#ভাঙনের_বাঁশিতে_মিলনের_সুর
#সাইক্লোট্রনের_ইতিকথা
‘এখন থেকে যিনি নতুন কণা আবিষ্কার করবেন, তাঁকে দশ হাজার ডলার জরিমানা করা উচিৎ’ - কথাটা ঠাট্টা করে বলেছিলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী উইলিস ল্যাম্ব। এই ঠাট্টার কারণও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর যখন কণা পদার্থবিজ্ঞানে নতুন করে প্রাণ ফিরে আসে, মার্কিন বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমা তৈরির কারখানা থেকে বেরিয়ে আসেন ঠিকই, কিন্তু গাঁট হয়ে লেগে থাকেন পরমাণুর অন্দরমহলে। তারই পরিণামে একের পর আবিষ্কার হচ্ছিল নতুন কণা আর আবিষ্কারকরা বগলদাবা করছিলেন নোবেল পুরষ্কার। কণা পদার্থবিজ্ঞানে এত এত নোবেল পুরষ্কার দেখেই ঠাট্টা করেছিলেন ল্যাম্ব। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন কণা আবিষ্কার করা কিন্তু ৫০-৮০ দশকের মতো ডালভাত বলে মনে হয় না, এখন এটা চলে গেছে বিগ সায়েন্সের দখলে। যেখানে দুতিন জন বিজ্ঞানী মিলে গবেষণা করেন না। কয়েক শ বা কয়েক হাজার বিজ্ঞানীর মিলিত প্রয়াস- সার্নের মতো এলএইচসি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের লাইগো প্রকল্পের মতো বিশাল বিশাল প্রজেক্টের হাত ধরেই এগিয়ে চলেছে এখনকার বিগ সায়েন্স। মহাকশ গবেষণার কথা বাদই দিলাম, শুধু যদি কণা ক্ষুদে কণাদের যে অতি ক্ষুদ্র জগত সেই জগতে পাড়ি দিতেই এখন বিশাল বিশাল কণা ত্বরক যন্ত্রের সাহায্য নিতে হয়। কতটা বিশাল সেই যন্ত্র, যারা সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলইডারের খবর রাখেন না, তাঁদের চোখ কপালে উঠে যাবে। হিগস বোসনের মতো ভরহীন একটা কণা, যার পেছনে বিজ্ঞানীরা লেগে ছিলেন চিনে জোঁকের মতো প্রায় চল্লিশটি বছর, সেই কণার সন্ধান দিয়েছে এলএইচসির যে সাইক্লোট্রোনটি, তার দৈর্ঘ্য পাক্কা তেইশ কিলোমিটার। এই যে মহাযজ্ঞ, এর ইতিহাস কিন্তু অনেক লম্বা। আর শুরুর দিকে যেসব কণা ত্বরক যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়, সেগুলোর দৈর্ঘ্য মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার। বিন্দু বিন্দু জল থেকে যেমন বিশাল সিন্ধু কণা ত্বরক যন্ত্রের বিবর্তনের ইতিহাস বিন্দু থেকে সিন্ধুর মতোই। আর এর পেছনে জড়িয়ে অসম্ভব অধ্যাবসয়ী কিছু বিজ্ঞানী নিজেকে নিংড়ে দেওয়া শ্রম।
কণা ত্বরক যন্ত্র, যেটাকে আজকাল আমরা সাইক্লোট্রন বলছি, এর শুরুটা হয়েছিল প্রকৃতি থেকেই । সেটা আবার কেমন? আসলে মহাবিশ্বে সব কণারা সুখে শান্তিতে পরমাণুর ভেতর চুপটি করে বাস করে না। কিছু পদার্থ অতি উত্তেজিত, নিজেকে নিজে না ভাঙলে ওদের চলে না। তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে, নিজে ভেঙে অন্য মৌলের পরমাণুতে রূপ বদল করে। মৌলিক পদার্থের পরমাণুরে নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন নামে কণা। এসব কণা কণরা প্রাকৃতিকভাবে ভেঙে গিয়ে জন্ম দেয় গতিশীল তেজস্ক্রিয় রশ্মির। সেসব রশ্মি আলোক রশ্মির মতো হলেও এর মধ্যে থাকে নানা রকম কণা আর শক্তি হিসেবে থাকে আলো বা ফোটন। নিউট্রন, প্রোটন আবিষ্কারের আগেই তেজস্ক্রিয় রশ্মি আবিষ্কার হয়। তেজস্ক্রিয় রশ্মি কেন বিকিরিত হয়, আর এর মধ্যে থাকেই বা কোন কোন কণা সে সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা ছিল না কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের ১৯১১ সালের আগ পর্যন্ত।
