ঘন নীল পানির একটা দীঘিতে আমি আস্তে আস্তে ডুবে যেতে থাকি। একটু আগে ভ্যাপসা গরম লাগছিল। শীতল পানির স্পর্শে খুব আরাম লাগছে। আমার চোখ বুজে আসে। ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেকটা বিছানায় শোয়ার ভঙ্গীতে আমি আস্তে আস্তে দীঘির আরো গভীরে ডুবে যেতে থাকি। চারপাশের নীল রঙের আলো হারিয়ে যেতে থাকে। হালকা নীল রঙ থেকে চারপাশ গাঢ় নীল রঙের হয়ে যায়। তারপর আরো গাঢ়। তারপর প্রায় কালো রঙের অন্ধকার। এবার আমার ভয় করতে থাকে। আমি কি ডুবে মারা যাচ্ছি?
‘ধুর, স্বপ্নের ভেতর কেউ মারা যায় নাকি?‘ দূর থেকে কোন একটা মেয়ে কথা বলে ওঠে।
কে কথা বলে? আমি প্রাণপণে মেয়েটাকে খুঁজতে থাকি। আমার চারপাশ আরো গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায়। তীব্র ভয়ে আমার শরীর দুর্বল হয়ে আসে।
ধীরে ধীরে মেয়েটা আমার সামনে চলে আসে। পানিতে মেয়েটার চুলগুলো দুলতে থাকে। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা মুখে আঙুল দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
‘চল, সামনের বাসটায় উঠে আমরা পালিয়ে যাই। বাসটার শেষ স্টপেজে আমরা নামব। তারপর সেখানে একসাথে থাকব।‘
আমার ঘুম ভেঙে গেল। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম। ঘামে বিছানা ভিজে গেছে। সিলিং ফ্যানটা ঘটর-ঘটর শব্দ করে ঘুরছে। এই ফ্যানটায় প্রচণ্ড শব্দ হয় কিন্তু বাতাস তেমন হয় না। একেই বোধহয় বলে ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’।
স্বপ্নের মেয়েটাকে আবার দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে হয় আবার ঘুমিয়ে পড়ি, স্বপ্নের বাকিটা যদি দেখতে পাই! কিন্তু যে বিশ্রী গরম তাতে আর ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। ঘরের ভেতর অন্ধকার হয়ে আসছে। সন্ধে হয়ে গেছে বোধহয়। ইদানীং ছুটির দিনগুলোয় দুপুরে লম্বা ঘুম হচ্ছে। কিছুদিন আগেও দুপুরে ঘুমাতে পারতাম না।
স্বপ্নের বাকী অংশটায় কী ঘটত কে জানে! মেয়েটার কথা ভেবে আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে ওঠে। খুবই মায়াকাড়া চেহারা মেয়েটার। কী আশ্চর্য শান্ত দুটো চোখ!
মেয়েটা ছেলেটার (আমার!) হাত ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। চারপাশের অন্ধকার কেটে যেয়ে সেই হালকা নীল রঙের আলোটা আবার দেখা যায়। মেয়েটা ছেলেটাকে টেনে তীরে তুলে ফেলে। বিশাল বড় দীঘি। প্রথমে নদী বলে ভুল হয়। টলটলে নীল পানি। মেঘহীন বিশাল আকাশের ছায়া দীঘিটার বুকে। দীঘির চারপাশে বড় বড় ঘাস। একপাশে একটা গাছ। তারপাশে চওড়া পিচ ঢালা রাস্তা। মেয়েটা ছেলেটাকে নিয়ে গাছটার নিচে বসে আছে। শক্ত করে ছেলেটাকে ধরে রেখেছে, যেন আবার কোথাও হারিয়ে না যায়।
‘প্রথম যে বাসটা আসবে আমরা সেটাতেই উঠে পড়ব।‘
‘ঐ বাসের শেষ স্টপেজ যদি কাছেই কোথাও হয়? হয়ত এর পরের স্টপেজটায় শেষ স্টপেজ। তাহলে আমাদের পালানো হবে কেমন করে?’ ছেলেটা বেরসিকের মত জিজ্ঞেস করে।
‘এই এলাকাটা আমি চিনি। এখানে কাছে কোথাও কোন স্টপেজ নেই। সবচেয়ে কাছের স্টপেজটাও অনেক দূরের পথ।‘
‘কতক্ষণ লাগবে ওখানে যেতে?’
