বাবা

অনেকদিন আগের কথা। তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। সামনে নির্বাচনী পরীক্ষা। স্বাভাবিকভাবে পড়ার চাপ একটু বেশি। খেলার মাঠেও খুব একটা যাওয়া হয় না। আব্বার কাজেও সাহায্য করতে পারিনা। মনের মধ্যে একটিই ইচ্ছে। পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে। হেডমাষ্টার স্যার ঘোষনা করেছেন, নির্বাচনী পরীক্ষায় যে প্রথম হবে তার ফরম ফিলাপে কোনো টাকা পয়সা লাগবে না। কোনোভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।

একদিন দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। দেখলাম আব্বা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে কয়েকজন লোক। আমাদের লাল গাভীটাকে দেখছে। আমি কাছে গেলাম। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম,

-কী হয়েছে?

আব্বা বললেন,

-গরুটাকে বিক্রি করবো।

কথাটি বলাতে আমি যে কিছুটা কষ্ট পেয়েছি তা আব্বা বুঝতে পেরেছেন। কারন লাল গাভী ও বাছুরটাকে আমি সবসময় দেখা শুনা করতাম। কী কারনে বিক্রি করবেন তা জানিনা। লাল গাভীটা আর আমাদের গোয়ালে থাকবেনা এটা কোনো ভাবে মানতে পারছিলাম না। লোকজন চলে গেলো। আব্বা এবং আমি বাড়িতে চলে এলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

-গরুটাকে বিক্রি করবে কেন? মা বললেন,

-কয়েকদিন পরেই তোর ফরম ফিলাপ। হাতে টাকা পয়সা নেই।

সেইথেকে আমিও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, নির্বাচনী পরীক্ষায় যেভাবে হোক প্রথম হতেই হবে। যাতে আমার লাল গাভীটা হাতছাড়া না হয়।

আমার স্কুল ড্রেসটা পুরোনো হয়ে গিয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে যখন পড়ি তখন বানিয়েছিলাম। নতুন আরেকটি দরকার। স্কুল ড্রেস বলতে আমরা শুধু জামাটাকেই বুঝতাম। প্যান্টের নির্দিষ্ট কোনো রং ছিল না। যে যেমন পারতো তেমন করে বানাতো। পায়ে কখনো কের্স পড়িনি। সাধারণ স্লিপার দিয়ে চালিয়েছি। জামার রং ছিল সাদা। আমার এই একটি মাত্র সাদা জামা। সপ্তাহে একবার পরিষ্কার করতাম। বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতাম। নতুন ড্রেসের কথা মাকে বলতে পারছি না। টুকিটাকি যে আবদার থাকতো তা মায়ের কাছেই বলতাম। আব্বার কাছে বলার সাহস নেই। একদিন মায়ের কাছে বললাম,

  • আমার ড্রেসটা পুরানো হয়ে গেছে। মা কিছু বললেন না।

দুদিন পর, আব্বা আমাকে বললেন,

-বাজারে যাবি?

আব্বার কথা বুঝতে পারলাম না। কোনকিছু না বুঝে আব্বার সাথে বাজারে রওয়ানা দিলাম। আমি আব্বার পিছু পিছু হাঁটছি। আব্বা একটা টেইলার্সের দোকানে নিয়ে গেলেন। জামার মাপ দিলাম। আব্বা বললেন ,

-একটা প্যান্টেরও মাপ দিয়া যা। দোকানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে আব্বা বললেন,

-ছেলে এইবার মেট্রিক দিবে। তাই নতুন জামা প্যান্ট বানাইতে দিলাম ।

আমরা যেটাকে এস এস সি বলি আব্বা ওটাকে মেট্রিক বলেন। মনের মধ্যে খুব খুশি খুশি লাগছে। জীবনে প্রথমবার একসাথে নতুন জামা ও প্যান্ট পাচ্ছি। এ আনন্দ রাখি কোথায় ! আব্বা একটা ইলিশ মাছ কিনলেন। আমি মাছ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি । আব্বার কী যেন কাজ আছে। তাই একটু পড়ে আসবেন। মাছের যা ওজন তাতে বাড়ি পর্যন্ত যেতে তিনবার হাত বদল করতে হয়েছে।

বাড়ি পৌঁছলাম। হঠাৎ গোয়ালের দিকে তাকালাম। লাল গাভী ও বাছুরটা নেই। মাকে ডাকলাম,

-মা লাল গরুটা কই?

মা বললেন,

-ঐ লোকেরা নিয়া গেছে।

কথাটি বলতে মায়ের যে কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। আব্বা লাল গাভীটাকে বিক্রি করে দিলেন। এটা মানতে পারছিনা। নতুন জামা- প্যান্ট ও এই ইলিশ মাছের উপর প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে আমার । সেদিন রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছিল ছোট বাছুরটা যেন ডাকছে। আব্বা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। আমাকে ডেকে বললেন,

-পড়ালেখা শেষ করে যখন চাকরি করবি এ রকম দশটা গরু তুই কিনতে পারবি। আব্বার কথাটি আমার মনে ধরলো।

নতুন জামা পড়ে স্কুলে যাচ্ছি। খুব ভাল লাগছে। স্কুলে বসে খুব সতর্ক থাকলাম যাতে নতুন জামায় কেউ কলমের দাগ দিতে না পারে।

পরেরদিন আব্বা কী কাজে যেন বাজারে যাবেন। দেখলাম আব্বা আমার পুরোনো সাদা জামাটি পড়েছেন। আমি অবাক হলাম। এটা তো পুরোনো জামা ! তাছাড়া এটা আমি ফেলে দিয়েছি। সেটা আব্বা পড়বে কেন? আমি যে অবাক হয়েছি আব্বা তা বুঝতে পেরেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-এখনো অনেকদিন গায়ে দিতে পারবো। ব্লিচিং পাউডার দিয়া তোর মায় ধুইছে। একদম নতুন হইয়া গেছে।

আমি কিছু বলতে পারিনি।লাল গাভীটা বিক্রি করাতে আব্বার প্রতি আমার একটু রাগ জমে ছিল। আজ সেই রাগ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।

আমার ফেলে রাখা জামাটি আব্বা আরো বছর খানের পড়েছিলেন।

আজ আব্বা নেই। অথচ আমার কত কিছু আছে! আমার কারখানায় প্রতিদিন হাজার হাজার সাদা জামা তৈরি হয়। কিন্তু আব্বার জন্য একটিও রাখতে পারিনা।আজ অনেকগুলো গাভী কেনার সামর্থ্য আমার আছে। কিন্তু সেই লাল গাভীকে তো আর পাবো না।

রাতের আকাশে যখন তারা উঠে তখন আব্বাকে খুঁজে বেড়াই। যদি আরেকটিবার আব্বাকে পেতাম!

~ Simul ckm.....

2
$
User's avatar
@Simul152 posted 3 years ago

Comments