জ্বীনবর_২
পর্বঃ ১২
মেহরাব আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে বলল, এভাবেই থেকো আমার সাথে। কখনো ছেড়ে যেও না বউ। তাহলে বড্ড একা হয়ে যাব।
আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, উহু। কখনোই যাবনা। এত্তগুলা ভালোবাসি তোমায়।
-- আমিও এত্তগুলা ভালোবাসি। অযু করে এসো একসাথে নামায পড়ব। এতদিন যেদিনটার অপেক্ষা করেছি, সেদিনটা এসে গেছে বউ।
আমি লজ্জামাখা মুখে আচ্ছা বলে অযু করে এলাম। একসাথে নামায পড়লাম, এটা এত সুন্দর অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবনা। নামায পড়া শেষে উনার পা ধরে সালাম করলাম, উনি মুচকি হেসে আরেকটা চুমু দিয়ে কোলে তুলেন আমায়। আমি উনার শার্ট আকড়ে ধরে বললাম,
-- কি করছেন কি! নামান আমায়। পড়ে যাব তো।
-- উহু পড়বেনা। কোলে করে ব্যালকুনিতে নিয়ে এসে দোলনায় বসালেন। আস্তে আস্তে দোল দিতে দিতে বললেন, বউ...
-- হুম।
-- তোমার জন্য একটা উপহার রেখেছিলাম বাসররাতে দিব বলে। সেদিন আর দিতে পারিনি, আজ দিব।
-- কি উপহার?
-- তুমি চোখ বুজে বসো। আমি রুম থেকে নিয়ে আসছি। না বলা অব্ধি তাকাবেনা। আমিও বাধ্য মেয়ের মত চোখ অফ করে বসে রইলাম। উনি এসে মাথার উপর কি যেন জড়িয়ে দিলেন। চোখ খুলে দেখলাম একটা টকটকে লাল শাড়ি, গলায় একটা হার পড়িয়ে দিলেন তাতে একটা অক্ষর ছিল ' M'
আমি অবাক হয়ে বললাম, এতকিছু?
-- সামান্য ই। এসো তোমায় মেহেদী পরিয়ে দেই।
-- পরাতে পারবেন?
-- বউয়ের জন্য এইটুকু পারব না? উনি মেহেদী পরিয়ে দিলেন আমি অবাকচোখে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা জ্বীন এত পাগলামী করতে পারে জানা ছিলনা। এরপর বলে শাড়িটা পরে এসো। শাড়ি জড়ালাম কিন্তু মেহেদীর জন্য কুচি করতে পারছিলামনা। উনি এসে ভাজে ভাজে কুচি করে দিলেন। আয়নার সামনে বসিয়ে চুলে খোপা করে দিলেন তাতে আবার ফুল গুজে দিলেন। চোখে কাজল পরিয়ে দিলেন। শাড়ির আচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা চড়িয়ে দিয়ে বললেন, এবার একদম বউ বউ লাগছে। আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ গুজলাম। জ্যোৎস্না ভরা চাদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-- দেখুন আজকের চাদটা কত সুন্দর।
-- আমার বউয়ের থেকে বেশী নয়। লজ্জামাখা চোখে উনার চোখের দিকে তাকালাম। সেখানে আমার জন্য হাজারো অনুভূতি আর ভালোবাসা দেখয়ে পেলাম। এই প্রথম বুঝতে পারলাম জ্বীনরা ক্ষতি করতে নয়, ভালোবাসতে জানে। মানুষের চেয়ে বেশী ভালোবাসা আর পবিত্রতা তাদের মনে আছে। এমন একটা জ্বীনবর পেয়ে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। মুখে বলেই ফেললাম, জ্বীনবর, প্রচন্ড ভালোবাসি তোমায়।
