জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ

1 4
Avatar for shafiulkayes
3 years ago

মো. মজনুর রশিদ


আজ (২৪ অক্টোবর) জাতিসংঘ দিবস। ১৯৪৫ সালের এই দিনে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংস স্তূপের বিপরীতে শান্তি ও নিরাপত্তার মূল বার্তা নিয়ে গঠিত হয় জাতিসংঘ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯২০ সালে গঠিত লীগ অব নেশনস মূলত ১৯৩৯ সালে বিশ্ব শান্তি রক্ষার্থে ব্যর্থ হয়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নামে পৃথিবী পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।

যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। এই যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ হতবাক হয়ে পড়েন এবং বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার নতুন ভাবনায় তৎকালীন বিশ্ব নেতাদেরকে ভাবিয়ে তোলে।

সে ভাবনা সৃষ্টি করে ধ্বংসের পাথরের উপর দাঁড়িয়ে পৃথিবীর বুকে শান্তি, নিরাপত্তা, সৌহার্দ, স্বাধীনতা ও প্রগতির অঙ্গীকার নিয়ে আজকের জাতিসংঘ। জাতিসংঘ গঠনের সময় জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র ছিলো ৫১টি। বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৯৩টি। স্বাধীন জাতিসমূহের সর্ববৃহৎ সংগঠন হলও জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জাতিসংঘের নামকরণের প্রস্তাব করেন। ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হয়। সেই থেকে প্রতি বছর বিশ্বের জাতি রাষ্ট্রসমূহ ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস পালন করে থাকে।

জাতিসংঘ প্রধান ৬টি অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং এর ১৬টি বিশেষায়িত সংস্থা রয়েছে। জাতিসংঘের অফিসিয়াল বা দাপ্তরিক ভাষা ৬টি। বর্তমানে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯৯ সালে বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

জাতিসংঘের প্রধান অঙ্গসংগঠনগুলো হলো-
১. সাধারণ পরিষদ
২. নিরাপত্তা পরিষদ
৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ
৪. অছি পরিষদ
৫. আন্তর্জাতিক আদালত
৬. সচিবালয়।

জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত সকল দেশ সাধারণ পরিষদের সদস্য। সাধারণ পরিষদে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একটি করে ভোটের ক্ষমতা রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্র ১৫টি। যার মধ্যে স্থায়ী সদস্য ৫টি রাষ্ট্র (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন)। এদের সাংবিধানিক অধিকার ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। ঠবঃড় অর্থ- ‘আমি মানি না’ এবং অস্থায়ী ১০টি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত নিরাপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘে কোনো প্রস্তাব পাশ বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থায়ী ৫ টি দেশ এবং অস্থায়ী ৪ দেশসহ মোট ৯টি দেশের সমর্থনের প্রয়োজন পড়ে। তবে স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের কেউ ভেটো দিলে সেই প্রস্তাব পাস বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। অছি পরিষদের- মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে নাউরু, নিউগিনি, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন, পালাউ, অছি পরিষদভুক্ত একমাত্র অঞ্চল আইসল্যান্ড।

১৯৯৪ সালের পর থেকে সংস্থাটি স্থগিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ অপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধের শাস্তি এই আদালতের মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হয়েছে। এই আদালতের বিচারের মাধ্যমে অনেক যুদ্ধ অপরাধীর বিচার শেষে ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে। জাতিসংঘ সচিবালয় হলো জাতিসংঘের সকল কর্মকাণ্ডের মূল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এর সদর দপ্তর অবস্থিত। ইউরোপীয় সচিবালয় অবস্থিত জেনেভায়। জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব ট্রিগভেলী, নরওয়ে এবং বর্তমান মহাসচিব হলেন আন্তোনিও গুতেরেস, পর্তুগাল। জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র দুইটি – ফিলিস্তিন এবং ভ্যাটিকান সিটি।

জাতিসংঘের অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য দেশে নিজেদের সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নানারকম সমস্যার সমাধান, সুবিধা বৃদ্ধি, উন্নত জীবনমান গঠন এবং নিরাপত্তা দানে এ প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে থাকে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ মানব কল্যাণমূলক কর্মসূচি- ডব্লিউএফপি (প্রধান কার্যালয়- রোম, ইতালি) এ বছর (২০২০ সাল) শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে। যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত, খরা, ও অনাহারে থাকা মানুষদের জন্য খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানের নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করে এই সংস্থাটি। এছাড়াও ইউএনএইচসিআর- ১৯৫৪ ও ১৯৮১ সালে, ইউনেস্কো- ১৯৬৫ সালে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী- ১৯৮৮ সালে, মহাসচিব কফি আনান (ঘানা) ও জাতিসংঘ ২০০১ সালে ও আপিসিসি- ২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে।

জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের একটা গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। ১৯৭৪ সালে ১৩৬তম রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ। যদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ প্রথম সদস্য পদ লাভ করে ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথ-এর। জাতিসংঘের মাধ্যমে মায়ানমারের সাথে বঙ্গোপসাগর বিজয় ছিল বাংলাদেশের বড় অর্জন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব থেকেই জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের সম্পর্ক তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের শক্তিশালী ভিত্তিমূল। মেহেরপুর জেলায় গঠিত স্বাধীন দেশের প্রথম সরকার মুজিবনগর সরকারের (শপথ গ্রহণ, ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল) প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতসহ আরও কিছু বন্ধু রাষ্ট্র।

২০ অক্টোবর ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পত্র লিখে বলেন, ‘আপনারা যদি বিশ্বাস করেন যে, আমার দফতর আপনাদের উপকারে আসবে তাহলে আমি আপনাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবো।থ এই যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভক্তি ঠেকানো অসম্ভব, এই দুর্ভাবনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের মস্ত শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে এবং ৪ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে। উভয় দেশ জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ এনে পত্র পাঠান। মহাসচিব ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিবেদন পেশ করেন। নিরাপত্তা পরিষদের ৯ সদস্য রাষ্ট্রের অনুরোধে ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে জরুরী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

সোভিয়েত রাশিয়া ও পোল্যান্ড দাবি জানায় যে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে তাদের দেশের বক্তব্য প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে। আমেরিকা ও চীন এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। ফলে প্রস্তাব ভোটে দেওয়া হয় এবং যেকোনো উপায়ে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১১ ভোট এবং ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত থাকে। রাশিয়া ও পোল্যান্ড বিপক্ষে ভোট দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রক্ষা পায়। মুক্তিকামী জাতির নিকট এমন পরম বন্ধু আর কে হতে পারে। জাতিসংঘের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের ˜ব্যর্থহীন সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক বিজয় অর্জন করা সম্ভবপর হয়। জাতিসংঘের তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে অবহিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের মধ্য দিয়ে ইয়াকফ মালিক ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। বর্তমান রাশিয়া বাংলাদেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। বন্ধুত্বের এমন বন্ধন চিরকালের। জাতিসংঘ সে বন্ধনের আতুর ঘর।

বিশ্ব শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে জাতিসংঘের ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি বহু নেতিবাচক ভূমিকাও রয়েছে। অধিকিন্তু জাতিসংঘ বর্তমানে অনেকটা পুতুল সংগঠনে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি দেশের ইচ্ছা আর অনিচ্ছার সংগঠনে পরিণত হয়েছে বিশ্ব সংগঠনটি। এছাড়াও বহু দেশের স্বাধীনতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা অত্যন্ত দুঃখজনক। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যার ইতিবাচক কোনো সমাধান আনতে জাতিসংঘ পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এছাড়াও, বহু বছর ধরে ফিলিস্তিনদের ওপর ইযরাইল রাষ্ট্রের নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, বাড়ি দখল, জমি দখল, গুম, অত্যাচার প্রভৃতি বন্ধে জাতিসংঘ পুরোপুরিই ব্যর্থ ও ক্ষমতা রাষ্ট্রের নিকট কুক্ষিগত।

মধ্য প্রাচ্যের অস্থিরতা এবং সংঘাত প্রশোমনে জাতি রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকা বিতর্কিত ও হিংসাক্তক। ইউক্রেন, সিরিয়া, মিশর, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কাশ্মীর, লাদাখ, ফকল্যান্ড দ্বীপ, লেবানন, উপজাতি ও সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সুরক্ষা, আর্মেনিয়া- আজারবাইজান সমস্যা, আফ্রিকার ক্ষুধা নিবারণ, জঙ্গি তৎপরতা, উগ্রবাদের উত্থান, মেক্সিকো, কিউবা, তিব্বত, পরিবেশ বিপর্যয়, কোরিয়া ও ইরান সমস্যা, পারমানবিক হুমকি, রাশিয়া- আমেরিকার মৌন সংঘাত প্রভৃতি বিষয় সমূহে জাতিসংঘের ভূমিকা অকার্যকর হিসেবে প্রমাণ মিলেছে বাস্তবে। এসব বিষয়ের যৌক্তিক সমাধান ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ক্ষেত্রসমূহে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশ্ববাসী প্রত্যাশা করে।

মো. মজনুর রশিদ
চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সম্পাদক, বাংলাদেশ স্কাউটস গোপালগঞ্জ জেলা রোভার।

সোর্সঃ https://thecampustoday.com/

2
$ 0.00
Avatar for shafiulkayes
3 years ago

Comments

good

$ 0.00
3 years ago