বং জুন হো পরিচালিত অনবদ্য কোরিয়ান মুভি প্যারাসাইট। ৮.৬ রেটিং নিয়ে অস্কারজয়ী এই মুভিটা নিয়ে হয়েছে বেশ কিছু আলোচনা/ সমালোচনা। অনেকের কাছে নাকি মুভিটা ছিলো ওভাররেটেড বা তাদের মনে হয় মুভিটা অস্কার ডিজার্ভ করেনা। তবে যদি আমাকে বলতে বলা হয় তাহলে আমি বলবো এই মুভি একশোবার অস্কার ডিজার্ভ করে। কারণ আমাদের সমাজের করুণ বাস্তবতার এমন অসাধারণ প্রতিফলন আমি এর থেকে বেশি আর কোনো মুভিতেই খুঁজে পাইনি। এই মুভির ভাইব টা কিছুটা নেগেটিভ। এটা নিয়ে কিছুটা সমালোচনা করা গেলেও আজ আমি শুধুমাত্র মুভির সংক্ষিপ্ত এক্সপ্লেনেশন দেওয়ার চেষ্টা করবো আর মুভিটা কেনো অস্কার ডিজার্ভ করে সে বিষয়ে লিখবো। মুভির কাহিনী সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্তারিত তথ্য থাকবে তাই থাকবে বেশ কিছু স্পয়লারও। তাই যারা এখনো মুভিটা দেখেননি তাদের জন্য ইগনোর করাটাই ভালো।
মুভিটির মূল পয়েন্ট হচ্ছে পরনির্ভরতা। তবে এর সাথেও মুভিটিতে তিনটি বড় ধরনের সমস্যাকে তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো মানবিক বা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা আর অপর দু'টি হলো সামাজিক সমস্যা। আমরা যদি সমস্যাগুলোকে একটু বিস্তারিতভাবে বলতে যায় তাহলে বলা যায় মানুষের ভেতরের যে চাহিদা, আরো পাওয়ার নেশা, এটাকে বলা যায় লোভ। আর সামাজিক সমস্যা দুটি হলো দারিদ্রতা আর ধনী-গরীব বৈষম্যতা। এবার আসি এগুলোর স্পষ্ট প্রতিফলনে।
মুভিতে বেসিক্যালি দুইটি পরিবারের ওপর বেশি ফোকাস করা হয়েছে। কিম পরিবার আর পার্ক পরিবার। কিম পরিবার হলো সম্পূর্ণ দরিদ্র, চাকরির অভাব আর জীবিকার তাগিদে কাজ খুঁজতে থাকা একটা অসহায় পরিবার। আর এদিকে পার্ক পরিবার হলো বড় বাড়ি, ব্যাবসা আর অর্থসম্পন্ন একটা প্রতিষ্ঠিত পরিবার। ঘটনা চক্রে কিম পরিবারের সন্তান 'কি য়্যু কিম' মিথ্যে সার্টিফিকেট নিয়ে পার্ক পরিবারের মেয়েকে ইংলিশ পড়ানোর চাকরি নেয় আর এভাবেই শুরু হয় পার্ক পরিবারে তাদের যাত্রা। কি য়্যু একই ভাবে চালাকি করে তার বোন কেউ ঢুকিয়ে দেয় পার্ক পরিবারের একমাত্র ছেলেকে আর্ট শেখানোর কাজে। এবার কিম পরিবার ধীরে ধীরে করতে থাকে মাস্টারপ্ল্যান। চালাকি করে তারা তাদের বাবাকেও ঢুকিয়ে নেয় ওই পরিবারের ড্রাইভার হিসাবে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তারা একদমই আলাদা পরিচয় নিয়ে পার্ক পরিবারে কাজ করছে অর্থাৎ পার্ক পরিবারের কেও জানেই না যে ওরা পুরো একটা পরিবার। এখন শুধু বাকি থাকে কি য়্যু'র মা 'চুং স্যুক'। আর তারা আবার বুদ্ধি করে পার্ক পরিবারের হাউসকিপারকে ফাঁসিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আর 'চুং স্যুক' কে বানায় ওই বাসার হাউসকিপার।