পরেরদিন গুলো আমার এত আনন্দে কেটে গেল, মনেই হল না দুঃখ নামক বস্তু আমার জীবনে আছে। এত ভালোবাসে জ্বীনবরটা আমায়! আমার চোখেমুখে সবচেয়ে সুখী বউয়ের ছাপ লেগে থাকে। সারাটাদিন খুনসুটি, একসাথে নামায পড়া, আমাকে রান্না শিখিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে ছোটছোট সারপ্রাইজ, ঘুরতে যাওয়া,রাত হলেই তার বুকে মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া সবমিলিয়ে জ্বীনবর আর আমার সংসার।এর মাঝে ফুপি একবার এসে দেখে গেলেন আমাকে। এত সুখী দেখে হয়ত চোখে-মুখে একটু হিংসে ভাব জেগে ছিল। সীমা খুশি হয়ে বলেছিল, " মুশু তুই সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী, ভাগ্য করে একটা হীরে পেয়েছিস। আগলে রাখিস, হারিয়ে যাতে না যায় তোর অবচেতনে।"
এর মধ্যে দাদীমা মারা যায় অদ্ভুতভাবে। কেউ যেন তাকে অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলেছে। আমরা দুইজন খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তাও ও অনেক শক্ত ছিল। আমাকে খুব আগলে আগলে রাখত, একা ছাড়ত না বেশিক্ষণের জন্য।
ভাবলাম, "অতি আপনজনকে এভাবে হারিয়ে, ওর মধ্যে ভয়টা ঝেকে বসেছে। তাই ও আমাকে নিয়েও ভয় পাচ্ছে। আমি ওকে যথেষ্ট বোঝার চেষ্টা করতাম।
সেদিন রাতে মেহরাব বাসায় ছিলনা, আমি রুমে বসে হাদিসের বই পড়ছিলাম। হঠাৎ নিচ থেকে ধুপধাপ শব্দ আসতে লাগল। ভয় পেয়ে গেলাম একটু, নিচে তো শাকি রা আর আন্টি আছেন। কি হল তাদের আবার?
বইটা রেখে নিচে আসলাম। আন্টির ঘরের সামনে আসতে দেখি দরজা হাট করে খোলা। আস্তে আস্তে রুমে ভিতরে ঢুকে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। একটা কালো লোমশ ভয়ানক প্রাণী আন্টির পেটে তার বড় বড় চোখ ঢুকিয়ে পেটের সব বের করে আনছে। আন্টি চিৎকার চিৎকার করতে চুপ হয়ে গেলেন, আমি এই অবস্থা দেখে জোরে চিৎকার করে উঠলাম।
প্রাণীটি শরীর না ঘুরিয়ে শুধু মাথাটা ঘুরিয়ে লাল লাল চোখে আমার দিকে তাকায়। তার সারা মুখে রক্তমাখা। মুচকি হেসে আমাকে ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লম্বা করে।
এসবদেখে আমি স্থির থাকতে পারলামনা দৌড়ে রুমে এসে দরজা লক করে ওয়াশরুমে চলে এলাম। চোখের সামনে পুরো ঘটনাটা যেন ভাসছে। আর সহ্য হলনা, বমি করে দিলাম। ফ্রেশ হওয়ার পর যেন শক্তি পাচ্ছিলামনা উঠে দাড়ানোর। তাও রুমে আসলাম এমনসময় দরজা জোরে জোরে ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। এতজোরে ধাক্কাচ্ছে মনে হচ্ছে ভেঙ্গে ই যাবে। জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।
কয়েকবার পড়ার পর দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেল। কিছুটা সাহস ভর করে দরজা খুলে দেখতে যাব, অল্প খুলতেই প্রাণীটির ভয়াবহ চিৎকার শুনলাম। সাথে সাথে আবার লক করে বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। মেহরাব যে কোথায়? আমার ভীষণ ভয় করছে। বাবা বলেছিলে কখনো বিপদে পড়লে সুরা তিলওয়াত করতে। মনে মনে যত সুরা পারি সব পড়লাম, আল্লাহকে ডাকছিলাম। তখনো কিন্তু দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়নি। হঠাৎ দরজার বাহিরে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনলাম। মনে হল খুলে দেখি, কিন্তু দ্বিতীয়বারের মত সাহসটা পেলামনা। প্রায় কিছুক্ষণ পর মেহরাবের গলা পেলাম,
-- মুশু দরজা খুলো।
তাড়াতাড়ি নেমে দরজা খুলতে যাব, তখন আরেকটা আওয়াজ এল,
