট্রিয় যুবতী তাঁর জীবনে একটা নতুন ঝড় তুলে দিতে পারেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর বড়ভাই শরৎ বসুর নাতি ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুগত বসু নিজের বই 'হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট - সুভাষ চন্দ্র বসু এন্ড ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল এগেইনস্ট এম্পায়ার'-এ লিখেছেন, এমিলির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই সুভাষের জীবনে একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল। সুগত বসুর মতে তার আগে পর্যন্ত সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনে প্রেম বা বিয়ের বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছিল। সেসবে তাঁর কোনও আগ্রহই ছিল না। কিন্তু এমিলির সৌন্দর্য্য সুভাষের ওপরে যেন কী একটা জাদু করে দিল। বিখ্যাত উক্তি: সুভাষচন্দ্র বসুর সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হল, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব" (হিন্দিতে, তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙ্গা)। ৪ জুলাই ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্মাতে এক র‌্যালিতে তিনি এই উক্তি করেন। তার আর একটি বিখ্যাত উক্তি হল 'ভারতের জয়' ('জয় হিন্দ'), যা কিনা পরবর্তীতে ভারত সরকার গ্রহণ করে নেয়। অন্তর্ধান ও তথাকথিত মৃত্যু: একটি মতে নেতাজি সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বন্দি অবস্থায়, সাইবেরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। আর একটি মতে, বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজির চিতাভস্ম পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে -ওই চিতাভস্ম নেতাজির নয়। আসলে ভারতবর্ষে নেতাজির তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একদল উঁচুতলার ভারতীয় নেতা(জওহরলাল নেহেরু) এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে নেতাজিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। তাই ভারতীয় সরকার কখনো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ জনসমক্ষে আনেননি। অনেকের মতে ফৈজাবাদের ভগবান জি ওরফে গুমনামি বাবা হলেন নেতাজি। কিন্তু এ ব্যাপারটি আজও স্পষ্ট নয়। আরেকটি মতে নেতাজি নাকি আজো জীবিত! সম্মাননা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে 'দেশনায়ক' আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।" আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে , ত্রিপুরায় , অসমে ও ওডিশায় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তার নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তার নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তার নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: 'নেতাজি ভবন' (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও 'নেতাজি' (পূর্বনাম কুঁদঘাট)। . . তথ্যসূত্র: ↑ "১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে হরিপুরায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে সুভাষ বসু প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রবর্তনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং এই প্রচেষ্টা কার্যকর করা হলে তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার আবেদন করলেন। এছাড়া সুভাষ বসু কংগ্রেসকে একটি ব্যাপক গণসংগঠনে পরিণত করে জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানালেন। কংগ্রেস সভাপতি পদে আসীন থাকার সময় সুভাষ বসু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বর্জন ও আপোষহীন সংগ্রামের সপক্ষে বলিষ্ঠ মতামত প্রকাশ করতে লাগলেন। জুলাই মাসে (১৯৩৮ খ্রি.) এক বিবৃতিতে তিনি ঘোষণা করলেন–"কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য যদি ফেডারেশন সম্পর্কে কোনো আপোষরফায় রাজি হয় তাহলে কংগ্রেস দলে গৃহযুদ্ধের সূচনা হবে।" আধুনিক ভারত (১৯২০–১৯৪৭), দ্বিতীয় খণ্ড, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১৫২ ↑ আধুনিক ভারত (১৯২০–১৯৪৭), দ্বিতীয় খণ্ড, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১৫৬ ↑ "করাচি কংগ্রেস উদ্বোধনের ঠিক আগে ২৩ মার্চ ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসির ঘটনায় তীব্র হয় র‌্যাডিকাল জাতীয়তাবাদীদের হতাশা ও ক্রোধ।" আধুনিক ভারত (১৮৮৫-১৯৪৭), সুমিত সরকার, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০০৪, পৃ.২৬৭ ↑ "ভাইসরয় আরউইন গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব করে প্রথম যে ঘোষণা করেন তাকে সুভাষচন্দ্র প্রথম থেকেই খুব সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল আসলে এটি ব্রিটিশ সরকারের একটি ফাঁদ মাত্র। প্রথমে মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালব্য, সর্দার প্যাটেল প্রমুখ নেতারা ও গান্ধিজি নিজে আরউইনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে একটি বিবৃতিতে সই দেন। সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল এবং আরো কয়েকজন এর বিরোধিতা করে পৃথক এক ইস্তাহার প্রচার করার মনস্থ করেন। কিন্তু... জওহরলাল গান্ধিজির কথায় তাঁর মত পরিবর্তন করেন।" দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র: এক ঐতিহাসিক কিংবদন্তি, নিমাইসাধন বসু, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ১৩৯ ↑ "রাজনৈতিক গুরু হিসাবে সুভাষচন্দ্র গান্ধিজির তুলনায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকেই গণ্য করেছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশবন্ধু নির্দেশিত পথই অনুসরণ করে গিয়েছেন।

1
$
User's avatar
@mahmudakter posted 3 years ago

Comments