নকশা করা কাগজটা শাহেদ পেল ওদের বাসায়, বিছানার তোষকের নিচে। সেটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এলো মিলার বাবার কাছে। কাগজটা দেখিয়ে বললো, 'দেখেনতো, এই কাগজটাই কি আপনারা পেয়েছিলেন মাথার খুলির ভেতরে?'
মিলির বাবা অবাক হয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই কাগজটাই তো। তুমি কোথায় পেলে?'
'আমাদের বাসায়। আরেকটা কাগজ ছিলো বলেছিলেন?'
'হ্যাঁ, দুটো কাগজ ছিলো।'
'আরেকটা তবে গেল কোথায়?'
মিলির বাবা বললেন, 'এর চেয়ে বড় প্রশ্ন, এ কাগজটা তোমাদের বাসায় কি করে গেল?'
'জানি না। অনেকদিন পরে ছিলো আমাদের বাসায়। মিলি তুলে নিয়ে বিছানার তোষকের নিচে রেখেছিলো।'
'অদ্ভুত তো।'
শাহেদ কাগজটা মিলির বাবার হাতে দিয়ে বললো, 'আপনি কোথাও রাখুন কাগজটা। আরেকটা কাগজ পাওয়া গেলে তখন এগুলো নিয়ে কি করা যায় ভাবা যাবে। আমি এখন মিলির কাছে যাচ্ছি।' শাহেদ বেরিয়ে গেল। মিলির বাবা একা বাসায় রয়ে গেলেন।
***
ডিউটি ডাক্তার এসে দেখলেন ১৩ নম্বর কেবিন খালি। এই কেবিনে শাহানার ডিউটি ছিলো আজকে। ওতো নেই, সাথে রুগীও নেই।
ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে হাঁটতে লাগলেন। তার নাকে খুব বাজে একটা গন্ধ এসে লাগছে। গন্ধটি যে কোথা থেকে আসছে তিনি বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ তার মনে হলো পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি পেছন ফিরে দেখলেন একটা মেয়ে। মেয়েটাকে তিনি চেনেন। ১৩ নম্বর কেবিনের রোগী। কিন্তু মেয়েটার তো জ্ঞান ফেরেনি দুদিন, ও এখানে এলো কিভাবে?
ডাক্তার কিছু বলবার আগেই মেয়েটা চোখ মেলে তাকালো, লাল টকটকে দুটি চোখ। হাত বাড়িয়ে ডাক্তারের গলা চেপে ধরলো সে। ডাক্তার চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না।
***
শাহেদ হাসপাতালে পৌঁছে দেখলো পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই ইন্সপেক্টর এগিয়ে এলেন, বললেন 'আপনাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো আপনার সাথে দেখা হয়ে গিয়ে।'
'কেন?'
ইন্সপেক্টর ওকে নিয়ে হাসপাতালের অফিসরুমে বসলেন। এরপর গম্ভীর মুখে বললেন, 'আপনার স্ত্রী একজন ডাক্তারকে খুন করার চেষ্টা করছিলো। ভাগ্য ভালো দুজন ওয়ার্ডবয় দেখে ফেলেছিলো, তারাই গিয়ে আপনার স্ত্রীকে থামায়। ওর কেবিনের দায়িত্বে থাকা নার্সকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।'
'এসব কি বলছেন?'
'জ্বি সবই সত্যি। প্রত্যক্ষদর্শী আছে। ভয় পাবেন না, আপনার শ্বশুরের প্রভাব আছে এলাকাতে। আমরা আপনার স্ত্রীকে আটকে রাখতে পারবো না। শুধু আজ রাতটিতে ও আমাদের কাস্টডিতে থাকবে।'
'কিন্তু ওতো এমন মেয়েই না। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।'
'কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?'
'জ্বি করেন।'
'আপনার ছেলে কিভাবে মারা যায়?'