-- বউ আমি না বলা অব্ধি দরজা খুলবেনা। থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম, আবার আওয়াজ, মুশু দরজা খুলো, ওটা নাহলে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার কন্ঠে নকল করে সে তোমাকে বাধা দিচ্ছে। মুশু বাচাও আমাকে।
-- বউ, ওর কথায় ভুলোনা। যতক্ষণ না ফজরের আযান পড়ছে, তুমি ঘর থেকে বের হবেনাম এটা তোমার স্বামীর আদেশ।
দরজা না খুলে জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদা দিয়ে লম্বা মোনাজাত ধরলাম। আমি বুঝে গেছি কে আসল আর কে নকল। বিয়ের পর থেকে মেহরাব আমাকে কখনোই মুশু বলে ডাকত না, এটাও আমি জানি ওর জীবন যত বিপন্ন হোক ও আমাকে ওকে বাচাতে বলবে না। অপেক্ষা শেষ হল, ফজরের আযান দিয়ে দিল। নামায শেষ করে দরজা খুলতে গেলাম। ভয় আর দুশ্চিন্তায় সারা রাত কেদেছি, আমার মেহরাবের কিছু হয়ে যায়নি তো।
দরজা খুলে দেখলাম, ও মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কপাল আর মুখে আচড়ের দাগ। নিশ্চয়ই ধস্তাধস্তিটা ওর সাথেই হয়েছিল। সেদিন রাতেও তবে এই প্রাণীটির সাথে মেহরাবের সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেক কষ্টে ও উঠিয়ে বিছানায় শোয়ালাম। প্রাথমিক চিকিৎসা দিলাম, আমার ভাবনা হতে লাগল এত কিছু হয়ে গেল শাকি বা বাকি মেয়েগুলোর কোনো সাড়াশব্দ পেলামনা কেন? তার মানে কি ওদেরকেও! আল্লাহ কে এ শত্রু যে আমাদের সুখের জীবনে অভিশাপ লাগাতে এসেছে। প্রায় কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরল। খুব কষ্ট পাচ্ছিল ও। আমি ওকে জড়িয়ে ধরল। ও আমাকে শান্ত্বনা দিতে লাগল এই বলে যে, আমার কিছু হয়নি বউ। কেদোনা।
-- কে ওই প্রাণীটি? এভাবে কেন আঘাত করছে আমাদেরকে?
-- বউ ভয় পেয়োনাহ। কিচ্ছু হবেনা, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে তোমাকে একা রেখে গিয়ে। আর কখনো তোমায় একা ছাড়বনা।
-- আমরা আর এখানে থাকবনা মেহরাব।
-- কোথায় যাবে?
-- আমার বাবার কাছে যাব।
-- এটা হয়না বউ।
-- কেন হয়না? আমি এত বুঝি বুঝতে চাইনা মেহরাব। আপনি আমার সাথে বাবার বাড়ীতে যাবেন। নতুবা আমি কিন্তু কিছু করে বসব।
মেহরাব অনেক পীড়াপীড়ি তে হ্যা বলতে বাধ্য হল। সব গুছিয়ে আমরা বিকেলের দিকে বের হলাম। গাড়িতে উঠে টলমল চোখে বাড়ীটাকে দেখতে লাগলাম। এই বাড়ীতে এতদিন সুখে সংসার করলাম, এই বাড়ীটাই ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সবার কথা খুব মনে পড়ছে। চোখের পানি মুছে নিলাম পড়ার আগেই। মেহরাব দেখলে কষ্ট পাবে, ওকে আমি কষ্টে রাখতে চাইনা।
অনেকদিন পর নিজের বাড়ীতে পা রাখলাম, যে বাড়ী থেকে একদিন রাতের আঁধারে পালিয়েছিলাম। আমি একটা জ্বীনকে বিয়ে করেছি বাবা জানলে জানিনা কি হবে! কিন্তু মেহরাবকে দেখলে বাবা মানতে বাধ্য, ও যে অনেক ভাল।
দরজা নক করতেই চাচ্চু দরজা খুলল। আমি সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরল, আমাকে দেখে খুব খুশি হল চাচ্চু। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-- এতদিন কোথায় ছিলাম?
