ঐত্রী চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল "শুভঙ্কর আমার বাচ্চা চাই!" আমি তার টকটকে লাল চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দিলাম "তোমার প্র‍্যাগনেন্সীর সাত মাস চলছে!" ঐত্রী কিছুক্ষন আমার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে বাচ্চা মেয়ের মতো গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো! যেন আমার কথা সে কিঞ্চিত সংশয় নিয়ে বিশ্বাস করেছে। এমন অধিকাংশ সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি ঐত্রী জেগে বসে আছে। চোখগুলো প্রচন্ড লাল। তাকিয়ে থাকা যায় না ধরনের লাল। প্রথম দিকে ভয় পেতাম! দুশ্চিন্তা হতো! একগাদা প্রশ্ন করতাম তাকে উত্তর পেতাম না! আস্তে আস্তে বুঝলাম ওই বিশেষ সময়ে ঐত্রী প্রশ্ন আকারে করা কোন বাক্যের উত্তর দেয় না! আস্তে আস্তে আমার ভয় কাটলো থেকে গেলো দুশ্চিন্তা৷ সকাল সকাল ঐত্রীকে সুবোধ বাবুর কাছে নিয়ে আসলাম। পার্কস্ট্রিটের অ্যালেন পার্কের পাশে দোতলা এক অভিজাত বিল্ডিং এ সুবোধ সরকারের চেম্বার। ঐত্রীকে গত ছ'মাস ধরে তার কাউন্সেলিয়েই রাখা হয়েছে। ওর সমস্যা টা মূলত শুরু হয়েছে প্র‍্যাগনেন্সীর পর থেকে। কিছু অদ্ভুত অচরন প্রথমে আমি গুরুত্ব না দিলেও আস্তে আস্তে সব অস্বাভাবিক লাগা শুরু হল। "ঐত্রী দেবী, কেমন আছেন?" ঐত্রী সহজ গলায় সুবোধ বাবুকে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো , 'আপনাদের ধারনা আমি পাগল হয়ে গেছি?" সুবোধ বাবু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন সম্ভবত উত্তর খুঁজলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন 'আপনার কি কোনদিন মনে পড়বে মেঘালয়ে কাটানো আপনার শৈশব কেমন ছিলো?' কথোপকথনের এ পর্যায়ে আমি বের হয়ে গেলাম। আমি জানি ঐত্রীর উত্তর কি হবে! তার মনে নেই কিছু। গত ছয়মাসে সুবোধ বাবু এই প্রশ্ন কয়েকশ বার করেছে! ঐত্রীর ভুলে যাওয়া যেন আমাকে অথৈ সাগরে এনে ফেলেছে! বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডানহিলের প্যাকেটে থাকা শেষ সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে আমার মনে হল ঐত্রী সুবোধ বাবুর সামনে "আপনার ধারনা" বলে নি বলেছে "আপনাদের ধারনা!" ঐত্রীর ভেতরে কি আমার জন্য কোন ক্ষোভ জন্মেছে বা অভিমান? অথবা অন্য কোন নতুন অনুভূতি!

সন্ধ্যায় কফি মগ হাতে ছাদে বসেছি। ঐত্রী আজকে হালকা সোনালী রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। আমার ধারনা মাতৃত্বের সমানুপাতিক হারে দিন দিন তার রূপ বাড়ছে। সে রূপ আবার মাঝেমাঝে অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে যায়! আমি অবাক হয়ে ভাবি মানুষ এত সুন্দরও হয়! নিরবতা ভেঙে ঐত্রী জিজ্ঞেস করলো 'মেয়ে হলে নাম কি রাখবে?' 'জানলে কি করে মেয়ে হবে?' 'মেয়েই হবে!' 'মেঘদূত' ঐত্রী বাচ্চা মেয়ের মতো আহ্লাদী গলায় জিজ্ঞেস করলো 'মেঘদূত কেন?' 'ওর মা এক টুকরো মেঘ আর ও মেঘদূত!' বাক্য শেষ করার আগে ঐত্রী চোখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। এর পরের ঘটনা প্রেডিকটেবল। এবার সে মেঘ দেখবে। বেশ কিছুক্ষন মেঘ দেখবে। তারপর মন খারাপ করে ঘরে ফিরবে। বালিশে মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে যাবে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখবো টকটকে লাল চোখ নিয়ে জেগে বসে আছে! ঐত্রীর বর্তমান আমি ততটাই জানি যতটা ঐত্রী নিজেও জানে না। কিন্তু ওর অতীত? কার কাছে পাব আমি ওর অতীত? ইদানীং আমার ঐত্রীকে রেখে অফিসে যেতে ভয় লাগে। আমার একঘর ভর্তি রঙ তুলি পড়ে আছে সে ছুঁয়েও দেখে না আর। আলমারী ভরা আকাশী রঙের শাড়ি ভুল করেও ভাঁজ খোলে না আর। অথচ বছরখানেক আগেও ঐত্রী ছিলো ঝর্নার মতো চঞ্চল! মেঘের টুকরোর মতো হালকা শুদ্ধ আর পরিপূর্ণ!

