রিভিউ উপন্যাস:যোগাযোগ লেখক:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মূলত গল্পের পরিস্থিতি অবিনাশ ঘোষালকে দিয়ে শুরু হলেও এর আড়ালে রয়েছে এক বিচিত্র পটভূমি যা পুরো উপন্যাসের চরিত্র, ঘটনা,পরিস্থিতি নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।সে পটভূমি রচিত হয়েছিল ঘোষাল আর চাটুজ্যেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে। ঘোষলদের অর্থবৈভব,প্রতিপত্তি মধ্যম ইতিহাসে এসে কোনো এক দেবতার পূজো নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে রক্তারক্তি পর্যায়ে চাটুজ্যেদের সাথে সন্ধি হলেও, ভঙ্গজ ব্রাক্ষণ দোষে দুষ্ট হয়ে ঘোষালদের মানহানি নামসর্বস্ব শূন্যে উঠে একেবারে নতুন করে উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল নুরনগর ছেড়ে রজবপুরে।

গল্পের পুরো পরিবেশ কুমুদিনী, বিপ্রদাস,মধুসূদন জুরে কেবল এ অন্তর্দ্বন্দ্বে বিস্তারই লাভ করেনি, বরং চরিত্রগুলোর বিশেষ উত্থান পতন নাচিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। কোনো এক বিশেষ ঘটনাকে কুমু দেবতার আশীর্বাদ ভেবে নতুন জীবনে আগত ব্যক্তিকে স্বাগত জানিয়ে পরিশেষে আফসোসের পরিসীমা নাকচ করতে গিয়ে ঠেকাতেও পারেনি। কুমুর এমন আশীর্বাদ অভিশাপ বোধগম্য হবার আসল কারণ কী অন্তর্দ্বন্দ্ব না কি পরিস্থিতির যোগসূত্র? তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্ব, মোহনীয় সৌন্দর্যের অধীষ্ঠিত কুমুদিনী দাদা বিপ্রদাসের আদর্শের এক বলিষ্ঠ উদাহরণ। এমন উদাহরণ মধুসূদন ঘোষালের জীবনে বিশেষ কিছু কি পরিবর্তন করতে পেরেছিল? পেরেছিল কি মধুসূদনের মতো সংকীর্ণমনা মানুষের অহম চুকাতে? না কি এ অহম শেষ পর্যন্ত মাতৃকুল ভক্ত কুমুদিনীর মাতৃসম্পর্কীয় সকল যোগাযোগ ছিন্ন করার মূল পন্থা!

মধুসূদন সংকীর্ণমনা অর্থদাম্ভিকতার অহমে মজে থাকলেও প্রিয়তম স্ত্রীর মন জয় করার এক প্রবল অভিব্যক্তি পোষণ করেন। কিন্তু জয় কী আদৌও করতে পেরেছিল? মধুসূদনের ব্যক্তি জীবনে শ্যামাসুন্দরীর বিশেষ আগমন কুমু আর মধুসূদনের মনের যোগাযোগ আরও বহুদূরে ঠেলে দেয়।

বিপ্রদাস বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব নিঃসন্দেহে লেখক সকল গুণে অতুলনীয় করে সাজিয়েছেন তাকে। অর্থের তাড়ানায় যথাসময়ে বোন কুমুদিনীর বিবাহ না দিতে পেরে দীর্ঘদিন কুমুকে নিজের সংস্পর্শে রেখে শিক্ষা দীক্ষায়, আচার-আচরনে অমায়িক করে তোলে। অবশেষে কুমুর বিবাহকে কেন্দ্র করে এক গোলযোগ সৃষ্টি হয়। বিপ্রদাসের মতো দূরদর্শী ব্যক্তি বিবাহের পরিস্থিতি নিয়ে বহু আশঙ্কিত অবস্থা চিত্তপটে চিত্রের ন্যায় গেঁথে যায়। বিপ্রদাসের এমন সংকেত কুমুদিনী নাকচ করতেও দ্বীধাবোধ করেনি।

লেখক নিজের শব্দ এবং বাক্যরচনা দ্বারা পরিস্থিতি এতোই অর্থবহ করে তোলেন যার ফলে চরিত্রগুলোর ছন্দপতনে, আসলে কে দায়ী তা যথাযথ নির্ণয় করা দুষ্কর বিষয় ! গল্পে মধুসূদনকে ভিলেনগোচের মনে হতে পারে যদিও লেখক এমন এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন পড়েই মনে হবে তার দোষ-ত্রুটি খুব হালকা টাইপের এবং হওয়াও খারাপ নয়। কিছু কিছু বিষয় মধুসূদনের ছ্যাচড়ামো মাত্রায়ও নিয়ে যায়। হাবলু তথা মোতিকে কেন্দ্র করে সমস্ত ঘটনা এর উদাহরণ। যায় হোক মূলত এ বিষয়টি ছাড়া বাকি বিষয়গুলোর মধ্যে মধুসূদনের অন্তরের বিশ্লেষণ ঘনঘন দেয়া হয়েছে। এরফলে পাঠকের মনেও হতে পারে এটা পরিস্থিতি ছাড়া আর কিছু নয়।

মধুসূদনের ঔদ্ধত আচরণ শ্যামাসুন্দরীর অহেতুক আগমন কুমুদিনীর মনের সন্ধি একেবারে দুর্বল করে তোলে। মাতুলালয় থেকে কুমুর সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকরণে লিপ্ত মধুসূদনের সাথে দাম্পত্যকলহের এক নতুন মোড় নিয়ে মাতৃগৃহে চিরতরে থাকার পরিকল্পনা করে। অবশেষে মধূসূদন প্রিয়তম স্ত্রীকে আনতে মনের অহম দূরে ঠেলে দেয়। কুমু কি ফিরে এসেছিল মধুসূদনের কাছে না কি বিপ্রদাসের কাছে চিরতরে রয়ে যায়? আর যদি বিপ্রদাসের কাছে থেকেও থাকে মধুসূদন কি এতো সহজে কুমু আর বিপ্রদাসকে নিস্তার দেবে? আর কী হয়েছিল যোগাযোগ হয় দাদার কাছে নয় স্বামীর কাছে?

মূলত যোগাযোগ দ্বারা যতটা না শারীরিক যোগাযোগ বোঝানো হয়েছে তারচেয়ে বেশি বোঝানো হয়েছে মনের যোগাযোগ। মধুসূদনের সারাজীবনের আক্ষেপ স্ত্রীর মনের সানিধ্যে পৌঁছানো। হিংসা মানুষের বুদ্ধিলোপ করতে সেকেন্ড সময় বোধহয় নেয় না। দাদার প্রতি কুমুর ভক্তি মধুসূদনকে এমনই করে তোলে। দাদার প্রতি সকল প্রতিকূলতা তৈরী করলেও মনের যোগাযোগ কুমু টিকিয়ে রেখেছে। এখানেই মধুসূদনের সকল বিদ্বেষ! চরিত্রগুলোর এমন অবস্থা লেখক তৈরী করেন না পারে চরিত্রগুলো থুথু গিলতে আর না ফেলতে। নবীন আর মোতির মা এ চরিত্রগুলো গল্পে না হলেই নয়। তুখোড় উপস্থাপনের রচিত এক উপন্যাস।

1
$
User's avatar
@Mdemon456 posted 4 years ago

Comments