'এটা আমি ঠিক মতো জানি না। দুপুরে ছেলেটা ওর মায়ের সাথেই ছিলো। মিলি ওকে বিছানায় রেখে বাথরুমে যায় কিছু সময়ের জন্য। ফিরে এসে দেখে ছেলেটার গলায় ওর মায়ের ওড়না পেঁচিয়ে গেছে কিভাবে যেন, খেলতে খেলতেই মনে হয় এমনটা হয়েছে। মিলি তাড়াতাড়ি ওড়না ছাড়ায়, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।'
'সো স্যাড। আচ্ছা, আপনার কি কখনো মনে হয়নি, ওরনাটা বাচ্চার গলায় আপনার স্ত্রীও পেঁচিয়ে দিতে পারে।'
শাহেদ রেগে উঠলো, 'আপনি কি বলতে চান?'
'আমি কিছুই বলতে চাই না। শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বললাম। অপরাধবিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন ঘটনা কিন্তু আপনি অনেক পাবেন, যেখানে মানসিক বিকারগ্রস্ত মা সন্তানদের খুন করেছেন।'
'আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।'
'হয়তো করছি। আপনার শ্বাশুরি যেদিন খুন হন, সেদিনও তো তার সাথে কেবল আপনার বউ ছিলো, তাই না? আচ্ছা, এখন যাই, বেশ কিছু কাজ আছে। কাল সকাল সকালই থানায় চলে আসবেন, কেমন?'
ইন্সপেক্টর মিলিকে নিয়ে চলে গেলেন।
***
ডিউটি ডাক্তার এসে দেখলেন ১৩ নম্বর কেবিন খালি। এই কেবিনে শাহানার ডিউটি ছিলো আজকে। ওতো নেই, সাথে রুগীও নেই।
ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে হাঁটতে লাগলেন। তার নাকে খুব বাজে একটা গন্ধ এসে লাগছে। গন্ধটি যে কোথা থেকে আসছে তিনি বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ তার মনে হলো পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি পেছন ফিরে দেখলেন একটা মেয়ে। মেয়েটাকে তিনি চেনেন। ১৩ নম্বর কেবিনের রোগী। কিন্তু মেয়েটার তো জ্ঞান ফেরেনি দুদিন, ও এখানে এলো কিভাবে?
ডাক্তার কিছু বলবার আগেই মেয়েটা চোখ মেলে তাকালো, লাল টকটকে দুটি চোখ। হাত বাড়িয়ে ডাক্তারের গলা চেপে ধরলো সে। ডাক্তার চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না।
শাহেদের সাথে মিলির সম্পর্ক অনেক দিনের। ছোটবেলায় শাহেদের বাবা মা মারা যাবার পর থেকেই শাহেদ মিলিদের বাসায় থাকে। শাহেদের বাবা আর মিলির বাবা বিজনেস পার্টনার এবং বন্ধু ছিলেন। বন্ধুর ছেলের সব দায়িত্বই মিলির বাবা নিজের হাতে তুলে নেন। শাহেদের বাবা, মা আর ছোট ভাই কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়, ওর বয়স তখন চার বছর। সেই বছরই মিলির জন্ম হয়।
মিলিকে এতোদিন ধরে চেনে শাহেদ, কখনোই মনে হয়নি ওর কোনো সমস্যা থাকতে পারে। ইন্সপেক্টরের ধারণা ভুল মনে হয় ওর কাছে। বাসায় ফিরে ও, মিলির বাবাকে নিয়ে থানায় যেতে হবে এখন। কিন্তু বাসায় পৌঁছেই ও অবাক হয়ে যায়। বাসা পুরো খালি, কেউ নেই। অথচ মেন গেইট খোলা। বাবার রুমে চলে যায় শাহেদ, ভাবে বাবা হয়তো কোনো কাজে বাহিরে গেছেন। ফিরে আসবেন এখনি।
ইন্সপেক্টর একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তিনি গম্ভীরমুখে বললেন, 'দেখেন, আমার বিশ্বাস আপনি নির্দোষ। আপনি নিজের ইচ্ছাতে কাজগুলো করছেন না। আপনার দুর্বল মানসিক অবস্থাই এর জন্য দায়ী। আপনি আজ এখানেই থাকুন, কাল একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আসবেন আপনার সাথে কথা বলতে।'
'আপনি বলতে চান আমি পাগল?'
