--- আমার দুটো বাচ্চা আছে জেনে ও আপনি আমাকে বিয়ে করলেন?
বিয়ের প্রথম রাতেই ইমাদের মুখ থেকে এমন কথা শুনে নাজিফা একটু শুকনো হেসে বললো ---- হাসালেন আপনি আমাকে। আরে আমি নিজেই তো একজন ডিভোর্সি মহিলা, স্বামীর সাথে সংসার করতে- না করতেই দু বছরের মাথায় ও আমাকে ডিভোর্স দিলো । আমার আবার পছন্দ--- অপছন্দ। পরিবারের কাছে এই ১ টা বছর বোঝার মতো ছিলাম, অবশেষে আপনার সাথে বিয়ে হওয়ায় একটু মুক্তি পেলাম। কিন্তু আপনি আমাকে কেন বিয়ে করলেন?
।
।
নাজিফার কথার উওর দিতে গিয়ে ইমাদের চোখ দুটো লাল হয়ে যায়, কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে ইমাদ বললো --- আমি তো আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি, ইনফ্যাক্ট এ বিয়েতে রাজি ও ছিলাম না, কিন্তু মা অনেক জোর করলো, আমাকে নিয়ে হাপিঁয়ে গেছে মানুষ টা, সেদিন আমার সামনে এসে মায়া ময় কন্ঠ বললো
-
-- বাবা তুই কী আমাকে বেঁচে থেকে ও মরার লাশের মতো রাখবি।
সেদিন মায়ের কথাটি শুনে খুব কষ্ট হলো, আলতো করে মায়ের কোলে মাথা রেখে
বললাম--- মা তুমি কেন এমন বলছো?
মা তখন দুহাত তুলে আমাকে বললো --- দে না বাবা আমাকে একটা বউ, মানুষের জীবনে তো এমন সুখ-- দুঃখ থাকেই, কিন্তু তাই বলে কী তুই নিয়তির সাথে রাগ করে জীবনকে থামিয়ে রাখবি??
সন্তান গুলোর কথা অন্তত ভাব, ওদের পুরো জীবনটা এখন ও পড়ে আছে। ওদের ও তো মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে।
সেদিন কেন জানী মায়ের কথা গুলো খুব লাগলো , মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনাকে বিয়ে করতে বাধ্য হলাম।
ইমাদের কথা শুনে বিশাল ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েটির চোখ দুটো অশ্রুতে ভিজে গেলে, কিন্তু ইমাদ সে খবর নিলো না, বরং তিক্ত কথা শুনাতে লাগলো --- দেখুন আমি আপনাকে কখনো স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো কীনা জানীনা, তবে বন্ধু হিসেবে আপনাকে সবসময় সাহায্য করবো, আর হ্যা আপনার আগের স্বামী আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে কেন, সেটা ও আমি জানীনা, তবে জানতে ও চাইনা, কারন আপনাকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, তবে মায়ের থেকে যেটুকু শুনেছি আর এতোক্ষণে আপনাকে যেটুকু দেখেছি তাতে আমার মনে হচ্ছে আপনি খুবেই পরেহেজগার, আর সেই জন্যই হয়তো আমাদের বিয়েটাও মসজিদে হয়েছে, কিন্তু বুঝতে পারছিনা আপনি এতো পরেহেজগার হওয়া শর্তে ও আপনার হ্যাজবেন্ড আপনাকে ছেড়ে কেন চলে গেছে?????
আবার সেই প্রশ্নটার সম্মুখীন, এই ১ বছরে মেয়েটি এই প্রশ্নটি শুনতে-- শুনতে প্রায় ক্লান্ত হয়ে যায়। ভেবেছে এবার একটু মুক্তি পাবে কিন্তু তাও হলোনা।
।
ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েটি ইমাদের প্রশ্নের কোনোই উওর দিলোনা।
ইমাদ একটু সংকোচ করে তখন বললো --আসলেই কী আপনি ভালো? নাকি ভালো হওয়ার অভিনয় করছেন।
নাজিফা তখন শান্ত কন্ঠে বললো ---- হয়তো খারাপ তাই আজ অবধি কারো মনে জায়গায় পেলাম। না।
---- আপনি কী আমার কথায় রাগ করেছেন?
--- এ মা কী বলছেন, রাগ কী সবার উপর করা যায় বলুন, রাগ করতে হলে মানুষটার উপর অধিকার থাকতে হয়।
।
।
ইমাদ আর কোনে জবাব দিলোনা, একটু নিচু করে মুখটাকে রেখে নাজিফাকে উদ্দেশ্য করে বললো --- দেখুন আমি জানীনা আপনি দেখতে কেমন? আর আপনাকে দেখার ও আমার কোনো আগ্রহ নেই, তবে আপনাকে একটা কথা বলে রাখি আপনি প্লিজ আমার কাছে কখনো স্ত্রী র অধীকার চাইবেন না।
---- চাইবো না, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলাই আমার জন্য যথেষ্ট ।
নাজিফার কথা শেষ না হতেই দরজায় কেউ নক করতে লাগলো, ইমাদ একটু চিন্তিত হয়ে দরজার সামনে গিয়ে বললো ---- কে??
