প্রিয়তমেষু,
কখনো হিসেব করেছেন কতবার আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে? আমি করেছি। আপনার সঙ্গে আমার সবমিলিয়ে দেখা হয়েছে আটত্রিশবার।
প্রথম যেদিন নীল পাঞ্জাবিটা পরে এলেন আমাদের বাড়িতে, আমি সেদিন হাঁটতে বেরিয়েছি পোষা কুকুরটাকে নিয়ে। বাড়ির সামনে আমাকে ওভাবে দেখে ভাবলেন, আমি বুঝি তাড়িয়ে দিচ্ছি তাকে। এক ধমক দিয়ে বললেন, “পালতে যখন পারবেই না, তখন এনেছিলে কেন ওকে বাড়িতে?”
সেদিন আপনার কঠিন কঠিন কথাগুলো আমার কান দিয়ে ঢুকছিলো না। আমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে ছিলাম আপনার দিকে। মনে আছে? মনে থাকাবার অবশ্য কথা নয়। আমি তো আর আপনার জীবনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারিনি। তবে আপনি রেখেছেন, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা তো আপনারই। আমার মনটা বোঝার চেষ্টা করলেন না কেন সিফাত ভাই?
আপনার মনে আছে? যেবার আমরা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম! আপনিও গিয়েছিলেন আমাদের সাথে। আমি খেলতে খেলতে পরে গেলাম গ্রামের নর্দমায়। বাড়ির সবাই আমাকে ওভাবে দেখে হাসাহাসি করলেও, আপনি হাসেননি। এক বিন্দুও হাসেননি। উল্টো হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে, টেনে তুললেন নর্দমা থেকে। আমার হাত পা ভালোই কেটেছিল। আপনি পরম মমতায় আমাকে নিয়ে গেলেন গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। দুটো স্টিচ লাগলো, কি কি যেন ইনজেকশন দেওয়া হলো আমাকে। জানেন, কোনো ব্যাথাই আমাকে সেদিন স্পর্শ করতে পারছিল না। আমাকে শুধু স্পর্শ করছিল আপনার মায়া, আপনার মমতা।
মনে আছে? একবার স্কুলের অ্যানুয়াল ডে তে আমি ‘দূর দেশী সেই রাখল ছেলে’ গানটা গাইবো বলে ঠিক করলাম। কিন্তু বাড়ির কেউ সেই গান জানে না,জানে না আমার কোনো বান্ধবীও। তাহলে আমাকে গানটা শেখাবে কে? ভারী বিপদে পরলাম, সেই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন আপনি। আপনার কিন্নরকণ্ঠে গান গেয়ে শোনালেন সেই গান। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে আপনার কণ্ঠে গান শুনেছি। বুঝতে পারলাম, পৃথিবীর কোনো অশ্রাব্য গানও আপনার কণ্ঠে মধুর শোনাবে।
আমার বাবা মা আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। আপনাকে কখনোই বাবার অফিসের সামান্য কর্মচারী মনে করেননি তারা। আপনিই বরং মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বারবার।
গত মাসে বাবা যখন আপনাকে বাড়িতে ডেকে সবার সামনে বলল, “সিফাত বাবা, আমি যে তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করি এটা কি তুমি জানো?”
আপনি ভদ্রভাবে বললেন, “জি জানি।”
বাবা বলল, “আমি চাই আমাদের সম্পর্কটাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমি চাই, তুমি আমার বড় কন্যা জেরিনকে বিবাহ করো।”
বাবার মুখে এমন কথা শুনে আমি ভাবলাম, ঠাট্টা করছে বুঝি! কিন্তু না। বাবা ঠাট্টা করেনি।
আপনার সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা আপা সহজভাবেই মেনে নিল, আপনিও নিলেন। শুধু মানতে পারলাম না আমি। বুঝলাম আমার বিয়ের বয়স হয়নি, কিন্তু ভালোবাসতে কোনো বয়স লাগে না-কি? ক্লাস টেনে পড়া একটা মেয়ে কি কাউকে ভালোবাসতে পারে না? না-কি অধিকার নেই ভালোবাসার? আচ্ছা, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা কি কারোই চোখে পড়েনি?
আমি আপনাকে ভালোবাসি সিফাত ভাই। প্রথম দেখায় যেদিন আপনি আমাকে ধমক দিয়েছিলেন, সেদিন আপনার প্রেমে পরেছিলাম। আর যেদিন আপনি আমাকে নর্দমা থেকে টেনে তুললেন, সেদিন থেকে শুরু করলাম আপনাকে ভালোবাসা। আচ্ছা আপনি কি এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ভালোবাসেননি? নির্ঘাত বাসেননি!
বাসলে কি আর পারতেন হতে অন্য করো?
আজ যখন আপনাদের বিয়ে পরানোর সময়ে কাজী সাহেব আপনাকে কবুল বলতে বললেন, আমার ইচ্ছে করছিল দৌড়ে গিয়ে আপনার মুখটা বন্ধ করে দিতে। পারলাম না! তার আগেই আপনি কবুল বলে ফেলেছেন।
সিফাত ভাই, আমি কিন্তু দুর্দান্ত অভিনেত্রী। আজ আপনাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মা যখন আমাকে বলল আপনাকে ‘দুলাভাই’ ডাকতে, কি নির্বিকারভাবে হাসিমুখে ‘দুলাভাই’ ডাকলাম আপনাকে। আচ্ছা, আপনার তো কতো জ্ঞান! আপনি কি বলতে পারেন, স্বর্গে অভিনয় করার কোনো সুযোগ আছে কিনা?
আমার জীবনে আপনার ভূমিকা যে কতটা প্রখর সেটার একটা উদাহরন দেই। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ডক্টর হবো, মানুষের সেবা করবো। আপনার জন্যে সেই স্বপ্ন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি। আপনাকে নিজের করে না পাওয়াটা কষ্টের কিছু না। কিন্তু চোখের সামনে আপনাকে অন্য করো হতে দেখাটা অসহনীয় কষ্টের। আমি বরাবরই কষ্ট সহ্য করতে পারি না। আজও পারলাম না। তাই চলে যাচ্ছি আমি। চলে যাচ্ছি আকাশের তারা হতে, কিংবা বৃষ্টির ফোঁটা হতে। অথবা হয়তো মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো কোনো এক শঙ্খচিলের সঙ্গী হতে। আমি চলে যাচ্ছি।
আপনি যখন এই চিঠি পড়বেন, ততক্ষণে সিলিয়ের সঙ্গে ঝুলতে থাকা একটা লাশ হয়ে থাকবো আমি। জানি আমার কথাগুলো আপনাকে দারুন অপরাধবোধে ভোগাবে। কিন্তু কিছু সময় পর আপনি ঠিকই নিজেকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনি যে কখনো আমার মনটাকে বুঝতে পারেননি।
ইতি,
আকাশের তারা হয়ে যাওয়া,
তারিন
আগের দিন টি ভালই ছিলো কি রোমান্টিক প্রেম ছিলো চিঠি ছিলো আমরা তো এখন মোবাইলে অন্ধ হইগেচি তাই চিঠি কে ভুলে গেছি