-- চাচ্চু আমি বিয়ে করে ফেলেছি। শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম।
-- বলিস কি! এত খুব খুশির সংবাদ। জামাই কই আমাদের?
-- আসছে, গাড়ি থেকে লাগেজ নামাচ্ছে।
-- আয় জামাই নিয়ে আগে ভেতরে আয়। তারপর বাকি কথা হবে।
-- তুমি যাও, আমি উনাকে নিয়ে আসছি।
মেহরাব লাগেজ নিয়ে চলে আসল একটু পর। আমি বাসা দেখিয়ে বললাম,
-- এটা তোমার শ্বশুড়বাড়ি। এসো ভেতরে এসো। বাবা একটু রাগী, তবে খুব ভাল। জ্বীন বিয়ে করেছি জানলে হয়ত একটু রাগ করবে। সমস্যা নেই চাচ্চু আছে। বাবাকে মানিয়ে নিতে পারবে। এসো ভেতরে এসো।
আমি ভেতরে ঢুকার পরো দেখলাম উনি বাহিরে দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করছে। ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত বোধ করছিল। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-- কি হয়েছে?
-- কিছু না তো। আমি হাত টেনে ভেতরে নিয়ে আসলাম। চাচ্চু ওকে দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-- তুই কাকে বিয়ে করেছিস?
.
(চলবে)
জ্বীনবর_২
পর্বঃ ১২
মেহরাব আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে বলল, এভাবেই থেকো আমার সাথে। কখনো ছেড়ে যেও না বউ। তাহলে বড্ড একা হয়ে যাব। আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, উহু। কখনোই যাবনা। এত্তগুলা ভালোবাসি তোমায়। -- আমিও এত্তগুলা ভালোবাসি। অযু করে এসো একসাথে নামায পড়ব। এতদিন যেদিনটার অপেক্ষা করেছি, সেদিনটা এসে গেছে বউ। আমি লজ্জামাখা মুখে আচ্ছা বলে অযু করে এলাম। একসাথে নামায পড়লাম, এটা এত সুন্দর অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবনা। নামায পড়া শেষে উনার পা ধরে সালাম করলাম, উনি মুচকি হেসে আরেকটা চুমু দিয়ে কোলে তুলেন আমায়। আমি উনার শার্ট আকড়ে ধরে বললাম, -- কি করছেন কি! নামান আমায়। পড়ে যাব তো। -- উহু পড়বেনা। কোলে করে ব্যালকুনিতে নিয়ে এসে দোলনায় বসালেন। আস্তে আস্তে দোল দিতে দিতে বললেন, বউ... -- হুম। -- তোমার জন্য একটা উপহার রেখেছিলাম বাসররাতে দিব বলে। সেদিন আর দিতে পারিনি, আজ দিব। -- কি উপহার? -- তুমি চোখ বুজে বসো। আমি রুম থেকে নিয়ে আসছি। না বলা অব্ধি তাকাবেনা। আমিও বাধ্য মেয়ের মত চোখ অফ করে বসে রইলাম। উনি এসে মাথার উপর কি যেন জড়িয়ে দিলেন। চোখ খুলে দেখলাম একটা টকটকে লাল শাড়ি, গলায় একটা হার পড়িয়ে দিলেন তাতে একটা অক্ষর ছিল ' M' আমি অবাক হয়ে বললাম, এতকিছু? -- সামান্য ই। এসো তোমায় মেহেদী পরিয়ে দেই। -- পরাতে পারবেন? -- বউয়ের জন্য এইটুকু পারব না? উনি মেহেদী পরিয়ে দিলেন আমি অবাকচোখে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা জ্বীন এত পাগলামী করতে পারে জানা ছিলনা। এরপর বলে শাড়িটা পরে এসো। শাড়ি জড়ালাম কিন্তু মেহেদীর জন্য কুচি করতে