গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_সেপ্টেম্বর_২০২০

অসময়ে বৃত্ত ৪র্থ পর্ব মোহাম্মদ জহির ইসলাম

জাহানারার স্বামী শাকিল মাহমুদ একবারে গোসল সেরে বসার ঘরে এসে বসলো। রোহান তার ঘর থেকে বেরিয়ে তার আম্মুর কাছে গিয়ে রোহানের আর তার আব্বুর জন্য কফি এনে সোফায় বসে। -আব্বু দেখেছো আমি শীতের ছুটি কাটাতে আম্মুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলাম আর নানি নিজেই এসে হাজির। -সমস্যা কোথায়? এসেছেন যখন থেকে যাক কিছু দিন। -আরে তুমি বুঝতে পারছো না আমি গ্রামে অনেক দিন থাকতে চাই। তাই আগেই যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সব শেষ করে দিয়েছে বুড়ী।

"কে সব শেষ করে দিয়েছে নানা ভাই? " জাহানারার মা রান্না ঘর হতে বেরিয়ে রোহানের কথা শুনে বললো। -না মানে ইয়ে হচ্ছে গিয়ে...। রোহানকে এভাবে কথা বলতে দেখে রোহানের আব্বু হেসে বললো, -আপনার কথা বলছে রোহান। গ্রামে গিয়ে আপনাদেরকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল কিন্তু আপনি এসে পড়াতে নাকি তার যাওয়া বাধা পড়েছে। রোহানের কান ধরে মর্জিনা বেগম বললেন, "তোকে কে যেতে না করেছে? তোর নানি আছে এটাই তো মনে করিস না। আবার আমাকে দেখতে যাবি? গ্রামে যাওয়ার ভুত ঘাড়ে চেপেছে কিসের জন্য সখী লাগবে নাকি? -আব্বু দেখো বুড়ী বলে কী? আমি এখনো বাচ্চা ছেলে আমার আবার বিয়ে কিসের? -তোর মা একা থাকে একটা লোক ঘরে দরকারি। -তাই তো। তাছাড়া বান্দরকে ঠিক করতে একটা সখী লাগবেই। -দুর তোমাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তোমরা আমাকে ভালোবাসো না। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো ঢংয়ে রোহান বলল। -যে সখী আসবে সেই ভালোবাসবে। যাকগে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে এখন তোমরা সারপ্রাইজ নাও। কালকেই আমরা গ্রামে চলে যাচ্ছি।
-আপনি রোহানের কথায় কিছু মনে করবেন না। মজা করে একটু। আমরা কিছু দিন পরে যায় গ্রামে। -আরে বাবা বান্দরকে গ্রামে নিয়ে ঠিক করবো। আমি এখানে এসেছি ওদের নিতে। তুমি ছুটিতে চলে এসেছো এতে আমার জন্য ভালোই হয়েছে। আমেনাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি। বয়স তো আমার কম হইনি কখন চলে যায়। তাই নিজের হাতে বিয়ে দিয়ে যেতে চায়।

"সত্যি? তুমি আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছো? রোহান সোফায় দুই পা তুলে লাফিয়ে বলল। -তাহলে কী বললাম এতক্ষণ? -বিয়ের দাওয়াত খেতে গেলে তো আমাদের কিছু শপিং করতে হবে। কালকেই যাওয়া যাবে না। রোহানের আব্বু বলল কথাটি। -সমস্যা নেই। আমি বলে এসেছি আমি শহর থেকে ফিরে এসেই বিয়ের আয়োজন শুরু করবো। তোমরা তোমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারো।

জাহানারা সকলকে খাবার টেবিলে ডাকে খাওয়ার জন্য। সকলে খেয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য বসার ঘরে এসে হাজির হয়। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে টিভি দেখে সকলে।

রাতে যে যার রুমে ঘুমাতে চলে যায়। জাহানারা সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে গিয়ে দেখে তার স্বামী এখনো ঘুমায়নি। -ঘুমাও না? -কত্তো দিন পরে বাড়িতে এসেছি তোমাকে ছাড়া কেমনে ঘুমায়। বলে জাহানারাকে বুকে টেনে নেয়।

সকালে উঠে রোহান ব্যায়াম করতে বের হতে যাচ্ছে এমন সময় মর্জিনা বেগম বেরিয়ে বলে, "কোথায় যাওয়া হচ্ছে? সখীরে দেখতে যাবি নাকি?" -কেন তুমি আছো তো। তোমাকে রেখে অন্য কাউকে দেখতে যাবো ভাবলে কেমনে? -তাহলে যাস কোথায়? -হাঁটাহাঁটি করতে যাচ্ছি। যাবে নাকি আমার সঙ্গে? চেপে ধরবো না কথা দিচ্ছি। বলে রোহান তার নানিকে চোখ মারে। -দাঁড়া বান্দর। বলিস কী আমারে? রোহান দৌড়িয়ে চলে যায় সামনে থেকে। আর এ-ই দিকে মর্জিনা বেগম হাসছে। হঠাৎ মর্জিনার মনে হয় কুমারী বয়সের কথা। তাকে সেলিম জড়িয়ে ধরে ছিল। সে ভয়ে কেঁদে দিয়েছিল। তারপর সেলিমের সাথে কখনো কথা বলেনি। সবই আজকে স্মৃতি হয়ে আছে। কিন্তু মানুষগুলো নেই চারপাশে।

শপিং করতে যায় সকলেই। রোহানের সাথে তার আব্বু কয়েকটা দোকানে ঘুরে তাদের পোশাক কিনে। মর্জিনাকে জাহানারা দুটো শাড়ী কিনে দেয়। এবং দুটো আমেনার জন্য একটা তার ভাইয়ের বউয়ের জন্য। আর নিজের জন্য কিছু কিনে চলে আসে বাড়িতে।

