ভেজা চিরকুট -- ৩৬তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৬৬. অনু আর মামুন যেখানে নামল, সেই জায়গাটা প্রায় জনশূন্য। মাঝে মাঝে দুই একটা বাস দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে শুধু। পরিষ্কার রাস্তাটার একপাশে একটা তালাবদ্ধ দোকান, আর অন্যপাশে দিয়ে পশ্চিমে বয়ে গেছে মাটির ধুলোমাখা রাস্তা। সেই রাস্তার দুই পাশ দিয়ে আবার গাছাপালা, কিছু বাড়ি। অনু মুগ্ধ হয়ে চারিদিকটা দেখল খানিকক্ষণ। এত সুন্দর একটা জায়গায় লিপি থাকে, এটা ভাবতেই গর্ব হচ্ছে কিছুটা। আড়চোখে মামুনের দিকে তাকিয়ে দেখল, সে-ও অপলক দৃষ্টিতে চারিদিক দেখছে। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর প্রায় ১টা বাজে। আশেপাশে মসজিদ থাকলে শীঘ্রই মুয়াজ্জিনের গলার স্বর শোনা যাবে। রৌদ্রজ্বল দুপুরের উত্তপ্ততা একটু বেশিই বটে, তবে কাবু করার মতো না। বিশেষ কারণ এই শীতকালীন সময়টা। তাঁর উপর প্রকৃতির এমন রমরমা দৃশ্য। টানা তিন-চার ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকাতে যতটা বিরক্তি, অস্বস্তি হচ্ছিল, এই মুহূর্তে সব যেন উধাও হয়ে গেছে। অনু সহসা অস্ফুটস্বরে বলল, "চলুন।" "কোনদিকে যাবো?" মামুন এতক্ষণ বিমুগ্ধ হয়ে চারিদিকের পরিবেশ দেখছিল। অনুর কথা শুনেই কিছুটা চমকিত হয়ে প্রশ্ন করল। সরাসরি তাকালো ওর চোখের দিকে। অনু নিচের শুকনো ঠোঁটটা হালকা ভিজিয়ে বলল, "এই রাস্তা দিয়ে এগোতে হবে। আমি গুগল ম্যাপে দেখেছিলাম।" "আচ্ছা।" দু'জনে আর দাঁড়িয়ে না থেকে সামনের দিকে এগোতে লাগল। হাঁটার তালে তালে রাস্তার ধূলো মৃদুভাবে উড়তে লাগল। মাথার উপর রাগান্বিত সূর্য, হালকা বাতাস, আর এই ধুলোমাখা পথ, খুব একটা খারাপ লাগছে না। বরং অনেকদিন পর এমন খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নিতে পেরে স্বস্তি হচ্ছে। চারিদিকে পাহাড় সমান উঁচু উঁচু বিল্ডিং নেই, পায়ের নিচে পাকা রাস্তা নেই, মাথায় উপর বিভৎস আকাশ নেই। আকাশটা এক হলেও বিস্তর পার্থক্যও আছে বটে! ওখানে পথে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তালাকে দেখা যায় কারখানার ক্ষতিপূর্ণ কালো ধোঁয়া। আর এখানে উপরের দিকে তাকালে দেখা যায় ধূসর-সাদা রঙের সুশ্রী মেঘ! হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এলো অনু আর মামুন। রাস্তায় পাশ দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর উঠোন থেকে অদ্ভুত চোখে কিছু মানুষ তাকিয়ে দেখছে তাঁদের। গ্রামে এই ব্যাপারটা বেশ নজর কাড়ে। নতুন মানুষের উপস্থিতি হলে গ্রামবাসীর কৌতূহলের অন্ত নেই। দু'জন ছেলে-মেয়ে যখন পাশাপাশি থাকে, তখন তাঁদের কৌতূহল গাঢ় হয়, এদের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা জানার উদ্বেগে ব্যাকুল হয়। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। রাস্তাটা শেষ হচ্ছে না; তবে বাড়িগুলো কমতে শুরু করেছে। বেশ দীর্ঘ জমির পর একটা করে বাড়ি দেখা যাচ্ছে এখন। অনু সহসা বলল, "আপনি তো শুধু একটা শার্ট পরে এসেছেন। শীতের জামা সাথে আনেননি কেন?" মামুন হাস্যরত গলায় বলল, "এই রোদে শীতের জামা দিয়ে কী করব?" "আপনি মাঝে মাঝে এমন বোকা বোকা কথা বলে না!" কপট রাগ প্রকাশ করল অনু। হাঁটা অব্যাহত রেখে আবার বলল, "এই রোদ কি সমসময় থাকবে? সন্ধ্যের পর যা শীত পড়ে না, আপনাকে একেবারে চিবিয়ে খাবে।" মামুন চোখ পিটপিট করে বলল, "এত সাহস ওর! আপনি আছেন না।" "আমি কি করব?" অনু বিস্মিত হলো। মামুন খানিক ঠাট্টার ছলে বলল, "আপনার গায়ের চাদর দিয়ে আমায় রক্ষা করবেন।" জবাব দিতে গিয়েও থমকে গেল অনু। বিস্মিত হয়ে কিছুদিন আগের ঘটনাটা মনে করল। সেদিন রেলওয়ে স্টেশনে সে আর মামুন এক চাদরের আশ্রয়ে রাত পার করেছিল। এবং