গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_সেপ্টেম্বর_২০২০
'তীক্ষ্ণ বাণ' (পর্ব-০৩)
পরের দিন ভাবি রিপাকে নিজের মতো করে ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে দিলেন। বুঝালেন রিপাও দাদিও। কিন্তু সেসবের দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় কোথায় রিপার? সে তো এখনো আকিবের ধান্দাতেই রয়েছে। আকিবের সাথে যোগাযোগ করার ফন্দি আঁটছে মনে মনে। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছে না তেমন। সারাক্ষণ সাথে কেউ না কেউ থাকবেই। বিশেষ করে তাকবীর। ছেলেটা ওকে চোখে হারায়। পুরুষ মানুষ হয়েও এত ঘরের কোণে বসে বসে শুধু বউয়ের চেহারা দেখার এত ধৈর্য্য কই পায় সেটা রিপার বুঝে আসে না। কখনো বাড়ির বাইরে বেরও হয় না। কিংবা বাড়ি থেকে বাইরে বের হলেও রিপাকে সাথে নিয়েই বের হয়। কী অদ্ভুত নির্লজ্জ এই লোকটা! লাজ-শরমের বালাই নেই বললেই চলে।
এরপর আরো দুইদিন চলে গেল। দাদিও চলে গিয়েছেন গতকাল। ভেতরটা ক্রমশই ভারী হয়ে আসছিল রিপার। বিষন্নতায় ভেতরটা ছেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই বিষন্নতা দাদি চলে যাওয়ার জন্য নাকি আকিবের জন্য সেটা তৎক্ষনাৎ টের পেল না রিপা।
টের পেল রাতে। যখন তাকবীর ওর সাথে কোনোরকম দুষ্টুমি, ফাযলামি না করেই চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো তখন। তাকবীর গত দুইদিন ধরেই এরকম করছে। সেদিনের পর থেকে তাকবীর ওর সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলেনি। এমনি দূর থেকে তাকিয়ে থাকে, সবার সামনে স্বাভাবিক ব্যবহার করে। অথচ ঘরে আসলে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ হয়ে যায়। এত এত দূরের কেউ হয়ে যায়।
আচ্ছা! তাকবীর তো কাছের কেউ কখনো ছিল না। সে দূরের মানুষ, দূরে দূরেই থাকে। এতে তো বরং রিপার খুশি হওয়ার কথা। সে তো এটাই চেয়েছিল মনে মনে। কিন্তু তা না হয়ে এটার জন্য এত অভিমান ভর করে কেন রিপার কিশোরী মনে? কেন ওকে নানানভাবে জ্বালাতন না করার জন্য ওর বুক ফেটে কান্না পায়? কেন বার বার মনে হয় যে, ওই মানুষটা কাছে আসুক? একটু জ্বালাতন করুক!
রিপা পাত্তা দিবে না। একটুও পাত্তা দিবে না তাকবীরকে। তবুও তাকে বার বার রিপার পিছু পিছুই ঘুরঘুর করতে হবে, রিপাকে খোঁচাতে হবে, সারাক্ষণ জ্বালাতে হবে। কেন সে রিপার পেছনে ঘুরঘুর করে না সারাক্ষণ? রিপা পাত্তা দেয় না বলে ওকে পিছপা হতে হবে? কেন? রিপা ওর বউ লাগে না? বউ পাত্তা না দিলেও বউয়ের পেছনে ঘুরঘুর করতে হয়। এটা কি তাকবীর বুঝে না?
ইশ! এসব কী ভাবছে রিপা? এত উল্টা পাল্টা পাগলামি মার্কা চিন্তা মাথায় ভর করেছে কেন হঠাৎ? কী চাচ্ছে ওর মন? মনকে বারবার প্রশ্ন করার পর মন উত্তর দিলো যে, সে তাকবীরের সঙ্গ চায়। চোখের সামনে তাকবীরের এই অবহেলা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। সেদিনের ওই ব্যবহারে তাকবীর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে?
এরপর রিপার কী হল রিপা জানে না। সে হুট করেই বিছানায় কপালের উপর হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে থাকা তাকবীরের প্রশস্ত বুকে জীবনের প্রথমবারের মতো নিজের মাথাটা রেখে তাকবীরকে জাপটে ধরে আহ্লাদিত স্বরে বলল, "এমনে রাগ কইরা আছেন ক্যান আমার উপর? আমার কষ্ট লাগতাছে বুঝেন না?"