'না। আমি এটা বলতে পারি না। এটা কাল যে বিশেষজ্ঞ আসবে তিনি বলবেন। আজ আপনি রেস্ট নিন একটু।' বলেই তিনি থেমে গেলেন। কিসের যেন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শব্দটা মিলিও শুনলো। কেমন একটা বন্য জন্তুর গর্জনের মতো আওয়াজ। ও খুব ভয় পেলো। এ শব্দটা ও আগেও শুনেছে। যেদিন ও অজ্ঞান হয়ে যায়, মায়ের সাথে রান্নাঘরে থাকার সময়, সেদিন।
ইন্সপেক্টর বললেন, 'মনু মিয়া যাও তো, দেখো তো কিসের শব্দ বাইরে।' হাবিলদার মনু মিয়া বাইরে গিয়ে দেখে এসে বলে, 'স্যার, বাইরে কিছু নাই। খালি অন্ধকার। এতো অন্ধকার আমি আমার পুরা জীবনে দেখি নাই।'
***
মিলির বাবা কাগজটা ড্রয়ারে রাখলেন যত্ন করে। এরপর চুপচাপ নিজের বিছানার ওপর বসে রইলেন। আজ পুরো বাসায় একা তিনি, অনেকদিন পর সেই গা ছমছমে অনুভূতিটা ফিরে আসছে আবার। তিনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। নিকষ কালো রাত, অন্ধকারে দুগজ দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। তার বাড়িটা এমন জায়গাতে যে আশেপাশে কোন লোকবসতি নেই। বাড়ির চারদিকে আম, কাঁঠাল, সেগুন গাছের সারি। দূর থেকে দেখলে নির্জন ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয় এ জায়গাকে।
মিলির বাবার হাত কাঁপছে। খুব বেশি ভয় পেলে তার হাত কাঁপে। তিনি ঠিক করলেন জানলাটা বন্ধ করে দেবেন। এজন্য বিছানা থেকে উঠলেন। এসময় কারেন্ট চলে গেল। কালো আঁধারে ডুবে গেল পুরো বাড়ি। বাবা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মুখ জানলার দিকে। চোখে অন্ধকার সয়ে আসছে একটু একটু করে। এসময় তিনি শুনলেন পেছনের জঙ্গলে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গম্ভীর, ধীর, শান্ত, ভয়ঙকর সে আওয়াজ। এ আওয়াজ কোনোভাবেই মানুষের পায়ের আওয়াজ হতে পারে না।
আওয়াজটা আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে চলে এলো। বাবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। নিকষ অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধুই আঁধারে ঢাকা পৃথিবী।
এসময়েই এক শীতল হাসির শব্দ শুনলেন তিনি।
এরপরই তার জানালা দিয়ে এক বিভৎস, বিশাল, ভয়ঙকর মুখ উঁকি দিলো। মিলির বাবার দিকে তাকিয়ে ভয়ঙকরভাবে হাসতে থাকলো সে। মিলির বাবা তার দোতলার রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন সেই মুখটির দিকে।
একপাল কুকুরের ভয়ার্ত কান্নার শব্দে ভেঙে গেল সে রাতের নিরবতা।
শাহেদের সাথে মিলির সম্পর্ক অনেক দিনের। ছোটবেলায় শাহেদের বাবা মা মারা যাবার পর থেকেই শাহেদ মিলিদের বাসায় থাকে। শাহেদের বাবা আর মিলির বাবা বিজনেস পার্টনার এবং বন্ধু ছিলেন। বন্ধুর ছেলের সব দায়িত্বই মিলির বাবা নিজের হাতে তুলে নেন। শাহেদের বাবা, মা আর ছোট ভাই কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়, ওর বয়স তখন চার বছর। সেই বছরই মিলির জন্ম হয়।
মিলিকে এতোদিন ধরে চেনে শাহেদ, কখনোই মনে হয়নি ওর কোনো সমস্যা থাকতে পারে। ইন্সপেক্টরের ধারণা ভুল মনে হয় ওর কাছে। বাসায় ফিরে ও, মিলির বাবাকে নিয়ে থানায় যেতে হবে এখন। কিন্তু বাসায় পৌঁছেই ও অবাক হয়ে যায়। বাসা পুরো খালি, কেউ নেই। অথচ মেন গেইট খোলা। বাবার রুমে চলে যায় শাহেদ, ভাবে বাবা হয়তো কোনো কাজে বাহিরে গেছেন। ফিরে আসবেন এখনি।
