গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_সেপ্টেম্বর_২০২০
গল্পঃ স্বাধীনতার জন্য
পর্বঃ০১
লেখকঃ দুর্জয় দাশ
চারিদিকে তখন প্রস্তুতি চলছিলো। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি। তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেও, কেউই যেন এটাকে যুদ্ধ বলতে চাইতেন না। গ্রামের কেউ কেউ বলতেন মুক্তিযুদ্ধ। অনেকে আবার বলতেন জনযুদ্ধ।
মাতৃভূমিকে, মাতৃভূমির সকল মানুষকে শাসনের নামে শোষণ, অধিকার বঞ্চনা, অত্যাচার ও দখলদারত্বের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সবাই সেদিন নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, ষাটের দশকেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হওয়া শুরু করেছিলো। ১৯৬০ সালের গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনই তার প্রমাণ।
স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্কুরিত বীজ ডালপালা গজিয়ে পূর্ণাঙ্গ বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছিল একাত্তরে। এই বটবৃক্ষটিকে লালন-পালন করে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে পরিণত করেছিলেন এক মহান ব্যক্তি। নাম তাঁর শেখ মুজিব। এই মানুষটিই বাঙালির অভিভাবক হয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের পথ দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
পূর্ব বাংলার একটি গ্রামের নাম পাহাড়পুর। তবে, পাহাড়ের বদলে কেবল সবুজে ঘেরা দিগন্ত বিস্তৃত কুঁড়ে ঘরগুলোই দেখা যেত এই গ্রামে। কৃষকের ঘরে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ না থাকলেও সবাই অনেক আনন্দেই থাকতেন। কিন্তু, আজ আর সেই আনন্দ নেই। আনন্দের বদলে দিগন্ত থেকে দিগন্তে কেবল হাতাশা আর বেদনার কালোমেঘ দেখা যাচ্ছিলো। সকলের মনজুড়ে ছিলো তীব্র শঙ্কা৷ চোখ জুড়ে ছিলো দুশ্চিন্তার কালো ছায়া।
পাহাড়পুর গ্রামের সবাই আজ তাদের গ্রামকে, দেশমাতাকে রক্ষা করার লড়াইয়ে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পাহাড়পুর গ্রামের যে লোকেরা দেশমাতাকে রক্ষা করার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, তাদেরই একজন ছিলেন জসীম। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন তিনি। ছোটভাই জলিল গত বছর কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছোটবেলা থেকেই বেশ চঞ্চল স্বভাবের ছিলেন জসীম। জসীম যে সময় ছোট ছিলেন, সে সময় গ্রামের কেউই পড়ালেখার প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। তাই হয়তো নিজের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ভাগ্যদেবতা উনার সহায় ছিলেন না। তাই আর পড়াশোনা করা হয়ে উঠেনি।
জসীমের বয়স যখন উনিশ, তখনই তাঁর বাবাও কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন থেকেই তাঁকে পরিবারের সকল দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নিতে হয়। পরিবার বলতে একমাত্র মা ছাড়া আর কেউই ছিলো না তাঁর।
১৯৭১ সাল, মার্চ মাসের ৭ তারিখ। গ্রামের হাট-বার ছিলো সেদিন। জসীম সেদিন অন্যান্য সকলের মতোই বাজার করার জন্য হাটের দিকে যাচ্ছিলেন। হাটের উত্তরদিকে ছিলো মতিন মিয়ার ছোটো একটা চায়ের দোকান। এই চায়ের দোকান থেকে তিনি যা রোজকার করেন, তা দিয়েই কোনো রকমে তাঁর সংসার চলে। এমন কোনো মানুষ গ্রামে নেই, যে মতিন মিয়াকে ভালোবাসে না। তবে এর যথেষ্ট কারণও আছে। মতিন মিয়া ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও কর্মপ্রিয় একজন মানুষ। ছয় ফুট উচ্চতার এই মানুষটি যেকোনো কাজই খুব অনায়াসে করতে পারতেন।
মতিন মিয়ার দোকানে গ্রামের সবারই নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। কারণ, মতিন মিয়ার রেডিওতে দেশের সকল খবরাখবর নেওয়া যেত নিয়মিত৷ পাশাপাশি গল্প-গুজবও করা যেত। সেদিন যখন বাজার করার জন্য জসীম হাটে গেলেন, দূর থেকে তার চোখ পড়লো মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে। তার কাছে সেদিন মনে হলো, মতিন মিয়ার দোকানে অন্যদিনের তুলনায় মানুষের জটলা তুলনামূলকভাবে বেশি। রেডিওতে কারোর কথা শুনা যাচ্ছিলো। জসীম যতই দোকানের কাছে যাচ্ছিলেন, সেই কথাগুলো আরোও স্পষ্ট হচ্ছিলাও তাঁর কাছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে, মুহূর্তেই তাঁর শরীর শিউরে উঠলো। তাঁর মনে হলো, শেষ আশাটুকু ফুরিয়ে যায়নি। কথাগুলো শুনে তাঁর চোখ জলে ভরে ওঠে। তিনি বুঝতে পারলেন, এবার সত্যিই আমাদের অধিকার আদায়ের সময় এসে গেছে। তিনি চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলেন দৃঢ় কণ্ঠের সেই ভাষণ, "এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।" কিছুক্ষণ পর সকলকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই তিনি বলে উঠলেন, আমাদের পারতেই হবে৷ তোমরা সবাই প্রস্তুত হও। আমরা লড়াই করবো, সংগ্রাম করবো। এই সংগ্রামের জন্য আমরা আমাদের অভিবাবককে পেয়ে গেছি। আজ থেকে আমাদের অভিবাবক শেখ মুজিবুর রহমান। তোমাদের মনে রাখতে হবে। এই সংগ্রাম আমাদের, সকল বাঙালির। এই সংগ্রাম শেখ মুজিবের।
উপস্থিত সবাই তখন বললেন, "হ্যাঁ, আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর কথা।" তিনি বলেছেন, "রক্ত যখন দিয়েছি, আরে দেব। দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।"
২০ শে মার্চ, ১৯৭১। এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেদিন। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যেও বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রাপ্য অধিকারের বিষয়টিই তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন অবশ্য গ্রামের হাট-বার ছিলো না। কিন্তু, তবুও সেদিন পাহাড়পুর গ্রামের সকলেই ভিড় জমায় মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে। মানুষ আলাদা হলেও তাঁদের সকলের উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হলো রেডিওতে প্রিয় মানুষটির দৃঢ কণ্ঠের সাহস যোগানো, স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা শুনা।
২৬ শে মার্চ, ভোর ছয়টা। গ্রামের রেডিও নামে পরিচিত হাসান সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের জাগিয়ে দিতে শুরু করলো। আঠারো বছর বয়সী এই কিশোরের তাতে কোনো কষ্টই যেন হচ্ছিলো না। বরং, তার মনে যেমন শঙ্কা ছিলো, তেমনি ছিলো প্রবল উৎকণ্ঠা। হাসানের আসল পরিচয় হলো, সে মতিন মিয়ার একমাত্র ছেলে। সবাই যখন একত্রিত হয়ে মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলো, তখন তিনি সকলের মনোযোগ নিয়ে গেলেন রেডিও'র খবরের দিকে। সবাই শুনলেন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরটা শুনে সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হৃদয়ের মধ্যে যেন এক চিন চিন ব্যথা হচ্ছে সকলের। সবাই বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো শুনলেন।
তিনি বললেন, "এটিই হয়তো তোমাদের উদ্দেশ্যে আমার শেষ ভাষণ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।" এরপর একদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো, অন্যদিকে বাঙালিদের উপর আক্রমণ করাও শুরু হলো।
মার্চ মাসের শেষের দিক। দা-বটি, কোড়াল, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে শুরু করে দিলো আশেপাশের অনেকেই। পাহাড়পুর গ্রামের লোকেরা রাত জেগে পালাক্রমে পাহাড়া দিতে থাকেন গ্রামের লোকজনকে। লক্ষ্য একটাই। পাক-বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের লোকজন সবাইকে রক্ষা করা।
এপ্রিল মাসের প্রথম শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে সবাই উপস্থিত হলেন মতিন মিয়ার দোকানে। দুপুর দুইটা বাজতেই রেডিওতে খবর পড়া শুরু হলো। সবাই অনেক শঙ্কা, আবেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে খবর শুনতে শুরু করলেন। ততক্ষণে সবার মধ্যে দুপুরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কেবল দু-একটা পাখির কিচিরমিচির ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিলো না। রেডিওতে সংবাদ পাঠক বলতে লাগলেন, "মিলিটারিদের আক্রমণের অঞ্চলসীমা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা শহর ছেড়ে বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। "
কথাটি শুনে সকলের চেহারায় দুশ্চিন্তার কালোছায়া দেখা দিলো।