সাইক্লোট্রনের জন্মই হয়েছে কণা গতিশীল থেকে আরও গতিশীল অর্থাৎ ত্বরিত করতে। তার আগে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে ছুটে বেরিয়ে আসা কণারাই ছিল বিজ্ঞানীদের কামানের গোলা। এই গোলাই কাজে লাগিয়েছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। আলফা কণা পরীক্ষায়।
কেন এই ত্বরণের দরকার। কণারা এমনিতেই অতি ক্ষুদ্র, গতি অনেক বেশি হলেও ভর খুব কম। তাই এদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো কঠিন। কিন্তু কণাদের যদি আরও গতিশীল করা যায়, তারপর এদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো যেতেই পারে। কথা হলো সংঘর্ষের আদৌ কি দরকার আছে?
আছে। প্রকৃতির মন পুরোপুরি এখনো বুঝে উঠতে পারেনি মানুষ। এখনকার পদার্থবিজ্ঞানের দুটো শাখা। বড়দের জগৎকে অর্থাৎ গ্রহ নক্ষত্রের গতি, ভর, বেগ, বল, মহাকর্ষ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে করে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা। অন্যদিকে পরমাণুর অন্দরমহলের যে জগৎ সেটা ব্যাখ্যার জন্য দরকার হয় কোয়ান্টাম বল্যবিদ্যা। কোয়ন্টাম বলবিদ্যা দিয়ে বড়দের জগৎ ব্যাখ্যা করা যায় না, অন্যদিকে সাধারণ আপেক্ষিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না খুদে কণাদের জগৎ। অথচ মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্য করতে, অর্থাৎ বিগব্যাং তত্ত্বের সত্যিকার প্রমাণ পেতে হলে দরকার এই দুই তত্ত্বের মিলন। আবার ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের খবরও আমরা জানি না। সেটা জানতে হলে এই দুই তত্ত্বের মিলন জরুরি। জরুরি একটি সার্বিক তত্ত্বের, যেটি কোয়ান্টাম মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করতে পারবে।
মহাবিশ্বের জন্মের পর পরই কোনো কণার জন্ম হয়নি। এমনকী প্রকৃতির যে চার বল- মহাকর্ষ, বিদুৎচুম্বক, সবল ও দুর্বল নিউক্লীয় বল- এগুলোর আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না শুরুতে। চার বল একসঙ্গে ছিল। বিজ্ঞানীরা তাই নিশ্চিত, মহাবিশ্বের জন্ম-ইতিহাস, মহাবিশ্বের গোপন রহেস্যর সবটকু জানতে হলে, এই চার বলকে একত্রিত করতে শিখতে হবে। বিদ্যুৎচম্বকীয় দুর্বল নিউক্লীয় বলকে একত্রিত করা গেছে গত শতাব্দীর ৭০ দশকে। কিন্তু মহাকর্ষ আর সবল নিউক্লীয় বল সেই তড়িৎ-দুর্বল বলের সঙ্গে এখনো একত্রিত করা যায়নি। এই কাজটাই করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
মৌলিক বলগুলোর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়েই তাই বিজ্ঞানীরা একের পর এক কণার হদিস পাচ্ছিলেন, আর সেজন্যই উইলিস ল্যাম্বের ওই রসালো মন্তব্য।