বাবার টেবিলের কাছে যায় ও, দেখতে যে বাবা ওর জন্য কোনো চিরকুট রেখে গেছেন কিনা। কিন্তু তার বদলে ও একটা কাগজ পায়, কাগজে অনেক অদ্ভুত সংকেত আর নকশা আঁকা। কিন্তু এটা ওর আগের কাগজটা না। এটা কি তবে দ্বিতীয় কাগজ? শাহেদ পুরো ঘর খুঁজতে থাকে প্রথম কাগজটার জন্য। খুঁজতে খুঁজতে ড্রয়ার খোলে, সেখানে কাগজটা তো পায়ই, সাথে এমন একটা জিনিস দেখে, ভয়ানক চমকে ওঠে ও।
***
থানায় ইন্সপেক্টর মিলিকে জেরা করছে। মিলি এখন ভালো, কিন্তু ও মনে করতে পারছে না জ্ঞান ফেরার পর ও কি করেছিলো। শুধু মনে আছে কালো লম্বা চাদরওয়ালা কেউ দাঁড়িয়ে ছিলো ওর পাশে। এরপর আর কিছু মনে নেই ওর।
'তার মানে আপনি জ্ঞান ফেরার পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন?' ইনস্পেক্টর টিটকিরি মেরেই প্রশ্নটা করলেন। মিলি কিছু বললো না।
'দেখুন মিসেস মিলি, ভূতের গল্প বলে আপনি অনেকের বাহবা পেতে পারেন, কিন্তু আপনি কি করে ভাবলেন যে এই বাজে গল্প শুনিয়ে আপনি পার পেয়ে যাবেন আমাদের কাছ থেকে? কি হয়েছিলো সত্যি করে বলুন, আপনার লাভ হবে তাতে।'
'আমি সত্যিই বলছি।'
'তাহলে ডাক্তারের গলা টিপে ধরেছিলো কে? আপনার ভূত?'
'আমার জ্ঞান ফেরার পরই দেখছি আমি থানায়। মাঝখানে কি হয়েছে আমি জানি না, সব আপনার কাছ থেকেই শুনেছি। আপনি যে সত্যি বলছেন তার কি প্রমাণ আছে?'
ইন্সপেক্টর একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তিনি গম্ভীরমুখে বললেন, 'দেখেন, আমার বিশ্বাস আপনি নির্দোষ। আপনি নিজের ইচ্ছাতে কাজগুলো করছেন না। আপনার দুর্বল মানসিক অবস্থাই এর জন্য দায়ী। আপনি আজ এখানেই থাকুন, কাল একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আসবেন আপনার সাথে কথা বলতে।'
'আপনি বলতে চান আমি পাগল?'
'না। আমি এটা বলতে পারি না। এটা কাল যে বিশেষজ্ঞ আসবে তিনি বলবেন। আজ আপনি রেস্ট নিন একটু।' বলেই তিনি থেমে গেলেন। কিসের যেন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শব্দটা মিলিও শুনলো। কেমন একটা বন্য জন্তুর গর্জনের মতো আওয়াজ। ও খুব ভয় পেলো। এ শব্দটা ও আগেও শুনেছে। যেদিন ও অজ্ঞান হয়ে যায়, মায়ের সাথে রান্নাঘরে থাকার সময়, সেদিন।
ইন্সপেক্টর বললেন, 'মনু মিয়া যাও তো, দেখো তো কিসের শব্দ বাইরে।' হাবিলদার মনু মিয়া বাইরে গিয়ে দেখে এসে বলে, 'স্যার, বাইরে কিছু নাই। খালি অন্ধকার। এতো অন্ধকার আমি আমার পুরা জীবনে দেখি নাই।'
ইন্সপেক্টর বললেন, 'তুমি বেশি কথা বলো। যাও তোমার কাজে যাও।'
আবার গর্জনের শব্দ শোনা গেল, এবার বেশ কাছে। থানায় মোট সাতজন মানুষ ছিলেন এই রাতের বেলাতে, সবাই ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ইন্সপেক্টর রিভলবারের গুলি চেক করে বললেন, 'সবাই এলার্ট থাকবা। কোনো বন্য জন্তু চলে আসছে মনে হয়। কিছু দেখলেই গুলি করবা সরাসরি।'
