১.তথ্য দিতে রাজি হননি বলে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্লামস্টিডের গবেষণাপত্র কেড়ে নিয়েছিলেন নিউটন
জ্ঞান-বুদ্ধিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বলেই তাঁরা বিজ্ঞানী। তাঁদের অসাধারণ বুদ্ধির জোরেই পৃথিবী এত আধুনিক হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোই মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কাণ্ড করে বসেন। কিছু কিছু কাণ্ড হয়তো অতি বোকারাও করবে না। কিছু অদ্ভুত কাজ আবার স্বজ্ঞানেই করেন স্রেফ মজা করার জন্য। নিউটন কত বড় বিজ্ঞানী, কত বড় মানুষ! কিন্তু তাঁর আচরণ ছিল হিংসুটের মতো। খুব ছোটবেলায় নিউটনের বাবা মারা যান। মা আরেকজনকে বিয়ে করে নিউটনকে ছেড়ে চলে যান। ভীষণ একা হয়ে পড়েন তিনি। এর প্রভাব পড়ে তাঁর ব্যক্তিজীবনে। হিংসুটে ও বদমেজাজি হয়ে ওঠেন। গান, সিনেমা, নাটক, কবিতা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ঘৃণা করতেন। তাই এসব থেকে নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রাখতেন। তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না, বন্ধু আর সহকর্মীদের সন্দেহের চোখে দেখতেন। নিউটন ‘না’ শব্দটা একেবারেই পছন্দ করতেন না। কেউ তাঁর বিরোধিতা করলেও খেপে যেতেন।
নিউটনের বিখ্যাত বই প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা। এটা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বই বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। জন ফ্লামস্টিড অনেক তথ্য দিয়ে নিউটনকে এই বই লিখতে সহযোগিতা করেন। বইয়ের প্রথম সংস্করণের তথ্যসূত্রে একাধিক জায়গায় ফ্লামস্টিডের নাম ছিল। সেই ফ্লামস্টিডকেই নানাভাবে হেনস্তা করেন নিউটন।
বিজ্ঞানী সমাজে নিউটনের তখন বিরাট ক্ষমতা। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে তাঁর দাপট ছিল। রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমির তথ্য-উপাত্ত বিভাগে নিযুক্ত ছিলেন ফ্লামস্টিড। নিউটন তাঁর কাছে ব্যক্তিগত গবেষণার জন্য কিছু তথ্য চান। কিন্তু এসব তথ্য কাউকে দেওয়ার অনুমতি ছিল না। তাই ফ্লামস্টিড সেগুলো দিতে অস্বীকার করেন। এতে নিউটন ভীষণ চটে যান। নিজের ক্ষমতাবলে তিনি রয়্যাল মানমন্দিরে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন। ফ্লামস্টিডকে আবারও চাপ দেন তথ্য প্রকাশের জন্য। তিনি রাজি হননি। তখন নিউটন ফ্লামস্টিডের ব্যক্তিগত কিছু গবেষণাপত্র কেড়ে নেন। তারপর সেগুলো জার্নালে প্রকাশ করেন এডমন্ড হ্যালির নামে। হ্যালি ছিলেন ফ্লামস্টিডের জাতশত্রু। ফলে ফ্লামস্টিডও ভীষণ খেপে যান। নিউটনের বিরুদ্ধে গবেষণাপত্র চুরির অভিযোগে মামলা করেন। এতে আরও ক্ষুব্ধ হন নিউটন। প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে যেখানে যেখানে ফ্লামস্টিডের নাম ছিল, সেগুলো সব বাদ দেন।
২.আইনস্টাইন সম্পর্কে অনেক বোকামির গল্প প্রচলিত আছে
আইনস্টাইন ছিলেন নিউটনের একেবারে উল্টো চরিত্রের। সাদাসিধে ভালো মানুষ যাকে বলে। কিছুটা বোকাও ছিলেন। তার বোকামির ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। আসলে আইনস্টাইন বিজ্ঞানের ভেতর এতটাই ডুবে থাকতেন, চারপাশের অন্য কিছুর দিকে তাঁর খেয়াল থাকত না। একদিন আইনস্টাইন কোথায় যেন গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে এসে দরজায় নক করলেন। আইনস্টাইনের খ্যাতি তখন তুঙ্গে। সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, ছাত্র, গবেষকেরা ভিড় করতেন তাঁর বাসায়। বারবার দরজা খুলতে খুলতে বিরক্ত আইনস্টাইনের স্ত্রী। তাই আইনস্টাইন বাসায় না থাকলে তিনি ভেতর থেকে হেঁকে বলতেন, আইনস্টাইন বাসায় নেই। সেদিন বোধ হয় বিজ্ঞানী মহাশয় একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছিলেন। তাই দরজায় নক করতেই তাঁর স্ত্রী হেঁকে বললেন, ‘আইনস্টাইন বাড়ি নেই।’ এ কথা শুনে আত্মভোলা আইনস্টাইন চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর রাস্তায় নেমে এলেন। আবার শুরু করলেন নিজের বাড়ি খোঁজা।
