মহাকাশ যাত্রায় প্রথম প্রাণী লাইকার মৃত্যু রহস্য!
একদিনের খাবার আর এক সপ্তাহের অক্সিজেন নিয়ে মস্কোর পথের যে সারমেয়ী ১৯৫৭ সালে মহাশূন্যে যাত্রা করেছিল সেই হতভাগাই হলো লাইকা। সে আসলে একটি কুকুর।
মস্কোর রাস্তা থেকে ২০০০ মাইল উপরে পৃথিবীর নির্জন কক্ষপথে লাইকার ভ্রমণ ছিল অমানবিক। প্রচণ্ড ভয়ে তার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছিল, ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল শ্বাস নিতে। উত্তপ্ত, ভীত, ক্ষুধার্ত লাইকা মহাকাশযানে করে পৃথিবীর নির্জন কক্ষপথে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যা ছিল মূলত এক আত্মঘাতী মিশন।
হাস্কি-স্পীতজ শংকর কুকুর লাইকার করুণ কাহিনী মানব ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে কক্ষপথ পরিভ্রমণ করা প্রথম প্রাণী হিসেবে। ৬০ বছর আগে লাইকাকে বহনকারী সোভিয়েত মহাকাশযান স্পুটনিক-২ মহাকাশে যাত্রা করে। নিকিতা ক্রুশচেভের অনুরোধে সোভিয়েত মহাকাশ প্রকৌশলীরা ১৯৫৭ সালে ৩ নভেম্বর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীতে স্পুটনিক ২ উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করেন।
মনুষ্যবিহীন, কুকুরবিহীন স্পুটনিক ১ তৈরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, ব্লু প্রিন্টের নকশা পুরো অনুসরণ না করেই পুরো দলটি কঠোর পরিশ্রম করে দ্রুত মহাকাশযান প্রস্তুত করে ফেলে উড্ডয়নের জন্য।
এই যানেই কুকুরের জন্য একটা চাপযুক্ত কামরা তৈরি করা হয়। এর আগে মহাকাশযান স্পুটনিক-১ ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমণ করে ইতিহাস তৈরি করেছিল। এবারের পরিকল্পনা হলো স্পুটনিক-২ পৃথিবীর কক্ষপথের সর্বশেষ ধাপে ঢুকবে।
যা হবে আরেকটি নতুন রেকর্ড। স্পুটনিক-২ এর ওজন ছিল ১১২০ পাউন্ড, যা স্পুটনিক-১ এর প্রায় ছয় গুণ। প্রকৌশলিরা এই মহাকাশযানের ওজন কমানোর জন্য যাত্রীর জন্য কম খাবার পরিবহনের পরিকল্পনা করেন।
১৯৫৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সভিয়েত মিত্র দেশ রোমানিয়া, আলবেনিয়া, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো লাইকাকে নিয়ে ডাকটিকিট বের করেছে। মহাকাশ যাত্রার সাত দিনের মাথায় অক্সিজেনের অভাবে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই লাইকার ব্যথাহীন মৃত্যু হবে এমনটাই ভেবে নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
মাত্র কয়েক আউন্স খাবারের ওজন অনেক কিছু পাল্টে ফেলতে পারে, এমনটাই সন্দেহ করেন স্মিতসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেইস মিউজিয়ামের আন্তর্জাতিক মহাকাশ প্রোগ্রাম এবং স্পেসস্যুটের কিউরেটর ক্যাথলিন লুই।
তিনি এটাও মনে করিয়ে দিতে চান যে যাত্রার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে একজন নারী চিকিৎসক সব প্রোটোকল ভেঙে লাইকাকে খাবার খাইয়েছিলেন। একদল বেওয়ারিশ কুকুর থেকে সোভিয়েত কুকুর সংগ্রহকারীরা সম্ভাব্য মহাকাশচারী কুকুর নির্বাচন করতে গিয়ে তারা মেয়ে কুকুর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন।
কারণ মেয়ে কুকুর হয় অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সহনশীল। এর সঙ্গে প্রাথমিক পরীক্ষায় আনুগত্যকে মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত সারমেয়ীদের একটা চাপ যুক্ত ছোট ক্যাপস্যুলে প্রথমে কয়েকদিন এবং পরবর্তীতে পুরো সপ্তাহ রাখা হয়।
