ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের সংগ্রামমুখর জীবনী

0 5
Avatar for alma45
Written by
3 years ago

হোমিওপ্যাথির আবিষ্কারক ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের সংগ্রামমুখর জীবনী।

1755 সালের 10 এপ্রিল মধ্যরাতে জার্মান দেশের অর্ন্তগত মিসেন শহরে এক দরিদ্র চিত্রকরের গৃহে জন্ম হয়েছিল হ্যানিমানের। অবহেলা আর দারিদ্রের মধ্যেই বড় হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেদিন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে এই শিশুটি একদিন হয়ে উঠবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন ধারার জন্মদাতা । হ্যানিম্যানের বাবা গটফ্রিড চিনামাটির কারখানায় বাসনের উপরে নকশা আঁকার কাজ করতেন। এই কাজে উপার্জন ছিল খুবই কম, তাই অতি কষ্টে তাদের সংসার চলতো। হ্যানিম্যান ছিলেন চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। তার পিতার আশা ছিল হ্যানিমান বড় হয়ে তার সাথেই ছবি আঁকার কাজ করবে , তাকে সাহায্য করবে, তাতে হয়ত সংসারের আর্থিক সমস্যা কিছুটা দূর হবে। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই হ্যানিম্যান ছিল শিক্ষার প্রতি অত্যাধিক আগ্রহ । বাড়িতেই বাবা-মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ করে 12 বছর বয়সে হ্যানিম্যান ভর্তি হলেন স্থানীয় টাউন স্কুলে। অল্পদিনের মধ্যেই তার অসাধারণ মেধার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন তার শিক্ষকরা। গ্রীক ভাষায় তিনি এতটা দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তিনিই প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রদের গ্রীক ভাষা পড়াতেন। টাউন স্কুলের শিক্ষা শেষ করে হ্যানিম্যান ভর্তি হলেন প্রিন্সেস ইস্কুলে। কিন্তু সংসারে ক্রমশই অভাব বাড়ছে। গটফ্রিডের পক্ষে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠছিলো। নিরুপায় হয়ে তিনি হ্যানিম্যানকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে লিপজিক শহরে এক মুদির দোকানে মাল কেনাবেচার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন । কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ এ কথা জানতে পেরে হ্যানিম্যানের স্কুলের সব মাইনে মকুব করে হ্যানিমানকে আবার পড়াশোনা আরম্ভ করালেন। যথা সময়ে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে তিনি উত্তীর্ণ হলেন । হ্যানিমান একাধিক ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। ক্রমশঃ তার মধ্যে উচ্চশিক্ষার আকাঙ্খা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছিলো। তিনি লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। হাতে সম্বল ছিলো মাত্র ২০ খেরল, মানে আমাদের দেশের ১৪ টাকার মতন। নিজের খরচ মেটাবার জন্য এক ধনী গ্রীক যুবককে জার্মান এবং ফরাসী ভাষা শেখাতেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশকের তরফে অনুবাদের কাজ করতেন।

হ্যানিম্যানের ইচ্ছা ছিল চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করবেন । তখন কোন ডাক্তারের অধীনে থেকে কিছুদিন কাজ শিখলে তবেই চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করার সুযোগ হতো। কিন্তু লিপজিগে কোন ভাল ডাক্তার না থাকায় তিনি ভিয়েনাতে ডাঃ কোয়ারিনের কাছে কাজ করার সুযোগ নিয়েছিলেন। তখন তার বয়স মাত্র বাইশ বছর, আর ইতিমধ্যেই তিনি ইংরাজী, আরবি, স্পানিশ , হিব্রু, লাটিন, এবং জার্মান ভাষায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন। এবার ভাষাতত্ত্ব ছেড়ে শুরু হলো চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন।

দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় তার সামান্য গচ্ছিত অর্থ একদিন সব চুরি হয়ে গেল। নিদারুণ অর্থ সংকটে পড়লেন তিনি। এই বিপদের দিনে তাকে সাহায্য করলেন স্থানীয় গভর্নর। তাকে তার লাইব্রেরী দেখাশোনার ভার দিলেন হ্যানিম্যানকে। এই সুযোগটিকে পুরোপুরি সদব্যবহার করেছিলেন তিনি । এক বছর নয় মাস, থাকাকালীন এই লাইব্রেরির প্রায় সমস্ত বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন । এখান থেকে হাতে কিছু অর্থ এলে তিনি ভর্তি হলেন আরল্যানজেন

বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি ২৪ বছর বয়সে ডাক্তারী পাশ করে অর্জন করলেন M. D. বা ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রী। এক বছর প্রাইভেট প্রাকটিস করলেন, তারপর জার্মানীর এক হাসপাতালে চাকরি নিলেন।

অন্য সব বিষয়ের মত রসায়নের প্রতি হানিমানের ছিল সবচেয়ে বেশী আগ্রহ। সেই সুত্রেই হেসলার নামে এক ঔষধের কারবারীর সাথে তার পরিচয় হয়। নিয়মিত তার বাড়িতে যাতায়াত করতে হত তাকে। হেসলারের সাথে থাকতেন তার পালিতা কন্যা হেনরিয়েটা। হেনরিয়েটা ছিলেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং আকৃষ্টমনা। অল্পদিনেই তাই দুই তরুন-তরুনী পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৭৮২ সালের ১৭ই নভেম্বর দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। হ্যানিম্যানের বয়স তখন ২৭, এবং হেনরিয়েটার ১৮।

এই সময় হ্যানিম্যান রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রচনা প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। এই সময়ে বেরুলো তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা--- " কিভাবে ক্ষত এবং ঘা সারানো যায়, সে বিষয়ে নির্দেশনামা "। সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন বই অনুবাদের কাজেও নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। সে যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অন্য বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন না, কিন্তু হ্যানিমানের আগ্রহ ছিলো বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে রসায়ন শাস্ত্রের উপরে বেশী জ্ঞাণ অর্জন করা। তাই তিনি রসায়ন বিদ্যার প্রতি অত্যাধিক আকৃষ্ট হয়েছিলেন । পারদকে অন্য ফর্মে এনে সলুবেল করে আবিষ্কার করলেন Mercurius Solubilis । এই সময়ে তার লেখা আর্টিকেল--On Arsenic Poisoning গবেষণার জগতে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়েছিলো। রসায়নের জগতে তাঁর গবেষণা তখন যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিলো। তার নাম যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এই সময় ফরাসি ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় একাধিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলি ছিলো---দুই খন্ডে---The Art of Manufacturing Chemical products, দুই খন্ডে----The Art of distilling liquors , ইত্যাদি ।

এই সময় কিছুদিন তিনি টাউন হাসপাতালে চাকরী নেন। হঠাৎ ঐ হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার ডাঃ ওয়াগলার অসুস্থ হলে পুরো হাসপাতালের দায়িত্ব এসে পড়ল হ্যানিম্যানের উপর । যেমন প্রচুর রোগী দেখতে থাকলেন, তেমনি দিনের পর দির বীতশ্রদ্ধ হতে থাকলেন তৎকালীন বিদঘুটে আনাড়ী হ্যাপাজার্ড চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে।

মন থেকে সায় দিচ্ছিল না ঐ সব বিসম চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা করতে।

মনের মধ্যে তাই অনবরত চিকিৎসা সংক্রান্ত নতুন কিছু উদ্ভাবনের স্বপ্ন ধীরে ধীরে জেগে উঠছিলো। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন সমস্ত দিন হাসপাতালে পড়ে থাকলে মনের ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব হবে না। ছেড়েই দিলেন তাই হাসপাতালের চাকরীটা। কিন্তু জীবিকা নির্বাহ ত করতে হবে। কয়েকটি পুত্র কন্যারও পিতা হয়ে গেছেন। সেইজন্য তখন থেকে তিনি তার রিসার্চ ওয়ার্কের ফাঁকে ফাঁকে অনুবাদের কাজে হাত দিলেন কিছু উপার্জন করার জন্য।

অাসলো সেই দিন। ১৭৯০ সালের একদিন। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাঃ উইলিয়াম কালেনের একটি ইংরাজী মেটিরিয়া মেডিকা ইংরাজী থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদের কাজে হাত দিলেন। এই বইয়ের একটি অধ্যয়ের পাদটিকায় লেখা ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের ঔষধ কুইনাইন যদি কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা যায় , তবে অল্প দিনের মধ্যেই তার শরীরে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবে ।