বিয়ের পর তাকবীর দুইমাস বাড়িতে ছিল। এই দুইমাসে রিপার ভেতর অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। তাকবীরের আদর-ভালোবাসায় আকিবের কথা খুব একটা মনেও পড়ত না। সারাক্ষণ তাকবীরের এমন আনাগোনায় আকিবের কথা মনে করার এত সময় কোথায়?
মনে মনে যে নেতিবাচক প্রতিজ্ঞা করে এই বাড়িতে পা রেখেছিল সেই প্রতিজ্ঞাও শেষ পর্যন্ত পূরণ করা হয় উঠেনি। শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, জা সবাই ওর প্রতি এত বেশি অমায়িক ছিল যে, ওই মানুষগুলোর সাথে একটা সময়ের পর থেকে মুখ গোমড়া করে কথা বলতে ওর নিজেরই খারাপ লেগেছে৷ এতগুলো মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করা ওর পক্ষে রিতীমত অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
বিয়ের এই দুই মাসেও মুন্নি ওকে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘেঁষতে দেয়নি। শুধু রান্নাবান্নাই না; অন্য কোনো কাজেও ধরতে দেয়নি। তার এক কথা, "এখন তোমার কাজ করা লাগব না। যে কয়দিন আমার দেবর আছে, সেই কয়দিন ওর সামনে থিকা এক সেকেন্ডের জন্যও সরবা না। কাজ কাম যা আছে আমিই করতে পারমু।"
শাশুড়ির মুখেও একই কথা। উল্লেখ্য যে, মুন্নির বর তাইমুম বিশেষ কোনো চাকরি-বাকরি করতো না। বাজারে মুদির দোকান আছে একটা; সেইটাই দেখাশোনা করতো। সে আবার একটু উড়নচণ্ডী স্বভাবেরও ছিল। সংসারের ভালো-মন্দের দিকে খুব একটা নজর দিতো না সে। সংসার খরচের সিংহভাগ টাকা ইতালি থেকেই আসতো। যার জন্য তাকবীরের একটা আলাদা কদর ছিল বাড়িতে। তাকবীরের সূত্র ধরে রিপাও সেই বাড়তি কদরের ভাগীদার হয়েছিল। পুরো সংসারের রাজা-রানি যেন ওরা দুজনেই ছিল।
দেখতে দেখতে তাকবীরের চলে যাওয়ার দিন যত ঘনিয়ে আসছিল, রিপার বুকের অদৃশ্য অভিমানী পাথরটা ততই যেন ভারী হচ্ছিল। এতদিনে সে তাকবীরকে ঠিক কতখানি ভালোবাসতে পেরেছে তা সে জানে না। তবে এতটুকু জানে যে, তাকবীরের সঙ্গ ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। রিপার কিশোরী মনের অনেকখানি জায়গা ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে তাকবীর নামক মানুষটা।
চলে যাওয়ার আগের রাতে পিচ্চি ওই পুতুলটা তাকবীরকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! পিচ্চিটা পিচ্চিদের মতোই কান্না করছিল। সে কি আর তাকবীরের কোনো বুঝ মানতে চায়!
রিপার এমন কান্নাকাটিতে তাকবীরের খারাপ লাগছিল, আবার ভালোও লাগছিল। অদ্ভুত এক মিশ্র অনূভুতিতে ভেতরটা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল তার। যে মেয়েটা একটা সময় তাকে সহ্যই করতে পারতো না, সে কি-না আজ এভাবে অবুঝ বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে কাঁদছে তার আসন্ন বিরহে! এটা যে তার পরম পাওয়া!