বাতাসের চাপে এবং উৎক্ষেপণের মুহূর্তের প্রচণ্ড শব্দে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা পর্যবেক্ষণ করা হয়। মল-মূত্র ত্যাগের জায়গায় যুক্ত করা হয় বিশেষ যন্ত্র যা বেশকিছু সারমেয়ী সহজে গ্রহণ করেনি এবং তারা মল-মূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়ে যায়। তবে কিছু কুকুর এই ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়েও নেয়।
শান্ত কুদ্রিয়াভকা বা ছোট্ট কার্লিকে স্পুটনিক-২ এর মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত করা হয় আর আলবিনা বা শাদাকে রাখা হয় অতিরিক্ত হিসেবে। জনগণের সঙ্গে পরিচিত করার সময় কুদ্রিয়াভকা রেডিওতে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় লাইকা।
রাশিয়ান শব্দ লাইকা অর্থ ঘেউ ঘেউ করা। জনশ্রুতি আছে, আলবিনা লাইকার চেয়ে বেশি যোগ্য ছিল কিন্তু আলবিনা মহাকাশ যাত্রার আগেই সন্তান জন্ম দেয়ায় তাকে মহাকাশে পাঠানোর ব্যাপারে দ্বিধা তৈরি হয়। কারণ আলবিনাকে ছাড়া তার বাচ্চাদের কষ্টের কথা বিবেচনায় নেয়া হয়। ফলে সৌভাগ্যবতী আলবিনা ভয়ংকর এই মহাকাশ যাত্রা থেকে বেঁচে যায়।
তবে তার আগে সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসকরা লাইকা এবং আলবিনার শরীরে বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করে তাদের হৃদপিণ্ডের গতি, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ এবং শারীরিক নড়াচড়া সবই পর্যবেক্ষণের আওতায় আনে।
উৎক্ষেপণের তিন দিন আগে লাইকাকে তার জন্য নির্দিষ্ট চাপ যুক্ত, বদ্ধ কক্ষটিতে প্রবেশ করানো হয়। যেখানে তার নড়াচড়া করার জন্য মাত্র কয়েক ইঞ্চি জায়গা ছিল। ধাতব কাঠামোতে আবদ্ধ মহাকাশের পোশাক পরার আগে লাইকাকে নতুন করে পরিষ্কার করে, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেন্সর শরীরে যুক্ত করে। পয়ঃনিষ্কাশন যন্ত্রও যুক্ত করা হয়।
সাধারণ অভিকর্ষ মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি শক্তি দিয়ে ৩রা নভেম্বর ভোর সাড়ে ৫টায় মহাকাশযান স্পুটনিক-২কে উৎক্ষেপণ করা হয়। মহাকাশযানের প্রচণ্ড শব্দ এবং চাপ লাইকাকে ত্রস্ত করে তোলে। তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে যায়। শ্বাসের গতি হয় প্রায় চার গুণ বেশি।
উৎক্ষেপণের সময় লাইকার অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের রিডিং দেখতে পায় ন্যাশনাল এয়ার এণ্ড স্পেস মিউজিয়াম। ১০৩ মিনিটে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে লাইকা পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে, তখনো সে জীবিত ছিল।
তবে তাকে তাপ থেকে সুরক্ষা দেওয়া বর্মটি দুঃখজনক বিকল হয়ে গেলে দ্রুতই ক্যাপস্যুলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায়। ফলে লাইকা বেঁচে থাকলেও মহাকাশযান কক্ষপথে প্রবেশের পরপরই আসলে লাইকা মৃত্যুবরণ করে। ১৯৯৩ সালে রাশিয়ান চিকিৎসক ও মহাকাশ কুকুর অভিযাত্রী প্রশিক্ষক অলেগ গাজেনকো এই তথ্য প্রকাশ করেন।
কক্ষপথে চতুর্থবার পরিভ্রমণের সময় মহাকাশযানের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রির উপরে রেকর্ড করা হয়েছিল, এমনটাই বলেন লুইস। এমন তাপমাত্রায় লাইকার পক্ষে এক বা দুই প্রদক্ষিণের বেশি টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। লাইকার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। মৃত লাইকাকে নিয়ে স্পুটনিক ২ আরো পাঁচ মাস কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।