কয়েকদিন পর শহর থেকে একদল লোক আসলো পাহাড়পুর গ্রামে। দশ-বারো জন লোকের মধ্যে চারজন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দু'জন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক। দেশের জন্য যুদ্ধ করার জন্য তাঁরা সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো, তাদের মধ্যে একজন হলো জমশেদ। গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সে। সে'ই মূলত সবাইকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো গ্রামের লোকজনকে সশস্ত্রভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানো এবং যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়। প্রশিক্ষণ শেষ করে গ্রামের কয়েকজন যুবক প্রশিক্ষণ প্রদানকারীদের সাথে শহরে চলে যান যুদ্ধ করার জন্য। বাকিদের সিদ্ধান্তে জসীমকে কমান্ডার বানিয়ে শুরু হয় যুদ্ধ। মতিন মিয়ার বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প বানানো হলো। আর চায়ের দোকানটাকে বানানো হলো খবর আদান-প্রদান করার মুখ্য জায়গা।
কিছুদিন পর গ্রামে মিলিটারিরা আক্রমণ চালায়। গ্রামের মাথায় জঙ্গলের ধারে তারা ঘাঁটি গাড়ে। প্রথম আক্রমণ জসীমের নেতৃত্বে থাকা মুক্তিবাহিনী বেশ ভালোভাবেই সামাল দেয়৷ কিন্তু, বিপত্তির সৃষ্টি হয় কয়েকদিন পর থেকে। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পাক বাহিনীর আক্রমণ আরও বাড়তে থাকে। এখন তাদের প্রতিহত করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সকল পরিকল্পনার তথ্য কিভাবে যেন পাকিস্তানিরা জেনে যাচ্ছে। দুদিন পর এর আসল কারণ সবাই জানতে পারলেন। তাঁদের সহযোদ্ধা কামাল রহমান মিলিটারিদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি গ্রামের সমস্ত পথ-ঘাটও লোক চক্ষুর আড়ালে গিয়ে হানাদারদের দেখিয়ে দিচ্ছেন। তিনি এতোদিন একজন মুক্তযোদ্ধা সেজে বসে ছিলেন। কিন্তু, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাক বাহিনীর গুপ্তচর, রাজাকার। কামাল রহমান তার সহযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। শেষবারের মতো কামাল রহমানকে ক্ষমা করে দিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অবশেষে কামাল রহমানের সহযোগিতায় এবারের মতো পাক বাহিনীকে প্রতিহত করা সম্ভব হলো।
গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_সেপ্টেম্বর_২০২০
গল্পঃ স্বাধীনতার জন্য পর্বঃ০১ লেখকঃ দুর্জয় দাশ
চারিদিকে তখন প্রস্তুতি চলছিলো। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি। তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেও, কেউই যেন এটাকে যুদ্ধ বলতে চাইতেন না। গ্রামের কেউ কেউ বলতেন মুক্তিযুদ্ধ। অনেকে আবার বলতেন জনযুদ্ধ।
মাতৃভূমিকে, মাতৃভূমির সকল মানুষকে শাসনের নামে শোষণ, অধিকার বঞ্চনা, অত্যাচার ও দখলদারত্বের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সবাই সেদিন নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, ষাটের দশকেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হওয়া শুরু করেছিলো। ১৯৬০ সালের গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনই তার প্রমাণ। স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্কুরিত বীজ ডালপালা গজিয়ে পূর্ণাঙ্গ বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছিল একাত্তরে। এই বটবৃক্ষটিকে লালন-পালন করে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে পরিণত করেছিলেন এক মহান ব্যক্তি। নাম তাঁর শেখ মুজিব। এই মানুষটিই বাঙালির অভিভাবক হয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের পথ দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
পূর্ব বাংলার একটি গ্রামের নাম পাহাড়পুর। তবে, পাহাড়ের বদলে কেবল সবুজে ঘেরা দিগন্ত বিস্তৃত কুঁড়ে ঘরগুলোই দেখা যেত এই গ্রামে। কৃষকের ঘরে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ না থাকলেও সবাই অনেক আনন্দেই থাকতেন। কিন্তু, আজ আর সেই আনন্দ নেই। আনন্দের বদলে দিগন্ত থেকে দিগন্তে কেবল হাতাশা আর বেদনার কালোমেঘ দেখা যাচ্ছিলো। সকলের মনজুড়ে ছিলো তীব্র শঙ্কা৷ চোখ জুড়ে ছিলো দুশ্চিন্তার কালো ছায়া।
