টাইম ম্যাগাজিনের লেখক চেতন বাগত ধোনি সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘তিনি শুধু ভারতকে বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দেননি, ১২০ কোটি ভারতীয়কে শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে বিশ্বকে জয় করা যায়।’ কিন্তু এই ধোনিই একসময় রেলের টিকেট চেকার ছিলেন। এই পেজটিতে মহেন্দ্র সিং ধোনির জীবনের জানা-অজানা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
জন্ম ও পরিবার
ধোনির বাবার জন্মস্থান ভারতের উত্তরাঞ্চলের আলমোড়া জেলার তলসালম একটি অচেনা অখ্যাত গ্রাম। খুব ভালো চাষাবাদ না হওয়ায় অল্প লেখাপড়া জানা ধোনির বাবা একটি চাকরীর আশায় চলে যান উত্তর প্রদেশের লখনউয়ে। সেখানে কাজ না জোটায় তিনি চলে যান ঝাড়খণ্ডের বোকারো। কিন্তু এখানেও কোন কাজ জুটল না। তাই আবার একটা কাজের আশায় পাড়ি জমালেন ঝাড়খণ্ডেরই রাঁচিতে। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন স্টিল কোম্পানিতে। এরপর ১৯৮১ সালের ৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তার পিতার নাম পন সিং এবং মায়ের নাম দেবকী। ধোনিরা তিন ভাইবোন। ধোনির বড় এক ভাই ও বোন রয়েছে।
ধোনির ক্রিকেটার হয়ে ওঠা
স্কুলেই ধোনির ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়। রাঁচির স্টিল কোম্পানির স্কুলে পড়াশোনা করতেন ধোনি। প্রথমদিকে ফুটবলের প্রতি টান ছিল ধোনির। ইচ্ছা ছিল ভালো গোলকিপার হওয়ার। একসময় ব্যাডমিন্টন, হকি ও টেবিল টেনিসের প্রতি নেশা চেঁপে বসে। ধোনি যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন সেই স্কুলে একজন বাঙালি শিক্ষক ছিলেন। তিনি স্কুলের একটি ক্রিকেট টিম তৈরি করেন। কিন্তু তার দলের কোনো উইকেটকিপার ছিল না। তাই তিনি ধোনিকে উইকেট কিপার হিসেবে খেলার কথা বলেন। ধোনি তার কথায় রাজি হয়ে উইকেট কিপার হিসেবে যোগ দেন সেই ক্রিকেট টিমে। উইকেট কিপার হিসেবে যোগ দিলেও অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভালো ব্যটসম্যান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন ধোনি। এভাবেই স্কুল জীবনে ক্রিকেট খেলায় হাতেখড়ি হয় মহেন্দ্র সিং ধোনির।
ধোনির বয়স যখন ১৫ বছর তখন সুযোগ পান বিহার দলে। বয়সের কোঠা ১৯ এর ঘরে পৌঁছলে অভিষেক ঘটে ‘রনজি ট্রফিতে’। এরপর সুযোগ হয় ‘পূর্বাঞ্চল’ টিমে। ক্রিকেটের সফলতার পাশাপাশি পড়াশোনায়ও ভালো ছিলেন ধোনি। শিক্ষাজীবনে কখনো খারাপ ফলাফল করেননি। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর গসনা কলেজে ভর্তি হলেও পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। তবে ধোনি বিভিন্ন দেশের সাম্মানিক ডি-লিট পেয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন।
আগেই বলেছি ধোনি একসময় রেলের টিকেট চেকারের কাজ করতেন। রেল বিভাগের হয়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই লম্বা চুলের এই তরুন নজরে পড়ে যান সবার। অবশ্য ম্যাচ খেলতে গিয়ে চাকুরি হারিয়েছিলেন তিনি। সেটাই যেন জীবন বদলে দিল ধোনির। বিহারের অনুর্ধ-১৯ দলে ধোনি খেলেছেন সেই ১৯৯৮-৯৯ সালে। এরপর বিহার জাতীয় দল হয়ে খেলতে খেলতেই ডাক মেলে ভারতীয় এ দলে।
ভারতীয় দলের হয়ে ধোনির শুরু
২০০৪-০৫ এ বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিলো রাঁচির এই ক্রিকেটারের। কিন্তু শুরুটা ছিল একেবারে বাজেভাবে। রান আউট হয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন বিনা রানেই। তবে লড়াকু এই ক্রিকেটার জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়েননি। বিহার ও ভারতীয় ‘এ’ দলের ধারাবাহিক পারফরমেন্সে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১২৩ বলে ১৪৮ রানের অসাধারণ ইনিংসটির পরই সবার নজরে পড়েন ধোনি। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে আইসিসি প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ারে ভূষিত হন তিনি। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান অর্জন করেন।