এরমধ্যেই কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল পুরো থানা। ইন্সপেক্টর সভয়ে শুনলেন, তার কনস্টেবলরা মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠছে। তিনি তাড়াতাড়ি আন্দাজে ডেস্কের ড্রয়ারটা খুললেন, এরপর হাতড়ে হাতড়ে তিন ব্যাটারির টর্চটা বের করে নিয়ে আসলেন। ওটা জ্বালাতেই দেখলেন, তার কয়েক ফিট সামনেই তার এক কনস্টেবল চিত হয়ে পড়ে আছে, তার চোখ পুরোপুরি খোলা, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইন্সপেক্টরের দিকে। আর তার বুকের উপর উঠে বুক চিড়ে ফেলছে বিশাল এক জন্তু। সেটা দেখতে মানুষের মতো, কিন্তু বিশাল, সারা গায়ে লোম। আলো পড়তেই সেটা ঘুরে লাফিয়ে পড়লো ইন্সপেক্টরের ওপর। তিনি গুলি ছুড়লেন, কিন্তু লাভ হলো না। টর্চটা নিভে গেল।
***
মিলির জ্ঞান ফিরতেই ও দেখলো ওর নিজের বাড়ির বিছানাতে শুয়ে আছে। থানায় ঐ ঘটনার সময়ই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এখন জ্ঞান ফিরতে সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। ওর বিছানার পাশে ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। মিলি উঠে বসতে গেল, কিন্তু পারলো না। ওর হাত পা বিছানার সাথে বাঁধা। ও অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো। বাবা মিলির কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, 'একটু অপেক্ষা কর মা। এরপরই সব শেষ হয়ে যাবে।'
'কি শেষ হবে? আপনি আমার হাত পা বেঁধে রেখেছেন কেন? শাহেদ কোথায়?'
'শাহেদ কোথায় তাতো জানি না। কিন্তু ওর এখন এখানে থাকা ঠিক হবে না। তোমার হাত পা কেন বেঁধে রেখেছি, এটুকু শুধু বলি। এখনো ভোর হতে বেশ কিছুক্ষণ বাকি, গল্প বলতে বেশিক্ষণ লাগবে না।
যখন আমি শাহেদের বাবার সাথে মিলে ব্যবসা শুরু করি, তখন আমাদের পুঁজি বেশি ছিল না। কম পুঁজিতেই বেশ ভালো লাভ করি আমরা। পরের বছর ঠিক করলাম, ব্যবসা বাড়ানো লাগবে। জমিজমা বন্ধক রেখে বড় পুঁজি নিয়েই সেবার নামলাম। কিন্তু কি কপাল আমাদের, সেবারই এমন ধরা খেলাম, সবকিছু হারিয়ে পথের ফকির হওয়া বাকি ছিলো। আমাদের দুজনেরই তখন মাথা খারাপ অবস্থা, কি করবো বুঝতে পারছি না। এরমধ্যেই একজন বললো, কালোজাদু করে নাকি ধনী হওয়া যায়। আমরা ঠিক করলাম চেষ্টা করে দেখবো। পুরনো বই পেলাম একটা, সেটাতে যেভাবে যা করতে বলে সব করলাম। কিন্তু শেষের একটা কাজ বাকি থাকতেই শাহেদের বাবা মা আর ভাই মারা যায়। আমি একা শেষ কাজটুকু করি। এক ছোট বাচ্চার মাথার খুলিতে দুটো নকশা আঁকা কাগজ রেখে পুঁতে রাখার দরকার ছিলো। শাহেদের ছোট ভাইয়ের মাথার খুলি নিয়েই করি কাজটা। কাজটা শেষ করবার সাথে সাথেই দেখলাম এক কালো চাদর গায়ে লম্বা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কি চাই। আমি অনেক টাকা চাইলাম। সে আমার ইচ্ছা পূরণ করলো।
কিন্তু এর কিছুদিন পর, তুমি যখন তোমার মায়ের পেটে, তখন ওকে তোমার মা দেখতে পেতেন। আমি শুনে খুব ভয় পেলাম। একজন লোককে নিয়ে আসলাম সমস্যা সমাধানের জন্য। তাকে সব বলার পর তিনি বললেন, আমাদের এই জগতের বাইরেও অন্য এক ভুবন আছে। সেখানে যারা থাকে, তারা এতই ভয়ঙকর, বিভৎস, হিংস্র যে আমরা কল্পনাতেও কেবল সামান্যই আন্দাজ করতে পারি। সেই জীবগুলোর মাঝে যারা কেবল মধ্যম মানের, তাদের কাউকে যদি কোনো মানুষ কেবল স্বপ্নে দেখে এক মুহূর্তের জন্যও, তবু সে পাগল হয়ে যাবে l সেই ভুবন আর আমাদের ভুবনের মাঝে এক বন্ধ দরজা আছে, সেই জীবগুলো এই দরজা পার হতে পারে না। যদি পারতো, তবে আমাদের ওপর যে ভয়াবহ অবস্থা নেমে আসতো, তা কল্পনাও করতে পারি না আমরা। সে ভুবনের দরজা খোলার কিছু উপায় আছে। আমরা তার একটা করেছি। এর জন্য যে এসেছে, সে ওখানের জীবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিম্নস্তরের, অথচ তার ক্ষমতা যেকোন মানুষের চাইতে বেশি।
