২০০৪ সাল। রাত ১০ টা বাজে। মা কাঁদছে।
আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে গেলেই মা লজ্জা পাবে। এই মহিলাটিকে আমি লজ্জা দিতে চাই না।
রাত পেরিয়ে সকাল হলেই ঈদ। বাবা এখনও আসেনি৷ "বাবা এখনও আসেনি" সেই কষ্টে মা কাঁদছে না, মা কাঁদছে অন্য কষ্টে...
মা চোখের জল মুছে আমাকে ডাকলেন। আমি ঘরে গিয়ে চুপচাপ মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম। গভীর রাতে বাবার কন্ঠে আমার ঘুম ভেঙে গেল। বাবা এসেছে। বাবার হাতে একটি ব্যাগ। মা ব্যাগ থেকে একে একে সেমাই, চিনি বের করতে লাগলেন।
আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মার বিষন্ন মুখটা হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে গেল। ব্যাগের তলানি থেকে কি বের হয়েছে কে জানে!? তাকিয়ে দেখি মায়ের হাতে একটি লাল শার্ট আর কোমড়ে রাবার দেওয়া একটি প্যান্ট...
ব্যাগে আর কোনো কাপড় নেই। থাকলে কি হতো?! অন্তত একটা শাড়ি;
কিংবা একটা পাঞ্জাবি;
কিন্তু নেই!
মা উঠে দাঁড়ালেন, বাবাকে বললেন- "রাবার দেওয়া প্যান্ট আনছো ক্যান? পোলাডা বেল্টওয়ালা প্যান্ট পরতে চায়"
বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "এইবার এইডাই পর বাবা, পরেরবার বেল্টওয়ালা প্যান্ট আইনা দিমু!"
মা আবার বাবাকে বললেন, " লাল শার্ট আনছো ক্যান? পোলাডায় সাদা শার্ট পরতে চায়"
বাবা আমাকে বললেন, "এইবার লাল শার্ট টাই পর বাবা, পরেরবার সাদা শার্ট কিইনা দিমু"
আমি চুপ করে আছি। আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে খালি ব্যাগটা। ব্যাগে আর কিছু নেই কেন?
অন্তত একটা শাড়ি কিংবা একটা পাঞ্জাবি!
ছোটবেলায় আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজেছি। পাইনি। কোথাও পাইনি। বড়বেলায় এসে বুঝেছি কয়েকটা কাগজের নোটের অভাবে ব্যাগের তলানি থেকে শাড়ি আর পাঞ্জাবি বের হয়না।
অনেক বছর পর যেদিন কাগজের নোট ইনকাম করতে শিখলাম। কোনো এক ঈদের আগের দিন রাতে আমিও একটি ব্যাগ এনে মায়ের হাতে দিলাম।
মা ব্যাগ থেকে একে একে সেমাই চিনি বের করতে লাগলেন। আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মার বিষন্ন মুখটা হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে গেল। ব্যাগের তলানি থেকে কি বের হয়েছে কে জানে!? তাকিয়ে দেখি মায়ের হাতে দুইটা শাড়ি আর দুইটা পাঞ্জাবি।
শাড়ি আর পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে মা কাঁদছে। কেন কাঁদছে কে জানে!? হয়তো অনেক বছর আগের খালি ব্যাগটার কথা মনে পরে গেছে।
মা কাঁদছে। আমি দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছি। সামনে গেলেই মা লজ্জা পাবে। এই মহিলাটিকে আমি লজ্জা দিতে চাই না।