ও পাশ থেকে তখন আওয়াজ আসলো--- বাবাই আমরা।
বাবাই শব্দটা ইমাদের কানে আসতেই এক মুখ হাসি নিয়ে ছেলেটি দরজা খুললো, দরজা খুলতেই একটি চার বছরের মেয়ে ইমাদের কোলে উঠে পড়লো, একমুখ হাসি নিয়ে মেয়েটি ইমাদকে বলতে লাগলো --- ও বাবাই, আমি তোমার পাতে তুবোনা?
কথাটি নাজিফার কানে যেতেই নাজিফা খিলখিল করে হাসতে লাগলো, ওর হাসির আওয়াজ ইমাদের ১৩ বছরের মেয়ে নওরীনের কানে যেতেই ও বাবাকে রাগী স্বরে বলতে লাগলো --- বাবাই তোমার আর মায়ের ঘরে এ কে??
ওকে কেন এই ঘরে এনেছো, আর তাছাড়া ও এভাবে সেজে বসে আছে কেন?
মেয়েটির এমন কথা নাজিফার কানে যেতেই নিমিষে ওর হাসিটা উদাও হয়ে যায়।
ইমাদ নওরীনের মাথায় হাত দিয়ে বললো --- মামুনি এনি তোমাদের আনটি হয়।
--- আনটি! আচ্ছা মামুনি বলে পরিচয় দিলে কী হতো? ও বাচ্চাদের আম্মু হতে ও বুঝি আপনার স্ত্রীর অধিকার লাগবে। নাজিফা মনে-- মনে এই ভাবতে--- ভাবতে নিশ্চুপ ভাবে বসে রইলো।
কিন্তু নওরীন বড় জেদি ও এক রোখা টাইপের মেয়ে, ঘরে ঢুকেই নাজিফার হাতটা শক্ত করে ধরে ওকে ঘর থেকে বের করে দিলো, চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো --- আমার বাবাইয়ের রুমে তুমি কী করছো, যাও এখান থেকে?
ইমাদ তখন নওরীনকে বলতে লাগলো --- আম্মু এমন করেনা, ও তো আমাদের বাড়ির মেহমান।
--- না বাবাই, ও কেউ না, ফুফু বলেছে ও আমাদের সৎ মা, বাবাই ওকে চলে যেতে বলো, নাহলে আমি কিন্তু তোমার সাথে আর কোনো দিন কথা বলবোনা, এই বলে নওরীন, নাবার দিকে তাকিয়ে ইমাদকে বললো --- নাবা ও তোমাকে কোনো দিন বাবা বলে ডাকবেনা।
।
।
।
নাজিফা অবাক হয়ে গেলো নয় বছরের একটি বাচ্চার মুখে এমন সব আচরণ দেখে , খুব অবাক ভাবে ও নওরীনের দিকে তাকালো, মেয়েটির চেহারায় এতো পরিমান মায়া, যা যে কেউকে ওর প্রতি ভালোবাসায় জড়াবে কিন্তু বড্ড বেশি জেদি ও এক রোখা টাইপের মেয়ে।
---- কী হলো তুমি এখনো দরজার সামনে দাড়িয়ে আছো কেন? প্লিজ এখান থেকে যাও, বাবাই ওকে চলে যেতে বলো।
নওরীনের চেঁচামেচিতে মিসেস সালেহা বেগম উপরে উঠে আসতে বাধ্য হলো , ইমাদের রুমে এসে নতুন বউকে বাহিরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আর নওরীন, ও নাবাকে ইমাদের সাথে দেখে গম্ভীর কন্ঠে সালেহা বেগম নওরীনকে জিজ্ঞাসা করলো ---- কী ব্যাপার তুমি এখানে কী করছো?
নওরীন আমি না তোমাকে আর নাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসলাম। তোমরা এ ঘরে কী করছো?
