একাদশের অনলাইন ক্লাসে নেই মফস্বলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, সঙ্কট প্রযুক্তির

1 9
Avatar for shafiulkayes
3 years ago

করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের সব কলেজে গত ৪ অক্টোবর থেকে অনলাইনে একাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এতে মফস্বল এলাকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ একেবারের হাতেগোনা। নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপের হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘৪ অক্টোবর থেকে অনলাইনে একাদশের ক্লাস শুরু হলেও আমরা এখন পর্যন্ত ক্লাস করতে পারিনি। অথচ শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছে। এতে করে আমরা পিছিয়ে পড়ে যাচ্ছি।’

শুধু দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার কামরুল নয়, করোনাকালে মফস্বল এলাকার একাদশের অনলাইনে ক্লাসের চিত্রটি কমবেশি এমনই। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন না।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত মফস্বল এলাকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরিবাবে স্মার্টফোন নেই। এছাড়াও নিয়মিত বিদ্যুৎ না থাকায় একটা বড় অংশের অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার অনেক কলেজে এখনও অনলাই ক্লাস শুরু করতে পারেনি।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া একাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ না রেখে অনলাইনে চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাদের পক্ষে সম্ভব হবে, তারাই এ কার্যক্রমে অংশ নেবেন। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে এসব ক্লাসের লেকচারগুলো ইউটিউব বা ওয়েবসাইটে আপলোড করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিবছর জুলাই মাস থেকে কলেজগুলোতে একাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এ বছর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বদলে গেছে শিক্ষা ক্যালেন্ডার। তিন মাস দেরিতে হলেও গত ৩ অক্টোবর একাদশ শ্রেণিতে নতুন ভর্তি করা শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। অথচ মফস্বলের কলেজগুলো বা শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রস্তুতিই নেই। আবার মফস্বলের যেসব শিক্ষার্থী রাজধানীর কলেজগুলোতে ভর্তি হয়েছে, তাদেরও গ্রামে বসে অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ নেই।

এমনই একজন শিক্ষার্থী নোয়াখালী জেলার সূর্বনচরের রাকিব হোসেন। তিনি মিরপুর বাংলা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার থাকছেন নিজ এলাকায়। রাকিব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এলাকার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। কখনো কখনো ক্লাসে জয়েনই করতে পারি না। আবার ক্লাসে জয়েন করতে পারলেও সাউন্ড সিস্টেম ক্লিয়ার থাকে না। অনলাইন ক্লাস করতে খুব সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ রকম চলতে থাকলে শহরের শিক্ষার্থীদের থেকে আমরা পিছিয়ে যাবো।’

এদিকে শহরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইনে ক্লাস হলেও মফস্বলের কলেজেগুলোয় তেমনভাবে অনলাইন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে না। কিছু কিছু প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশন ফি আদায় করতে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানতে অনেকটা নামকাওয়াস্তে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে অনেকটা পিছিয়ে। মফস্বলের নেটওয়ার্ক কাঠামো খুব দুর্বল থাকায় পূর্বে রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পেইজে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস আপলোড দেওয়া হলেও তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায় না।

জানা যায়, অনলাইন ক্লাসে মফস্বলের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের স্মার্টফোন বা অনলাইন ক্লাসের জন্য অন্য কোনো ডিভাইস না থাকায় ক্লাস করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। যার ফলে প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হওয়ার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার ইন্টারনেটের উচ্চদাম ও গতি দুর্বল থাকায় অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া মফস্বলের শিক্ষকরাও তথ্য-প্রযুক্তিতে খুব একটা দক্ষ নয়। এমনকি অনেক শিক্ষকেরই স্মার্টফোনও নেই। যার ফলে মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমান অনলাইন ক্লাস অনেকটা নির্দেশনার মধ্যেই বন্দি হয়ে আছে।

যদিও বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) প্রধান পরিসংখ্যানবিদ আলমগীর হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘দেশের কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিতে সক্ষম বা কতজন শিক্ষার্থী স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করেন তার কোন পরিসংখ্যান তাদের হাতে নেই।’