শেষ রাতে একে অপরকে অন্তরঙ্গ ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। মুহূর্তটা মনে পড়তেই অনু শিউরে উঠল। গায়ে কাটা দিয়ে উঠল তাঁর। মামুনের দিকে তাকানোর দুঃসাহস দেখালো না আর। মামুন ভীত গলায় বলল, "রাগ করলেন নাকি?" অনু আচমকা হাঁটা থামালো। কয়েক সেকেন্ড ধীর গতি; এরপর আচমকা দৌড় দিলো। মামুন হতভম্ব হয়ে কয়েক সেকেন্ড অনুর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল, এরপর সে-ও দৌড় দিলো। একটা দীর্ঘ নদী। ঘাটে সাড়ি-সাড়ি নৌকা বাঁধা। দু'য়েকটা নৌকাতে মাঝি দেখা যাচ্ছে। নদীর সচ্ছল পানিতে ঢেউ খেলছে। ঢেউ খেলানোর সাথে পানির কলরব শব্দ হচ্ছে। অনু দুই হাত কোমরে রেখে উচ্চস্বরে হেসে, "আমিই কিন্তু প্রথম শব্দটা শুনেছি।" "হু, আপনিই প্রথম শুনেছেন।" হেসে স্বীকার করল মামুন। ওদের দেখেই এক মাঝি এগিয়ে এলো। সামনে এসে মামুনের উদ্দেশ্যে বলল, "ভাইজান, কই যাইবেন?" মামুন তাকালো অনুর দিকে। পাশ থেকে অনু বলল, "মোখলেস কৃষকের বাড়ি যাবো। উনার মেয়ের নাম লিপি। আপনি চেনেন?" মাঝির মুখে প্রশস্ত হাসি ফুঁটলো, "হ্যাঁ, আপা, চিনি। নদীর ওই পাড়ে। চলেন নিয়া যাই।" ঠোঁট টিপে মাথা ঝাঁকালো অনু; সম্মতি জানালো। নৌকা যখন নদীর বুকে ভাসছে, তখন হঠাৎ মামুন বলল, "একটা কথা বলব?" নৌকাতে মাঝিসহ তিনজন। মাঝি নৌকার যে-পাশে বসে আছে, মামুন আর অনু তার উল্টো পাশে। অনু এতক্ষণ নদীর পাড়গুলো দেখছিল। মামুনের গলার আওয়াজ শুনে পাশ ফিরে তাকালো। তবে মুখে কোনোরকম শব্দ করল না। সম্মতির লক্ষন বুঝতে পেরে মামুন সহসা বলল, "আপনাকে খুব সুন্দর দেখতে লাগছে।" অনু সুপ্রসন্ন হাসি দিয়ে বলল, "তাই নাকি? কিন্তু আমার থেকেও সুন্দরী মেয়ে ঢাকায় আছে। ঢাকায় রিকশা চালান; নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী রিকশায় চড়ে বসে।" মামুন শুকনো গলায় বলল, "সবার সৌন্দর্য তো নকল।" "আমারটা বুঝি আসল?" "অবশ্যই আসল। রোদে-পুড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পরেও যাকে এত সুন্দর দেখতে লাগে, তাঁর সৌন্দর্য অবশ্যই খাঁটি।" অনু মুখ টিপে হাসি আটকিয়ে বলল, "হু, ইমপ্রেস করার প্রচেষ্টা। লেখকদের অনেকগুলো বিশেষ গুণের মধ্যে একটা গুণ হলো, ক্ষত-বিক্ষত বস্তুকেও অক্ষত হিসেবে উপস্থাপন করা। ভালো, চালিয়ে যান। কিন্তু আমি পটছি না।" মামুন আহত হয়ে বলল, "আমি আপনাকে পটানোর জন্য কথাটা বলিনি। যা সত্যি, তাই বলেছি। সূর্যের আলোটা মনে হচ্ছে আপনার মুখে একটা বেশি করেছে পড়েছে। আপনার ঘামে ভেজা মুখটা একটু বেশিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সেজন্য প্রশংসা করলাম। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে করিনি।" অনু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মাঝি ফোঁড়ন কাঁটায় তাকে চুপ থাকতে হলো। মাঝি ওপাশ থেকে খানিক চেঁচিয়ে বলল, "ভাইজান কি রিকশা চালান?" মামুন মাঝির দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল, "হ্যাঁ।" "আর আপায় কী করেন?" অনু উচ্চস্বরে জবাব দিলো, "আমি উনার রিকশার গুরুত্বপূর্ণ যাত্রী।" মামুন বিহ্বলিত হয়ে মাঝির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার অনুর দিকে তাকাতেই দেখল, অনু সামনে দিকে ঝুঁকে হাত দিয়ে নদীর সচ্ছল পানি মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে। পানি অনুর মায়াবী মুখের সাথে সংঘর্ষ হয়ে আবার ছিটকে পড়ছে; চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মামুনের মুখেও কয়েক ফোঁটা পানি এসে পড়ল। কিন্তু সে আমলে নিলো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল অনুর দিকে। ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, কী অপূর্ব দেখতে আপনি!