উইলিয়াম কালেনের এই অভিমত হ্যানিম্যানের চিন্তা জগতে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করল। তিনি এর সত্যাসত্য পরীক্ষার জন্য নিজেই প্রতিদিন চার ড্রাম করে দিনে দুইবার সিঙ্কোনার রস খেতে আরম্ভ করলেন। এর তিন চারদিন পরে সত্যি সত্যিই তিনি ম্যালেরিয়ার মতন কাঁপুনি জ্বরে আক্রান্ত হলেন। এরপর পরিবারের প্রত্যেকের উপর তিনি এই একই পরীক্ষা করলেন এবং প্রতিবারই একই ফলাফল পেলেন। এর থেকে তার মনে প্রশ্ন জেগে উঠল , কুইনাইনের মধ্যে কি তাহলে ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ সৃষ্টিকারী কোন ক্ষমতা আছে? যদি থাকে, তাহলে নিশ্চয় অন্য সমস্ত ঔষধের মধ্যেও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ যে ঔষধ খেলে মানুষের কোন রোগ নিরাময় হয়, সুস্থ দেহে সেই ঔষধ খেলে ছিল নিঃসন্দেহে সেই রোগ সৃষ্টি হয় ।

এতদিন চিকিৎসকদের ধারণা ছিল বিরুদ্ধভাবাপন্নতাই বিরুদ্ধভাবাপন্নকে অারোগ্য করে। অর্থাৎ মানুষের দেহে অসুস্থ অবস্থায় যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায় তার বিপরীত ক্রিয়াশক্তি সম্পন্ন ঔষধই সেই রোগ আরোগ্য হয়। এই প্রচলিত মত তিনি খন্ডন করতে চাইলেন। এই পুরানো মতের বিরুদ্ধে শুরু হলো তার নতুন গবেষণা।

এই সময় তিনি যাযাবরের মতন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্থায়ী কোন আস্তানা গড়ে তুলতে পারেননি।

এমন সময় জার্মানীর ডিউক একটি মানসিক রোগের চিকিৎসালয় খোলার জন্য তার বাগানবাড়িটি হ্যানিম্যানকে ছেড়ে দিলেন। ১৭৯৩ সালে হ্যানিম্যান সেখানে একটি মানসিক রোগীদের হাসপাতাল গড়ে তুললেন, এবং একাধিক মানসিক রোগীকে সুস্থ করে তুলতে লাগলেন। ঐ সময় মানসিক রোগীদের উপর কঠোর নির্যাতন করা হত। শারীরিক নির্যাতন কে মানসিক রোগীদের চিকিৎসার প্রধান অঙ্গ বলেই মনে করা হত। হ্যানিমান সেই সময় পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি, যিনি ঐ সব বর্বর প্রথার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন।

কিন্তু তার গবেষণার কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে, মানসিক হাসপাতালে সারাটা দিন নষ্ট হচ্ছে, তার নিজের গবেষণাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কিছুদিন মানসিক হাসপাতালে থাকার পর তিনি আবার এই চাকরীটাও ছেড়ে দিলেন।

ইতিমধ্যে আটটি সন্তান হয়েছে। সংসারে দারুন অার্থিক অনটন। কিন্তু তা সত্তেও গবেষণার কাজে তিনি সামান্যতম বিঘ্ন ঘটান নি। একদিকে যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন, তেমনি অন্যদিকে নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজনে নিজেই বিভিন্ন রকম ঔষধ খেতে থাকলেন। এ কারনে বহুবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু তা সত্তেও গবেষণার কাজ থেকে তিনি কখনও বিরত থাকেননি ।

১৭৯০ থেকে ১৭৯৬, দীর্ঘ ৬ বছরের অক্লান্ত গবেষণার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে যথার্থই সদৃশ সদৃশকে আরোগ্য করে। বিরুদ্ধভাবাপন্ন বিরুদ্ধভাবাপন্নতাকে আরোগ্য করে না। তার এই ধারণা কোন অনুমান বা কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, এ সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো সত্যের এক স্বচছ সরোবর।

তার এই আবিষ্কার ১৭৯৬ সালে সে যুগের জার্মানীর একটি বিখ্যাত পত্রিকা হুফল্যান্ডস জার্নালে প্রকাশিত হল । প্রবন্ধটির নাম দেওয়া হল- এ্যান এসে অন এ নিউ প্রিন্সিপ্যল ফর এ্যাসারটেনিং দ্য কিওরেটিভ পাওয়ারস অব ড্রাগস এ্যান্ড সাম এক্সামিনেশন অফ দ্য প্রিভিয়াস প্রিন্সিপলস। ( An essay on a new principle for ascertaining the curative powers of drugs, and some examination of the new principles).