জীবটাকে আবার তার জগতে পাঠানোর চেষ্টা করলেন লোকটা। কিন্তু পারলেন না। তার আগেই তাকে মেরে ফেলা হলো। আমি তখন উপায় না পেয়ে বইটা পড়লাম, সেখানে ঐ জীবটাকে ফেরত পাঠানোর উপায় বলা ছিলো। সেরকম কাজ করলাম। ওটা চলে গেল। কিন্তু যাবার আগে বলে গেল, তোমার উপর সবসময়ই ওর নজর থাকবে।
তোমার বিয়ের পর যখন তোমার পেটের বাচ্চাগুলো মারা যেতে লাগলো, বুঝলাম সব ওরই কাজ। আমার ব্যবসার অবস্থা তখন আরো খারাপ, লোভ সামলাতে পারলাম না। আবার ডাকলাম ওকে। সে আসলো, কিন্তু এবার নতুন প্রস্তাব দিলো আমাকে। যদি আমি ওর কাছে তোমাকে দিয়ে দেই, তবে সে আমাকে অনেক সম্পদ তো দেবেই, সাথে আমাকে নতুন জীবন দেবে। আমি আরো অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারবো। এক জীবনের বদলে এক জীবন।'
মিলির বাবা টেবিলের কাছে গেলেন। মিলিকে থানা থেকে আনতে যাবার আগে সেখানে নকশা আঁকা কাগজ রেখে গিয়েছিলেন। সেটা তুলে নিয়ে বিদঘুটে ভাষায় কি সব পড়তে লাগলেন। মিলির শত কান্না, অনুনয় বিনয় তিনি কানেই তুললেন না।
পড়া শেষ হলে তিনি মিলির সামনে আসলেন। মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'আমায় ক্ষমা করে দিও মা।'
চারদিক শুনশান নিরব হয়ে আছে। এরমধ্যেই হঠাৎ জোরে বাতাস বইতে শুরু করলো। মিলি দেখতে পেল ওর পাশে কালো চাদর গায়ে লম্বা একজন দাঁড়িয়ে আছে l সে চাদর খুলে ফেলল। তার মুখ বিভৎস, সারা গা ঘন লোমে ঢাকা। সে এগোতে লাগলো মিলির দিকে। মিলির বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।
এরমধ্যেই অবাক ব্যাপার ঘটলো। সে জিনিসটা চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়লো, যেন আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তার গায়ে। মিলির বাবা তাকিয়ে দেখলেন শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, বইটা পুড়ছে ওর সামনে। তিনি দৌড়ে বইটা নেভাতে গেলেন। শাহেদ লাঠির এক বাড়ি লাগালো তার মাথায়, এক বাড়িত অজ্ঞান। জিনিসটা চিৎকার করতে করতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। বইটাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ততক্ষণে। শাহেদ গিয়ে মিলির হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো।
***
মিলির বাবার জ্ঞান ফিরলো একটু পরেই। জ্ঞান ফিরেই তিনি দেখলেন বিছানার সাথে তার হাত পা বাঁধা, শাহেদ আর মিলি দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। শাহেদ বলতে লাগলো, 'আপনি কালোজাদুর যে বইটা পেয়েছিলেন সেটা প্রাচীন মৈগালি ভাষার। সেই ভাষা কিছুটা জানতাম আমি। আপনার ড্রয়ার খুলে বইটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়। বাকি আপনার কথাগুলো লুকিয়ে থেকে শুনেছি।'
মিলির বাবা জিজ্ঞেস করলেন, 'বইটা কোথায়?'