পরের দিন সকলে রওয়ানা দেয় জাহানারার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

রোহান গ্রামে গিয়ে কি যে খুশি। তাকে ছোট্ট বেলায় এ-ই গ্রামে একবার নিয়ে এসেছিল। অথচ আজকে সে কতো বড়ো হয়ে গেছে খুশি হওয়ার কথায়। গ্রামের পোলাপান রোহানের পিছু ঘুরে যেন রোহান পাগল সেই ভাবে। কিন্তু না শহরের মানুষ দেখে গ্রামের পোলাপান গুলো খুশিতে রোহানকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। রোহানকে সঙ্গে নিয়ে পোলাপান নদীর পাড়ে যায় এবং নৌকা দিয়ে ঘুরিয়ে আনে। পোলাপানকে নদীর জলে লাফাতে দেখে রোহানও নদীর বুকে লাফ দেয়। হাসাহাসি করে গ্রামের পোলাপানদের সঙ্গে গোসল করে রোহান।

জাহানারা শহর থেকে কত্তো বছর পরে গ্রামে এসেছে এটা শুনে গ্রামের লোক দেখতে আসে। একসময় রাহুলের মা রেহানা বেগম শুনতে পায় গ্রামে জাহানারা এসেছে। সেটা শুনে জাহানারাদের বাড়িতে যায় রেহানা বেগম। জাহানারা প্রথমে রেহানাকে না চিনে তার মাকে জিজ্ঞেস করে রাহুলের মা কিনা। যখন জানতে পারে রাহুলের মা এসেছে তাকে দেখতে। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় জাহানারা। কত্তো কাল এই শরীরে গন্ধ নেয়নি। মা হারিয়ে জাহানারা একটা মা পেয়েছিল। কিন্তু ধরে রাখতে পারেনি। একটা কালবৈশাখী ঝড়ে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে দিয়ে যায়। জাহানারা হেঁচকি তুলে কান্না করে দেয়। তা দেখে রাহুলের মায়ের চোখেও পানি চলে আসে।

"কত্তো কাল রাগ করে গ্রামে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলি। তখন আমাদের একটুও মনে করিস নাই। এখন কান্না করছিস কেন? -আম্মু আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।আমি চায়নি গ্রামে এসে তোমাদের ক্ষত বাড়াতে। -তার থেকেও বেশি আঘাত পেয়েছি আমরা। যাকগে সেসব কথা তোর পোলা কোথায়? কত্তো বড়ো হয়েছে মনে হয়। চোখ মুছে জাহানারা বলল, "এসেই তো গ্রামের পোলাপানের সঙ্গে চলে গেছে। বাড়ির সকলে কেমন আছে?" -ভালোই। শুধু রাহুলের আব্বার শরীরটা ভালো না। একবার গিয়ে দেখে আছিস। -ঠিক আছে। এসে বসো রোহান এসে পরবে হয়তো। তারা তাদের সুখ দুঃখের গল্প একে অপরকে বলছে।

রোহান গোসল সেরে বাড়িতে ফিরে আসে। জাহানারা রোহানকে ভিজে গায়ে দেখে জিজ্ঞেস করে, "ভিজলি কেমনে?" -নদীতে নেমেছিলাম একটু। -ঠান্ডা লেগে যাবে তোর যা তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টিয়ে ফেল। মা ছেলের কথা শুনে রেহেনা বেগম বুঝতে পারে এটাই জাহানারার ছেলে। ভিজে গায়ের সাথে লেগে গিয়েছে পোশাক। দেখতে তো ভালোই চেহারা হয়েছে। জাহানারাকে জিজ্ঞেস করল, "এটাই তোর পোলা?" -জ্বি আম্মু। -মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে। -আপনাদের দোয়া সব। -ঠিক আছে আমি এখন যায়। -রোহানের সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দিলাম না। রোহান বাহিরে আয় তো। রোহান আসলে জাহানারা বললো, আমার আম্মু সালাম কর। রোহান সালাম জানিয়ে বলল, "তোমার এত্তো আম্মু? বাপ তো আমি একা।" -মশকরা করা হচ্ছে। -বেশি না একটুখানি। আপনি নিশ্চয় আম্মুর ছোট্টোবেলার মায়ের জায়গা নেওয়ার সেই মা? আমি আপনাদের সাথে রাগ করেছি। বলে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ায় রোহান।

রেহেনা বেগম রোহানকে জিজ্ঞেস করে, "আমাদের সাথে রাগ করার কারণ কী?" -রাগ করবো না? আম্মু কত্তো বছর গ্রামে আসেনি আপনারা খুঁজ নিয়েছেন কখনো? কখনো ভেবেছেন আম্মুর গ্রামে আসার মন চায় কিনা? মেয়ে ভাবলে এমন করতেন না কখনো। -রোহান বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। জাহানারা রোহানকে ধমক দিয়ে বলে উঠে। -মা দেখো দেখো বুড়ী মুখ কেমন করে আছে। বলেই রোহান হেসে দেয়। রোহানের মশকরা দেখে রেহেনা বেগমও হেসে জাহানারাকে বলে, "বজ্জাত তো তোর পোলা।" মর্জিনা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, "আপনাকেও বোকা বানিয়েছে তাহলে? আমি আরও ভাবলাম আপনি একটু নাকানিচুবানি খাওয়াবেন। আরও কিছুক্ষণ ঠাট্টা-তামাশার কথা বলে রেহেনা বেগম বাড়িতে চলে যায়।

চলবে...

2
$
User's avatar
@Mdemon456 posted 3 years ago

Comments