রিপার অসহ্য উষ্ণ অশ্রুধারায় সিক্ত হচ্ছিল তাকবীরের বুকের ভেতর ও বাহির; উভয়ই। নিজের বুক থেকে রিপার ক্রদনরত মুখখানি আলতো করে উঠিয়ে নিজের উষ্ণ ওষ্ঠের স্পর্শে শুষে নিচ্ছিল রিপার সমস্ত তরল, বহমান অশ্রু নামক অভিমান। রিপার ঠোঁটের অমৃত স্বাদ গ্রহণ করতে করতে পিচ্চি পুতুল পুতুল বউটাকে কোলে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় তাকবীর। এরপর শেষবারের মতো রিপাকে নিয়ে ডুব দেয় অমৃত ভালোবাসার বিশাল মহাসাগরের এক গহীন গহ্বরে।
তাকবীর চলে গিয়েছে সাতদিন হলো আজ। এরমধ্যে নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে বসেছে রিপা। এক বেলা জোর করে কেউ খাওয়ায় তো দুই বেলাই না খেয়ে থাকে। দুপুরের গোসল করতে করতে বিকেল হয়ে যায়। সারাক্ষণ শুধু মন ভার করে বসে থাকে। হুটহাট কান্না করে উঠে।
তাকবীরের মতো করে কেউ ওকে কখনো ভালোবাসেনি, আদর করেনি। তাকবীরকে প্রতিটা মুহূর্তে মনে পড়ে ওর। যেদিকেই তাকায় শুধু তাকবীরকেই দেখতে পায়। ঘরের ভেতরে দমটা আরো বেশি বন্ধ হয়ে আসে। এই ঘরটাতে তো তাকবীরের স্মৃতি সবচেয়ে বেশি। তাকবীরের সমস্ত দুষ্টুমি, আহ্লাদ, ভালোবাসা, মান, অভিমান; সব...সব এই ঘরের আনাচে-কানাচে লেপ্টে আছে। কীভাবে এই ঘরে তাকবীরকে ছাড়া ওর মন টিকবে? তাকবীরবিহীন একেকটা রাতকে ওর সহস্র বছরের সমান মনে হয়। এত কষ্ট কষ্ট লাগে কেন? অথচ এই তাকবীরকেই প্রথম দিকে কত অবহেলা, অবজ্ঞা করেছে ও!
একটু পর পর তাকবীরকে ফোন দিয়ে শুধু কান্নাকাটি করে রিপা। ওর ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভালো লাগে না।
রিপার এমন অবস্থা দেখে তাকবীর ওকে বলল বাবার বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসতে। সেখানে গেলে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। বাড়ির অন্য সবাইও তাকবীরের কথা সমর্থন করে রিপাকে নিয়ে ওর বাবার বাড়ি রেখে আসলো।
বাবার বাড়ি যাওয়ার পরের দিনই তাকবীরকে নিয়ে রিপার সদ্য গড়ে তোলা মাখামাখা ভালোবাসাময় পৃথিবীটা তাসের ঘরের মতো তছনছ করে দিতে আমাদের আকিব ভাই ফোন করলো রিপার নতুন নাম্বারে।
দুইবছরের ছোট্ট ভাইঝির সাথে ফ্লোরে বসে খেলছিল রিপা। ফোনটা হাতের কাছেই ছিল। রিংটোন শুনে ফোনের স্কিনের দিকে তাকাতেই আকিবের ফোন নাম্বার স্ক্রিনের উপর ভাসতে দেখে রিপার বুকটা ধক করে উঠলো।
আকিব ফোন দিয়েছে ওকে! আজকাল তো রিপার ওর কথা মনেই পড়ে না। এখন তো তাকবীরকে নিয়েই সারাক্ষণ বিভোর থাকে সে। হঠাৎ করেও কখনো আকিবের কথা মনে পড়ে না। কিংবা মনে পড়লেও কষ্ট লাগে না একটুও। বিয়ের পর প্রথম কয়েকদিন আকিবের সাথে কথা বলার জন্য সবসময় মন আকুপাকু করলেও সময়ের ব্যবধানে সেটাও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তাকবীরের সংস্পর্শে আসার পরে আর কখনো আকিবের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করেনি মোটেও।
কিন্তু এখন ওর ফোনকল দেখে ভেতরে কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিছু কান্না গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। এতদিন পর আকিব ওকে ফোন করেছে? কেন ফোন দিয়েছে সে? আর এই ফোন নাম্বারই বা সে পেল কই?
রিপা কি ফোন রিসিভ করবে? কিভাবে কথা বলবে সে আকিবের সাথে? কোন মুখে কথা বলবে? সে যে আকিবকে ঠকিয়েছে। খুব বাজে ভাবে ঠকিয়েছে, খুব! এরপরেও কি আকিবের সাথে কথা বলার কোনো মুখ আছে তার?
এরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা একাই কেটে গেল। সাথে সাথে আবারো বেজে উঠলো। এবার আর দেরি করলো না রিপা। কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে ফোনটা রিপা কানের কাছে ধরলো।
চলবে ইন-শা-আল্লাহ
{শব্দসংখ্যা ১২৫০+)
গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_সেপ্টেম্বর_২০২০
'তীক্ষ্ণ বাণ' (পর্ব-০৩)
পরের দিন ভাবি রিপাকে নিজের মতো করে ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে দিলেন। বুঝালেন রিপাও দাদিও। কিন্তু সেসবের দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় কোথায় রিপার? সে তো এখনো আকিবের ধান্দাতেই রয়েছে। আকিবের সাথে যোগাযোগ করার ফন্দি আঁটছে মনে মনে। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছে না তেমন। সারাক্ষণ সাথে কেউ না কেউ থাকবেই। বিশেষ করে তাকবীর। ছেলেটা ওকে চোখে হারায়। পুরুষ মানুষ হয়েও এত ঘরের কোণে বসে বসে শুধু বউয়ের চেহারা দেখার এত ধৈর্য্য কই পায় সেটা রিপার বুঝে আসে না। কখনো বাড়ির বাইরে বেরও হয় না। কিংবা বাড়ি থেকে বাইরে বের হলেও রিপাকে সাথে নিয়েই বের হয়। কী অদ্ভুত নির্লজ্জ এই লোকটা! লাজ-শরমের বালাই নেই বললেই চলে।
এরপর আরো দুইদিন চলে গেল। দাদিও চলে গিয়েছেন গতকাল। ভেতরটা ক্রমশই ভারী হয়ে আসছিল রিপার। বিষন্নতায় ভেতরটা ছেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই বিষন্নতা দাদি চলে যাওয়ার জন্য নাকি আকিবের জন্য সেটা তৎক্ষনাৎ টের পেল না রিপা।
টের পেল রাতে। যখন তাকবীর ওর সাথে কোনোরকম দুষ্টুমি, ফাযলামি না করেই চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো তখন। তাকবীর গত দুইদিন ধরেই এরকম করছে। সেদিনের পর থেকে তাকবীর ওর সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলেনি। এমনি দূর থেকে তাকিয়ে থাকে, সবার সামনে স্বাভাবিক ব্যবহার করে। অথচ ঘরে আসলে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ হয়ে যায়। এত এত দূরের কেউ হয়ে যায়।
আচ্ছা! তাকবীর তো কাছের কেউ কখনো ছিল না। সে দূরের মানুষ, দূরে দূরেই থাকে। এতে তো বরং রিপার খুশি হওয়ার কথা। সে তো এটাই চেয়েছিল মনে মনে। কিন্তু তা না হয়ে এটার জন্য এত অভিমান ভর করে কেন রিপার কিশোরী মনে? কেন ওকে নানানভাবে জ্বালাতন না করার জন্য ওর বুক ফেটে কান্না পায়? কেন বার বার মনে হয় যে, ওই মানুষটা কাছে আসুক? একটু জ্বালাতন করুক!
রিপা পাত্তা দিবে না। একটুও পাত্তা দিবে না তাকবীরকে। তবুও তাকে বার বার রিপার পিছু পিছুই ঘুরঘুর করতে হবে, রিপাকে খোঁচাতে হবে, সারাক্ষণ জ্বালাতে হবে। কেন সে রিপার পেছনে ঘুরঘুর করে না সারাক্ষণ? রিপা পাত্তা দেয় না বলে ওকে পিছপা হতে হবে? কেন? রিপা ওর বউ লাগে না? বউ পাত্তা না দিলেও বউয়ের পেছনে ঘুরঘুর করতে হয়। এটা কি তাকবীর বুঝে না?
ইশ! এসব কী ভাবছে রিপা? এত উল্টা পাল্টা পাগলামি মার্কা চিন্তা মাথায় ভর করেছে কেন হঠাৎ? কী চাচ্ছে ওর মন? মনকে বারবার প্রশ্ন করার পর মন উত্তর দিলো যে, সে তাকবীরের সঙ্গ চায়। চোখের সামনে তাকবীরের এই অবহেলা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। সেদিনের ওই ব্যবহারে তাকবীর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে?
এরপর রিপার কী হল রিপা জানে না। সে হুট করেই বিছানায় কপালের উপর হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে থাকা তাকবীরের প্রশস্ত বুকে জীবনের প্রথমবারের মতো নিজের মাথাটা রেখে তাকবীরকে জাপটে ধরে আহ্লাদিত স্বরে বলল, "এমনে রাগ কইরা আছেন ক্যান আমার উপর? আমার কষ্ট লাগতাছে বুঝেন না?"