'দেখলেনই তো পুড়িয়ে ফেলেছি।'
'আর কাগজগুলো?'
'সেগুলোর কথা পরে বলছি। আগে বলুন তো, আপনি বলেছিলেন অন্য ভুবনের দরজা খুলতে এক ছোট বাচ্চার মাথার খুলি লাগে। এবার আপনি কার মাথার খুলি নিয়েছিলেন?'
মিলির বাবা চুপ করে রইলেন। কিছু বললেন না।
শাহেদ বললো, 'আমাদের ছেলে রাতুলকে আপনি মেরেছিলেন, তাই না? সেদিন আপনি লুকিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাসায়, মিলি বাথরুমে যেতেই আপনি রাতুলের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে দেন। বলুন, এই কাজ আপনি করেননি?'
মিলির বাবা চুপ করে রইলেন এবারও। মিলি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। শাহেদ বললো, 'এজন্যই মিলি পরে রাতুলকে দেখতে পেত। আমাদের বাসায় কাগজগুলোও তাহলে আপনি রেখেছিলেন। রাতুলের মাথার খুলি আপনি নিশ্চয়ই বের করে নিয়ে আসছিলেন ওর দাফনের পর। কোথায় সেটা?'
'যেখানে প্রথম খুলিটা পোঁতা ছিলো, সেখানে। এখন বলো, কাগজগুলো কোথায়?'
'ওগুলো আমরা পুড়িয়ে ফেলেছি। '
শাহেদ এটা বলার পরপরই চারদিক নিশ্চুপ হয়ে গেলো। একটু আগে একটা পাখি ডাকছিলো সকাল হওয়ার খবর নিয়ে, তার ডাকটিও বন্ধ হয়ে গেল। মিলির বাবা আর্তনাদ করে উঠলেন, 'বোকা, এটা কি করেছো তুমি?'
'কেন?'
'ঐ কাগজটা ছিলো সেই ভুবনের দরজা খোলার মন্ত্র। আবার সেটাতেই ঐ দরজা বন্ধ করার মন্ত্রও ছিলো। আমি কেবল দরজা খোলার মন্ত্রটুকুই পড়েছিলাম, ওখান থেকে আসার পথ বন্ধ করি নি। এখন ঐ দরজা আর বন্ধ করা যাবে না। পুরো পৃথিবীর ওপর অভিশাপ নেমে আসবে...'
মিলির বাবা কথা শেষ করতে পারলেন না। তার মাথা নড়তে লাগলো খুব জোরে, পাগলের মতো হাসতে লাগলেন তিনি। তার চোখ, মুখ, নাক, কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগলো। তারপরই নিস্তেজ হয়ে পড়লো তার শরীর।
এরপরই ভয়ঙকর ঘটনাটি ঘটলো। তখন সকাল হচ্ছিলো, ভোরের ম্লান আলো ফুঁটছিলো আস্তে আস্তে। সে আলো হঠাৎ নিভে গেল। চারদিক ঢেকে গেল এক অদ্ভুত অন্ধকারে, এমন অন্ধকার, যা পৃথিবীর মানুষ কখনো দেখেনি।
শেষ সময়টুকুতে, শাহেদ শুধু মিলিকে আঁকড়ে ধরে ছিলো; বাকি যতটুকু সময় আছে তার হাতে,তারমধ্যে একমুহূর্তও সে কাছ-ছাড়া করতে চায় না মিলিকে। তাদের চারপাশে ধেয়ে আসতে লাগলো ভয় পাওয়া মানুষদের আর্তনাদ, আর অদ্ভুত অচেনা জীবদের হিংস্র গর্জনের আওয়াজ।
পুরো পৃথিবী এক অপার্থিব অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
Nice story!