মাঝির সহযোগিতায় লিপিদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো অনু আর মামুন। মাঝি চলে যেতেই অনু আর মামুন উঠোনে এসে দাঁড়ালো। একট টিনের বাড়ি। বাড়ির সামনের দুয়ার বেশ বড়। পাশে আরও দুই-তিনটে বাড়ি আছে। অনু একবার মামুনের দিকে তাকিয়ে, আবার সামনের দিকে তাকালো। দরজাটা ভেজানো। তাই করাঘাত করে ডাকল, "লিপি।" ভিতর ঘরে এক মহিলার কণ্ঠ ভেসে এলো, "কে?" কণ্ঠটা পরিচিত মনে হলো অনুর। আগেও শুনেছে বলে মনে হচ্ছে তাঁর। অনু আবারও একই সুরে ডাকল, "লিপি।" এবার ভিতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধ সবকিছু; এরপরই সামনের দরজাটা স্বঃশব্দে খুলে গেল। একটা মাঝবয়সী মহিলা উঁকি দিলো বাইরের দিকে। মহিলার চেহারাটা লিপির সাথে মিল আছে কিছু। তাই বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না যে, এটাই লিপির মা; আর সেদিন ফোনে এই মানুষটার সাথে কথা হয়েছিল। সঠিক জায়গায় এসেছে বুঝতে পেরে অনুর ঠোঁটের কোণে বিজয়ের হাসি ফুঁটলো। হাসিটা প্রশস্ত হলো লিপির মায়ের পরবর্তী কথা শুনে। তিনি বললেন, "তুমি কি অনু?" অনুর চোখে-মুখে পরিবর্তন দেখা গেল। বেশ খুশি হলো সে; তবুও ভুরু কুঁচকে বলল, "আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে, আন্টি?" সুনিশ্চিত হতেই লিপির মা'র মুখটা শুকিয়ে গেল। ভয়ার্ত চাহনিতে চারিদিকে চোখ বুলালো একবার, এরপর আকস্মিক অনুর হাত ধরে ভিতরে টেনে নিলো। এরপরই আনার হাতটা ছেড়ে দিলো। মামুনও সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকল। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মহিলার দিকে। অনু চারিদিকে একবার চোখ বুলালো। ঘরে তাঁরা তিনজনই আছে শুধু। লিপি কোথায় আছে কে জানে? চিন্তিত অনু উদগ্রীব হয়ে লিপির মায়ের দিকে তাকালো আবার। লিপির মা গম্ভীর গলায় বললেন, "লিপি এখানে এসে তোমার কথা অনেক বলেছিল। সেজন্য আমি দেখেই চিনতে পেরেছি।" অনু আপ্লুত হলো এই ভেবে যে, লিপি এখানে এসে তাকে ভুলে যায়নি। তবে খানিক অভিমানে আচ্ছন্ন হয়ে আবার মুখ ম্লান করে দাঁড়িয়ে রইল। লিপির মা কিছুটা সময় নীরব থেকে শুকনো গলায় জানতে চাইলেন, "তুমি কেন এসেছ এখানে?" অনু কোনো ভনিতা না করে স্পষ্ট সুরে বলল, "লিপির সাথে কথা বলতে।" "লিপি এখানে নেই। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।" অনু বিষণ্ণ গলায় বলল, "সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে?" লিপির মা আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, "হ্যাঁ। আমি মিথ্যা বলছি না, মা।" "কিন্তু আন্টি, ওর সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন।" লিপির মা এবার অনুর হাত জড়িয়ে ধরলেন। কান্নাজড়িত গলায় বললেন, "আমার মেয়ের সংসারটা ভেঙো না, মা।" অনুর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো। দুর্বল ভঙ্গিতে তাকালো মামুনের দিকে। মামুন একটু নড়েচড়ে শক্ত মুখে বলল, "আন্টি, আপনি একটু বুঝার চেষ্টা করুন। লিপির সাথে খুব অন্যায় হয়েছে। বাড়িওয়ালাকে যদি শাস্তি না দেওয়া হয়, তাহলে এইরকম ঘটনা সে ঘটাতেই থাকবে।" লিপির মা অনুর হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বলতে লাগলেন, "আমি এতসব কিছু বুঝি না; আর বুঝতেও চাই না। লিপির বিয়ে হয়ে গেছে। আর এইসব ঘটনা ওর শ্বশুর বাড়ির কেউ জানে না। এই নিয়ে এখন পুলিশী ঝামেলা হলে ওরা জেনে যাবে। তারপর আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিবে। সারাটাজীবন এর ফল ভুগতে হবে আমার মেয়েকে। আমি এইসব সহ্য করতে পারব না।" অনু বলল, "প্রতিবাদ না করে এভাবে আপনার মেয়ে সুখে থাকবে না। সারাজীবন ওর বিবেক ওকে ক্ষত-বিক্ষত করবে। ওকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাবে।" "সে আমরা বুঝব। আমাদের