‘চার-পাঁচ ঘন্টা।’
‘আমার যে খিদে পেয়েছে।’
আসলেই আমার খুব খিদে পেয়েছে। সেই কোন দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে পানসে ব্রয়লারের মাংস দিয়ে কয়টা ভাত খেয়েছি! নুরু মিয়া এমনিতেই জঘন্য রান্না করে, আজকেরটা ছিল স্পেশাল জঘন্য।
কাওসার ভাইয়ের রুম থেকে হইচই শোনা যাচ্ছে। সান্ধ্য আড্ডা জমে গেছে মনে হয়। আমাদের এটা মেস বাড়ি। একটা দোতলা বাড়ির নিচতলায় আমরা কয়েকজন মেস বানিয়ে থাকি। দোতলায় থাকে বাড়িওয়ালা নিজে। গ্রীন রোড দিয়ে ভুতের গলিতে ঢুকে কিছুদূর যাওয়ার পর ডাইনে একটা সরু গলি। সেই গলির প্রথম চারটা বাড়ির পরই এই মেসবাড়ি। চারপাশে ছয়-সাত তলা উঁচু উঁচু বাড়ি, তার মাঝে এই ছোট দোতলা বাড়িটাকে কেমন অসহায় দেখায়। এই বাড়ির বাসিন্দাদের জন্য আকাশটা খুব ছোট। চারপাশের বিল্ডিংগুলোর অত্যাচারে ছোট চারকোণা আকাশের বেশি দেখা যায় না। শালার আকাশটাও আজকাল বড়লোকদের হয়ে গেছে।
এই মেসের বেশিরভাগ বাসিন্দাই আমার মত কমবয়সী চাকরিজীবী, যারা ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে কেউ বেশি বছর থাকে না। একটু প্রতিষ্ঠিত হলেই বিয়ে-শাদি করে এখান থেকে চলে যায়। এই আসা যাওয়ার মাঝে শুধু কাওসার ভাইই কন্সট্যান্ট। কাওসার ভাইয়ের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাল চাকরী করেন। তারপরও বেচারার সংসার করা হল না। ভদ্রলোক চিরকুমার মানুষ। ঠিক চিরকুমার না। যুবক বয়সে কাওসার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল। পারিবারিক ভাবে বিয়ে। সেই বউ দুইদিন সংসার করে তিন দিনের দিন যাবতীয় গয়নাগাটি নিয়ে তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেল। এই দুই দিনেই কাওসার ভাই তাঁর বউয়ের এমনই প্রেমে পড়লেন যে সেখান থেকে আজও বের হতে পারলেন না।
‘কাওসার ভাই, একটা বিয়ে করে ফেলেন, অনেকদিন বিয়ে খাই না।‘
‘না ভাই, আমার এক জীবন, এক নারী, এক ভালবাসা। বিয়ে-টিয়ের ঝামেলায় আর যাবো না।‘
‘কী যে বলেন! এই যুগে কেউ এমন দেবদাস হয়ে থাকে নাকি?’
‘ধুর মিয়া, দেবদাস হতে যাবো কোন দুঃখে। তোমাদের কি মনে হয়, আমি খুব দুঃখে থাকি?’