অধিনায়ক হিসেবে ধোনির সাফল্য
ধোনির নেতৃত্বে ভারতের অনেক সাফল্য রয়েছে ৷ ২০০৭-এ জোহানেসবার্গে টি-২০ বিশ্বকাপ জয় দিয়ে শুরু৷ তার পর ২০০৭-০৮ অস্ট্রেলিয়ায় সিবি সিরিজ জয়, ২০১০-এ এশিয়া কাপ এবং ২০১১ বিশ্বকাপ এবং ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়৷ ইংল্যান্ডের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় দিয়ে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে আইসিসি-র তিনটি ট্রফিই জিতেছেন ধোনি৷ তার অধিনায়কত্বেই ভারত টেস্টের র্যাংকিংয়ে এক নম্বরে উঠে এসেছিল। এখনো পর্যন্ত টেস্ট এবং ওয়ান-ডে ইন্টারন্যাশনালে তার রেকর্ড ভারতীয় অধিনায়কদের মধ্যে সেরা।
পরিণয় এবং বিয়ে
মহেন্দ্র সিং ধোনি ২০১০ সালের ৪ জুলাই বিয়ে করেন কলকাতার মেয়ে সাক্ষী রাওয়াতকে। এর দুই বছর আগে কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ধোনির সাথে সাক্ষী রাওয়াতের পরিচয় হয়। সাক্ষী রাওয়াত হোটেল ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।
বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীদের তালিকায় ধোনি
মনমোহন সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আর মুকেশ আম্বানি ভারতের সেরা ধনী ব্যক্তি। স্বাভাবিকভাবে এরাই প্রভাবের দিক দিয়ে সবার আগে থাকার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনের করা জরিপ বলছে মহেন্দ্র সিং ধোনি মনমোহন সিং, মুকেশ আম্বানি, বারাক ওবামাদেরও চেয়ে প্রভাবশালী। ম্যাগাজিনটিতে ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ধোনি ছাড়াও রয়েছেন আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি, টেনিস তারকা বেলজিয়ামের কিম ক্লাইস্টার্স। তবে একশ’র তালিকায় মেসির চেয়েও ওপরে রয়েছেন ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। যেখানে মেসি রয়েছেন ৮৭ নম্বরে, সেখানে ধোনি ৫২তম। শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি সেখানে ৬১তম, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন হোয়াইট ৫৮তম। এর চেয়েও অবাক ব্যাপার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সেখানে ৮৬তম।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেটার
বিশ্বের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বস এর তালিকা অনুযায়ী মহেন্দ্র সিং ধোনি বিশ্বের সেরা ধনী ক্রিকেটার। দুই কোটি ৬৫ লাখ ডলার উপার্জন করে তালিকায় প্রথম স্থানটা দখল করে নিয়েছেন ধোনি। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে আয় করেছেন দুই কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর ক্রিকেট খেলে আয় করেছেন ৩৫ লাখ ডলার। তালিকায় বলা হয়েছে ধোনি বাণিজ্যিকভাবে যে দুই কোটি ৩০ লাখ ডলার আয় করেছেন সেটাই ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ আয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এই তালিকাটি প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অ্যাথিলটদের তালিকায় ১৬ নম্বরে রয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।
বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ধোনি ১৬ তম ধনী ব্যক্তি
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অন্যতম সফল দৌড়বিদ উসাইন বোল্টকেও হারিয়ে দিলেন ধোনি। এমনকী টেনিসের রাজপুত্র রাফায়েল নাদালও ধোনির কাছে ম্লান হয়ে গেলেন। ধোনির কাছে হারলেন টেনিসের এক নম্বর নোভাক জকোভিচ, গ্ল্যামার গার্ল মারিয়া শারাপোভা, ফর্মুলা ওয়ানের মহাতারকা লুইস হ্যামিলটন, ফার্নান্দো আলান্সোরাও। ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিচারে বিশ্বের ধনীতম ক্রিড়াবিদের তালিকায় ১৬ তম স্থানে থাকলেন ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। গতবার এই তালিকায় ধোনি ছিলেন ৩১ নম্বরে। ফোর্বসের এই তালিকা অনুযায়ী ভারতের ক্রিকেট দলের অধিনায়কের বার্ষিক আয় ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২০০ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা ( $31.5 million)।নির জীবনী নিয়ে তৈরি করা হবে চলচ্চিত্র