আত্মমর্যাদা আছে। এইসব জানাজানি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।" লিপির মায়ের গলাটা একটু কঠিন হলো। অনু বলল, "আন্টি, আত্মমর্যাদা শুধু আপনাদেরই আছে, লিপির কি নেই?" "মানে?" লিপির মা সচকিত হলেন। অনু বলল, "লিপি মন থেকে চায় বাড়িওয়ালার কঠিন শাস্তি হোক। যে অত্যাচার, যে অপমান ওকে করা হয়েছিল, তাঁর বিচার চায় ও। কিন্তু আপনাদের কথা ভেবে সাহস করে এগোতে পারছে না। কিন্তু ওরও একটা হৃদয় আছে। সেই হৃদয়ে ক্ষত তৈরি হয়েছে। এই ক্ষত সাড়বে সঠিক বিচার পেলে। কিন্তু তা তো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়ত ও নিজের কাছে নিজে ছোট হচ্ছে। মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। মাথা উঁচু করে চলার সৎ সাহস এখন নেই ওর মাঝে। কারণ ও অনেক বড় একটা অন্যায়ের স্বীকার হয়েও চুপচাপ আছে। ওটা ওর আত্মমর্যাদায় খুব আঘাত করেছে।" "তোমার কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না। আমরা গরীব মানুষ। জানাজানি হলে সব শেষ।" অনু মুখ শক্ত করে বলল, "আত্মমর্যাদা মাটিচাপা দিয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকার চেয়ে স্বসম্মানে একদিন বাঁচা অনেক গৌরবের।" "যে গৌরব সারাজীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, সেই গৌরবের প্রয়োজন নেই। আগে যা হওয়ার হয়েছে। আমার মেয়ের ভাগ্যে যা লেখা ছিল, তাই হয়েছে, এবং আমরা সব সহ্য করেছি৷ এখন আমরা ভালো আছি। এরপর কিছু হলে সবাইকে গলায় দড়ি দিতে হবে।" "কিন্তু।" অনুকে থামিয়ে দিয়ে লিপির মা বললেন, "আর কোনো কথা নয়। তোমরা অনেকদূর থেকে এসেছ। হাত-মুখ ধুঁয়ে বসো, আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি। খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে যাও। আর এখানে এসো না।" অনু মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, "অন্তত লিপির শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা দিন।" লিপির মা গর্জে উঠলেন, "অসম্ভব।" অনু চমকিত হলো। মামুনের দিকে তাকালো। মামুন চুপচাপ দু'জনের কথপোকথন শুনছিল এতক্ষণ। অনুকে তাকাতে দেখে সে ইশারায় বলল, শান্ত হতে। অনু আর কথা বাড়ালো না। হতাশ হয়ে বিছানার উপর বসে পড়ল। লিপির মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, "বাইরে কলঘর। হাত-মুখ ধুয়ে বসো, ক্লান্ত দূর হবে। আমি পাকঘরে যাচ্ছি।" লিপির মা চলে যেতেই মামুন অনুর পাশে বসে ব্যস্ত গলায় বলল, "আপনি এখনই হাল ছেড়ে দিবেন না। এখনো সময় আছে অনেকটা। লিপির সাথে আমরা দেখা করেই যাবো।" অনু দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো।

ওদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মামুনের কথা শুনলেন লিপির মা। তাঁর কপালে ভাজ পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে পাকঘর নয়, প্রতিবেশীদের বাড়িতে গেলেন।

৬৭. অনু আর মামুন যখন লিপিদের বাড়ির থেকে বেরুলো, তখন বেলা চারটা। গত চার ঘণ্টা নিঃস্বার্থভাবে আপ্যায়ন করেছেন লিপির মা। মানুষটা বড় ভালো; হয়তো হাত-পা বাঁধা, না হলে কিছু একটা করতেন তিনি। দুয়ার পর্যন্ত জন্য এগিয়ে এলেন। এসে লিপির কাঁধে হাত রেখে অপরাধীর মতো নত গলায় বললেন, "মাফ করো, মা। তোমাদের নিরাশ করা ছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। মেয়ের সাংসার বাঁচানো আমার কর্তব্য।" অনু মহিলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, "আপনি এভাবে বলবেন না, আন্টি। আপনার জায়গা থেকে আপনি ঠিক। এখন চলি।" "আবার এসো।" "চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।"

লিপিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নীরবে হাঁটতে লাগল অনু; পাশে মামুন। মামুন বারবার আড়চোখে অনুর দিকে তাকাচ্ছে। অনেক ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। উদাসীন ভাবে হাঁটছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। মামুন অস্ফুটস্বরে বলল, "লিপির বিয়েটা যে সত্যি, তা বুঝতে পেরেছি। আমরা আচমকা এসেছি; লিপি কোনো কাজে বাইরে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে ফিরে আসতো নিশ্চয়ই।" অনু জবাব দিলো না। চাদরটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিলো। সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। জ্বালাময়ী আলোটা ফেকাসে হচ্ছে ধীর গতিতে। শীতলতা বাড়ছে। মামুন আবার বলল, "লিপির শ্বশুর বাড়ির খোঁজ করলে হয় না?" অনু মাথা তুলে মামুনের দিকে তাকিয়ে বলল, "খোঁজ পাওয়া যাবে না। লিপির মা নিশ্চয়ই প্রতিবেশীদের সতর্ক করেছেন।" মামুন কপাল ভাজ করে ভেবে বলল, "ওই মাঝিকে নিশ্চয়ই সতর্ক করেননি?" অনু চমকিত হলো মামুনের কথা শুনে। আশ্চর্য! মাঝির কথা তাঁর মনেই ছিল না। যে মাঝি লিপির বাড়ির সবাইকে চিনে, সে নিশ্চয়ই লিপির শ্বশুর বাড়িও চিনবে। অনুর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন হলো মুহূর্তেই। চোখ-মুখ সতেজ হয়ে ঝলমলিয়ে উঠল। অতি দৃঢ় গলায় বলল, "চলুন।" পায়ের গতি বাড়ালো অনু আর মামুন। কিন্তু হঠাৎ কানে ভেসে এলো পরিচিত এক কণ্ঠস্বর। কেউ 'অনু আলা' বলে জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে। চমকিত অনু হাঁটা থামিয়ে পিছনে তাকালো হঠাৎ। সহসা দেখল, কিছুটা দূরে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দাঁড়াতে দেখেই মেয়েটা দৌড়াতে লাগল। অনুর সারা শরীর জুরে শিহরণ বয়ে গেল। কঠোর পরিশ্রমের পর একজন শ্রমিক পারিশ্রমিক পেলে যেমন আনন্দিত হয়, যেমন উৎফুল্ল হয়, অনুর-ও এখন তেমন আনন্দ হচ্ছে, খুশিতে ভরে উঠেছে সারা মুখ। চোখ বড় বড় করে দেখছে, লিপিকে। মেয়েটার পরণে লাল শাড়ি। শাড়ির আঁচল শরীরে জড়িয়ে একহাতে ধরে রেখেছ। গলার একটা গয়না। ও এইসব নিয়েও ছুটে আসছে। আর পিছনের ছেলেটা আগের মতোই তাকিয়ে আছে। বোধহয় তাজ্জব বনে গেছে ছেলেটা! লিপি সামনে এসে দাঁড়ালো। হাঁপাচ্ছে সে। ঠোঁটের কোণে উচ্ছ্বাসের হাসি ফুটিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর সহসা অনুকে ঝাপটে ধরে কাঁপা গলায় বলতে লাগল, "আপনি কখন এসেছেন, আপা? আমাকে বলেননি কেন আপনি আসবেন? আর একটু দেরি হলেই তো আপনাকে হারিয়ে ফেলতাম।" অনু স্বস্তি পেল; তবে উত্তেজনা কমেনি। একটা সময় মনে হয়েছিল, লিপির সাথে আর দেখা হবে না। অথচ এমন আশ্চর্যজনক একটা ঘটনা ঘটল। ভাগ্যিস বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, না হলে তো দেখাই হতো না। নিজেকে সামলে নিয়ে অনু লিপির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "আমি তো একসময় ভেবেছিলাম এতদূর এসেও তোমার দেখা পাবো না।" অনুকে ছেড়ে দিয়ে সামনে দাঁড়ালো লিপি। তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝড়ে ঝর্নার মতো করে গাল বেয়ে পড়ছে। অনুকে নিজের গ্রামের বাড়িতে দেখে আনন্দে আত্মহারা সে। লিপি হাত দিয়ে চোখ মুছল, গাল মুছল; বলল, "আমাদের আগামীকাল আসার কথা ছিল। কিন্তু আমার মনটা আজ সকাল থেকে খচখচ করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, বাড়ি যাওয়া দরকার। সেজন্য বায়না ধরতেই ও নিয়ে এলো।" "ও কে?" অনু বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল। লিপির লাজুক হাসি দিলো। মাথায় নুইয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। অনু হাস্যোজ্জ্বল ভাবে ভুরু কুঁচকে একবার মামুনের দিকে তাকালো, একবার তাকালো লিপির দিকে। লিপির চিবুকে হাত রেখে আহ্লাদ গলায় বলল, "ওমা! লজ্জা পেলে নাকি?" লিপির চিবুক বুকের উপর। সে মাথা নুইয়েই পিছনের দিকে