কিন্তু কণা আবিষ্কারের পথটা সহজ ছিল না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কণাদের ভাঙনের ইতিহাস। আর সেটা শুরই হয়েছিল গত শতাব্দীর শুরুর দিকে। ১৯০৮ দুর্ভাগ্যক্রমে রসায়নে নোবেল পেয়ে যান রাদারফোর্ড। দুর্ভাগ্য এইজন্য, তিনি ছিলেন আপদমস্কত পদার্থবিজ্ঞানী। এমনকী রসায়নবিজ্ঞানীদের খাটো করে দেখার একটা প্রবণতা তার মধ্যে ছিল, সেই তিনিই কিনা পেলেন রসায়নে নোবেল! যাইহোক, নোবেল বক্তৃতা দিতে গিয়েই আলফা কণা শনাক্ত করার একটা পথ বাতলে দেন তিনি। তখনও জানাতেন না আলফা কণা আসলে কী? পরে নিশ্চিত হন, তেজস্ক্রিয় বস্তু থেকে যে আলফা কণা বেরিয়ে আসে সেগুলো আসলে হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস।
এরপর সেই সুবর্ণ বছর- ১৯১১ সাল- করলেন তাঁর বিখ্যাত স্বর্ণপাত পরীক্ষা। রাদারফোর্ড একটা যন্ত্র বানালেন, সেই যন্ত্রের ভেতরে ছিল কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ। যন্ত্রের সামনের দিকে ছিল একটা ছিদ্র। সেই ছিদ্র দিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বেরিয়ে আসে আলাফ কণা আঘাত সামনে থাকা স্বর্ণপাতকে। স্বর্ণপাতের চারপাশ জিংক সালফাইডের পদার্য় গিয়ে আঘাত করে স্বর্ণপাত ভেদ করে বা স্বর্ণের নিউক্লিয়াসে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসা আলফা কণা। এ পরীক্ষা থেকেই রাদারফোর্ড নিশ্চিত হন পরমাণুর কেন্দ্রে আছে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস। অর্থাৎ স্বর্ণপাতের সঙ্গে আলফা কণার সঘর্ষ ঘটিয়ে রাদারফোর্ড পেলেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সন্ধান। এক্ষেত্রে পরমাণুটি ছিল গোল্ড বা স্বর্ণের। দ্রতগামী কণার সঘর্ষ ঘটিয়ে কণা আবিষ্কারের পথ বাতলে দেয় রাদারফোর্ডের এই পরীক্ষাটিই।
এর কিছূদিন পরে, ১৯১৫ সালে আরেক নিউজিল্যান্ডার আর্নেস্ট মার্সডেন একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেন। আলফাকণাকে বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটান তিনি। এই সংঘর্ষের ফলে এক ধরনের কণার জন্ম হচ্ছে। কণাগুলো বেশ ভারি। তিনি কণাগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে দেখেন, এ ধরনের কণার দেখা রাদারফোর্ড আগেই পেয়েছেন। রাদারফোর্ড হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করে এই কণার সন্ধান পেয়েছিলেন। মার্সডেন ভাবলেন এটাই বোধহয় হাইড্রোজেনে নিউক্লিয়াস। ব্যাপারটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাদারফোর্ডেরও। তিনি ভাবলেন, এটা অন্য কিছুও হতে পারে। ১৯১৭ সালে তিনি লেখেন, বাতাসে আলফা কণার সংঘর্ষে যে সব কণা তৈরি হচ্ছে সেগুলো শুধু হাইড্রোজেন নয়, বাতাসে অন্য যেসব উপাদান আছে--নোইট্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়ামেরও হতে পারে। তিনি বিষয়টা নিয়ে আরো গবেষণা চালিয়ে গেলেন। তারপর দীর্ঘ দুবছর গবেষণার পর ১৯১৯ সালে একটা প্রবন্ধ লিখলেন। শিরোনাম