পারছিলামনা। উনি এসে ভাজে ভাজে কুচি করে দিলেন। আয়নার সামনে বসিয়ে চুলে খোপা করে দিলেন তাতে আবার ফুল গুজে দিলেন। চোখে কাজল পরিয়ে দিলেন। শাড়ির আচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা চড়িয়ে দিয়ে বললেন, এবার একদম বউ বউ লাগছে। আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ গুজলাম। জ্যোৎস্না ভরা চাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, -- দেখুন আজকের চাদটা কত সুন্দর। -- আমার বউয়ের থেকে বেশী নয়। লজ্জামাখা চোখে উনার চোখের দিকে তাকালাম। সেখানে আমার জন্য হাজারো অনুভূতি আর ভালোবাসা দেখয়ে পেলাম। এই প্রথম বুঝতে পারলাম জ্বীনরা ক্ষতি করতে নয়, ভালোবাসতে জানে। মানুষের চেয়ে বেশী ভালোবাসা আর পবিত্রতা তাদের মনে আছে। এমন একটা জ্বীনবর পেয়ে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। মুখে বলেই ফেললাম, জ্বীনবর, প্রচন্ড ভালোবাসি তোমায়। পরেরদিন গুলো আমার এত আনন্দে কেটে গেল, মনেই হল না দুঃখ নামক বস্তু আমার জীবনে আছে। এত ভালোবাসে জ্বীনবরটা আমায়! আমার চোখেমুখে সবচেয়ে সুখী বউয়ের ছাপ লেগে থাকে। সারাটাদিন খুনসুটি, একসাথে নামায পড়া, আমাকে রান্না শিখিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে ছোটছোট সারপ্রাইজ, ঘুরতে যাওয়া,রাত হলেই তার বুকে মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া সবমিলিয়ে জ্বীনবর আর আমার সংসার।এর মাঝে ফুপি একবার এসে দেখে গেলেন আমাকে। এত সুখী দেখে হয়ত চোখে-মুখে একটু হিংসে ভাব জেগে ছিল। সীমা খুশি হয়ে বলেছিল, " মুশু তুই সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী, ভাগ্য করে একটা হীরে পেয়েছিস। আগলে রাখিস, হারিয়ে যাতে না যায় তোর অবচেতনে।" এর মধ্যে দাদীমা মারা যায় অদ্ভুতভাবে। কেউ যেন তাকে অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলেছে। আমরা দুইজন খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তাও ও অনেক শক্ত ছিল। আমাকে খুব আগলে আগলে রাখত, একা ছাড়ত না বেশিক্ষণের জন্য। ভাবলাম, "অতি আপনজনকে এভাবে হারিয়ে, ওর মধ্যে ভয়টা ঝেকে বসেছে। তাই ও আমাকে নিয়েও ভয় পাচ্ছে। আমি ওকে যথেষ্ট বোঝার চেষ্টা করতাম। সেদিন রাতে মেহরাব বাসায় ছিলনা, আমি রুমে বসে হাদিসের বই পড়ছিলাম। হঠাৎ নিচ থেকে ধুপধাপ শব্দ আসতে লাগল। ভয় পেয়ে গেলাম একটু, নিচে তো শাকি রা আর আন্টি আছেন। কি হল তাদের আবার? বইটা রেখে নিচে আসলাম। আন্টির ঘরের সামনে আসতে দেখি দরজা হাট করে খোলা। আস্তে আস্তে রুমে ভিতরে ঢুকে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। একটা কালো লোমশ ভয়ানক প্রাণী আন্টির পেটে তার বড় বড় চোখ ঢুকিয়ে পেটের সব বের করে আনছে। আন্টি চিৎকার চিৎকার করতে চুপ হয়ে গেলেন, আমি এই অবস্থা দেখে জোরে চিৎকার করে