এক সকালে অফিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। এমন সময় সুবোধ বাবুর ফোনকল। কিঞ্চিত অবাক হলাম। ভদ্রলোক সাধারনত জরুরী দরকার ছাড়া কল করে না। ফোন ধরে চিন্তিত গলায় বললেন 'আপনার স্ত্রীকে একবার দেখতে আসতে পারি? 'অবশ্যই! কিন্তু বিশেষ কিছু কি?' সুবোধ বাবু স্মিত হেসে বললেন 'আরে নাহ মশাই। উদ্দেশ্য রোগীর সাথে সখ্যতা বাড়ানো! আপনার স্ত্রী তো আবার আমাকে বিশেষ পছন্দ করেন না!' আমি ভদ্রতা করে বললাম 'তাহলে দুপুরে আমাদের সাথেই লাঞ্চ করুন তারপরে জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে' সুবোধ বাবু হেসে ফেললেও সবকিছু আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হল না। ওনার গলায় অস্বস্তি ছিলো। কিঞ্চিত তাড়াহুড়াও ছিলো যেন আরেকটু কথা বললেই আমি ধরে ফেলবো উনি কি ভাবছেন। এইসব অযাচিত ভাবনা আমার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিলো। সুবোধ বাবু আসবে শুনে বিরক্তিতে ঐত্রীর চোখমুখ কুচকে গেলো। আমি অফিস কামাই দিয়ে খাবার রেডি করলাম। তারপর বসে রইলাম চারটে নাগাদ! সুবোধ বাবু এলো না। আমার অপেক্ষা আর দুশ্চিন্তা দেখে ঐত্রী দুএকবার টিপ্পনী কাটলো। আমি ভেবে পেলাম না সুবোধ বাবু কেন আসছে না! সুবোধ বাবু আসলেন সন্ধ্যার পর। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ থাকলেও আচরনে বেশ শান্ত। যথাসম্ভব নিচু গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন 'ঐত্রী কোথায়?' আমি প্রথমবার সুবোধ বাবুর মুখে ঐত্রীকে নামধরে ডাকতে শুনলাম। উনি সাধারনত ঐত্রীকে ঐত্রী দেবী ডাকেন। 'ঐত্রী ঘুমোচ্ছে। ডেকে দিব?' সুবোধ বাবুর কপালে চিন্তার রেখা যেন আরেকটু স্পষ্ট হল। তিনি শান্ত গলায় বললেন 'নাহ। শুভঙ্কর বাবু, এখন যা বলব মন দিয়ে শুনবেন। ঐত্রী দেবীর ডেলিভারী ডেটের আগে পর্যন্ত আপনি আর অফিসে যাবেন না। রাতে ঘুমোবেন না। সেল্ফ হার্ম করার মতো কোন টুলস ঘরে রাখবেন না। কিচেনের ছুরি পর্যন্ত রাখা যাবে না' একদমে কথাগুলো বলে গেলো সুবোধ বাবু। আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম 'আপনি কি সাসপেক্ট করছেন?' সুবোধ বাবু উত্তর না দিয়ে উঠে গেলেন। দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হল না।

সেই যে ঘুমালো ঐত্রী আর খেতেও উঠলো না। আমি রাত আড়াইটার দিকে ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে বুঝলাম ঐত্রী উঠে বসেছে। তাহলে কি সে ঘুমোচ্ছিলো না? আমি চোখ খুললাম না। কিছুক্ষন পর ঐত্রী আবার শুয়ে পড়লো। আমি তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চোখের নিচে কালি। মসৃন ত্বক শুষ্ক হয়ে গেছে। ঠোঁটগুলো শুকনো। আমার তাও মনে হল ঐত্রীকে সুন্দর লাগছে। প্রচন্ড সুন্দর লাগছে। ছুঁতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলাম ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে! সেই রাতে ঐত্রীর গালে একবার ছুঁয়ে না দেওয়ার আক্ষেপ আমার সারাজীবন থেকে যাবে!

পরেরদিন রাতে আমার ঘুম ভাঙলো সাড়ে তিনটার দিকে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ঐত্রী পাশে নেই! খুঁজতে খুঁজতে ঐত্রীর ছবি আকার ঘরের দরজা ধাক্কা দিতেই চোখের সামনে যেই দৃশ্য দেখলাম তা দেখার জন্য আমি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। ঐত্রী প্রচন্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। পরনে মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া ট্রাইবের ট্র‍্যাডিশনাল পোষাক। এই পোষাকে আমি তাকে শেষবার দেখেছি চার বছর আগে যেদিন ও মেঘালয় ছেড়ে আমার সাথে কলকাতায় চলে এসেছিলো। আমার সামনে মালবেরী সিল্কের লাল হলুদ জামা পড়া আমারই অনাগত সন্তানের বার্তা জানিয়ে যন্ত্রনায় কাতরানো মেয়েটাকে আমার ভীষন অপরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও আমার কেউ না! ও যেন দূর মেঘালয়ের ছোট্ট একটা ট্রাইবের সতেরো বছর বয়সী কিশোরী!

ঐত্রীকে ওটিতে নেওয়া হল। ও বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে! ডাক্তার এসে এক ফাঁকে বলে গেলো 'এত দেরী কেন করলেন! ব্যাথা উঠেছে অনেকক্ষন!' কি আশ্চর্য! ঐত্রী কতক্ষন ধরে এমন ব্যথায় কাতরাচ্ছিলো! আমাকে ডাকেনি কেন? ঐত্রী কি চেয়েছিলো! দেরী হয়ে যাক? কম্পলিকেশন হোক? অপারেশন শুরু হবার আগে আমার ডাক পড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমার মাথায় সুবোধ বাবুর বলা একটা শব্দই ঘুরেছে 'সেল্ফ হার্ম!'

এনেস্থেশিয়া দেওয়ার আগে ঐত্রী আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে যেই লাইন বলল তাতে আমার মনে হল আমার হাত পা অবশ হয়ে গেছে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা রক্ত বয়ে গেল....

চলবে.....

মেঘদূত

পর্ব_১

~শাহরিন শৈলী

2
$
User's avatar
@Mdemon456 posted 3 years ago

Comments