কলাইশন অব আলফা পার্টিকেল উইথ লাইট অ্যাটোম, অর্থাৎ হালকা পরমাণুর সঙ্গে আলফা কণার সংঘর্ষ। সেই প্রবন্ধে রাদারফোর্ড যা বললেন, তা ছিল মধ্যযুগের অ্যালকেমিস্টদের সেই অধরা স্বপ্ন ! অ্যালকেমিস্টরা চেয়েছিলেন সঞ্জিবীনী রস তৈরি করতে, যা খেয়ে মানুষ অমর হবে। তাঁদের আরেকটা স্বপ্ন ছিল লোহাকে সোনায় রূপান্তর করা। সেযুগে কণা পদার্থবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি, আধুনিক রসয়ান থেকেও বিস্তুর দূরত্ব, সুতারাং অ্যালকেমিস্টরা তখন যেন ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। রাদারফোর্ড লোহাকে সোনায় পরিণত করার পথে প্রথম বাতলে দিলেন। বললেন আলফা কণা দিয়ে যদি নাইট্রোজেনকে আঘাত করা হয়, তাহলে সেই নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে হাইড্রোজেন। আর এই হাইড্রোজেরে জন্ম হয়েছে ওই নাইাট্রোজেনের বুক থেকেই। এটাই ছিল নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটিয়ে এক পদার্থ থেকে আরেক পদার্থ জন্ম দেওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে গতিশীল কণাদের দিয়ে আঘাত করিয়ে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের দুয়ারও খুলে গিয়েছিল তখন।
১৯১৭ সালে রাদারফোর্ড আরেকটা পরীক্ষা করেন। সেই পরীক্ষার ফল তিনি প্রকাশ করেন ১৯১৯ সালে। পরীক্ষাটিতে রাদারফোর্ড নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসকে আঘাত করেন আলফা কণা দিয়ে। এই সংঘর্ষ থেকে জন্ম হয় একটি অক্সিজেন নিউক্লিয়াস আর একটি ধনাত্মক চার্জ যুক্ত কণা। এতদিন সেই কণাটি শুধু হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসেই পাওয়া যেত এতদিন। রাদারফোর্ড নিশ্চিত হলেন, যেটাকে এতদিন তিনি শুধু হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস বলেই মনে করতেন, সেই কণাটি আসলে সকল পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরেই থাকে। এর ভর ইলেকট্রনের ১৮৩৬ গুণ। চার্জ ইলেকট্রনের সমান কিন্তু বিপরীত। ১৮১৫ সালে এমন একটি কণার কথা বলেছিলেন উইলিয়াম প্রাউট। আর এটাকেই হাইড্রোজেন আয়ন বলে পরিচিতি দিয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী ইউজিন গোল্ডস্টাইন। রাদারফোর্ডই প্রথম কণাটি শণাক্ত করে দেখালেন।
এরপর থেকে কণা পদার্থবিজ্ঞান তরতর করে এগিয়ে চলল। এখন দরকার আরেকটা কণা, যেটা চার্জ নিরপেক্ষ। এরজন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই রেখেছিলেন রাদারফোর্ড। তিনি অনুমান করেন এমন কিছু হাইড্রোজন পরমাণু আছে, যার কক্ষপথ থেকে ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে নিউক্লিয়াসে পতিত হবে। তখন হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রন পরস্পরের চার্জকে নাকচ করে দিয়ে চার্জ নিরপেক্ষ কণায় পরিণত হবে। আর বিকিরিত হবে গামা রশ্মি। ১৯২০ সালে এক বৃক্তৃতায় এই অনুমানের কথা বলেন রাদারফোর্ড। সেই বক্তৃতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ালথার বোথেকে। তিনি এই কণার খোঁজে নামেন।