এই প্রবন্ধের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন হ্যানিম্যান। সেই কারনে 1796 সালকে বলা হয় হোমিওপ্যাথির জন্ম বর্ষ। হোমিওপ্যাথি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রীক শব্দ হোমোস (Homoeos), এবং প্যাথোস ( Pathos), --- অর্থাৎ রোগ লক্ষনের সম লক্ষন বিশিষ্ট ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা ।

হ্যানিম্যানের এই যুগান্তকারী প্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে চিকিৎসা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হল । চিকিৎসা জগতের প্রায় সকলেই এই মতের ঘোরতর বিরোধী হয়ে উঠলেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তীব্র সমালোচনা মূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে আরম্ভ হলো। তাকে বলা হল অশিক্ষিত হাতুড়ে চিকিৎসক।

কিন্তু নিজের আবিষ্কৃত সত্যের প্রতি তার এতটা অবিচল আস্থা ছিল যে কোন সমালোচনাতে তিনি সামান্যতম বিচলিত হলেন না। নিজের এবং অাত্মীয়স্বজনের উপরে চালাতে থাকলেন বিভিন্ন ঔষধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তার মনে হয়েছিল সুস্থ মানব দেহের উপর ঔষধ পরীক্ষা করেই তার ফল উপলব্ধি করা সম্ভব। ঔষধের মধ্যে যে আরোগ্যকারী শক্তি আছে তা জানতে হলে সেই সব ঔষধ সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষা করতে হবে, এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই । সাধারণ পরীক্ষায় বা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে কোন ঔষধের সাধারন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝা যেতে পারে , কিন্তু মানুষের উপরে কিভাবে তা প্রতিক্রিয়া করবে তা জানবার জন্য মানুষের উপরে পরীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।

এইভাবে একের পর এক ঔষধ পরীক্ষা করে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করলেন, যা সিমপটমস সংগ্রহ করলেন, তার ভিত্তিতে বিভিন্ন বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়েও এযাবত যে ২৭ টি ঔষধ পরীক্ষা করতে পেরেছেন , ১৮০৫ সালে ল্যাটিন ভাষায় তা প্রকাশ করলেন একটি বই আকারে, যার নাম দিলেন --- Fragmenta de viribus medicamentorum positivis, sive in sano corporae humano observatis। এই বইটিকে তাই প্রথম হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা, বা ভেষজ লক্ষণ সংগ্রহ বলা যেতে পারে । এরপর থেকে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আরম্ভ করলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তার পরীক্ষিত সত্যকে যতক্ষণ না রোগীর রোগ চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তা জনগণের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করতে সক্ষম হবে না। এই সময় তাকে রোগী দেখা, চিঠিপত্র লেখা, গবেষণার কাজ, এবং এছাড়া বই লেখার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত।

প্রতিদিন ভোর ছয়টায় তিনি ঘুম থেকে উঠতেন। সকালের জলখাবার ছিল দুই কাপ দুধ । তারপর কিছুক্ষণ বাগানে পায়চারি করে চেম্বারে চলে যেতেন। দুপুরবেলা বাড়ী ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। তার এই বিশ্রামের সময় টুকু কড়া পাহারায় রাখতেন তার মেয়েরা। কারণ, সামান্য সময় পেলেই আবার চিঠিপত্র লেখার কাজ শুরু করে দিতেন। অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই আবার রোগী দেখতে চলে যেতেন। সন্ধ্যা অবধি চলত তার রোগী দেখা। তারপর বাড়ী ফিরে এক কাপ গরম দুধ আর রাতের খাওয়া সেরে চলে যেতেন পড়ার ঘরে। মধ্য রাত, কোন কোন সময় শেষ রাত অবধি চলত চিঠিপত্র লেখা, বই লেখা এবং ঔষধ বানানো।

১৮১০ সালে প্রকাশিত হলো তার বিখ্যাত বই অর্গানন অব মেডিসিন। এই বইকে বলা হয় হোমিওপ্যাথির বাইবেল। এই বইতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির নীতি ও বিধান সমূহের বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অার অকাট্য যুক্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন তার প্রতিটি অভিমত। এই বইয়ে হোমিওপ্যাথিক মূলনীতির আলোচনা ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসা প্রণালী আলোচনা করে তিনি হোমিওপ্যাথির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এছাড়াও সেযুগে চিকিৎসার নামে যে ধরনের অমানুষিক কার্যকলাপ প্রচলিত ছিল তার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র ভাষায় সমালোচনা করলেন।

১৮১০ সালের এপ্রিল মাসে অর্গানন অব মেডিসিন বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে তুমুল সমালোচনা আর বিতর্কের ঝড় বইতে আরম্ভ হলো। তার উপর শুরু হল নানা রকম মানসিক নির্যাতন ।

তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হতে থাকলো বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালের মাধ্যমে, বই লিখে, প্যামফ্লেট বা ছোট ছোট পুস্তিকা পাবলিশ করে, গ্রামে গঞ্জে টিন বাজিয়ে ঢেঁড়ি পিটিয়ে। ১৮১০ সালের জুন মাস থেকে ডাঃ হেনরো নামে একজন মাসিক জার্নাল বের করা শুরু করে দিল --" এ্যান্টি অর্গানন ", নাম দিয়ে। ডাঃ সিমসন নামে একজন ডাক্তার আরও একটি জার্নাল বের করা শুরু করে দিল, " এ্যান্টি হোমিওপ্যাথিক আর্কিভ ", নাম দিয়ে। হুফল্যান্ড, যে একদা তার প্রিয় বন্ধু ছিলেন, যার ম্যাগাজিনেই তিনি ১৭৯৬ সালে An essay ------ পাবলিশ করেছিলেন, সে এখন তার জার্নালের প্রতিটি সংখ্যায় হ্যানিম্যানকে তীব্রভাবে আক্রমন করতে লাগলেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেকার সাহেব১৮১৯ সালের জুলাই মাসে, ১০০ পৃষ্ঠার উপরে একটি বই বের করলেন-- হ্যানিমান ও হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে। দেমাকি নামে একজন বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ রসায়নবিদ, যার রসায়ন শাস্ত্রের বই হ্যানিমান মাত্র ২১ বছর বয়সে জার্মান ভাষায় অনুবাদ এবং পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত করে দেমাকের কাছ থেকে ভীষণভাবে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন, সে লিখলো,---" এই লোকটার রসায়ন শাস্ত্রে যা দক্ষতা ও পান্ডিত্য ছিলো তাতে হতে পারতো একটা বড় রসায়নবিদ, কিন্তু কি দূর্ভাগ্য, সে একটা হাতুড়ে ডাক্তারের ভূমিকায় নিজেকে নামিয়ে নিয়ে গেল।

এ্যাপোথিকারী গিল্ড নামে জার্মানীর কেমিস্ট এ্যান্ড ড্রাগিষ্ট এ্যাসোসিয়েশন গভঃ র কাছে আবেদন জানালো -- ঐ ছিটিয়াল, মূর্খ, অসভ্য লোকটার অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা ও কাজকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। গভঃ তাদের কথা শুনলেন, এবং হ্যানিম্যান ও তার ৬ জন ছাত্রকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তৈরী, ও বিতরন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। সব ছাত্রদের ঔষধ এবং ঔষধ বানানোর সরঞ্জাম সরকারী তত্ত্বাবধানে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল। একজন ছাত্রের জেল হলো।

১৮২০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী হ্যানিমানকে সশরীরে লিপজিক কোর্টে হাজিরা দিয়ে তার চার্জের বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে বলতে বলা হল।

হ্যানিমান জানতেন যারা নতুন কিছুর আবিষ্কারক তাদের সকলকেই এই ধরনের অত্যাচার সইতে হয়। এই ব্যাপারে তিনি প্রথম ব্যক্তি নন, শেষ ব্যক্তিও নন। নিজের উপর তার এতখানি আত্মবিশ্বাস ছিল যে ১৮১৯ সালে যখন তিনি অর্গাননের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত করেন বইয়ের প্রথমে লিখলেন Aude Sapare, যার অর্থ--- আমি নিজেকে সাহসী বলে ঘোষণা করছি, সত্যের জন্য আমি নির্ভীক। এই ভাবে তিনি তৎকালীন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তীব্র ভাবে অথচ শালীনতা বজায় রেখে প্রতিবাদ জানালেন।

হ্যানিম্যানের জীবদ্দশায় অর্গাননের আরও চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিটি সংস্করণে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত থেকে উন্নততর রুপে নিয়ে যাওয়ার থিওরি দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক হ্যানিম্যানকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নতুন আবিষ্কার সম্মন্ধে বলার বা পড়ানোর জন্য নিয়োগে সচেষ্ট হলেন, কিন্তু অধ্যাপকদের একাংশ এই কাজে বাধা সৃষ্টি করতে থাকলেন। প্রবল বাধাদান সত্বেও হ্যানিম্যানকে শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হল। তার বক্তৃতা শোনার জন্য দলে দলে ছাত্ররা এসে ভিড় করলো । সকলেই হানিমানের নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানতে উৎসাহী আর কৌতুহলী হয়ে উঠলো। তখন হ্যানিমান যদিও প্রৌড়ত্বের সীমানায় পৌঁছে গিয়েছেন, তবুও তরুণদের মত তেজোদ্দীপ্ত বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে হোমিওপ্যাথিক তত্ত্বের নানান বর্ণনা দিতে থাকলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশই তার মতবাদকে গ্রহণ করতে চাইল না। কারণ তাদের মধ্যে প্রচলিতকে ছেড়ে নতুন কিছু গ্রহণ করার মতন মানসিকতা সৃষ্টি হল না। সামান্য কয়েকজন ছাত্র হিসেবে হ্যানিমান যাদের পেলেন তারা উত্তরকালে তার চিকিৎসা ব্যবস্থার ধারক-বাহক হয়ে উঠেছিলেন।