না, কাওসার ভাইকে দুঃখী মনে হয় না। বেশ মজাতেই থাকেন। সবসময় হাসি হাসি মুখ। সকাল বেলা গোসল করতে করতে গান ধরেন,
‘ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে,
তোমারে করেছে রাণী,
তাই তোমার দুয়ারে কুড়াতে এসেছি,
ফেলে দেয়া মালা খানি।‘
প্রতিদিন সকালে গোসল করতে গেলে এই একই গান গাইবেন। আমি গত ছয় মাস ধরে শুনছি। আমার পাশের ঘরের জাকির ভাই বলে, সে গত দেড় বছর ধরে শুনছে।
গত কয়েকদিন ধরে এই গান আমার মাথায় ঢুকে গেছে। আমিও ‘এক জীবন, এক নারী, এক ভালবাসা’র চক্করে পড়ে যাচ্ছি কিনা তা নিয়ে একটু চিন্তিত।
একজন কিন্তু সত্যিই আমাকে বলেছিল, ‘চল, সামনের বাসে উঠে পালিয়ে যাই’। নীলু বলেছিল। নীলু আমার ক্লাসমেট ছিল। স্বপ্নের মেয়েটার সাথে কি নীলুর চেহারার কোন মিল আছে? নীলুর চোখদুটোও খুব শান্ত। কিন্তু বাকি চেহারার তেমন মিল নেই। অবশ্য এ মুহূর্তে নিশ্চিত হতে পারছি না। হঠাৎ করে কেন জানি নীলুর চেহারা মনে করতে পারছি না। মনে করতে গেলেই কেমন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
চোখ দুটো খুব শান্ত হলেও মেয়ে হিসেবে নীলু বড়ই অশান্ত। আজ গানের প্রোগ্রাম তো কাল বন্যাদুর্গতদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছে। পরশু দেখা যাবে ওদের নাটকদলের প্রোগ্রাম। এর কয়দিন পরে দেখা যাবে রক্ত দানের জন্য কাউকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্লাসে ওর নামই দিয়েছিলাম ‘লেডি ড্রাকুলা’। ‘বাঁধন’ এর সম্পাদক না সহকারী সম্পাদক- কি জানি একটা পদে ছিল। গান গাইত মোটামুটি ভাল, অভিনয় করত দুর্দান্ত আর পড়াশোনায় তো আরো ভাল। মোট কথা ভার্সিটিতে কোন কাজই নীলু ছাড়া হবে না। তাছাড়া নীলুর মত সুন্দরী মেয়েও খুব বেশি দেখা যায় না। খুব উচ্ছল আর হাসিখুশি মেয়েটা। নীলু কাছে এসে দাঁড়ালে চারপাশ অনেক উজ্জ্বল হয়ে যেত, ভ্যাপসা গরম কেটে যেত, এতক্ষণ যে বাতাসের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সে ব্যাটাও বয়ে যাওয়া শুরু করত।
আমি নীলুকে খুব পছন্দ করতাম। সত্যি বলতে ভালবাসতাম। এখনও বাসি। খুব ভালবাসি।
আমি মফস্বল শহরের ছেলে। ভার্সিটি এসে প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম। আমি জানতাম ভার্সিটিতে সবাই খুব পড়াশোনা করে। এখন দেখি এখানে পড়াশোনার থেকে বাকি বিষয়গুলোই বেশি গুরুত্ব পায়। আমি একটু লাজুক আর মুখচোরা ধরনের ছেলে। ঐ যে বলে ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’- ওটা আমার জন্যই বলে বোধহয়। তবে ভার্সিটির এইসব হই-হুল্লোড় আমার বেশ ভাল লাগত। অবশ্য আমার অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। হই-হুল্লোড় ভাল লাগার সবচেয়ে বড় কারণটা ছিল – সব হই-হুল্লোড়েই নীলু থাকত।
আমাদের ক্লাসে বেশ কয়েকজন গান গাইত। এরকম একসাথে এক ব্যাচে সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না। এতে লাভ হত, একটু সময় পেলেই আমরা গানের আসর জমিয়ে ফেলতাম। আমাদের ক্লাসে সবচাইতে ভাল গাইত আসিফ। চমৎকার গীটার বাজাত আর গান গাইত। ফয়সালও গান বাজনা করত। আর নীলু তো ছিলই।
ক্লাসে এ ধরণের আসরগুলোয় এক কোণায় বসে থেকে দেখতাম। ওদের হিংসা হত খুব। একজন গান ধরত, আরেকজন তার সাথে সুর মেলাতো, কেউ টেবিলে তবলার আওয়াজ তুলত আর এসবের সাথে ছিল গীটারের সুর। আসিফ শিষ দিয়ে খুব সুন্দর সুর তুলতে পারত।
ইচ্ছে হত সারাক্ষণ নীলুর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। অল্প একটু তাকিয়েই চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে আনতাম। তারপরও লজ্জা লাগত খুব। মনে হত এই বুঝি বুঝে ফেলেছে। অবশ্য আমি এটাও চাইতাম যে নীলু যেন বুঝতে পারে। নীলু যেন জানে আমি ওকে কী প্রচণ্ড ভালবাসি।
কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস ছিল না। নীলু সামনে আসলেই আমার হাতের তালু ঘামা শুরু হয়ে যেত, হাঁটু দুটো দুর্বল হয়ে পড়ত, গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। পরে অবশ্য নীলুর সাথে মোটামুটি ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এটা তেমন বড় কিছু না। নীলু সবারই খুব ভাল বন্ধু। আমার ইচ্ছা করত নীলু শুধু আমারই বন্ধু হবে, শুধু আমার সাথেই কথা বলবে।
আমি রক্ত সহ্য করতে পারি না। রক্ত দেওয়া ব্যাপারটাতেও আমার ভয় ভয় লাগত। তারপরও সুযোগ পেলেই নীলুর সাথে রক্ত দিতে যেতাম। এমনই কপাল, আমার রক্তের গ্রুপ A+। খুব বেশি দরকার লাগত না। তার উপর চার মাস পর পর দেওয়া যায়। এর ভিতরে রক্ত দেওয়া যাবে না। আমি আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম কবে আবার রক্ত দিতে যাবো। প্রথম দিকে নীলু আমার সাথে যেত। তারপর একবার ‘বাঁধন’র অন্য একজনের সাথে পাঠিয়ে দিল। আমার এত মন খারাপ হল।
এর পরের বার নীলুকে বলেই ফেললাম,
‘রক্ত দেওয়ার সময় তুই সাথে থাকিস। রক্ত দেওয়ার সময় আমার ভয় লাগে।‘
‘আমি সাথে থাকলে ভয় লাগে না?’