নোয়াখালী জেলার দ্বীপ অঞ্চল হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী কামরুল বলেন, ‘আমাদের দ্বীপ অঞ্চলে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল, এর উপর বেশির শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন বা অনলাইনে ক্লাস করার মত ডিভাইস নেই। যার ফলে আমারা অনলাইন ক্লাসের সুফল পাচ্ছি না। আমি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বিনীতভাবে আবেদন করছি যেন আমরাও অনলাইন ক্লাস করতে পারি শহরের শিক্ষার্থীদের মতো, সেই ব্যবস্থা করে দিন।’

হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘আমাদের কলেজের প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফোন আছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই বাটন ফোন ব্যবহার করে। কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পরিবার নিম্নবৃত্ত। কলেজের মাসিক বেতনও ঠিকমতো তারা দিতে পারে না। ইন্টারনেট কেনার টাকা কোথায় পাবে? আমরা নিজেরাও অনলাইনে ক্লাস নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হই। নেটওয়ার্ক থাকে না। আর প্রশিক্ষন না থাকায় সকল শিক্ষক ও অনলাইনে ক্লাস নিতে পারে না। তারপরও যখন সরাসরি অনলাইনে ক্লাস নিই, তখন দুই থেকে তিন শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী থাকে না। তবে পরে আরো ১০ শতাংশ দেখে।’

এদিকে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই ছুটি আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মার্চ মাস থেকেই সংসদ টেলিভিশনে মাধ্যমিকের ক্লাস এবং এপ্রিল মাস থেকে প্রাথমিকের ক্লাস প্রচার করা হচ্ছে। মূলত মে মাস থেকেই শহরাঞ্চলের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস শুরু করে, কিন্তু শহরাঞ্চলের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও তাদের কেউ কেউ আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইন ক্লাস শুরু করে। ফলে এখনো বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাসের বাইরে রয়ে গেছে। অবশ্য টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রাথমিক-মাধ্যমিকের ক্লাস প্রচার করা হলেও সেগুলোতে শিক্ষার্থীদের খুব একটা আগ্রহ নেই।

ভোলার আলতাজের রাহমান ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মো. জাহানজেব আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরই স্মার্টফোন নেই। এছাড়াও নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে না। আর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পরিবার নিম্নবৃত্ত হওয়ায় তাদের সন্তাদের অনলাইন ক্লাসের ডিভাইস কিনে দিতে পারছে না। তারপরও আমরা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকে সুফল পাচ্ছে, আবার অনেকে পাচ্ছে না।’

এদিকে, শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকালের এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন বিরাট বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রাম-শহর ও ধনী-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বৈষম্য চরম আকারে বাড়ছে। শহরের শিক্ষার্থীরা টেলিভিশনের ক্লাস না দেখলেও অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছে। এমনকি পরীক্ষাও দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও স্কুল-কলেজের অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি ধনী পরিবারের সন্তানরা অনলাইন বা সরাসরি প্রাইভেট পড়ছে। এতে তারা পুরো সিলেবাসই শেষ করতে পারছে। অন্যদিকে গ্রামের ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এসব সুবিধার বাইরে রয়েছে। ফলে শিক্ষায় বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মু. জিয়াউল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কত ভাগ শিক্ষার্থীকে এই পাঠদান সুবিধা দিতে পারছি তার কোন ধারণা আমার জানা নেই। তবে করোনার প্রভাবে ঝিমিয়ে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা এই কার্যক্রম নিঃসন্দেহে কিছুটা হলেও গতিশীল করবে। আর যেহেতু এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি, তাই একাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ না রেখে অনলাইনে ক্লাস শুরুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যাদের পক্ষে সম্ভব হবে, তারাই অনলাইনের এই ক্লাস করবে। তবে আমি সব কলেজ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, তারা যেন ক্লাসগুলো ইউটিউব বা ওয়েবসাইটে আপলোড করে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনমতো সময়ে ক্লাসগুলো দেখতে পারে।’

2
$ 0.10
$ 0.10 from @himu
Avatar for shafiulkayes
3 years ago

Comments

good post

$ 0.00
3 years ago