সারা দেশ থমথমে, ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। পাকিস্তানী আর্মি গ্রামেগঞ্জে ঢুকে পড়েছে। এখানে সেখানে আগুন জ্বলছে। চারদিকে শুধু গুলির শব্দ। মা রোকেয়া বেগমের আঁচলে মুখ লুকিয়ে ভয়ে কাঁপছে রানী আর সাদাত। বাবা টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে। রেডিওর খবর শুনছে।
রাত এক টা। দরজাতে খটখট শব্দ। বুটের শব্দ। ভয়ে কুঁকড়ে আছে সবাই। এবার দুম্ দুম্ শব্দ। বাবা দরজা খুলতে যাচ্ছিলেন। মা বারণ করতেই চুপচাপ বসে রইলেন বাবা।
কিছুক্ষণ নীরব সব কিছু। কিন্তু একটু পরেই হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর মতো দরজাতে কিছু দিয়ে আঘাত করা হলো। তারপর লাথি। একটু পরেই দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়লো হায়েনার দল। সাথে এলাকার দু-একজন সুবিধাবাদীকেও দেখতে পাওয়া গেলো।
মুখে কিছুই বলল না তারা। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজল। তারপর বাবাকে আর রানী বুবুকে টেনে-হিঁচ্ড়ে নিয়ে যেতে লাগলো, মা পাকিস্তানী আর্মিদের পায়ে ধরলো, আল্লাহর দোহাই দিলো। তাতে একটুও মন নরম হলো না ওদের।
মায়ের মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতেই মা জ্ঞান হারালেন। সাদাতকে এক রকম ছুঁড়েই ফেলে দিলো একজন। তারপর আর কিছুই মনে নেই সাহাদাতের
পরদিন ভোরে পাল্লার বিলে বাবার হাত-পা বাঁধা লাশ, আর বুবুর বিবস্ত্র মৃতদেহ বুকে নিয়ে সাদাত আর্তনাদ করে উঠেছিল। মা তা-ও করতে পারেনি। সেই যে মা বাকহীন হয়ে পড়লেন, আর কখনো কথা বলেননি। সাদাত এখনো জানে না বাবার কী দোষ ছিল। রানী বুবুরই বা কী ছিল অপরাধ।
মাকে নিয়ে পালিয়ে সেদিনই মামার বাড়িতে চলে এসেছিল সাদাত। ভারত সীমান্তে মামার বাড়ি। কিছুটা নিরাপদ। ভারতীয় বর্ডারও খুলে দেয়া হয়েছিল। তাই একটু বেশি গোলযোগ সৃষ্টি হলেই ভারতে ঢুকে পড়ত বাংলাদেশীরা।
বাবা আর বোনকে হারিয়ে বুকের ভেতর এক যন্ত্রণা আর আগ্নেয়গিরির আগুন পুষে সাদাত যোগ দেয় মুক্তিবাহিনিতে।তখন কতই বা তার বয়স! দশম শ্রেণীর ছাত্র সে। কিন্তু তার বুকে যে বিদ্রোহের আগুন, তা দিয়ে সে নিজেকে তৈরী করে নেয়। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ। দেশমাতৃকাকে বাঁচানোর জন্য শোষণ আর নির্বিচারের বিরুদ্ধে, সব অনিয়ম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।
সীমান্তবর্তী এলাকা মহেশপুর ও দামুড়হুদা এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উড়িয়ে দেয় শত্রুপক্ষের ঘাঁটি। সবুজ ধানের ক্ষেতে আগুন, এখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখে আরো কত রানীর লাশ, শরীরে তাদের অত্যাচারের চিহ্ন। কতো বাবা-মেয়ের লাশ পড়ে থাকে ঝোপ-জঙ্গলে। সাদাত এই ভেবে সান্ত্বনা পায় যে- বাবা আর বোন তার দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। মা দেশের জন্য বাকহীন হয়েছেন। একটা সুন্দর সকালে যখন স্বাধীন দেশের পতাকা মুক্ত বাতাসে উড়বে, তখন সব কষ্টই কিছুটা হলেও তো ভুলে থাকা যাবে। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে সাদাতের। কিন্তু সে সুযোগ, সে সময় হয়ে ওঠে না। সহযোদ্দা রিয়াদের কাছে জিজ্ঞেস করে-
: হ্যাঁরে বন্ধু, তুই তো জীবন নগর গিয়েছিলি। মা কেমন আছে জানিস? মা কি এখনো কথা বলে না? মা কি এখনো নীরবে চোখের জল ফেলছে একা একা? মা কি এখনো ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে বাবার আশায়? রানী বুবুর জন্য ভাতের থালা হাতে এখনো কি ঘুরে বেড়ায় সারা উঠোন? এখনো কি আমার জামা হাতে নিয়ে আমাকে খুঁজে বেড়ায় এবাড়ী ওবাড়ী?