৩.অদ্ভুত এক কাণ্ড করে নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে দুটো নোবেল প্রাইজ বাঁচিয়েছিলেন নিলস বোর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। হিটলারের প্রচণ্ড রাগ ইহুদিদের ওপর। যেখানে ইহুদি পাচ্ছে ধরে ধরে মেরে ফেলছে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। এমনকি নিজ দেশ জার্মানির বিজ্ঞানীরাও রেহাই পাচ্ছে না হিটলারের হাত থেকে। আলবার্ট আইনস্টাইন ইহুদি ছিলেন। হিটলারের ভয়ে তিনিও পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। যুদ্ধের ডামাডোলে আটকা পড়েন দুই পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভন লু ও ম্যাক্স ফ্রাঙ্ক। দুজনই নোবেল পেয়েছেন। দুজনই ইহুদি। নোবেল দেওয়া হয় সুইডেন থেকে। সুইডেন আবার হিটলারের শত্রু দেশ। শত্রুদের কাছ থেকে তাঁর দেশের দুই ইহুদি বিজ্ঞানী নোবেল নিয়েছেন! হিটলার সেটা মুখ বুজে সহ্য করবেন কেন। লু আর ফ্রাঙ্ককে ধরার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়ল নাৎসি বাহিনী। লু আর ফ্রাঙ্ক ভাবলেন, ধরা পড়লে নির্ঘাত মরতে হবে। সেই সঙ্গে নোবেল প্রাইজটাও কেড়ে নিয়ে নষ্ট করে ফেলবে হিটলারের সৈন্যরা। তাঁরা নিজেদের চেয়ে নোবেল প্রাইজ নিয়েই বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। প্যাকেট ভরে মেডেল দুটো পাঠিয়ে দিলেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। সেখানে তাঁদের বন্ধু বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিলস বোর বাস করতেন।
বোর মেডেল দুটো যত্ন করে লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু বেশি দিন নয়। কারণ, নাৎসি বাহিনী ডেনমার্কেও হামলা করেছে। যেকোনো সময় বোরের গবেষণাগারেও হামলা চালাতে পারে। তখন মেডেল দুটো বাঁচানোই মুশকিল হয়ে যাবে। বোর প্রথমে ভাবলেন, মেডেল দুটো মাটিতে পুঁতে রাখবেন। কিন্তু নাৎসিদের বিশ্বাস নেই। ওরা ঠিক মাটি খুঁড়ে বের করে ফেলবে। বোরের এক সহকারী ছিলেন। হাঙ্গেরিয়ান রসায়নবিদ জর্জ হাভাসি। তিনি বোরকে বুদ্ধি দিলেন সোনাগুলো গুলিয়ে তরল করে ফেলতে। যে সে তরলে সোনা গলে না। সোনা গলাতে লাগে রাজ অম্ল অ্যাকোয়া রেজিয়া। অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যাসিড। বোর আর হাভাসি তখন নোবেল মেডেল দুটো অ্যাকোয়া রেজিয়ার ভেতর ফেলে গলিয়ে ফেললেন। সোনা আর অ্যাসিড মিশে তখন হলুদ রঙের এক তরলে পরিণত হয়েছে। বোর সেই হলুদ তরল একটা বোতলে ভরে রেখে দিলেন আলমারিতে। তারপর কোপেনহেগেন থেকে তাঁরা পালিয়ে বাঁচলেন।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে হিটলার হেরে যান। বোর আর হাভাসি আবার কোপেনহেগেনে ফিরে আসেন। তাঁদের ল্যাবরেটরি লন্ডভন্ড করে রেখে গেছে নাৎসি সৈন্যরা। কিন্তু আলমারির কোণে সেই হলুদ তরলের বোতল একেবারে অক্ষত! মাথা মোটা নাৎসিরা ওর মর্ম কী বুঝবে! পরে নিলস বোরের ছেলে অ্যাগেই বোর অ্যাকোয়া রেজিয়া থেকে আবার সোনাগুলো পুনরুদ্ধার করেন। নিলস বোর সেই সোনা পাঠিয়ে দেন সুইডেনের নোবেল কমিটির কাছে। নোবেল কমিটি সেই সোনা দিয়ে আবার দুটো মেডেল তৈরি করে তাতে লু ও ফ্রাঙ্কের নাম লিখে পাঠিয়ে দেয় বোরের কাছে। এভাবেই রক্ষা পায় বিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর নোবেল প্রাইজ।
৪.মজার এক কথা লিখে বোরের চিঠির জবাব দিয়েছিলেন উলফ্যাং পাউলি
অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফ্যাং পাউলি। ‘পাউলির অপবর্জন নীতি’ নামে একটা বিখ্যাত সূত্র আছে পদার্থবিজ্ঞানে। সূত্রটা তাঁরই আবিষ্কার। এই পাউলিই সর্বপ্রথম নিউট্রনো কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তবে এর পেছনে নিলস বোরের অবদান আছে। সময়টা ১৯২৯ সাল। বোর তখন বিখ্যাত বনে গেছেন তাঁর পরমাণু মডেলের কারণে। বোর একটা পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখলেন পাউলিকে। পাউলি বোরের চেয়ে ১৫ বছরের ছোট। তা ছাড়া তত দিনে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেছেন বোর। তবু ২৯ বছর বয়সী জুনিয়র বিজ্ঞানীর কাছে পরামর্শ কেন? কারণ, পাউলি স্পষ্ট বক্তা হিসেবে বিখ্যাত। কোনো বিজ্ঞানীর তত্ত্ব ঠিক মনে না করলে সরাসরি বলে ফেলতেন তাঁর বক্তব্য। তাঁর কটু মন্তব্যের ভয় পেতেন অনেক তরুণ বিজ্ঞানীও। এ জন্য বোর তাঁর তত্ত্ব পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলেন পাউলির কাছে। পাউলি বোরের ধারণার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। জবাবে লিখেছিলেন, ‘বিকিরণ বিষয়ে আপনার ধারণা মোটেও সন্তোষজনক নয়। আপাতত আপনার ধারণা ঘুমিয়ে থাকুক আর নক্ষত্ররা আলো দিক শান্তিতে...!’ বোরের মুখের ওপর এমন জবাব দেওয়ার সাহস তখন অনেক ডাকসাইটে বিজ্ঞানীরও ছিল না।