উঠলাম। প্রাণীটি শরীর না ঘুরিয়ে শুধু মাথাটা ঘুরিয়ে লাল লাল চোখে আমার দিকে তাকায়। তার সারা মুখে রক্তমাখা। মুচকি হেসে আমাকে ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লম্বা করে। এসবদেখে আমি স্থির থাকতে পারলামনা দৌড়ে রুমে এসে দরজা লক করে ওয়াশরুমে চলে এলাম। চোখের সামনে পুরো ঘটনাটা যেন ভাসছে। আর সহ্য হলনা, বমি করে দিলাম। ফ্রেশ হওয়ার পর যেন শক্তি পাচ্ছিলামনা উঠে দাড়ানোর। তাও রুমে আসলাম এমনসময় দরজা জোরে জোরে ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। এতজোরে ধাক্কাচ্ছে মনে হচ্ছে ভেঙ্গে ই যাবে। জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।
কয়েকবার পড়ার পর দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেল। কিছুটা সাহস ভর করে দরজা খুলে দেখতে যাব, অল্প খুলতেই প্রাণীটির ভয়াবহ চিৎকার শুনলাম। সাথে সাথে আবার লক করে বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। মেহরাব যে কোথায়? আমার ভীষণ ভয় করছে। বাবা বলেছিলে কখনো বিপদে পড়লে সুরা তিলওয়াত করতে। মনে মনে যত সুরা পারি সব পড়লাম, আল্লাহকে ডাকছিলাম। তখনো কিন্তু দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়নি। হঠাৎ দরজার বাহিরে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনলাম। মনে হল খুলে দেখি, কিন্তু দ্বিতীয়বারের মত সাহসটা পেলামনা। প্রায় কিছুক্ষণ পর মেহরাবের গলা পেলাম, -- মুশু দরজা খুলো। তাড়াতাড়ি নেমে দরজা খুলতে যাব, তখন আরেকটা আওয়াজ এল, -- বউ আমি না বলা অব্ধি দরজা খুলবেনা। থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম, আবার আওয়াজ, মুশু দরজা খুলো, ওটা নাহলে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার কন্ঠে নকল করে সে তোমাকে বাধা দিচ্ছে। মুশু বাচাও আমাকে। -- বউ, ওর কথায় ভুলোনা। যতক্ষণ না ফজরের আযান পড়ছে, তুমি ঘর থেকে বের হবেনাম এটা তোমার স্বামীর আদেশ। দরজা না খুলে জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদা দিয়ে লম্বা মোনাজাত ধরলাম। আমি বুঝে গেছি কে আসল আর কে নকল। বিয়ের পর থেকে মেহরাব আমাকে কখনোই মুশু বলে ডাকত না, এটাও আমি জানি ওর জীবন যত বিপন্ন হোক ও আমাকে ওকে বাচাতে বলবে না। অপেক্ষা শেষ হল, ফজরের আযান দিয়ে দিল। নামায শেষ করে দরজা খুলতে গেলাম। ভয় আর দুশ্চিন্তায় সারা রাত কেদেছি, আমার মেহরাবের কিছু হয়ে যায়নি তো। দরজা খুলে দেখলাম, ও মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কপাল আর মুখে আচড়ের দাগ। নিশ্চয়ই ধস্তাধস্তিটা ওর সাথেই হয়েছিল। সেদিন রাতেও তবে এই প্রাণীটির সাথে মেহরাবের সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেক কষ্টে ও উঠিয়ে বিছানায় শোয়ালাম। প্রাথমিক চিকিৎসা দিলাম, আমার ভাবনা হতে লাগল এত কিছু