কোয়ারাইন্টাইনে থেকে আমাদের মানসিক ও শারীরিক উভয়েরই পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ওজন বৃদ্ধি।
করোনাভাইরাসের জন্য সবাই এখন লকডাউনে সারাদিন খেয়ে, ঘুমিয়েই কেটে যায় সময়।খেয়ে, বসে, শুয়ে আপনার বেড়ে যাচ্ছে ওজন। আর ওজন বাড়া মানেই রোগের উৎপত্তি।এছাড়া অনেকেই সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরবেলা ঘুমোতে যাচ্ছেন। এইযে সুস্থ জীবনযাপনে আসলো কিছু বিপত্তি, তার সমাধানে আমার আজকের পর্ব কীভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন।
প্রথমেই বলি সেসকল খাবার যা আপনার সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করবে –
মধু-লেবুর পানি
ঘুম থেকে উঠেই এক গ্লাস খুব হালকা কুসুম পানির সঙ্গে মধু ও লেবু মিশিয়ে পান করুন। খালিপেটে এই পানীয়টি খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি আপনার শরীরের ওজন কমানোর পাশাপাশি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন) বের করতে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
পানি
নিজেকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে ভুলবেন না। এটি আপনাকে অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকিং থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করে এবং ত্বক, হজম ইত্যাদির জন্য ভাল। অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বাঁচতে খাওয়ার ৩০মিনিট আগে ১-২ গ্লাস পানি পান করুন।
গ্রিন টি
মানসিক চাপ ও ওজন কমানোতে সাহায্য করে এমন একটি পানীয় হচ্ছে গ্রিন টি। ডা. নিকো বলেন, ‘গ্রিন টি এর প্রধান সক্রিয় পুষ্টি হচ্ছে অ্যামাইনো অ্যাসিড এল-থিয়েনিন।’
বায়োকেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল বুলেটিনে প্রকাশিত গবেষণায় পাওয়া গেছে, লো ক্যাফেইন গ্রিন টি এর এল-থিয়েনিনমস্তিষ্কের ওপর ঘুমাচ্ছন্ন প্রভাব না ফেলেই মনকে শিথিল করতে পারে এছাড়াও গ্রিন টি তে উপস্থিত কেটাচিন পেটের মেদ ঝরাতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
তাই সকাল বেলা ব্রেকফাস্টের আগে এক কাপ চিনি ছাড়া গ্রিন টি পান করে নিলেন।
ওটমিল
২০১৬ সালে জার্নাল অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সেসে প্রকাশিত রিভিউ গবেষণা অনুসারে, এক বাটি উষ্ণ ওটমিল শিথিলতা ও প্রশান্তির মাত্রা যোগ করতে পারে।
ডা. দেবজি বলেন, ‘জটিল কার্বোহাইড্রেট খেলে সেরোটোনিনের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই কেমিক্যালটি স্ট্রেস হরমোন হ্রাস করে।’ ওটস হচ্ছে ট্রিপ্টোফ্যানের ভালো উৎস, যা শরীরে সেরোটোনিনে রূপান্তরিত করে। এছাড়াও এটি ফাইবার, আয়রন, প্রোটিন ও ভিটামিন যুক্ত একটি খাবার। ওটসে থাকা ভিটামিন-বি ও কার্বোহাইড্রেট হজমে সাহায্য করে। এছাড়াও কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
মৌসুমী ফল
যতটা সম্ভব মৌসুমী ফল অন্তর্ভুক্ত করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ২-৩ টি ফল রাখার অভ্যাস করুন। বিশেষ করে টক ফল যেমন – আমড়া, জাম্বুরা, লেবু এছাড়াও ভিটামিন-সি যুক্ত ফল যেমন- আমলকি, পেয়ারা ইত্যাদি। এছাড়াও আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল তো রয়েছেই। তবে ছোটো আম ২টিরবেশি কোনো ভাবেই এখন খাবেন না। বেশি আম ওজন বৃদ্ধি করে।
সবুজ শাকসবজি
সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলস ইত্যাদি থাকে। এ সমস্ত শাকসবজি শরীরের গঠন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই রোজ দুপুরের খাবারে এক বাটি করে মিক্স সবজি খান। বিশেষ করে যেসব খাবারে প্রোটিন ও ফাইবার দুই রয়েছে সেগুলি শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই দুপুর এবং রাতের খাবারে নিয়মিত রাখতে পারেন ব্রকলি, কচুশাক, মিষ্টি আলুর শাক, কলমি শাক, পুদিনা পাতা, পুঁইশাক, মুলা শাক, ডাঁটা শাক, লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার আগা-ডোগা শাক, সাজনা, কলার মোচা, ঢেঁড়স, ডাঁটা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, গাজর, শিম, পটল, কচু, বেগুন, বরবটি ও মটরশুঁটি ইত্যাদি।
কার্বোহাইড্রেট কম, প্রোটিন বেশি
যদি আপনি ওজন হ্রাস করার দিকে মনোনিবেশ করে থাকেন তবে ভাল কার্বস এবং খারাপ কার্বসের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হওয়া জরুরী। সাদা রুটি, সিরিয়াল, পাস্তা এবং ডোনাট এবং কেকের মতো চিনির জিনিস আপনার ওজন বৃদ্ধি করে, জটিল কার্বোহাইড্রেট বা পুরো গমের তৈরী খাবারগুলি আপনার খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি মাছ, ডিম, মুরগী রাখতে হবে।
মাছের তেলে থাকে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং মাছে থাকে প্রোটিন, ভিটামিন এবং মিনারেল যা শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট জমতে দেয় না এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। মুরগিতে থাকা ভিটামিন-বি৬ শরীরে বিপাকের মাত্রা উন্নত করে, খাবার হজম করতে সাহায্য করে। তবে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করে।
আপেল
কথায় বলে, ‘একটা করে আপেল খান, আর ডাক্তারের ঠিকানা ভুলে যান!’