হাত ইশারা করে কোমল সুরে বলল, "আমার স্বামী; ওই যে দাঁড়িয়ে আছে।" অনু লিপির হাত অনুসরণ করে নির্দিষ্ট জায়গায় তাকিয়ে দেখল, ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। পরণে একটা পাঞ্চাবি। হাতভাব দেখেই মনে হচ্ছে নতুন বর। ছেলেটাকে হাতের ইশারায় ডাকল অনু। বয়স বেশি না। শুভ্র'র মতো। লম্বাচওড়া দেহের গড়। গায়ের রং শ্যাম বর্ণের। ছেলেটা এগিয়ে আসতেই লিপি মিনমিন করে বলল, "ওর নাম মাহবুব। ওর সাথেই আমার বিয়ে হইছে।" অনু ভালো করে লক্ষ্য করল ছেলেটাকে। ছেলেটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলেও ঠোঁটের কোণে উজ্জলরা ফুটে উঠেছে। যেন তাঁদের উপস্থিতিতে খুশিই হয়েছে। দু'জনকে পাশাপাশি দেখে অনু ঠাট্টার ছলে বলল, "অল্প বয়সে বিয়ে, সংসারটা তো হবে টুনা-টুনির সংসার।" মাহবুব হাসল আড়চোখে লিপির দিকে তাকিয়ে। আর লিপি লজ্জায় রক্তলাল হতে লাগল; অনুর হাত চেপে ধরল শক্ত করে। অনু এবার মামুনের দিকে তাকিয়ে বলল, "দেখুন দেখুন, আমাদের লিপিকে শাড়ি পরে কেমন গিন্নীর মতো দেখাচ্ছে। খুব সংসারী বধূর মতো দেখতে লাগছে।" মামুন মৃদু আওয়াজে হাসল। লিপি লজ্জা লাল হয়ে আবার অনুকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলল, "আপা, আপনি ইচ্ছে করে আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন।" অনু স্বঃশব্দে হাসল। মাহবুব বলল, "আপনারা চলে যাচ্ছেন কেন? বাড়িতে আসুন।" অনু হাসি থামিয়ে বলল, "এতক্ষণ বাড়িতেই ছিলাম। দুপুরে এসেছিলাম এখানে।" পাশ থেকে লিপি বলল, "এখন আবার চলেন। আমি এসেছি, এখন যেতে দিবো না আপা।" অনু ইতস্ততভাবে বলল, "তুমি কি অনুমান করতে পারছ আমি এখানে কেন এসেছি?" লিপির মুখটা অনুজ্জ্বল হলো না। মাথা ঝাঁকিয়ে কম আওয়াজে বলল, "পারছি।" "তবুও যেতে বলছ?" অনু অবাক হলো। লিপি দৃঢ় গলায় বলল, "হ্যাঁ। চলুন।" "কিন্তু?" কথা বলতে গিয়ে মাহবুবের দিকে চোখ পড়তেই অনুর গলা কেঁপে উঠল। থমকে যেতে বাধ্য হলো সে। লিপি অনুর হাত ধরে বলল, "আপনি আসুন আমার সাথে।" অগত্যা আর 'না' করতে পারল না অনু। এগোতে লাগল। লিপি একনজর পিছনে তাকিয়ে মামুনের উদ্দেশ্যে বলল, "ভাইজান আপনি কেমন আছেন?" মামুন ম্লান স্বরে বলল, "ভালো।" "আসুন।" মামুন অনুর পিছনে পিছনে হাঁটতে শুরু করেছে। তাঁর মাঝে কিছুটা সংকোচ কাজ করছে। ভয়ও হচ্ছে। আবার না গণ্ডগোল হয়।

লিপির মা সবাইকে একসাথে দেখেই আঁতকে উঠলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি অনুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অনু ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে লিপির উদ্দেশ্যে বলল, "উনারা ভিতরে যাক, তুমি আমার সাথে এসো।" সবাই ভিতরে গেলে লিপি আর অনু কিছুটা দূরে দাঁড়ালো। অনু বলল, "লিপি, তোমার মা'র সাথে আমি কথা বলেছি। কিন্তু উনি কিছুতেই চাচ্ছেন না বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে তুমি সাক্ষী দাও।" লিপি জবাব দিলো না। নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকল অনুর দিকে। অনু লিপির কাঁধে হাত রেখে বলল, "এভাবে নিজেকে গুটিয়ে রেখো না, লিপি। প্রতিবাদ করো। তোমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে, তাঁর বিচার দাবী করো।" লিপি ইতস্ততভাবে বলল, "কিন্তু অনু আপা।" লিপিকে থামিয়ে দিয়ে অনু বলল, "আমি জানি তুমি মন থেকে চাও বাড়িওয়ালার শাস্তি হোক। অতবড় একটা অপরাধী এত সহজে পার পেতে পারে না। ও তোমার সর্বনাশ করেছে। আমারও সর্বনাশ করার চেষ্টা করেছিল। আমরা যদি চুপচাপ থাকি, তাহলে ও আরও উৎসাহ পাবে।" লিপি অস্বস্তি বোধ করল। অনু আবার বলল, "এখন ও ছাড়া পেয়ে বাড়িতে আছে। এরপর আবার বাড়িতে কোনো মেয়েকে আনবে। সে হয়তো তোমার বয়সী হবে। ওই মেয়েটার সাথেও এইরকম কিছু করবে। প্রতিনিয়ত