এই সময় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তাদের মধ্যে বহু সংখ্যক সৈন্য টাইফাস নামক একটি রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রচলিত কোন চিকিৎসাতেই তাদের রোগের প্রকোপ কমছিল না শেষে হ্যানিম্যানকে চিকিৎসার জন্য ডাকা হয়। তিনি বিরাট সংখ্যক সৈন্যকে অল্প দিনের মধ্যেই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করে সুস্থ করে তোলেন । এতে তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

অস্ট্রিয়ার যুবরাজ সোয়াজেনবার্গ এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় কোন উপকার না পেয়ে শেষে হ্যানিম্যানের কথা শুনে তাকে চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ করেন। হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন, কিন্তু সামান্য সুস্থ হতেই হ্যানিম্যানের নির্দেশ অমান্য করে আবার মদ্যপান করতে আরম্ভ করলেন। হ্যানিমান ক্ষুব্ধ হয়ে তার চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন এবং যুবরাজের চিকিৎসার জন্য আর তার প্রাসাদে গেলেন না। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই যুবরাজ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। এই ঘটনায় অস্ট্রিয়ানদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হল। এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকরা এই সুযোগে হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শুরু করলো এবং যুবরাজের মৃত্যুর জন্য সরাসরি হ্যানিমানকে দায়ী করলো।

আবার পিছনে লাগা, আবার কোর্ট। হ্যানিমানের উপর আবার নিষেধাজ্ঞা জারী করল জার্মান সরকার। হ্যানিম্যানের ঔষধ তৈরীর উপর আবার নিষেধাজ্ঞা জারী হলো। বলা হলো মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর এইসব ঔষধ। হ্যানিম্যান জবাবে শুধু বললেন--- ভবিষ্যতই সঠিক বিচার করবে । সম্মিলিত ভাবে চিকিৎসকরা সবাই তাকে বিরোধিতা করতে আরম্ভ করলেন । তাকে লিপজিক থেকে বহিষ্কারের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন সবাই। হ্যানিম্যান বুঝতে পারলেন তার পক্ষে আর লিপজিগে থাকা সম্ভব হবে না। তার জীবন সংশয়ও হতে পারে। নিরুপায় হ্যানিম্যান ১৮২১ সালের জুন মাসে লিপজিক পরিত্যাগ করে জার্মানীর কোথেন শহরে এসে বাসা ভাড়া নিলেন।

হ্যানিমানের জীবনের প্রতিটি পর্যায় যেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রে পাল ভাঙ্গা একটা নৌকা। চারিদিকে শুধু মানুষের বিদ্বেষ আর ঘৃণা। প্রতি পদক্ষেপে মানুষের অসহযোগিতা আর বিরুদ্ধাচারণ। সংসারে নিদারুন অভাব। কিন্তু এই প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি ছিলেন অটল, নির্বিকার। সংকল্পে ছিলেন পর্বতের মত দৃড়। অসাধারণ ছিল তার মহত্ত্বতা। কারন যে সব চিকিৎসকরা তার বিরুদ্ধাচারণ করতেন, তাদের বিরুদ্ধে কখনও তিনি কোন কটু কথা বলেন নি, ঘৃণা প্রকাশও করেন নি, কোনরকম বিদ্বেষ পোষনও করেন নি।

বরং তিনি লিখলেন-- সকল চিকিৎসকরা আমার ভাই, আমার বন্ধু। তাদের কারুর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই।

তিনি লিখলেন--- সত্যের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ প্রচার মানুষের অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু মানুষের এই অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশের জন্য হোমিওপ্যাথির অগ্রগতি রোধ করা যাবে না।