বেরিলিয়ামকে তিনি আঘাত করেন আলফা কণা দিয়ে। এর ফলে জন্ম হয় গামা রশ্মির। তিনি ধরে নিলেন এই সংঘর্ষের ফলে এমন একটা হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি হয়েছে, যার নিউক্লিয়াসে নিউট্রন পতিত হয়ে একটা চার্জ নিরেপক্ষ কণা তৈরি করেছে। আর ইলেকট্রন-প্রোটন একত্রিত হওয়ার পরে উৎপন্ন হয়েছে গামা রশ্মি। অর্থাৎ হাইড্রোজেনের ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াস মিলে আসলে জন্ম হয় একটি চার্জ নিরপেক্ষ কণা। পরে তার নাম হয় নিউট্রন। সেই নিউট্রনের খোঁজেই পরমাণুর গভীর ধর্না দেন ফরাসী বিজ্ঞানী দম্পত্তি আইরিন কুরি আর ফ্রেডেরিক জোলিও। এঁরা ছিলেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী দম্পত্তি পিয়েরে কুরি ও মেরি কুরির মেয়ে জামাতা। নতুন কুরি দম্পত্তি বোথের পরীক্ষাটাকেই আরেকটু এগিয়ে নেন। দেখান, বোথে যে গামা রশ্মির সন্ধান পেয়েছিলেন, সেটা দিয়ে প্যারাফিনকে আঘাত করলে এর ভেতর থেকে প্রোটন বের করে দিতে পারে। এটা কঠিন একটা কাজ। সাধারণ আলোকরশ্মি ফটোতড়িৎক্রিয়ায় আলোকরশ্মির আঘাতে ইলেকট্রন ধাতু থেকে আলগা হয়ে যায় এবং ছুটে বেরিয়ে আসে ধাতব বন্ধন ছেড়ে। কিন্তু প্রোটনের ভর ইকেট্রনের চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি। সেটাকে নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে কীভাবে বের করে আনে গামা রশ্মি। এত শক্তি এই রশ্মি পাচ্ছে কোথায়? তাহলে আলফা ও বিটা রশ্মির মতো এই রশ্মিতেও লুকিয়ে আছে কোনো কণা?
আইরিন ও জুলিও দম্পত্তির গবেষণার কথা জানতে পারেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস চ্যাডউইক। তিনি গামা রশ্মি দিয়ে আঘাত করেন হিলিয়াম ও নাইট্রোজেন পরমাণুকে। এর ফলে সেসব পরমাণুর নিউক্লিয়াস বের হয়ে আসা প্রোটনের ধর্ম, গতি, শক্তি বিশ্লেণ করে চ্যাডউইক নিশ্চিত হন গামা রশ্মিতে চার্জ নিরপেক্ষ কণা আছে। যেটার নাম আগেই ঠিক করা হয়েছে নিউট্রন বলে।
কণা আবিষ্কারকরা এখানেই থামলেন না। রশ্মি বা কণা দিয়ে ভারী নিউক্লিয়াস বা কণাকে আঘাত করার নেশা তাঁদের পেয়ে বসে। তবে এর জন্য চাই আরও গতিশীল কণা। স্বাভিকভাবে বেজস্ক্রিয় রশ্মিতে যে গতিশক্তির কণা থাকে, এরচেয়েও বেশি শক্তির কণা তাঁরা চান। এজন্য চাই কণাকে গতিশীল করার যন্ত্র। যে যন্ত্র বন্দুকের মতো কণাকে ছুড়েই শুধু দেবে না। প্রতি মহূর্তে বাড়িয়ে দেবে কণার গতি।
১৯২৫ দুই মার্কিন বিজ্ঞানী জি ব্রাইট ও এমটুভে তাঁদের সহযোগিদের নিয়ে একটা টান্সফর্মার তৈরি করলেন। এই ট্রান্সফর্মারের সাহায্যে কণাকে ত্বরিত করার উপায় তাঁরা বের করেন। কিন্তু খুব বেশি সফলতা পাননি। তারপর একদল জার্মান বিজ্ঞানী প্রোটন ত্বরক যন্ত্র তৈরি করেন। ত্বরিত প্রোটন দিয়ে তাঁরা পরমাণুর নিউক্লিয়াসকেও ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন এ ব্যাস্ক ও এফ ল্যাংলে। তাঁদের ত্বরক যন্ত্র কতটুকু সফল হত কে জানে, মাঝপথেই থেমে যায় তাঁদের কর্মকাণ্ড। বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান একজন পদার্থবিদ।