মহাকাশ যাত্রার আগে এক বিজ্ঞানী লাইকাকে তার বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার জন্য।
সেসময়ে লাইকার বেঁচে থাকা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নানা গল্প ছড়ায়। বলা হয়, লাইকা কয়েক দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল।
এ প্রসঙ্গে লুইস বলেন, অফিসিয়াল কাগজপত্রে মিথ্যা লেখা হয়েছে। সোভিয়েত প্রচার মাধ্যমে বলা হয় লাইকা ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বেঁচে ছিল। এমনকি দ্য নিউয়র্ক টাইমস তার বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনার কথাও বলেছিল। সোভিয়েত প্রশাসন শেষ পর্যন্ত নয় দিন পর লাইকার মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে।
মহাকাশ অভিযানে প্রাণী পাঠানোর বিরুদ্ধে রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েল্টি টু এনিমেলস এবং দ্য ব্রিটিশ সোসাইটি ফর হ্যাপি ডগস তীব্র প্রতিবাদ জানায় লাইকার করুণ মৃত্যুতে।
নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে একদল কুকুরপ্রেমী তাদের পোষা কুকুরের গলায় প্রতিবাদের ভাষা ঝুলিয়ে সমাবেশ করে। ৩০ বছর পরেও রাশিয়ান প্রশিক্ষক অলেগ গাজেনকো বেদনার্ত হয়ে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনার জন্য আমার দুঃখবোধ বাড়ছে।
মহাকাশ যাত্রায় লাইকাই প্রথম কুকুর নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপ-কক্ষপথে পরীক্ষামূলক রকেট টেস্টে জার্মান রকেট ভি-২ তে করে আরো কিছু কুকুরকে পাঠানো হয়েছিল। তাদের কিছু কিছু জীবিত আবার কিছু মৃত অবস্থায় প্যারাসুটে করে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
এরপরও অনেক কুকুর মহাকাশ যাত্রায় প্রেরণ করা হয়েছিল। তবে তারা সবাই জীবিতই কক্ষপথ থেকে ফিরে আসে। ১৯৬০ সালে এক যুক্ত অভিযানের সফল অভিযাত্রার পর স্ট্রেল্কা এবং বেলকা নামে দুই কুকুর পৃথিবীতে ফিরে আসে।
পরবর্তীতে স্ট্রেল্কা বাচ্চাও জন্ম দেয় এবং তার এক বাচ্চাকে প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে উপহার দেন। মনুষ্য অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রও শিম্পাঞ্জি পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানোর কথা ভেবেছিল। তবে শিম্পাঞ্জীর বদলে কুকুর কেন নির্বাচন করা হল সোভিয়েত ইউনিয়েনের এই সিদ্ধান্তটা কারো কাছেই পরিষ্কার ছিল না।
তবে ধারণা করা হয়, আইভান পাভলপের কুকুরের শরীরবিদ্যা নিয়ে দক্ষতা এর একটা কারণ হতে পারে। এছাড়া পথের কুকুরের সহজলভ্যতাও একটা কারণ হতে পারে, যেখান থেকে পছন্দমত কুকুর নির্বাচন করা সহজ ছিল।
মহাকাশে প্রাণ দেয়া প্রথম প্রাণী লাইকা এখনো বিভিন্ন অর্ন্তজালের ইউটিউব ভিডিওতে, কবিতায়, ছোটদের বইয়ে বেঁচে আছে।
বিজ্ঞানীরা জানান, যদি সব কিছু ঠিক থাকত, খাবার, পানি আর অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকত মহাকাশযানে, তাহলেও লাইকা বাঁচত না।
কক্ষপথে ২৫৭০ বার পরিভ্রমণ শেষে মহাকাশযান পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলীতে প্রবেশ করার পরপরই মারা যেতো লাইকা।
মহাকাশ যাত্রায় প্রথম প্রাণী লাইকার মৃত্যু রহস্য!