অবশেষে সুখবর। দূর্যোগের কালো রাতও একসময় শেষ হয়ে ভোরের আকাশের রঙীন বর্ণচছটা দেখে। হোমিওপ্যাথির এই দুর্দিনে হ্যানিম্যানের পাশে এসে দাঁড়ালেন কোথেন শহরের মেয়র ডিউক ফার্দিনান্দ। তিনি কোথেন শহরে হ্যানিমানকে শুধু বাস করার অনুমতি নয়, তার ঔষধ তৈরী করার এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করার অনুমতিও দিলেন। তার ঔষধ প্রস্তুত ও চিকিৎসা করার অনুমতির জন্য যখন ডিউক এর কাছে আবেদন করলেন সেই আবেদন পরীক্ষার দায়িত্ব ছিল তখনকার দিনের একজন নাম করা চিকিৎসক আদম মূলারের উপর। হ্যানিম্যানের সাথে সাক্ষাতের অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন ডাঃ মুলার। তিনি লিখেছেন -- " লাঞ্ছিত, অপমানিত মানুষটিকে দেখে আমার দুই চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। এই মানুষটির দুঃখে আমার হৃদয় বেদনার্ত হয়ে উঠেছিল। আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম আমার সামনে বসে আছে এই শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, ভবিষ্যৎই যার আবিষ্কারের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারবে "।

ডিউক ফার্দিনান্দও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন হ্যানিমানের প্রতিভা। তিনি তাকে শুধু ঔষধ প্রস্তুত করার অনুমতি দিলেন তাই নয়, তাকে রাজসভার চিকিৎসক হিসাবেও মনোনীত করলেন ।

১৮২২ সালে হ্যানিম্যান প্রকাশ করলেন প্রথম হোমিওপ্যাথিক পত্রিকা। এর কয়েক বছর পর প্রকাশ করলেন তার শ্রেষ্ঠ রচনা- ক্রনিক ডিজিজ, দেয়ার নেচার এ্যান্ড হোমিওপ্যাথিক ট্রিটমেন্ট, ------পুরাতন রোগ চিকিৎসা সম্বন্ধীয় চিকিৎসা জগতে এক যুগান্তকারী পুস্তকের সংযোজন। পুরাতন রোগের চিকিৎসা সম্বন্ধে এমন বই ইতিপূর্বে কেউ রচনা করেন নি ।

হ্যানিমান বললেন, সোরা সিফিলিস, এবং সাইকোসিস হল মানবদেহের যাবতীয় রোগের কারণ, এবং এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক হলো সোরা। তার এই অভিমতের বিরুদ্ধে আবার তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হল । তার কিছু প্রিয় ছাত্র ও অনুগামীরা তার এই সব থিওরি বা মতের বিরুদ্ধাচারণ করে তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু চিকিৎসক অনুভব করতে পারলেন হ্যানিমানের কথার ও রচনার গুরুত্ব । কয়েকজন বিখ্যাত এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হোমিওপ্যাথিক শিক্ষার জন্য হ্যানিম্যানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন । আমেরিকা থেকে ডাঃ কন্সট্যান্টাইন হেরিং, ইংল্যান্ড থেকে ডাঃ কুইন এলেন-- হোমিওপ্যাথি শেখার জন্য। পরবর্তীতে এরা সকলেই নিজের দেশে হোমিওপ্যাথির প্রচার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন ।

১৮৩০ সালে হ্যানিম্যানের স্ত্রী হেনরিয়েটা ৬৭ বছর বয়সে মারা গেলেন। তিনি ১১ টি সন্তানের জননী ছিলেন। সমস্ত জীবন হ্যানিমানের পাশে ছিলেন তার যোগ্য সহধর্মিনী হিসাবে। বাইরের প্রতিকূলতার মাঝে হ্যানিমান যখন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন, সংসার জীবনে তখন অফুরন্ত শক্তি সাহস আর ভালোবাসায় পূর্ণ করে দিয়েছিলেন হেনরিয়েটা। হ্যানিমানের জীবনের অন্ধকারময় দিনগুলিতে হেনরিয়েটা ছিলেন তার চলার সঙ্গী, আর হ্যানিমানের জীবনে যখন অন্ধকার দূর হয়ে আলোর আভা ফুটে উঠলো , হেনরিয়েটা তখন হারিয়ে গেলেন চির অন্ধকারের জগতে ।