এতোটুকু পড়ে হয়তো আমরা হয়তো বুঝেই গেছি দারিদ্রতা আর লোভের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। কিম পরিবারের কাজগুলো করার প্রধান কারণই ছিলো দারিদ্রতা। আর সেই থেকে জিনিসটা আরো বড়সড় রূপ নিয়ে লোভে পরিণত হয় যার কারণেই তারা একের পর এক অন্যায়ভাবে পার্ক পরিবারে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছিলো।
কিন্তু এতোক্ষণ পর্যন্ত মুভিটাকে কমেডি মুভি মনে হলেও মুভিটার কাহিনী ধীরে ধীরে ভয়াবহ রূপে মোড় নেয়। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো পার্ক পরিবারের ওই হাউসকিপার 'মুং ইয়ন' কে ফাঁসানো। একদিন পার্ক পরিবার জন্মদিন পালনের জন্য ঘুরতে যায় আর সেই সুযোগেই এক হয় কিম পরিবার। তারা সেই বিশাল বাড়িতে বসার রুমে মদের আসর বসায়। তারা কোনো না কোনোভাবে ভাবতে শুরু করে এটা যেনো তাদেরই বাড়ি। কিন্তু হঠাৎ বাড়িতে আসে সেই প্রাক্তন হাউসকিপার আর সে কিছু না বলেই চলে যায় রান্নাঘরে। আর একটা গোপন দরজা খুলে চলে যায় বেসমেন্টে যেখানে তার স্বামী বাস করতো যেটা এখন পর্যন্ত ওই বাড়ির কেউ জানেনা। আর ওই হাউসকিপার তাকেই খাবার দেওয়ার জন্য বাড়িটিতে আসে। এগুলো দেখে নিতান্তই বিষ্মিত হয়ে যায় কিম পরিবার। প্রাক্তন হাউসকিপার 'চুং স্যুক' অর্থাৎ বর্তমান হাউসকিপারকে অনুরোধ করে যেনো এগুলো কাউকে না জানায়। কিন্তু ঘটনাচক্রে প্রাক্তন হাউসকিপার জেনে যায় যে ওরা চারজনই একই পরিবারের অর্থাৎ তারা চালাকি করে সবাইকে ফাঁসিয়েছে আর মিথ্যে বলেছে। সে আর তার স্বামী মিলে তাদের এই কাজের প্রমাণসরূপ তার ভিডিও করে ও ব্ল্যাকমেইল করে।
আমরা এই পর্যায়ে এসে মুভির নামের একটা সার্থক প্রতিফলন পাই। এখানে কিম পরিবার আর আর হাউসকিপার 'মুং' ও তার স্বামী- দু'টি পরিবারই সম্পূর্ণ ওই পার্ক পরিবারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। এরাই হলো প্যারাসাইট বা পরনির্ভর। (যদিও আক্ষরিক অর্থ পরজীবী)
এবার আসি মুভির টার্নিং পয়েন্টে। পার্ক পরিবার বৃষ্টির কারণে ফিরে আসবে জানতে পেরে কিম পরিবার 'মুং ইয়ন' আর তার স্বামীকে আটকাতে না পেরে আঘাত করে আর মুং ইয়ন গুরুতর আহত হয়ে মারা যায়। তার স্বামীকে বেঁধে রেখে তারা উপরে উঠে সবকিছু ঠিকঠাক করে 'চুং স্যুক' ছাড়া পরিবারের বাকি সকলে টেবিলের নিচে লুকিয়ে অপেক্ষা করে মি: পার্ক আর তার স্ত্রীর ঘুমানোর। সেই সময় মি: কিম শোনে তারা তাকে নিয়েই আলোচনা করছে। গা থেকে আসা দূর্গন্ধ, নিচু শ্রেণী ইত্যাদি। এগুলো শুনে তার খারাপ লাগে। অত:পর সকলে ঘুমিয়ে গেলে তারা বৃষ্টির ভেতরই বের হয়ে যায় আর গিয়ে দেখে তাদের ঘর সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। এটাই হলো করুণ বাস্তবতা। কিছুক্ষণ আগে যারা বিরাট অট্টালিকায় বসে মদ্যপান করছিলো, এখন তাদের থাকার জায়গাও নেই। পরদিন মি:পার্কের ছোট ছেলের