অত্যাচার করবে। একবার ভাবো লিপি, আমরা সব জেনেও যদি ওই মেয়েটাকে সাবধান না করি, তাহলে এই জীবনের মানে কী? নিজেদের বিবেকের মুখোমুখি হতে পারব আমরা? আমি তোমাকে জোরজবরদস্তি করছি না। শুধু বলব, তুমি নিজের মনের কথা শুনো। ওর যোগ্য শাস্তি ওকে পেতেই হবে।" "লিপি।" মাহবুব নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে ডাকল স্ত্রীকে। অনু হকচকিয়ে ওঠে পিছনে তাকিয়ে দেখল, উঠোনে মাহবুব দাঁড়িয়ে আছে। ভড়কে গেল অনু। ম্লানমুখে ক্রমান্বয়ে লিপি আর মামুনের দিকে তাকাতে লাগল। অনুর উদ্বিগ্নতা বুঝতে পেরে লিপি বলল, "ভয় পাবেন না, অনু আপা। ও সব জানে।" "সব?" লিপির কথা শুনে অনু হতভম্ব হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হলো। লিপি হাতের ইশারায় মাহবুবকে ডেকে বলল, "এদিকে এসো।" মাহবুব এগিয়ে আসতেই লিপি আবার বলতে লাগল, "মাহবুব আমাদের গ্রামেরই ছেলে। ও যে আমাকে পছন্দ করতো, সেটা আমি জানতাম না আগে। ক'দিন আগে ও নিজের বড় ভাইকে বলেছে এ-কথা। তারপর ওর বড় ভাই আমার বাবাকে বলেছে। বাজারে ওর একটা দোকান আছে। এইচএসসি পাস করেছে। তাই আমার বাবা আপত্তি করেনি। বাবা যখন আমাকে নিয়ে এলো গ্রামে, তখনই আমি জানতে পারলাম, ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হইছে। সবার থেকে ঢাকার পুরো ব্যাপারটা গোপন করা হইছে। আমার অমত ছিল এতে। মাহবুব এর মতো ভালো ছেলেকে ঠকাতে আমার মন সায় দিচ্ছিল না। আমার শরীরটা যে কলঙ্কিত। বিয়েতে আমার মত ছিল না। কিন্তু এটা প্রকাশ করার উপায় ছিল না। এরপর একদিনের ব্যবধানে বিয়েটা হয়েই গেল। খুব অপরাধবোধ কাজ করছিল আমার মধ্যে। কান্না পাচ্ছিল। বিয়ের দিন রাতে যখন আমরা একান্তে ছিলাম, আমি তখন সবটা খুলে বলি ওকে। ওর কিছুক্ষণ 'থ' মেরে বসে থাকে। আমি মুখ চেপে কাঁদছিলাম তখন। কারণ আমি ভেবেছিলাম, মাহবুব এক্ষুনি সবাইকে ডেকে সবটা জানিয়ে দিবে। এরপর আমার মা-বাবাকে অপমান করে আমাকে তাড়িয়ে দিবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আমার হাত ধরে আমাকে আশ্বস্ত করে। আমাকে সাহস দিলো। তখন আমি ভরসা পাই, স্বস্তি পাই, রুদ্ধ করা শ্বাস আবার স্বাভাবিক হয়।" একনাগাড়ে কথাগুলো বলে নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়ল লিপি। ফুঁপিয়ে উঠতে লাগল ও। অনু খেয়াল করল, মাহবুব লিপির হাত ধরেছে শক্ত করে। অন্য হাত লিপির কাঁধে রেখেছে। মুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটা দেখল অনু। মনেমনে বলল, এমনও মানুষ হয়! লিপি কিছুটা শান্ত হতেই মাহবুব বলল, "আসলে আপু, আমি ওকে এটাও বলেছিলাম, তুমি চুপচাপ না থেকে প্রতিবাদ করো। তখন ও আপনার কথা বলেছিল আমাকে। আমি আপনার ফোন নম্বরও চেয়েছিলাম ওর কাছে; কিন্তু ও দেয়নি। এমনকি ও নিজের মোবাইলও মায়ের কাছে রেখে গেছিল।" অনু হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মাহবুব এর উদ্দেশ্যে বলল, "তুমি কি চাও বাড়িওয়ালার শাস্তি হোক?" "অবশ্যই চাই। ওকে সামনে পেলে আমিই মেরে দিতাম।" মাহবুব ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠল সহসা। অনু চমকালো। সেই সাথে অভিভূত হলো মাহবুব এর কথা শুনে। লিপির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, "লিপি, তুমি ভালো একজন মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে। মাহবুব তোমার গৌরবের সঙ্গী।" লিপি সমর্থন করে বলল, "সত্যিই আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, আমার জীবনের এতকিছু কেড়ে নেওয়ার বিনিময়ে এইরকম একজনকে আমার সঙ্গী হিসেবে দিয়েছেন। ওর বিনিময়ে সেই হারানো সবকিছুই এখন তুচ্ছ লাগে আমার কাছে।" "একেবারে গিন্নীর মতো কথা।" অনু রসিকতার চেষ্টা করল। লিপি হাসল। হাতের কোণা দিয়ে চোখ মুছে বলল, "মাহবুব যদি আমার পাশে থাকে, তাহলে