মহেন্দ্র সিং ধোনির জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করবেন পরিচালক নীরাজ পান্ডে। এতে সুশান্ত সিং রাজপুত ধোনির চরিত্রে অভিনয় করবেন। ছবিতে একটি ছোট শহর থেকে ধোনির আন্তর্জাতিক তারকায় পরিণত হওয়ার সব কিছুই তুলে ধরা হবে। তবে ধোনির চরিত্রে সুশান্তকে চূড়ান্ত করা হলেও তার স্ত্রী সাক্ষি চরিত্রে এখনো কাউকে নেয়া হয়নি। শোনা যাচ্ছে, এ চরিত্রে দীপিকা অথবা শ্রদ্ধা কাপুরকে দেখা যেতে পারে। সব কিছু ঠিক থাকলে অচিরেই শিরোনামহীন এ ছবির শুটিং শুরু হবে। মার্চ, ২০১৪ তারিখে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
এশিয়ায় অ্যাওয়ার্ড জয়
ক্রীড়া-ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের জন্য এশিয়ান অ্যাওয়ার্ড ২০১৪ পেয়েছেন ভারতীয় অধিনায়ক ধোনি। এছাড়া মহেন্দ্র সিং ধোনিকে ২০০৯ সালে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার।
বিজ্ঞাপন চিত্রে ধোনি
ক্রিকেটের সফলতাকে পুঁজি করে বিজ্ঞাপনের বাজারে একচেটিয়া প্রভাব রয়েছে ধোনির। বিজ্ঞাপন বানিজ্যে বলিউড কিং শাহরুখ খানের পরই রয়েছেন তিনি। টেক্কা মেরেছেন বিগ বি অমিতাভ বচ্চনকেও। এ মুহূর্তে তিনি চুক্তিবদ্ধ পেপসি, রিবক, এক্সাইড, টিভিএস মোটরস, মাইসুর সোপ, ভিডিওকন, রিলায়েন্স কমিউনিকেশন, রিলায়েন্স এনার্জি, ওরিয়েন্ট পিএসপিও, ভারত পেট্রোলিয়াম, টাইটান সোনাটা, ব্রিলক্রিম, এনডিটিভি, জিই মানি, সিয়ারাম, বিগ বাজার, মাহা চোকো, বুস্ট, দৈনিক ভাস্কর, ডাবর হানি, কলকাতা ফ্যাশন উইক, এয়ারসেল, নোভা স্টটিয়া আর অমরাপল্লী কোম্পানির সঙ্গে। এখন ভারতের সর্বোচ্চ করদাতাদের তালিকায় তিনিও একজন।
সেনাসদস্য ধোনি
ছোটবেলায় সেনা বাহিনীতে যোগদানের স্বপ্ন ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির। ক্রিকেটের ব্যস্ততা না থাকলে মহেন্দ্র সিং ধোনি প্রায় বনে যান ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য। এর মধ্যেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল খেতাবও পেয়েছেন ভারত অধিনায়ক।
ধোনির যা পছন্দ
ধোনির বড় শখ দেশি বিদেশী কুকুর পোষা। আর আছে ভিডিও গেম খেলার নেশা। কিশোর কুমারের হিন্দি গানের ভক্ত ধোনি সিনেমা দেখায় উৎসাহী নন। দুধ খেতে খুব ভালবাসেন ধোনি। আর ভালবাসেন আলু-ভুজিয়া। এমনিতে আগে মাছ-মাংস না খেলেও, এখন দেশে বিদেশে ঘুরতে গিয়ে দুনিয়ার কোন খাবারেই আর অরুচি নেই ধোনির। তবে কলকাতায় এলে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভাত তার বেশ পছন্দের খাবার।
বলিউড অভিনেতা জন আব্রাহামের ভক্ত বলেই এক সময় লম্বা চুল রেখে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। হয়ে ওঠেন ফ্যাশন আইকন। বাইক ভালবাসেন তিনি। সময়-সুযোগ মিললেই মোটর সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। রাঁচিতে তার গ্যারেজে রয়েছে ৪টি গাড়ি। সঙ্গে ২৩টি হাইস্পিড মোটর সাইকেল।
ভারতের সর্বকালেরে সেরা দলের অধিনায়ক ধোনি
কপিল দেব, ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক। কপিল দেব ভারতের সর্বকালের একটি দল তৈরি করেছেন এবং সেই দলের অধিনায়ক নির্বাচন করেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। কপিলের স্বপ্নের একাদশ- মহেন্দ্র সিং ধোনি (অধিনায়ক), শচিন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন, যুবরাজ সিং, বিরাট কোহলি, অনিল কুম্বলে, হরভজন সিং, জাভাগাল শ্রীনাথ, জাহির খান। (দ্বাদশ ব্যক্তি- রবীন্দ্র জাদেজা)।
সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ধোনি
2
14
I don't understand Bangla, but I can say you are fan of Dhoni like me.