নাবা তখন বাবাইয়ের কোল থেকে দিদুনের কোলে গিয়ে আদৌ -- আদৌ করে বলতে লাগলো ---- দিদু, বোন, বোন উতিয়ে দিয়েছে আমায়, বোন, বাবাই, বাবাই আতবে বলে।
নাবার কথা শুনে মিসেস সালেহা গরম চোখে নওরীনের দিকে তাকাতেই ও ইমাদের পিছু গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। মিসেস সালেহা তখন ইমাদের পিছু থেকে ওর হাতটা শক্ত ধরে ওকে বলে ---- দিন-- দিন তোমার বেয়াদবি বেড়েই যাচ্ছে।
ইমাদ তখন ওর মায়ের হাতটা সরিয়ে মিসেস সালেহাকে বলে--- মা প্লিজ তুমি ওকে ছাড়।
।
।
----- এই তোর পশ্রয় মেয়েটি দিন-- দিন বিগড়ে যাচ্ছে, তোরা ওকে আদর দিয়ে দিয়ে দিন- দিন বানর বানিয়ে ফেলছিস।
---- আদর আর কী দিলাম, তোমার কথা রাখতে গিয়ে, তোমার জ্বালায় আমাকে আবার বিয়ে করতে হয়েছে, তাও একটা ডিভোর্সি মহিলাকে।
" ডিভোর্সি মহিলা " শব্দটি যেনো মেয়েটির একটা নাম হয়ে গেছে। এক সময় নাজিফার খুব কষ্ট হতো যখন পাড়ার মহিলারা ওকে দেখিয়ে বলতো--- দেখ মেয়েটি কী দ্বীনদার, অথচ এতো পরেহেজগার হওয়া শর্তে স্বামীর ঘর করতে পারলোনা, ডিভোর্স হয়ে গেলো।
কী যুগ রে বাবা, এরা আবার নাকি পরেহেজগার।
নাজিফার কাছে সেই কথাগুলো একসময় বিষণ আঘাতের অস্ত্র ছিলো, কিন্তু ধীরে-- ধীরে মেয়েটি একটা সময় এই কঠিন বাস্তবতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়।
তাহলে আজ ইমাদের মুখ থেকে এ কথা শুনে কষ্ট পাওয়ার কোনো প্রশ্নই তো আসেনা। কিন্তু তারপর ও হৃদয়ের মাঝে আজ কেন জানী পুরোনো কষ্ট টা আঘাত করলো আবার, নাজিফা বুঝে উঠতে পারলোনা ---- কেন এমন কষ্ট হলো!!!
।
।
বিয়ের দুদিন আগে ও তো মা কথায়-- কথায় ঠেস মেরে বললো ----- কপালে দুই বাচ্চার বাপ জুটেছে এটা ও তোর ভাগ্য ভালো, না হলে যে মেয়ে নিজে স্বামীকে ডিভোর্স দেয় তার আবার কেমন করে বিয়ে হয়????
নিজের আপন মা যখন সবকিছু যেনে ও এমন কথা বলে তখন তো কষ্ট -- যন্ত্রনার দরুন জ্বালা পাওয়ার কথা। কিন্তু কই সেদিন তো মায়ের কথাই আমার বিন্দু মাএ কষ্ট হলোনা, সমাজের আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের তালিকায় মাকে ও স্থান দিয়ে আমি সে কষ্ট টা নিমিষে দুর করে ফেললাম, তবে আজ কেন এই লোকটার কথায় পুরনো ক্ষতরা আবার মন পাজঁরে উতপাত শুরু করলো!!!!!!
।
।
।
নাজিফা প্রশ্নটির কোনো উওর পেলোনা, বুঝে ফেললো মেয়েটি ---- আসলেই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা হয়তো সহজ, কিন্তু ভালোভাবে বেঁচে থাকাটা ভীষণ জটিল, আর সেই জটিলতায় আমাদের অনেক প্রশ্নের কোনো উওর হয়না, অনেক কিন্তুর কোনো কারন হয়না, আর অনেক সম্পর্কের কোনো মানেই হয়না।
সালেহা ইমাদের এমন কথা শুনে , ইমাদকে রেগে গিয়ে বলে--- তুমি দিন-- দিন আসলেই যে কত পরিমান বিপথে যাচ্ছ তা আজ আমি টের পেলাম। ওকে ডিভোর্সি বলছো, তুমি কী? হ্যা, তুমি তো.....
---- মা প্লিজ আমি তোমাকে বলিনি আমি আবার বিয়ে করবো, অতএব আমি কী সে প্রশ্নটা এখানে আসছে কেন???আর এ বিয়েটাই আমার কাছে ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
---- বিয়েটা তোমার কাছে ছেলেখেলা মনে হলে ও তা আমার কাছে নয়, এই সংসারের আর তোমাদের যে অবস্থা তা থেকে তোমাদের সকলকে সঠিক পথে আনার জন্যই আমি ওকে এ বাড়ির বউ করে এনেছি, আর ও শুধু এ বাড়ির বউ না আমার মেয়ে ও।
।
।
।
নাজিফা যেনো বিশ্বাস করতে পারছেনা শাশুড়ি নামক মহিলা তাকে মেয়ে বলায়। কেন জানী মনে হচ্ছে মহিলাটি ভুল করে এমন কথা বলে ফেলেছে, আসলে শাশুড়িদের কাছে কখনো বউরা মেয়ে হয়না, যদি হতো তাহলে......
( চলবে)
গল্প: # নিয়তি( পর্ব-১)
0
20