বিয়ের পর তাকবীর দুইমাস বাড়িতে ছিল। এই দুইমাসে রিপার ভেতর অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। তাকবীরের আদর-ভালোবাসায় আকিবের কথা খুব একটা মনেও পড়ত না। সারাক্ষণ তাকবীরের এমন আনাগোনায় আকিবের কথা মনে করার এত সময় কোথায়?
মনে মনে যে নেতিবাচক প্রতিজ্ঞা করে এই বাড়িতে পা রেখেছিল সেই প্রতিজ্ঞাও শেষ পর্যন্ত পূরণ করা হয় উঠেনি। শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, জা সবাই ওর প্রতি এত বেশি অমায়িক ছিল যে, ওই মানুষগুলোর সাথে একটা সময়ের পর থেকে মুখ গোমড়া করে কথা বলতে ওর নিজেরই খারাপ লেগেছে৷ এতগুলো মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করা ওর পক্ষে রিতীমত অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
বিয়ের এই দুই মাসেও মুন্নি ওকে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘেঁষতে দেয়নি। শুধু রান্নাবান্নাই না; অন্য কোনো কাজেও ধরতে দেয়নি। তার এক কথা, "এখন তোমার কাজ করা লাগব না। যে কয়দিন আমার দেবর আছে, সেই কয়দিন ওর সামনে থিকা এক সেকেন্ডের জন্যও সরবা না। কাজ কাম যা আছে আমিই করতে পারমু।"
শাশুড়ির মুখেও একই কথা। উল্লেখ্য যে, মুন্নির বর তাইমুম বিশেষ কোনো চাকরি-বাকরি করতো না। বাজারে মুদির দোকান আছে একটা; সেইটাই দেখাশোনা করতো। সে আবার একটু উড়নচণ্ডী স্বভাবেরও ছিল। সংসারের ভালো-মন্দের দিকে খুব একটা নজর দিতো না সে। সংসার খরচের সিংহভাগ টাকা ইতালি থেকেই আসতো। যার জন্য তাকবীরের একটা আলাদা কদর ছিল বাড়িতে। তাকবীরের সূত্র ধরে রিপাও সেই বাড়তি কদরের ভাগীদার হয়েছিল। পুরো সংসারের রাজা-রানি যেন ওরা দুজনেই ছিল।
দেখতে দেখতে তাকবীরের চলে যাওয়ার দিন যত ঘনিয়ে আসছিল, রিপার বুকের অদৃশ্য অভিমানী পাথরটা ততই যেন ভারী হচ্ছিল। এতদিনে সে তাকবীরকে ঠিক কতখানি ভালোবাসতে পেরেছে তা সে জানে না। তবে এতটুকু জানে যে, তাকবীরের সঙ্গ ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। রিপার কিশোরী মনের অনেকখানি জায়গা ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে তাকবীর নামক মানুষটা।
চলে যাওয়ার আগের রাতে পিচ্চি ওই পুতুলটা তাকবীরকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! পিচ্চিটা পিচ্চিদের মতোই কান্না করছিল। সে কি আর তাকবীরের কোনো বুঝ মানতে চায়!
রিপার এমন কান্নাকাটিতে তাকবীরের খারাপ লাগছিল, আবার ভালোও লাগছিল। অদ্ভুত এক মিশ্র অনূভুতিতে ভেতরটা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল তার। যে মেয়েটা একটা সময় তাকে সহ্যই করতে পারতো না, সে কি-না আজ এভাবে অবুঝ বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে কাঁদছে তার আসন্ন বিরহে! এটা যে তার পরম পাওয়া!