রিয়াদ এসব কিছুর উত্তর দিতে পারে না। বলে-
এখন এসব ভাবলে চলবে না বন্ধু। এই মাটি এই দেশ সেও তো আমাদের মা। তাকে রক্ষা করতেই হবে। এখন এসব ভাবলে চলবে।
রিয়াদের কথায় চোখের জল মুছে নিয়ে নিজের কাজে মন দেয় সাদাত।
দীর্ঘ নয় মাস পর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। শত্রুমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বিজয় ছিনিয়ে আনে বাংলার দামাল ছেলেরা।
সাদাত মামাবাড়িতে ফিরে যায় প্রথমে। মা নেই। বড় মামা-মামীর সঙ্গে মা-ও শহীদ হয়েছেন। বুকের যন্ত্রণা আর চেপে রাখতে পারে না সাদাত। আর্তনাদ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
বাড়ি ফিরে দেখে বাড়ি নেই। কবেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। শুধু পেয়ারা গাছটা দাঁড়িয়ে আছে কোনোরকমে। যেন সাদাতের জন্য আজো পথ চেয়ে আছে সে।
গাছটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সাদাত। বন্ধু রিয়াদকে বলে-
জানিস বন্ধু, এই যে পেয়ারাগাছ। এই গাছে আমি আর বুবু দোল খেতাম। মা থালায় ভাত মেখে ডাক পাড়তেন ওরে খেয়ে নে, খেয়ে নে।আমি দুষ্টুমি করে খেতাম না। মা তা-ও কি ছাড়ে? এক গাল দু'গাল খাইয়ে দিয়ে তবেই ছাড়ত। আমি আর বুবু মায়ের আঁচলে মুখ মুছে নিয়ে আবার দোল খেতাম। এই গাছটা এখনো আছে। আমার আর কেউ নেই রে বন্ধু কেউ নেই।
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সাদাত।
আবার নতুন ঘর ওঠে এক সময়। কেটে যায় একে একে চল্লিশ বছর।
এখন সাদাতের বয়স হয়েছে। চোখে চশমা। চুলে পাক ধরেছে।
এখনো পেয়ারা গাছটা কোনোরকমে মরার মতো পড়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে চোখ ভেজায় সাদাত। বন্ধু রিয়াদকে ডেকে বলে-
কী পেলাম রে বন্ধু? সব হারিয়ে এই দেশ পাওয়া। কিন্তু সেই হত্যা, সেই নির্যাতন, সব, সব চলছে এখনো। আমরা কি এই দেশ চেয়েছিলাম?
মায়ের ছবিটা বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সাদাত। বন্ধু রিয়াদ সান্ত্বনা দিতেও ভুলে যায়।
...and you will also help the author collect more tips.
আমি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে এখনকার অবস্থা স্ব-চোখে দেখতে পারছি। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, মুক্তিযোদ্ধারা কি এসবের জন্য এত কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করেছিল??? আমরা লজ্জিত, আমরা দেশপ্রেমিক হতে পারলাম না😢