বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। ২১ জেলায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ এখন পানিবন্দী। আগস্ট পর্যন্ত বন্যার পানি থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। ইতিমধ্যে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে বিপদ হয়ে হাজির হয়েছে রোগবালাই। সরকারি হিসাবেই গত তিন সপ্তাহে বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে ৮৬ জন মারা গেছে। এরই মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগে ৬ হাজার ৩৮০ জন আক্রান্ত হয়েছে।
দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগও বাড়ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা দুদিন আগে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উৎকণ্ঠা জানিয়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রসের এশিয়া কার্যালয় থেকে গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, বন্যায় বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৯৬ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, করোনার কারণে তিন মাস ধরে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে থাকা এসব মানুষ এখন দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়েছে। এতে গ্রামীণ জনপদে দারিদ্র্য আরও বেড়ে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে।
‘ডুবে থাকা ৯৬ লাখ মানুষের মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হচ্ছে’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ দেশে বন্যায় এরই মধ্যে ৫৫০ জন মারা গেছে। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে ডুবে আছে। বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে রেডক্রস।
তবে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসিন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি একটি স্বাভাবিক বন্যা। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা সব বন্যার্ত মানুষের পাশে আছি। নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় খাদ্যসহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। ফলে মানবিক বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা নেই।’
রেড ক্রিসেন্ট বাংলাদেশের দুর্যোগে সাড়াদান বিভাগের পরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনা আর বন্যা ছাড়াও দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের মানুষ ঘূর্ণিঝড় আম্পানেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরপর তিনটি দুর্যোগে তাদের মধ্যে খাদ্যের পাশাপাশি আশ্রয়ের সংকট দেখা দিতে পারে।
এদিকে জাতিসংঘ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসার সহায়তায় বাংলাদেশের বন্যায় আক্রান্ত এলাকাগুলোর ওপর একটি মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে আগামী সপ্তাহে বন্যা কত এলাকায় ছড়াবে এবং কত দিন থাকতে পারে, তার একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদন ধরে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল মনে করছে, বাংলাদেশের বন্যার পানি নামতে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এই বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক
গতকাল দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক হয়। দেশের বন্যা বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানেরা এতে উপস্থিত ছিলেন। বন্যা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উপস্থিত বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ বলেন, এই বন্যা বেশি এলাকাজুড়ে না হলেও স্থায়িত্বের দিক থেকে দীর্ঘ হবে বলে মনে হচ্ছে। তাই এই সময়ে পানিবন্দী মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও ত্রাণের ব্যবস্থাপনাকে আগে গুরুত্ব দিতে হবে।
বৈঠকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যা মোকাবিলায় আমরা অবকাঠামো নির্মাণের কথা বেশি চিন্তা না করে বাঁধগুলো যাতে টেকসই হয়, সেদিকে মনোযোগ দিতে পারি। কারণ, বন্যার্ত মানুষের বেশির ভাগই আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বেড়িবাঁধে অবস্থান করছে।’
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার মতোই বন্যার ক্ষেত্রেও সরকার শুরু থেকেই আমলাদের দিয়ে সংকীর্ণ পথে এগোচ্ছে। সরকারি সংস্থা ও দলীয় কর্মীদের দিয়ে বন্যা মোকাবিলার এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি উৎসাহিত হচ্ছে এবং অব্যবস্থাপনা বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ত্রাণ চুরি ও অনিয়মের যেসব খবর আমরা পাচ্ছি, তাতে দলীয় লোকদের সম্পৃক্ততার তথ্য বেরিয়ে আসছে। এভাবে চললে সামনের দিনের পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।’
হোসেন জিল্লুর আরও বলেন, ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ফলে এই বন্যাতেও সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত ৩০ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত ৮৬ জন বন্যায় মারা গেছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে জামালপুরে। এ জেলায় ২৩ জন বন্যার পানিতে ডুবে ও অন্যান্য কারণে মারা গেছে। সেখানে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে ২৮৯ জন। কুড়িগ্রাম জেলা অবশ্য আক্রান্তের দিক থেকে শীর্ষে (৬৫৬ জন); আর মারা গেছে ১৮ জন। এরপরই গাইবান্ধায় ৪৩৬ জন রোগে আক্রান্ত ও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোগের মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি, আর মৃত্যু হওয়া ৮৬ জনের মধ্যে ৭১ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে।
সোমবার পর্যন্ত পানি বাড়বে
দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের গ্রামগুলো একেকটি পানির মধ্যে জেগে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জেগে আছে। বন্যার্ত দুর্গম এলাকায় খাদ্যের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে চর এলাকার বেশির ভাগ ডুবে গেছে। এসব এলাকায় ত্রাণও কম পৌঁছাচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, আগামী সোমবার পর্যন্ত পানি বাড়তে পারে। তারপর ধীরে ধীরে কমতে পারে।
পূর্বাভাস কেন্দ্রের হিসাবে, আজ বৃহস্পতিবার তিস্তা অববাহিকার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ঢাকা জেলার ডেমরায় আজকের মধ্যে বন্যার পানি ঢুকে পড়বে।