আপেলে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা খিদের মাত্রাকে কমায় এবং জমে থাকা ফ্যাট দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও আপেল ভিটামিন এবং মিনারেল যুক্ত হওয়ায় ওজন কমাতে দ্রুতো কাজ করে। তাই রোজ একটি করে আপেল খেতে পারেন তবে মিষ্টি লাল আপেল নয়, সবুজ একটু টক আপেল।
অ্যাভোকাডো
এই ফলটা একটু দামি ঠিকই। কিন্তু নিয়মিত যদি খেতে পারেন, তাহলে যে উপকার পাবেই পাবেন, সেকথা হলফ করে বলতে পারি। আসলে অ্যাভোকাডোতে ফাইবারের পাশাপাশি রয়েছে monounsaturated oleic acidনামক উপকারী ফ্যাট, যা ভুঁড়ি কামতে বিশেষ ভূমিকা নেয়।
দই
হজম ক্ষমতা বাড়লেও কিন্তু ওজন কমে। তাই তো নিয়মিত দই খাওয়া উচিত। কারণ, এতে উপস্থিত উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলি হজম ক্ষমতাকে অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে প্রদাহের মাত্রাও কমে। ফলে মেদ ঝরতে সময় লাগে না। তাই মাস খানেকের মধ্যে যদি ওজন কমানোর ইচ্ছা থাকে, তাহলে প্রতিদিন লাঞ্চের শেষে এক বাটি করে টক দই খেতে ভুলবেন না যেন!
ডিম
ঝটপট ওজন কমাতে চান তো কাল ব্রেকফাস্টে সিদ্ধ ডিম খাওয়া শুরু করেন। ডিমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, যা বহুক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে। ফলে বারে বারে মুখ চালানোর ইচ্ছা আর থাকে না। তাই শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরির প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে। সপ্তাহে ৪দিন কুসুম ছাড়া ও বাকি ৩ দিন কুসুম সহ ডিম খেতেই পারেন।
কলা
ওজন কমানোর ইচ্ছা থাকলে তাহলে ব্রেকফাস্টে নিয়ম করে খান দুয়েক কলা খাওয়া উচিত। ভাবছেন, তাতে কী লাভ হবে? তাহলে জেনে রাখা ভাল যে এই ফলটি পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামে ঠাসা, যা হজমে সহায়ক উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে সাহায্য করে। ফলে মেটাবলিজম রেট এতটাই বেড়ে যায় যে দ্রুত মেদ ঝরতে শুরু করে। তবে টক মিষ্টি যে কলা রয়েছে যেমন – চম্পা কলা, এমন কলা খেতে হবে। আর একটি প্যাকেজ হতে পারে, টকদই-চিড়া-কলা যা রাতে অনায়েশে আপনার চমৎকার খাবার হতে পারে।
আপনার পেটের একটা বন্ধু আছে নাম ডায়েটিশিয়ান। খাবারের চার্ট করতে তার সাহায্য নিন।
রাত ৮-৯ মধ্যে রাতের খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। আপনি ঘুমানোর কয়েক ঘন্টা আগে যদি বেশিরভাগ খাবার খান তবে আপনার শরীর আরও ভাল হজম করতে সক্ষম হয়। স্বাস্থ্যকর ওজন -পরিচালনার জন্য ভাল হজম গুরুত্বপূর্ণ।
দিনে লিটারচারেক পানি খাবেন, এতে করে দেহে ওয়াটার রিটেনশন হওয়ার আশঙ্কা কমে, যে কারণে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য হয়।
অতিরিক্ত আম খাওয়া থেকে বিরতো থাকুন।
আপনার বড় খাবারগুলি একাধিক ছোট খাবারে ভাগ করুন। কারণ মনের ক্ষুধা বড় ক্ষুধা। উদাহরণ – যখন ছোটো প্লেটে খাবার নিবেন, সাইন্টিফিকেলি আপনার কাছে মনে হবে বেশি খেয়ে ফেলেছেন। আর এই কাজটি আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করবে কিন্তু।
রেগুলার কাজ করুন। ঘর মোছা, ঝাড়ু দেয়া, টবে পানি দেয়া ইত্যাদি কাজে হাত দিন, ক্যালরি ক্ষয় হবে।
অবশ্যই নিয়ম করে প্রতিদিন ঘরের রুমে দরকার হলে হাঁটুন।
সকাল বেলা ছাদে গিয়ে গায়ে রোদ লাগিয়ে আসুন।
রাত জাগা বন্ধ করুন, আপনার হরমোনাল পরিবর্তন, স্ট্রেস সবকিছু কিন্তু দায়ী এই অনিয়মিতো ঘুম।
পরিবারকে সময় দিন, মেডিটেশন করুন।
দুপুরে রাতে খাবারের পর সালাদ, দই রাখুন।
শাক জাতীয় খাবার রাখুন। রাতে নয়, দুপুরে। তবে যেদিন বেশি খেয়ে ফেলবেন সেদিন শাক রাতেও রাখতে পারেন।
অতিরিক্ত পরিমাণে লবণ ওজন বাড়িয়ে দেয়। অতএব, শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় পরিমাণ লবণ গ্রহণ করতে হবে।