কৃত্রিম ত্বরকযন্ত্র দিয়ে প্রথম সফলভাবে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভাঙতে সক্ষম হলেন দুই বৃটিশ বিজ্ঞানী ডগলাস ককক্রফট ও আর্নেস্ট ওয়ালটন। তারা ক্ষরণ যন্ত্রে উচ্চ বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্য তৈরি করে কণাকে উচ্চ শক্তিতে ত্বরিত করতে সক্ষম হন। অতি উচ্চ বিভব পার্থক্য তৈরির জন্য তাঁরা একটা শক্তিশালী ট্রান্সফরমার বানালেন। সেটার বিভিব ছিল ২ লাখ ভোল্ট! সত্যিকার অর্থে এটাই ছিল প্রথম শক্তিশালী ও সফল কণা ত্বরকযন্ত্র।
এরপরই কণা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব কণাত্বরক যন্ত্রের মহানায়ক আর্নেস্ট অরনাল্ডো লরেন্সের। নরওয়েজিন বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম এই মার্কিন বিজ্ঞানীর যতটা ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ঝোঁক, তার অনেক বেশি ঝেৎাক ছিল যন্ত্রপাতির প্রতি। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে যোগদেন ১৯২৮ সালে। সেখানকার লাইব্রেরির একটা জার্নাল পড়তে গিয়ে তাঁর মাথায় সাইক্লোট্রোন তৈরির চিন্তা আসে। এর আগে যেসব ত্বরক যন্ত্র তৈরি হয়েছির সেগুলো, কণাকে ত্বরিত করত সোজা পথে। লরেন্স ধরলেন একটু ভিন্ন পথ। তার যন্ত্রে ছিল একটা বৃত্তাকার পথ, সেই পথে কণাদের বার বার ঘু্রিয়ে এদের গতি বাড়ানো হয় প্রতিটা বাঁকে। এজন্য একটা বিশেষ উপায় বের করেছিলেন লরেন্স। তার যন্ত্রের ভেতর তৈরি করেছিলেন উচ্চ শক্তির চৌম্বক বলক্ষেত্র। চুম্বকক্ষেত্রর ভেতর রাখা ঞয় একটা আয়ন উৎস। উৎসটা এমনভাবে রাখা হয় তা থেকে নির্গত কণার কণার চৌম্বকক্ষেত্রের বলরেখার লম্বভাবে ছুটবে। কিন্তু চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে সে আর সোজা পথে চলতে পারবে না। তার চলার পথ হবে বৃত্তাকার। এরপর পড়বে এসি কারেন্টের পাল্লায়- জলন্ত উনন থেকে ফুটন্ত কড়াই আরকি। বৃত্ত পথে এই কারেন্টের বিদ্যুৎক্ষেত্র ভেতর চলতে গিয়ে পড়বে এর কম্পাংকের ধাক্কায়। কণাকে বৃত্তপথে ছুটতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হবে মুহূর্মুহূ বিদ্যৎ কম্পােঙ্কের পাল্লায়। কম্পন পথের ব্যস প্রতিবার অতিক্রম করার সময় বাড়বে কণার বেগ। প্রতি সেকেন্ডেই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কম্পন, কণার বেগও তাই হুহু করে বাড়বে। লাভ করবে প্রবল গতিশক্তি। সেই পরাক্রমশালী কণা দিয়ে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে আঘতে করলে কী ঘটবে ভাবা যায়! ভেঙে চুরমার হবে নিউক্লিয়াস মুক্ত হবে বিপুল পরিমাণ শক্তি। এটাই ছিল লরন্সের সাইক্লোট্রনের মূলনীতি। আজকের এলএইচসির মতো সাইক্লোট্রনেও এই মূলনীতি মেনে চলা হয়।