পাহাড়পুর গ্রামের সবাই আজ তাদের গ্রামকে, দেশমাতাকে রক্ষা করার লড়াইয়ে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পাহাড়পুর গ্রামের যে লোকেরা দেশমাতাকে রক্ষা করার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, তাদেরই একজন ছিলেন জসীম। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন তিনি। ছোটভাই জলিল গত বছর কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছোটবেলা থেকেই বেশ চঞ্চল স্বভাবের ছিলেন জসীম। জসীম যে সময় ছোট ছিলেন, সে সময় গ্রামের কেউই পড়ালেখার প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। তাই হয়তো নিজের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ভাগ্যদেবতা উনার সহায় ছিলেন না। তাই আর পড়াশোনা করা হয়ে উঠেনি।
জসীমের বয়স যখন উনিশ, তখনই তাঁর বাবাও কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন থেকেই তাঁকে পরিবারের সকল দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নিতে হয়। পরিবার বলতে একমাত্র মা ছাড়া আর কেউই ছিলো না তাঁর।
১৯৭১ সাল, মার্চ মাসের ৭ তারিখ। গ্রামের হাট-বার ছিলো সেদিন। জসীম সেদিন অন্যান্য সকলের মতোই বাজার করার জন্য হাটের দিকে যাচ্ছিলেন। হাটের উত্তরদিকে ছিলো মতিন মিয়ার ছোটো একটা চায়ের দোকান। এই চায়ের দোকান থেকে তিনি যা রোজকার করেন, তা দিয়েই কোনো রকমে তাঁর সংসার চলে। এমন কোনো মানুষ গ্রামে নেই, যে মতিন মিয়াকে ভালোবাসে না। তবে এর যথেষ্ট কারণও আছে। মতিন মিয়া ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও কর্মপ্রিয় একজন মানুষ। ছয় ফুট উচ্চতার এই মানুষটি যেকোনো কাজই খুব অনায়াসে করতে পারতেন।
মতিন মিয়ার দোকানে গ্রামের সবারই নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। কারণ, মতিন মিয়ার রেডিওতে দেশের সকল খবরাখবর নেওয়া যেত নিয়মিত৷ পাশাপাশি গল্প-গুজবও করা যেত। সেদিন যখন বাজার করার জন্য জসীম হাটে গেলেন, দূর থেকে তার চোখ পড়লো মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে। তার কাছে সেদিন মনে হলো, মতিন মিয়ার দোকানে অন্যদিনের তুলনায় মানুষের জটলা তুলনামূলকভাবে বেশি। রেডিওতে কারোর কথা শুনা যাচ্ছিলো। জসীম যতই দোকানের কাছে যাচ্ছিলেন, সেই কথাগুলো আরোও স্পষ্ট হচ্ছিলাও তাঁর কাছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে, মুহূর্তেই তাঁর শরীর শিউরে উঠলো। তাঁর মনে হলো, শেষ আশাটুকু ফুরিয়ে যায়নি। কথাগুলো শুনে তাঁর চোখ জলে ভরে ওঠে। তিনি বুঝতে পারলেন, এবার সত্যিই আমাদের অধিকার আদায়ের সময় এসে গেছে। তিনি চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলেন দৃঢ় কণ্ঠের সেই ভাষণ, "এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।" কিছুক্ষণ পর সকলকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই তিনি বলে উঠলেন, আমাদের পারতেই হবে৷ তোমরা সবাই প্রস্তুত হও। আমরা লড়াই করবো, সংগ্রাম করবো। এই সংগ্রামের জন্য আমরা আমাদের অভিবাবককে পেয়ে গেছি। আজ থেকে আমাদের অভিবাবক শেখ মুজিবুর রহমান। তোমাদের মনে রাখতে হবে। এই সংগ্রাম আমাদের, সকল বাঙালির। এই সংগ্রাম শেখ মুজিবের।
উপস্থিত সবাই তখন বললেন, "হ্যাঁ, আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর কথা।" তিনি বলেছেন, "রক্ত যখন দিয়েছি, আরে দেব। দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।"
২০ শে মার্চ, ১৯৭১। এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেদিন। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যেও বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রাপ্য অধিকারের বিষয়টিই তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন অবশ্য গ্রামের হাট-বার ছিলো না। কিন্তু, তবুও সেদিন পাহাড়পুর গ্রামের সকলেই ভিড় জমায় মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে। মানুষ আলাদা হলেও তাঁদের সকলের উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হলো রেডিওতে প্রিয় মানুষটির দৃঢ কণ্ঠের সাহস যোগানো, স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা শুনা।