অবশেষে হ্যানিম্যানের জীবনে এল নতুন বসন্ত। তখন তার বয়স ৮০ বছর। ১৮৩৪ সালের ৮ই অক্টোবর এক সুন্দরী ফ্রেন্স যুবতী, নাম মাদাম মেলানি দূরারোগ্য চর্ম রোগের চিকিৎসার জন্য হ্যানিম্যানর কাছে এলেন। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন আইনমন্ত্রীর পালিতা কন্যা। হানিমানের সাথে সাক্ষাতের সময় তার বয়স ছিলো ৩৫ বছর। মিলানি ছিলেন কবি, এবং শিল্পী । বয়সের বিরাট ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও দুজনে দুজনের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভায় মুগ্ধ হলেন, এবং ১৮৩৫ সালের ১লা জানুয়ারি দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। মিলানি হ্যানিমানকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারীতে নিয়ে গেলেন। সেখানে সরকারীভাবে তাকে ডাক্তারি করার অনুমতি দেওয়া হল।

জীবনের এই অন্তিম পর্বে এসে হ্যানিমান পেলেন-- জীবনব্যাপী সংগ্রামের পুরস্কার ---- খ্যাতি, সম্মান, অর্থ, আরাম, সুনাম, যশ, এবং সাংসারিক সুখ।

ক্রমশঃ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল চারিদিকে। হ্যানিম্যানের জীবদ্দশায় চারটি হোমিওপ্যাথিক কলেজ গড়ে উঠেছিল। তার কয়েকজন ছাত্র প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হিসেবে সুনাম অর্জন করলেন।

৮৮ বছরে পা দিলেন হ্যানিমান। দেহের শক্তি কমে এসেছিলো কিন্তু মনের শক্তি একটুও হ্রাস পায়নি। সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে শেষ রক্ষা হল না ।

১৮৪৩ সালের ২রা জুলাই শেষ রাতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন হোমিওপ্যাথির জনক, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, শ্রেষ্ঠ এক বিজ্ঞানী ।

প্রকৃত মানবপ্রেমী কখনো নিজেকে প্রচার করে না। যদি অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয় তোমার পথ শ্রেষ্ঠ, তবে তা মানব কল্যাণে অবশ্যই নিয়োজিত করবে।

হ্যানিম্যান অত্যন্ত ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বারবার বলেছেন, সব কিছু অর্পণ কর ঈশ্বরকে। সব খ্যাতি অর্পন কর ঈশ্বরকে। তিনি বিশ্বাস করতেন জগতের সব কল্যানকর কাজকর্মের মধ্যে ঈশ্বরের স্পর্শ আছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার দ্বারা মানব কল্যাণে এই হোমিওপ্যাথির অাবিষ্কারও ঈশ্বরের দান। তাই তিনি বলেছেন, " Homoeopathy is a divine art of healing gifted by the gracious God, for the sufferings humanity ".

জীবনের বৃহত্তর অংশ তিনি অতিবাহিত করেছেন অন্যের নিন্দা, সমালোচনা, আর অপমানজনক কথাবার্তা শুনে। প্রতি পদক্ষেপে তাকে সইতে হয়েছে নির্যাতন, অপবাদ, আর গ্লানি। স্বার্থান্বেষী মানুষরা তাকে বারবার গৃহহারা করেছে, ঘরছাড়া করেছে। সারা জীবনে তিনি ৩৬ বার বাসা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। এমন বহু দিন গিয়েছে তিনি ও তার পরিবারের সবার কপালে জল ছাড়া কোন খাবার জোটে নি। সাবানের অভাবে আলু দিয়ে জামা কাপড় পরিষ্কার করেছেন। কনকনে শীতের রাতে ঘরে আগুন জ্বালাবার মত এক টুকরো কাঠ জোটেনি। একটা পাউরুটি ১০ টুকরো করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়েছে। কিন্তু কখনই, কোন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারান নি, এবং সত্য থেকে অবিচল হন নি। ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো তার গভীর আত্মবিশ্বাস।

মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীকে বলেছেন, আমি মানুষের জন্য যা কিছু করেছি সবই ঈশ্বরের অসীম করুণা আর তার শক্তিতে। ঈশ্বরের শক্তিতেই আমি সব করতে পেরেছি। সব কিছুর জন্যেই আমি ঈশ্বরের কাছে চির ঋণী । ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল তার গভীর আত্মবিশ্বাস।

তাই বোধ হয় মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিজের সম্বন্ধে শেষ বাণী উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন--- " আমার জীবন বৃথা যায়নি"।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা হয়।

ভারতে বর্তমানে প্রায় ৭৮৫৬ টি সরকারি হোমিওপ্যাথিক চেম্বার ও ২০৭ টি সরকারি হোমিওপ্যাথিক হসপিটাল আছে, তাছাড়াও অনেক বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক হসপিটাল আছে ।

1
$ 0.00
Avatar for alma45
Written by
3 years ago

Comments