আমার কোনো ভয় নেই, অনু আপা।" পাশ থেকে মাহবুব বলল, "অবশ্যই আমি তোমার পাশে থাকবো। আমরা ঢাকা যাবো। এরপর ওই হারামির নামে মামলা করব।" অনু বলল, "তোমার বাড়ির কেউ কি অনুমতি দিবে?" "লিপি আমা স্ত্রী। ওর সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। লোকটা ওর জীবনে কালো দাগ লাগিয়েছে, সেটা হয়তো মুছতে পারব না; কিন্তু ওই লোকটাকে শাস্তি দিতে পারব। অন্তত লিপিকে এখনকার মতো আয়নার সামনে মাথা নত করে দাঁড়াতে হবে না আর। অতীত ভেবে কাঁদতে হবে না। গত ক'দিন ওর মধ্যে যে অস্বস্তি আমি দেখেছি, সেটা থেকে মুক্তি পাবে।" অনু আপ্লুত হলো। প্রসন্ন হাসি দিয়ে বলল, "যদি তোমার বাড়ির লোক সবকিছু জেনে আর লিপিকে গ্রহণ না করে?" মাহবুব মুখ শক্ত করে বলল, "আমি তো আছি। লিপিকে সুখী করার জন্য আমি সব করতে পারব। বাড়িতে জায়গা না হলে আমি অন্য জায়গায় যাবো। তবুও চুপচাপ থেকে অন্যায়কে সমর্থন করব না। অন্যায় সহ্য করা মানে তো অন্যায়কে সমর্থন করা, তাই না?" অনু মাহবুব এর কাঁধে হাত রেখে বলল, "তুমি অসাধারণ, ভাই। সামাজিক সম্মানের কথা না ভেবে তুমি যে এভাবে স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছ, এতে আমি খুশি হয়েছি। গভীর ভালোবাসা না থাকলে এটা সম্ভব না। লিপিকে তুমি মন থেকেই ভালোবেসেছিলে, এবং সেখানে কোনো ত্রুটি ছিল না। সেজন্য তোমরা এক হয়েছ।" মাহবুব প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলল, "লিপির মা আপনাকে ডাকছেন। আসুন।" মাহবুব এর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে অনু বলল, "তোমরা যাও, আমি আসছি।" মাহবুব আর লিপি চলে যাওয়ার পর অনু ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল। এরপর শান্তনুর নম্বর বের করে ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে লিখল, "শান্তনু, তুমি আসলে কোনো প্রেমিকই না। প্রেমিকরা সাহসী হয়। তোমার মতো ভীতু হয় না। যারা মন থেকে ভালোবাসে, তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য হলো ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়া। তাঁর জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া। তুমি আমার পাশে থেকেছ ঠিকই, কিন্তু আমাকে নিজের করতে পারোনি। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছ। একটা ভীতু প্রেমিক তুমি। তোমাকে এখন সামনে পেলে চিবিয়ে খেতাম। সেসময় তুমি একটু সাহস দেখাতে পারলেই আজ সুখী থাকতাম আমি। এই ঝামেলাময় জীবনের মুখদর্শন করতে হতো না। গাধা একটা!" ম্যাসেজটা লিখে সেন্ড অপশনে চাপ দিলো অনু। কিন্তু কাজ হলো না। সহসা তাঁর মনে পড়ল, ঘণ্টা খানিক আগে শুভ্রর সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে। লেখাটা ডিলিট করে হতাশ ভঙ্গিতে ঘরে ফিরে এলো অনু।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, এবং মেয়েজামাইয়ের উপর ভরসা করে সমাজের সবার কথা ভুলে গিয়ে লিপির মা-ও সম্মতি দিলেন লিপির ঢাকায় যাওয়াতে। লিপির বাবা এখন বাড়িতে না থাকলেও লিপির মা আশ্বস্ত করেছেন, লিপির বাবাও অসম্মতি জানাবেন না। গ্রামের মানুষদের কটাক্ষের থেকেও মেয়ের আত্মমর্যাদা বড়। সেটা রক্ষা করতেই হবে। অবশ্য গ্রামের মানুষের জানার কথাও না, যদি তারা নিজেরা প্রচারণা না করেন। কারণ ঢাকার এইরকম খবরগুলো সচরাচর এই পর্যন্ত আসে না। তাছাড়া কোর্টে এইরকম অজস্র কেইস চলে। তেমন খুন-খারাবি কিংবা ভাইরাল ঘাটনা ছাড়া সব আড়ালই থাকে প্রায়। ঠিক হলো, পরদিন সকালে ট্রেনে করে অনুদের সাথে মাহবুব আর লিপি ঢাকা যাবে।

৩৬ পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক - https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/1037277720036280/

1
$
User's avatar
@Mdemon456 posted 4 years ago

Comments