রিপার অসহ্য উষ্ণ অশ্রুধারায় সিক্ত হচ্ছিল তাকবীরের বুকের ভেতর ও বাহির; উভয়ই। নিজের বুক থেকে রিপার ক্রদনরত মুখখানি আলতো করে উঠিয়ে নিজের উষ্ণ ওষ্ঠের স্পর্শে শুষে নিচ্ছিল রিপার সমস্ত তরল, বহমান অশ্রু নামক অভিমান। রিপার ঠোঁটের অমৃত স্বাদ গ্রহণ করতে করতে পিচ্চি পুতুল পুতুল বউটাকে কোলে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় তাকবীর। এরপর শেষবারের মতো রিপাকে নিয়ে ডুব দেয় অমৃত ভালোবাসার বিশাল মহাসাগরের এক গহীন গহ্বরে।
তাকবীর চলে গিয়েছে সাতদিন হলো আজ। এরমধ্যে নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে বসেছে রিপা। এক বেলা জোর করে কেউ খাওয়ায় তো দুই বেলাই না খেয়ে থাকে। দুপুরের গোসল করতে করতে বিকেল হয়ে যায়। সারাক্ষণ শুধু মন ভার করে বসে থাকে। হুটহাট কান্না করে উঠে।
তাকবীরের মতো করে কেউ ওকে কখনো ভালোবাসেনি, আদর করেনি। তাকবীরকে প্রতিটা মুহূর্তে মনে পড়ে ওর। যেদিকেই তাকায় শুধু তাকবীরকেই দেখতে পায়। ঘরের ভেতরে দমটা আরো বেশি বন্ধ হয়ে আসে। এই ঘরটাতে তো তাকবীরের স্মৃতি সবচেয়ে বেশি। তাকবীরের সমস্ত দুষ্টুমি, আহ্লাদ, ভালোবাসা, মান, অভিমান; সব...সব এই ঘরের আনাচে-কানাচে লেপ্টে আছে। কীভাবে এই ঘরে তাকবীরকে ছাড়া ওর মন টিকবে? তাকবীরবিহীন একেকটা রাতকে ওর সহস্র বছরের সমান মনে হয়। এত কষ্ট কষ্ট লাগে কেন? অথচ এই তাকবীরকেই প্রথম দিকে কত অবহেলা, অবজ্ঞা করেছে ও!
একটু পর পর তাকবীরকে ফোন দিয়ে শুধু কান্নাকাটি করে রিপা। ওর ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভালো লাগে না।
রিপার এমন অবস্থা দেখে তাকবীর ওকে বলল বাবার বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসতে। সেখানে গেলে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। বাড়ির অন্য সবাইও তাকবীরের কথা সমর্থন করে রিপাকে নিয়ে ওর বাবার বাড়ি রেখে আসলো।
বাবার বাড়ি যাওয়ার পরের দিনই তাকবীরকে নিয়ে রিপার সদ্য গড়ে তোলা মাখামাখা ভালোবাসাময় পৃথিবীটা তাসের ঘরের মতো তছনছ করে দিতে আমাদের আকিব ভাই ফোন করলো রিপার নতুন নাম্বারে।
দুইবছরের ছোট্ট ভাইঝির সাথে ফ্লোরে বসে খেলছিল রিপা। ফোনটা হাতের কাছেই ছিল। রিংটোন শুনে ফোনের স্কিনের দিকে তাকাতেই আকিবের ফোন নাম্বার স্ক্রিনের উপর ভাসতে দেখে রিপার বুকটা ধক করে উঠলো।
আকিব ফোন দিয়েছে ওকে! আজকাল তো রিপার ওর কথা মনেই পড়ে না। এখন তো তাকবীরকে নিয়েই সারাক্ষণ বিভোর থাকে সে। হঠাৎ করেও কখনো আকিবের কথা মনে পড়ে না। কিংবা মনে পড়লেও কষ্ট লাগে না একটুও। বিয়ের পর প্রথম কয়েকদিন আকিবের সাথে কথা বলার জন্য সবসময় মন আকুপাকু করলেও সময়ের ব্যবধানে সেটাও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তাকবীরের সংস্পর্শে আসার পরে আর কখনো আকিবের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করেনি মোটেও।
কিন্তু এখন ওর ফোনকল দেখে ভেতরে কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিছু কান্না গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। এতদিন পর আকিব ওকে ফোন করেছে? কেন ফোন দিয়েছে সে? আর এই ফোন নাম্বারই বা সে পেল কই?
রিপা কি ফোন রিসিভ করবে? কিভাবে কথা বলবে সে আকিবের সাথে? কোন মুখে কথা বলবে? সে যে আকিবকে ঠকিয়েছে। খুব বাজে ভাবে ঠকিয়েছে, খুব! এরপরেও কি আকিবের সাথে কথা বলার কোনো মুখ আছে তার?
এরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা একাই কেটে গেল। সাথে সাথে আবারো বেজে উঠলো। এবার আর দেরি করলো না রিপা। কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে ফোনটা রিপা কানের কাছে ধরলো।
চলবে ইন-শা-আল্লাহ
{শব্দসংখ্যা ১২৫০+)