জন্মদিন বাড়িতে উৎযাপন করার পরিকল্পনা করায় মি: কিম কে গাড়ি নিয়ে শপিংয়ে যায় মিসেস পার্ক। কিন্তু মি: কিমের গায়ের দূর্গন্ধে নাক চেপে ধরে সে যেকারণে মি: কিম হয়ে ওঠে রাগান্বিত। তবে সে কিছুই বলেনা। অন্যদিকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দিন মি: পার্ক তার ছেলেকে খুশি করার জন্য একটা কাহিনী সাজায় আর মি:কিম কে সাহায্য করতে বলে আর তাকে মনমরা দেখে ভালোমতো কাজ করতে বলে আর তাকে টাকার গরম দেখায়। হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। বেসমেন্ট থেকে মুন ইয়নের স্বামী তার স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ছুরি নিয়ে এগিয়ে এসে মি: কিমের মেয়েকে হত্যা করে এবং তার আগে তার ছেলের মাথায় পাথর মারে। এদিকে মি:পার্কের ছেলে তাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়।( এর কারণ এর আগে সে বেসমেন্ট থেকে একবার তাকেই বের হতে দেখে ভূত মনে করে খুব ভয় পেয়ে যায়, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।) এদিকে ওই লোককে আটকাতে না পেরে মিসেস কিম তাকে হত্যা করে। আর মি : পার্ক যখন তার ড্রাইভার অর্থাৎ মি:কিম কে গাড়ির চাবি বের করতে বলে তখনই মি:কিম তাকে খুন করে।
আর এই বিষয়টা নিয়ে যাদের সংশয় তাদেরকে জানিয়ে দিই এই খুনের পেছনের মূল কারণই হলো ধনী-গরীব বৈষম্যতা। যেখানে কিমের মেয়ের মৃত্যু হয়েছে, মোট দুটো খুন হয়েছে সেখানে তার ছেলে শুধুমাত্র অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরেও সে কিম কে ধমক দিয়ে বলে চাবি বের করতে। আর তাছাড়া আগের কথাগুলো তো ছিলোই। এখান থেকেই আমরা পেয়ে যায় আমাদের দ্বিতীয় সামাজিক সমস্যা।
আমার মুভির কাহিনী নিয়ে সম্পূর্ণভাবে আলোচনা করার কারণ হলো এখান থেকেই মুভির মূলভাবটা বেরিয়ে আসে।
★কেনো প্যারাসাইট অস্কার ডিজার্ভ করে★
আমাদের সমাজব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, আর এর পরিনাম -এগুলোকে খুব সুন্দরভাবেই প্রেজেন্ট করেছে পরিচালক। আর এটার বাস্তবিক কাহিনীই আমার কাছে এই মুভিটাকে অন্যান্য কোরিয়ান থ্রিলার মুভি থেকে আলাদা করেছে। আর আমরা মুভির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরখ করলেও হয়তো বুঝতে পারবোনা যে মুভিতে দোষ কার কতটুকু বা আসলে এখানে ভিলেইন/ হিরো কে। একটা মুভিকে মাস্টারপিস বলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটা বিষয় এই মুভিতে বিদ্যমান। আর অভিনয়ের কথা নাহয় না-ই বললাম।
সবমিলিয়ে এটাই বলবো আপনি যদি একজন বাস্তববাদী মানুষ হন তবে এই মুভিটা আপনার জন্য। এরকম জীবনমুখী একটা মুভি আমাদের এই ঘুণেধরা সমাজপ্রথাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সক্ষম।
https://read.cash/@Zayed500/we-love-muhammad-096b43f2