২৬ শে মার্চ, ভোর ছয়টা। গ্রামের রেডিও নামে পরিচিত হাসান সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের জাগিয়ে দিতে শুরু করলো। আঠারো বছর বয়সী এই কিশোরের তাতে কোনো কষ্টই যেন হচ্ছিলো না। বরং, তার মনে যেমন শঙ্কা ছিলো, তেমনি ছিলো প্রবল উৎকণ্ঠা। হাসানের আসল পরিচয় হলো, সে মতিন মিয়ার একমাত্র ছেলে। সবাই যখন একত্রিত হয়ে মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলো, তখন তিনি সকলের মনোযোগ নিয়ে গেলেন রেডিও'র খবরের দিকে। সবাই শুনলেন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরটা শুনে সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হৃদয়ের মধ্যে যেন এক চিন চিন ব্যথা হচ্ছে সকলের। সবাই বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো শুনলেন। তিনি বললেন, "এটিই হয়তো তোমাদের উদ্দেশ্যে আমার শেষ ভাষণ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।" এরপর একদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো, অন্যদিকে বাঙালিদের উপর আক্রমণ করাও শুরু হলো।
মার্চ মাসের শেষের দিক। দা-বটি, কোড়াল, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে শুরু করে দিলো আশেপাশের অনেকেই। পাহাড়পুর গ্রামের লোকেরা রাত জেগে পালাক্রমে পাহাড়া দিতে থাকেন গ্রামের লোকজনকে। লক্ষ্য একটাই। পাক-বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের লোকজন সবাইকে রক্ষা করা।
এপ্রিল মাসের প্রথম শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে সবাই উপস্থিত হলেন মতিন মিয়ার দোকানে। দুপুর দুইটা বাজতেই রেডিওতে খবর পড়া শুরু হলো। সবাই অনেক শঙ্কা, আবেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে খবর শুনতে শুরু করলেন। ততক্ষণে সবার মধ্যে দুপুরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কেবল দু-একটা পাখির কিচিরমিচির ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিলো না। রেডিওতে সংবাদ পাঠক বলতে লাগলেন, "মিলিটারিদের আক্রমণের অঞ্চলসীমা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা শহর ছেড়ে বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। " কথাটি শুনে সকলের চেহারায় দুশ্চিন্তার কালোছায়া দেখা দিলো।
কয়েকদিন পর শহর থেকে একদল লোক আসলো পাহাড়পুর গ্রামে। দশ-বারো জন লোকের মধ্যে চারজন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দু'জন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক। দেশের জন্য যুদ্ধ করার জন্য তাঁরা সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো, তাদের মধ্যে একজন হলো জমশেদ। গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সে। সে'ই মূলত সবাইকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো গ্রামের লোকজনকে সশস্ত্রভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানো এবং যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়। প্রশিক্ষণ শেষ করে গ্রামের কয়েকজন যুবক প্রশিক্ষণ প্রদানকারীদের সাথে শহরে চলে যান যুদ্ধ করার জন্য। বাকিদের সিদ্ধান্তে জসীমকে কমান্ডার বানিয়ে শুরু হয় যুদ্ধ। মতিন মিয়ার বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প বানানো হলো। আর চায়ের দোকানটাকে বানানো হলো খবর আদান-প্রদান করার মুখ্য জায়গা।
কিছুদিন পর গ্রামে মিলিটারিরা আক্রমণ চালায়। গ্রামের মাথায় জঙ্গলের ধারে তারা ঘাঁটি গাড়ে। প্রথম আক্রমণ জসীমের নেতৃত্বে থাকা মুক্তিবাহিনী বেশ ভালোভাবেই সামাল দেয়৷ কিন্তু, বিপত্তির সৃষ্টি হয় কয়েকদিন পর থেকে। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পাক বাহিনীর আক্রমণ আরও বাড়তে থাকে। এখন তাদের প্রতিহত করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সকল পরিকল্পনার তথ্য কিভাবে যেন পাকিস্তানিরা জেনে যাচ্ছে। দুদিন পর এর আসল কারণ সবাই জানতে পারলেন। তাঁদের সহযোদ্ধা কামাল রহমান মিলিটারিদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি গ্রামের সমস্ত পথ-ঘাটও লোক চক্ষুর আড়ালে গিয়ে হানাদারদের দেখিয়ে দিচ্ছেন। তিনি এতোদিন একজন মুক্তযোদ্ধা সেজে বসে ছিলেন। কিন্তু, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাক বাহিনীর গুপ্তচর, রাজাকার। কামাল রহমান তার সহযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। শেষবারের মতো কামাল রহমানকে ক্ষমা করে দিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অবশেষে কামাল রহমানের সহযোগিতায় এবারের মতো পাক বাহিনীকে প্রতিহত করা সম্ভব হলো।