নাহ, একটুও না।‘
নীলু মুখ টিপে হাসল। কী বুঝল কে জানে!
নীলুর সাথে আসিফের খুব খাতির ছিল। আর আমি হিংসায় মরে যেতাম। আসিফ খুব ভাল গল্প করতে পারত। আসর জমানোয় ওস্তাদ। আমাদের হাসাতো খুব। ক্যাম্পাসের ভেতর চলাফেরায় আমরা ভ্যানে চড়তাম। আমার এমনই কপাল, ভ্যানে কোথাও যেতে গেলে দেখা যেত আসিফ আর নীলু সামনে বসেছে, আর আমি একা পিছনে। সে সময় আমার খুব ইচ্ছা করত নীলুর সাথে ভ্যানের সামনে পা ঝুলিয়ে বসি। নীলুর সাথে গল্প করতে করতে যাই।
সেদিন আমরা প্রভিশনাল সার্টিফিকেট তুলতে গিয়েছিলাম। চার বছর ধরে পড়াশোনার স্বীকৃতির ঐ কাগজটা নিয়ে আমরা যে যার জীবনের পথে পা বাড়াবো – এমনটাই ভাবছিলাম সবাই। সেদিন আমি আর নীলু ভার্সিটির মেইন গেট দিয়ে বেরোচ্ছিলাম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়েই খুলনা-সাতক্ষীরা হাইওয়ে। আমরা যখন বেরোচ্ছি তখন একটা বাস সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। নীলু হঠাৎ আমাকে বলল,
‘চল, সামনের বাসটায় উঠে আমরা পালিয়ে যাই। শেষ স্টপেজে আমরা নামব। তারপর সেখানেই দুজন একসাথে থাকব।‘
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীলুর দিকে তাকাই। দেখি নীলু সিরিয়াস ভঙ্গীতে বাসটার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমরা বাসটায় উঠে পড়লাম। বাসটার শেষ স্টপেজ ছিল মংলা। বাসে উঠে নীলু আমার হাত ধরে রাখল। প্রথমে বসার জায়গা পাচ্ছিলাম না। একটা সিট পেয়ে নীলুকে বসালাম, আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখনও নীলু আমার হাত ধরে ছিল। এরপর নীলুর পাশের সিটটা খালি হওয়ায় বসে পড়লাম। নীলু আমার হাত ধরে রাখল। কী যে ভাল লাগছিল আমার! মনে হচ্ছিল পুরো বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। নীলু খুব কথা বলছিল, হাসছিল। আমার মাথায় তখন কিছুই ঢুকছে না। কেমন ঘোর ঘোর লাগছিল। কোনরকমে হ্যাঁ হু করে যাচ্ছিলাম।
আমাদের মংলা যাওয়া হল না। আমরা বাসে ওঠার পর বোধহয় আধাঘন্টা হয়েছে, বাস নষ্ট হয়ে গেল। বাস আর যাবে না। যাত্রীদের সবাইকে ভাড়ার কিছু টাকা ফেরত দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব। নীলু গম্ভীর হয়ে আছে। থমথমে মুখ। একটা কথাও বলছে না।
‘আমরা এখন কি করব? কোনদিকে যাবো?
নীলু চুপ।
‘মংলার দিকে যাবো না খুলনায় ফেরত যাবো?’