লরেন্স প্রথম যে সাইক্লোট্রন তৈরি করেন সেটার ব্যাস ছিল কয়েক ইঞ্চি মাত্র। এর পর একের পর এক সাইক্রোট্রনের তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিজ্ঞানীরা। ১৯৩৯ সাল নাগাদ সাইক্লোট্রনের ব্যাস গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৫ ইঞ্চিতে। এস সাইক্ল্রোট্রনে সাহায্যে ভারি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে তৈরি হলো না ধরনের আইসোটোপ। আর এই যন্ত্রের বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৩৯ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান লরেন্স।
এরপর বাজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যক্তরাষ্ট্র আর জার্মান বিজ্ঞানীরা তখন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর সেকাজে বড় সহায়ক হয়ে ওঠে কণা ত্বরকযন্ত্র। আর মার্কিন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির অগ্রগামী নায়ক রবার্ট ওপেনহাইমর। সেও বন্ধু লরেন্সে অনুরোধ ও সুপারিশে।
যুদ্ধের পর কণা পদার্থবিজ্ঞান প্রাণ ফিরে পায়। আর গবেষণাও চলে যায় বিগ সায়েন্সেরে দখলে। একের পর এক কণার ভবিষ্যদ্বাণী করছেন বিজ্ঞানীরা; কিন্তু সেগুলোর হদিস পাওয়ার জন্য চায় কণাদের মধ্যে সংঘর্ষ। এখন আর নিউক্লিয়াসকে কণা দিয়ে আঘাত করলে চলবে না। কিন্তু অতি হালকা এসব কণা একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষ করবে কনে? তাছাড়া সমচার্জের কণারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। তাহলে?
সংঘর্ষ ঠবে যদি সাইক্লোট্রনে কণাদের গতি কয়েক হাজর গুণ বাড়ানো যায়। সেই পরিমাণ গতিতে কণা ছুড়ে দেওয়া লরেন্সের সাইক্লোট্রনের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সেসময় প্রচলিত কোনো ত্বরক যন্ত্রের পক্ষেই। সত্তর দশকের শেষ দিকে আবদুস সালাম, স্টিভেন ওয়েনবার্গ আর শেলডন গ্ল্যাশোরা দুর্বল নিউক্লিয় বল আর বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলকে তাত্ত্বিকভাবে একত্রিত করতে সক্ষম হলেন। দুই বলের মিলনে জন্ম হলো তড়িৎদুর্বল বলের। আর এই বলের বাহক কণা W-, W+ এবং Z0 কণা। ইউরোপিয়ান কণা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্নের বিজ্ঞানীরা ১৭৪ সালের মধ্যে আবিষ্কার করে ফেললেন এই কণাগুলি। আর্ এই কাজের কাজী সার্নের শক্তিশালী কণা ত্বরকযন্ত্রগুলি। তখন সার্নের বিজ্ঞানীদের চোখ উঠে যায় আরও পরে। বস্তুর ভরের জন্য দায়ী যে কণা, সেই হিগস বোসন বা ইশ্বর কণার ইঙ্গিত ছিল আগেই। কিন্তু সেই কণা পেতে হলে যে পরিমাণ শক্তির দরকার, কণাকে সংঘর্ষ ঘটাতে যতটা ত্বরণের দরকার, সেই শক্তি বা ত্বরণ দান করার কষ্শতা তখনকার কণা ত্বরক যন্ত্রগুলো ছিল না। দরকার এরচেয়ে লক্ষকোটি গুণ শক্তিশালী সাইক্লোট্রন। আর সেজন্য সার্নের বিজ্ঞানীরা ভাবলেন এলএইচসির অর্থাৎ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। নামের মধ্যেই রয়েছে বিশালত্বের আভাস। কয়েক ইঞ্চি ব্যাস নিয়ে যে সাইক্লোট্রনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এলএইচসিতে গিয়ে দাঁড়ায় ২৩ কিলোমিটার পরিধিতে। কিন্তু এত বিশাল দক্ষযজহ্ঞের আয়োজনটা সহজ ছিল। তাছাড়া টাকাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখ রাঙানিতে থমকে শুরুর আগেই হোঁট খেয়েছিল এলএইচসির পরিকল্পনা।