একদিনের খাবার আর এক সপ্তাহের অক্সিজেন নিয়ে মস্কোর পথের যে সারমেয়ী ১৯৫৭ সালে মহাশূন্যে যাত্রা করেছিল সেই হতভাগাই হলো লাইকা। সে আসলে একটি কুকুর। মস্কোর রাস্তা থেকে ২০০০ মাইল উপরে পৃথিবীর নির্জন কক্ষপথে লাইকার ভ্রমণ ছিল অমানবিক। প্রচণ্ড ভয়ে তার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছিল, ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল শ্বাস নিতে। উত্তপ্ত, ভীত, ক্ষুধার্ত লাইকা মহাকাশযানে করে পৃথিবীর নির্জন কক্ষপথে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যা ছিল মূলত এক আত্মঘাতী মিশন। হাস্কি-স্পীতজ শংকর কুকুর লাইকার করুণ কাহিনী মানব ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে কক্ষপথ পরিভ্রমণ করা প্রথম প্রাণী হিসেবে। ৬০ বছর আগে লাইকাকে বহনকারী সোভিয়েত মহাকাশযান স্পুটনিক-২ মহাকাশে যাত্রা করে। নিকিতা ক্রুশচেভের অনুরোধে সোভিয়েত মহাকাশ প্রকৌশলীরা ১৯৫৭ সালে ৩ নভেম্বর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকীতে স্পুটনিক ২ উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করেন। মনুষ্যবিহীন, কুকুরবিহীন স্পুটনিক ১ তৈরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, ব্লু প্রিন্টের নকশা পুরো অনুসরণ না করেই পুরো দলটি কঠোর পরিশ্রম করে দ্রুত মহাকাশযান প্রস্তুত করে ফেলে উড্ডয়নের জন্য। এই যানেই কুকুরের জন্য একটা চাপযুক্ত কামরা তৈরি করা হয়। এর আগে মহাকাশযান স্পুটনিক-১ ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমণ করে ইতিহাস তৈরি করেছিল। এবারের পরিকল্পনা হলো স্পুটনিক-২ পৃথিবীর কক্ষপথের সর্বশেষ ধাপে ঢুকবে। যা হবে আরেকটি নতুন রেকর্ড। স্পুটনিক-২ এর ওজন ছিল ১১২০ পাউন্ড, যা স্পুটনিক-১ এর প্রায় ছয় গুণ। প্রকৌশলিরা এই মহাকাশযানের ওজন কমানোর জন্য যাত্রীর জন্য কম খাবার পরিবহনের পরিকল্পনা করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সভিয়েত মিত্র দেশ রোমানিয়া, আলবেনিয়া, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো লাইকাকে নিয়ে ডাকটিকিট বের করেছে। মহাকাশ যাত্রার সাত দিনের মাথায় অক্সিজেনের অভাবে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই লাইকার ব্যথাহীন মৃত্যু হবে এমনটাই ভেবে নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। মাত্র কয়েক আউন্স খাবারের ওজন অনেক কিছু পাল্টে ফেলতে পারে, এমনটাই সন্দেহ করেন স্মিতসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেইস মিউজিয়ামের আন্তর্জাতিক মহাকাশ প্রোগ্রাম এবং স্পেসস্যুটের কিউরেটর ক্যাথলিন লুই। তিনি এটাও মনে করিয়ে দিতে চান যে যাত্রার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে একজন নারী চিকিৎসক সব প্রোটোকল ভেঙে লাইকাকে খাবার খাইয়েছিলেন। একদল বেওয়ারিশ কুকুর থেকে সোভিয়েত কুকুর সংগ্রহকারীরা সম্ভাব্য মহাকাশচারী কুকুর নির্বাচন করতে গিয়ে তারা মেয়ে কুকুর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ মেয়ে কুকুর হয় অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সহনশীল। এর সঙ্গে প্রাথমিক পরীক্ষায় আনুগত্যকে মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত সারমেয়ীদের একটা চাপ যুক্ত ছোট ক্যাপস্যুলে প্রথমে কয়েকদিন এবং