নীলু চুপ।
কি করব বুঝতে না পেরে নীলুকে নিয়ে ফিরতি বাস ধরে খুলনায় চলে আসলাম। পুরো রাস্তা নীলু একটা কথাও বলল না। ওকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসলাম। তখনও কোন কথা বলল না। সেদিন পরে ওকে কল করলাম। মোবাইল বন্ধ। পরদিন ওর বাসায় যেয়ে শুনি ও মামার বাসায় বেড়াতে গেছে, আজ সকালেই রওনা দিয়েছে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত ওর সাথে সামনাসামনি আর দেখা হয় নি।
এর দিন সাতেক পরে ওর সাথে আমার মোবাইলে কথা হয়। নীলুই কল দিয়েছিল। কিছুক্ষণ কথা বলল। কথা-বার্তা সব আগের মত। যেন মাঝখানে কিছুই ঘটে নি, আমরা দুজন একসাথে পালিয়ে যাই নি। ঐ দিনটার যেন কোন অস্তিত্বই নেই। আমিও সেটা নিয়ে কোন কথা বললাম না।
এই পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি আজও বুঝি নি। এমন না যে আমাদের পালিয়ে যাওয়ার কোন দরকার ছিল। আমরা এমনিতেই, পরিবারের সম্মতি নিয়েই বিয়ে করতে পারতাম।
তবে আমার এটা ভাবতে ভাল লাগে যে, নীলু একদিন আমার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল। আধাঘণ্টার জন্য হলেও তো গিয়েছিল।
.
ভ্যাপসা গরমটা কেটে গেছে। জানালা দিয়ে দমকা বাতাস ঘরে ঢুকছে। আশে-পাশে কোথাও ঝড়-বৃষ্টি হছে মনে হয়। লোডশেডিং ব্যাটা রেডি হয়ে ছিল, ঝড়ের আভাস পাওয়া মাত্র তার কাজ শুরু করে দিল। আমার চার্জার লাইটটা গত দুই দিন ধরে নষ্ট, আলিস্যি করে ঠিক করা হচ্ছে না।
হারিকেনটা জ্বালিয়ে নিলাম।
এই হারিকেনটা আমাদের মেসের জাতীয় সম্পত্তি। বছর কয়েক আগে মেসের কোন বাসিন্দা এটা কিনেছিলেন। যাওয়ার সময় আর নিয়ে যান নি।
হারিকেনের আলো আমার বেশ ভাল লাগে। সারা ঘরে কেমন চমৎকার আলো-আঁধারির খেলা। হারিকেনের এই হলুদ আলোটা রাতের বেলার সাথে যায় ভাল। চার্জার লাইটের আলোগুলো কেমন দিনের আলোর মত।
ল্যাপটপ খুলে বসি, ফেসবুকটা একটু চেক করব। কৌতুকের সেই ছেলেটার হারিকেন জ্বালিয়ে টিভি দেখার কথা মনে পড়ল।
১ম বন্ধুঃ ভাগ্যিস এডিসন বাল্ব আবিস্কার করেছিল। নাহলে যে কী বাজে হত!
২য় বন্ধুঃ কি হত?
১ম বন্ধুঃ আমাদের হারিকেন জ্বালিয়ে টিভি দেখতে হত!
যাই হোক, আমি আপাতত হারিকেন জ্বালিয়ে ফেসবুক ব্যবহার করি। নীলু কয়েকটা নতুন ছবি আপলোড করেছে দেখি। নীলু এখন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নে মাস্টার্স করছে। ওখানকার ছবি। ওরা বোধহয় ‘Save The Climate’ নামে কোন ক্যাম্পেইন করছে। তার ছবি।
কয়েকটা ছবি দেখে মন খুব খারাপ হল। একটা ছবিতে এক শ্বেতাঙ্গ ছেলে ওর ঘাড়ে বেশ অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে হাত দিয়ে রেখেছে।
‘নীলু, এই সাদা চামড়ার ছেলেগুলো একদম ভাল না। আর চৌকো চোয়ালের ছেলেগুলা সবসময় খুব খারাপ হয়, আমি দেখেছি। একে একদম কাছে ঘেঁসতে দিস না।‘ আমি মনে মনে বলি।
‘আর ঐ ছুঁচোর মত নাকওয়ালা ছেলেটা নির্ঘাত ধড়িবাজ। কি দরকার ওর সাথে এত হাসি হাসি মুখ করে কথা বলার?’