জেড জিরো বোসন আবিষ্কারের পর নড়েচড়ে মার্কিন কণাবিজ্ঞানীরা। কণা আবিষ্কারের সাফল্য একের পর ঘর এক ঘরে তুলছে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের ভৎাড়ার পরিণত হতে চলেছে শূন্য কলসিতে। এ অবস্থান থেকে উত্তরণের উপায় এলএইচসি তৈরির আগেই এর চেয়ে বড় সাক্লোট্রন তৈরি করা। এর তড়িঘরে করে শুর হয় এসএসি প্রকল্প। অর্থাৎ সুপারকন্ডাক্টিং সুপার কোলাইডার। পরিধি ৮৭ কিলো, এলএচসির মতো এটাও বসানোর পরিকল্পনা ছিল মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে। রাশি রাশি টাকা ঢেলে শুরুও হয় কাজ। কিন্তু নোংরা রাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে মাঝপথেই পণ্ড হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কণা ত্বরক যন্ত্রের কাজ।
এএসসির ডামাডোলে থমকে গিয়েছিল এলএইচসির শুরুর কাজ। কিন্তু ওটার বাতিলে আবার আশা দেখলেন সার্নের বিজ্ঞানীরা। জোর কদমে শুরু হলো এলএইচসি প্রকল্পের কাজ। প্রায় দুই দশকের নির্মাণ কাজ শেষে ২০০৮ সালে চালু হয় এলএইচসি। এরপরই শুরু ঞয় হিগস বোসন আবিষ্কারের তোজড়। এলএইচসি’র সাইক্লোট্রনে প্রবল গতি নিয়ে প্রোটন কণার স্রোত ছুটে যায়, ধাক্কা মারে একে অপরকে। তা থেকে তৈরি হয় বহুরকমের কণা। কিছু ভারী কণাও তৈরি হয়। তবে তা অস্থায়ী। দ্রুতই সেই কণা কয়েকটা হালকা কণার জন্ম দিয়ে নিজে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিগস কণার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটার কথা। সাইক্লোট্রনে জন্ম নেয়া নানা ধরনের কণাকে পর্যবেক্ষণ করে, তাদের উৎস যে অন্য কণা নয়, হিগ্স কণা, এটা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল পদার্থবিদদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
২০১২ সালের ৪ জুলাই জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এলএইচসির পড়্গ থেকে জানানো হয়, হিগস বোসন কণার অসিত্মত্ব প্রাথমিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ওই সম্মেলনে একথাও বলা হয়, হিগস বোসন প্রাপ্তি সম্পর্কে মোটমুটি নিশ্চিত হলেও শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন কণা। তবে এই সন্দেহের কফিনে এলএইচসির বিজ্ঞানীরা শেষ পেরেক ঠোকেন ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ ইতালির এক সম্মেলেনে। তাঁরা এখন শতভাগ নিশ্চিত নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন। হিগস বোসন আবিষ্কারে সাথে সাথে বিজ্ঞান জগতে খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত। মেলে ‘বস্তুর ভরের উত্স কী’ প্রশ্নের উত্তর। সেই সঙ্গে মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনের জন্য যে মহামিলনের পথ খুঁজনে বিজ্ঞানীরা, সেই দিকেই বিজ্ঞানীদের এক ধাপ এগিয়ে দেয় কণা ভাঙনের এই যন্ত্র। তাই ভাঙনের বাশিতেই আজ আমরা শুনছি মিলনের গান।