পরবর্তীতে পুরো সপ্তাহ রাখা হয়। বাতাসের চাপে এবং উৎক্ষেপণের মুহূর্তের প্রচণ্ড শব্দে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা পর্যবেক্ষণ করা হয়। মল-মূত্র ত্যাগের জায়গায় যুক্ত করা হয় বিশেষ যন্ত্র যা বেশকিছু সারমেয়ী সহজে গ্রহণ করেনি এবং তারা মল-মূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়ে যায়। তবে কিছু কুকুর এই ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়েও নেয়। শান্ত কুদ্রিয়াভকা বা ছোট্ট কার্লিকে স্পুটনিক-২ এর মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত করা হয় আর আলবিনা বা শাদাকে রাখা হয় অতিরিক্ত হিসেবে। জনগণের সঙ্গে পরিচিত করার সময় কুদ্রিয়াভকা রেডিওতে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় লাইকা। রাশিয়ান শব্দ লাইকা অর্থ ঘেউ ঘেউ করা। জনশ্রুতি আছে, আলবিনা লাইকার চেয়ে বেশি যোগ্য ছিল কিন্তু আলবিনা মহাকাশ যাত্রার আগেই সন্তান জন্ম দেয়ায় তাকে মহাকাশে পাঠানোর ব্যাপারে দ্বিধা তৈরি হয়। কারণ আলবিনাকে ছাড়া তার বাচ্চাদের কষ্টের কথা বিবেচনায় নেয়া হয়। ফলে সৌভাগ্যবতী আলবিনা ভয়ংকর এই মহাকাশ যাত্রা থেকে বেঁচে যায়। তবে তার আগে সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসকরা লাইকা এবং আলবিনার শরীরে বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করে তাদের হৃদপিণ্ডের গতি, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ এবং শারীরিক নড়াচড়া সবই পর্যবেক্ষণের আওতায় আনে। উৎক্ষেপণের তিন দিন আগে লাইকাকে তার জন্য নির্দিষ্ট চাপ যুক্ত, বদ্ধ কক্ষটিতে প্রবেশ করানো হয়। যেখানে তার নড়াচড়া করার জন্য মাত্র কয়েক ইঞ্চি জায়গা ছিল। ধাতব কাঠামোতে আবদ্ধ মহাকাশের পোশাক পরার আগে লাইকাকে নতুন করে পরিষ্কার করে, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেন্সর শরীরে যুক্ত করে। পয়ঃনিষ্কাশন যন্ত্রও যুক্ত করা হয়। সাধারণ অভিকর্ষ মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি শক্তি দিয়ে ৩রা নভেম্বর ভোর সাড়ে ৫টায় মহাকাশযান স্পুটনিক-২কে উৎক্ষেপণ করা হয়। মহাকাশযানের প্রচণ্ড শব্দ এবং চাপ লাইকাকে ত্রস্ত করে তোলে। তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে যায়। শ্বাসের গতি হয় প্রায় চার গুণ বেশি। উৎক্ষেপণের সময় লাইকার অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের রিডিং দেখতে পায় ন্যাশনাল এয়ার এণ্ড স্পেস মিউজিয়াম। ১০৩ মিনিটে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে লাইকা পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে, তখনো সে জীবিত ছিল। তবে তাকে তাপ থেকে সুরক্ষা দেওয়া বর্মটি দুঃখজনক বিকল হয়ে গেলে দ্রুতই ক্যাপস্যুলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায়। ফলে লাইকা বেঁচে থাকলেও মহাকাশযান কক্ষপথে প্রবেশের পরপরই আসলে লাইকা মৃত্যুবরণ করে। ১৯৯৩ সালে রাশিয়ান চিকিৎসক ও মহাকাশ কুকুর অভিযাত্রী প্রশিক্ষক অলেগ গাজেনকো এই তথ্য প্রকাশ করেন। কক্ষপথে চতুর্থবার পরিভ্রমণের সময় মহাকাশযানের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রির উপরে রেকর্ড করা হয়েছিল, এমনটাই বলেন লুইস। এমন তাপমাত্রায় লাইকার পক্ষে এক বা দুই প্রদক্ষিণের বেশি টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। লাইকার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। মৃত লাইকাকে নিয়ে স্পুটনিক ২ আরো পাঁচ মাস কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। মহাকাশ যাত্রার আগে এক বিজ্ঞানী লাইকাকে তার বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার জন্য। সেসময়ে লাইকার বেঁচে থাকা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নানা গল্প ছড়ায়। বলা হয়, লাইকা কয়েক দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল। এ প্রসঙ্গে লুইস বলেন, অফিসিয়াল কাগজপত্রে মিথ্যা লেখা হয়েছে। সোভিয়েত প্রচার মাধ্যমে বলা হয় লাইকা ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বেঁচে ছিল। এমনকি দ্য নিউয়র্ক টাইমস তার বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনার কথাও বলেছিল। সোভিয়েত প্রশাসন শেষ পর্যন্ত নয় দিন পর লাইকার মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে। মহাকাশ অভিযানে প্রাণী পাঠানোর বিরুদ্ধে রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েল্টি টু এনিমেলস এবং দ্য ব্রিটিশ সোসাইটি ফর হ্যাপি ডগস তীব্র প্রতিবাদ জানায় লাইকার করুণ মৃত্যুতে। নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে একদল কুকুরপ্রেমী তাদের পোষা কুকুরের গলায় প্রতিবাদের ভাষা ঝুলিয়ে সমাবেশ করে। ৩০ বছর পরেও রাশিয়ান প্রশিক্ষক অলেগ গাজেনকো বেদনার্ত হয়ে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনার জন্য আমার দুঃখবোধ বাড়ছে। মহাকাশ যাত্রায় লাইকাই প্রথম কুকুর নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপ-কক্ষপথে পরীক্ষামূলক রকেট টেস্টে জার্মান রকেট ভি-২ তে করে আরো কিছু কুকুরকে পাঠানো হয়েছিল। তাদের কিছু কিছু জীবিত আবার কিছু মৃত অবস্থায় প্যারাসুটে করে পৃথিবীতে ফিরে আসে। এরপরও অনেক কুকুর মহাকাশ যাত্রায় প্রেরণ করা হয়েছিল। তবে তারা সবাই জীবিতই কক্ষপথ থেকে ফিরে আসে। ১৯৬০ সালে এক যুক্ত অভিযানের সফল অভিযাত্রার পর স্ট্রেল্কা এবং বেলকা নামে দুই কুকুর পৃথিবীতে ফিরে আসে। পরবর্তীতে স্ট্রেল্কা বাচ্চাও জন্ম দেয় এবং তার এক বাচ্চাকে প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে উপহার দেন। মনুষ্য অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রও শিম্পাঞ্জি পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানোর কথা ভেবেছিল। তবে শিম্পাঞ্জীর বদলে কুকুর কেন নির্বাচন করা হল সোভিয়েত ইউনিয়েনের এই সিদ্ধান্তটা কারো কাছেই পরিষ্কার ছিল না। তবে ধারণা করা হয়, আইভান পাভলপের কুকুরের শরীরবিদ্যা নিয়ে দক্ষতা এর একটা কারণ হতে পারে। এছাড়া পথের কুকুরের সহজলভ্যতাও একটা কারণ হতে পারে, যেখান থেকে পছন্দমত কুকুর নির্বাচন করা সহজ ছিল। মহাকাশে প্রাণ দেয়া প্রথম প্রাণী লাইকা এখনো বিভিন্ন অর্ন্তজালের ইউটিউব ভিডিওতে, কবিতায়, ছোটদের বইয়ে বেঁচে আছে। বিজ্ঞানীরা জানান, যদি সব কিছু ঠিক থাকত, খাবার, পানি আর অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকত মহাকাশযানে, তাহলেও লাইকা বাঁচত না। কক্ষপথে ২৫৭০ বার পরিভ্রমণ শেষে মহাকাশযান পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলীতে প্রবেশ করার পরপরই মারা যেতো লাইকা।