হয়ে গেল শাকি বা বাকি মেয়েগুলোর কোনো সাড়াশব্দ পেলামনা কেন? তার মানে কি ওদেরকেও! আল্লাহ কে এ শত্রু যে আমাদের সুখের জীবনে অভিশাপ লাগাতে এসেছে। প্রায় কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরল। খুব কষ্ট পাচ্ছিল ও। আমি ওকে জড়িয়ে ধরল। ও আমাকে শান্ত্বনা দিতে লাগল এই বলে যে, আমার কিছু হয়নি বউ। কেদোনা। -- কে ওই প্রাণীটি? এভাবে কেন আঘাত করছে আমাদেরকে? -- বউ ভয় পেয়োনাহ। কিচ্ছু হবেনা, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে তোমাকে একা রেখে গিয়ে। আর কখনো তোমায় একা ছাড়বনা। -- আমরা আর এখানে থাকবনা মেহরাব। -- কোথায় যাবে? -- আমার বাবার কাছে যাব। -- এটা হয়না বউ। -- কেন হয়না? আমি এত বুঝি বুঝতে চাইনা মেহরাব। আপনি আমার সাথে বাবার বাড়ীতে যাবেন। নতুবা আমি কিন্তু কিছু করে বসব। মেহরাব অনেক পীড়াপীড়ি তে হ্যা বলতে বাধ্য হল। সব গুছিয়ে আমরা বিকেলের দিকে বের হলাম। গাড়িতে উঠে টলমল চোখে বাড়ীটাকে দেখতে লাগলাম। এই বাড়ীতে এতদিন সুখে সংসার করলাম, এই বাড়ীটাই ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সবার কথা খুব মনে পড়ছে। চোখের পানি মুছে নিলাম পড়ার আগেই। মেহরাব দেখলে কষ্ট পাবে, ওকে আমি কষ্টে রাখতে চাইনা।
অনেকদিন পর নিজের বাড়ীতে পা রাখলাম, যে বাড়ী থেকে একদিন রাতের আঁধারে পালিয়েছিলাম। আমি একটা জ্বীনকে বিয়ে করেছি বাবা জানলে জানিনা কি হবে! কিন্তু মেহরাবকে দেখলে বাবা মানতে বাধ্য, ও যে অনেক ভাল। দরজা নক করতেই চাচ্চু দরজা খুলল। আমি সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরল, আমাকে দেখে খুব খুশি হল চাচ্চু। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, -- এতদিন কোথায় ছিলাম? -- চাচ্চু আমি বিয়ে করে ফেলেছি। শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। -- বলিস কি! এত খুব খুশির সংবাদ। জামাই কই আমাদের? -- আসছে, গাড়ি থেকে লাগেজ নামাচ্ছে। -- আয় জামাই নিয়ে আগে ভেতরে আয়। তারপর বাকি কথা হবে। -- তুমি যাও, আমি উনাকে নিয়ে আসছি। মেহরাব লাগেজ নিয়ে চলে আসল একটু পর। আমি বাসা দেখিয়ে বললাম, -- এটা তোমার শ্বশুড়বাড়ি। এসো ভেতরে এসো। বাবা একটু রাগী, তবে খুব ভাল। জ্বীন বিয়ে করেছি জানলে হয়ত একটু রাগ করবে। সমস্যা নেই চাচ্চু আছে। বাবাকে মানিয়ে নিতে পারবে। এসো ভেতরে এসো। আমি ভেতরে ঢুকার পরো দেখলাম উনি বাহিরে দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করছে। ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত বোধ করছিল। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, -- কি হয়েছে? -- কিছু না তো। আমি হাত টেনে ভেতরে নিয়ে আসলাম। চাচ্চু ওকে দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, -- তুই কাকে বিয়ে করেছিস? . (চলবে)