‘নীল গেঞ্জিওয়ালা ঐটাকে একদম পাত্তা দিবি না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাটার ধান্দা খারাপ।‘
নীলু বরাবরই এ ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না। দেশে থাকতেও কোন ছেলে ওর পাশে গা ঘেঁসে দাঁড়ালে কিছু বলত না। কোন কারণে কেউ ওর হাত ধরলেও কখনো আপত্তি করত না। কিন্তু বেয়াদবি করলে খবর আছে। একবার ভার্সিটির বাসে এক ছেলেকে কলার ধরে টেনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। ছেলেটার ভাগ্য ভাল যে বাসটা তখন কেবল চলা শুরু করেছে, স্পিড কম ছিল।
চ্যাট-এ নীলুর মেসেজ আসল।
‘তোর নতুন প্রোফাইল পিকচারে লাইক দিলেও আসলে কিন্তু পছন্দ হয় নি। শুয়ে বসে কেমন ভুড়ি বানিয়ে ফেলেছিস।‘
আমি চট করে নিজের পিক টা দেখে নিলাম। কই ভুড়ি তো চোখে পড়ছে না।
‘তুই ভুড়ি কোথায় দেখলি?’
‘তোর তো নিজের খারাপ কখনোই চোখে পড়বে না। তোর কোমরের মাপ কত এখন?’
‘তেত্রিশ’ তা ঠিক, আমার কোমরের মাপ ইঞ্চি দেড়েক বেড়েছে।
‘দেখেছিস! আমি ঠিকই বলেছি। একটু দৌড়া-দৌড়ী কর। আরেকটু বাড়লে তো ছবির ফ্রেমের বাইরে চলে যাবি। ঐ ভুড়ি নিয়ে আমার সামনে আসলে পেরেক দিয়ে গুতা দিয়ে ফাটিয়ে দেব।‘
‘ভুড়ির ভেতর কি গ্যাস ভরা থাকে যে পেরেক দিয়ে ফাটিয়ে দিবি?’
‘আমার তো ভুড়ি দেখলে ওরকমই মনে হয়।‘
যেরকম হঠাৎ করে চ্যাট-এ এসেছিল সেরকম হঠাৎ করে চলে গেল। আমি নীলুর একটা পিকচার খুলে বসে থাকি।
প্রচুর কাজ জমে আছে। করতে ইচ্ছে হয় না। নতুন তৈরি করা সফটওয়্যারটা কী কারণে জানি রান করছে না। একটু দেখার দরকার। ভাল লাগছে না।
আমি নীলুর দিকে তাকিয়ে থাকি। এত সুন্দর মেয়েটা! বুকের ভেতর কোথাও চিন চিন করে ওঠে।
.
আজকের এই সকালে আকাশের রংটা কেমন মনখারাপ করা নীল। আমি দেখেছি আমি যখনই আকাশের দিকে তাকাই, দেখি মন খারাপ করা আকাশ। ব্যাপারটা বোধহয় এমন যে মন খারাপ হলেই আমি আকাশের দিকে তাকাই। এর পরে মন ভাল থাকলে একদিন মনে করে আকাশ দেখব, দেখি হাসি-খুশি আকাশ পাওয়া যায় কি না।
এখনো ৬টা বাজে নি। এরই মাঝে চারপাশ বেশ ঝকঝকে হয়ে গেছে। আজ দৌড়াতে বের হয়েছি। আমি ভুড়িওয়ালা হতে চাই না। নীলু অপছন্দ করে এমন কোন কিছুই হতে চাই না।
নীলুর কি মনে পড়ে যে আমরা একসাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম, আধাঘন্টার জন্য আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম। ও কি ব্যাপারটা নিয়ে কখনো ভাবে? আমার মত করে?
এবার যদি আমি নীলুকে বলি, ‘চল নীলু আমরা পালিয়ে যাই’, ও কি রাজি হবে? যদি রাজি হয় সেদিন আমি হাসি-খুশি আকাশটা দেখব।
‘নীলু, তুই আমার সাথে আরেকবার পালাবি? এবার আমরা অনেক দূরে যাবো।‘
গল্পটা প্রচুর বড় বাট পড়তে খারাপ লাগেনি।খুব রোমান্টিক গল্প।উপস্থাপন ও সুন্দর হইছে।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো নীলু নামটা কেমন জানি মনের অজান্তেই খুব ভালো লাগে।বেশিরভাগ গল্প,উপন্যাসে এই নামটা বেশি ব্যাবহিত তাই হয়তো মায়া কাজ করে।ধন্যবাদ।