কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর এই পদ্যটি মনে আছে? বাঙালি চিরকালই জীবনরসিক, সেই সাথে ভোজনরসিকও। বাঙালির বিয়ে হোক বা বউভাত, কব্জি ডুবিয়ে উদরপূর্তি করা এ এক বড় পুরনো প্রথা।
সেকালের বিয়ে অনেকটা প্রদীপ জ্বালবার আগে সলতে পাকানোর পর্বের মতো! বিয়ের আগে ভিয়েন বসতো বিয়েবাড়িতে। পান্তুয়া, জিবেগজা, চিত্রকূট, বোঁদে, নিমকি, মিঠাই সন্দেশ নিপুণ হাতে তৈরি করতো হালুইকরেরা। সে মিষ্টি চাখবার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতো পরিবারের পোলপানদের দল।
লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী অমিয়া চৌধুরী স্মৃতিচারণে নিজের বউভাতের ভোজ প্রসঙ্গে লিখছেন:
‘...বিয়ের দিন গান্ধীজি হরতাল ডেকেছিলেন, প্রিন্স অফ ওয়েলস, অষ্টম এডওয়ার্ডের ভারত আগমন উপলক্ষে।
তাই আগের দিন বড় বড় রুই মাছ ও গলদা চিংড়ি এনে বরফ দিয়ে বাক্সে প্যাক করে রাখা হয়। হাঁড়ি হাঁড়ি দই এবং রাবড়িও ছিল।
উঠানের একধারে বড় বড় উনুন তৈরি হয়েছে। তাল তাল ছানা, খোয়া, বস্তা ভরা চিনি, ময়দা, ঘি-এর টিন এসেছে। মিষ্টি তৈরি করে রাখবার জন্য বড় বড় বারকোষ, থালা, মাটির গামলা। রাঁধুনি পোলাও রান্না করার কথা। খাবার পানি ঠান্ডা করা হয়েছিল বরফ দিয়ে’
সেকালে বনেদি পরিবারের বিয়ের ভোজের ছবি তুলে ধরেছেন লেখিকা শরৎকুমারী চৌধুরানী:
‘...রান্না হইয়াছে পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়া ছোলার ডাল, রুইয়ের মুড়া দিয়ে মুগের ডাল, আলুর দম ও ছক্কা। মাছের চপ, চিংড়ির কাটলেট। ইলিশ ভাজা, বেগুনভাজা, শাকভাজা, পটলভাজা, দই, মাছ আর চাটনি। তারপর লুচি, কচুরি, পাঁপড়ভাজা। মিষ্টান্নের একখানি সরায় আম, কামরাঙা, তালশাঁস ও বরফি সন্দেশ। ইহার উপর ক্ষীর, দই, রাবড়ি ও ছানার পায়েস। ’
স্বচ্ছল পরিবারের পাশাপাশি সেকালে মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারেও বিয়ে, বউভাতে ভোজের ব্যবস্থা ভালোই ছিল। চমকদারি না থাকলেও সে ভোজে আন্তরিকতার স্পর্শ থাকতো। খাওয়া হতো বাড়ির দালান বা ছাদে সামিয়ানা বেঁধে। আসন, চাটাই পাতা হতো। খাওয়া হতো কলাপাতায় আর পানি দেওয়া হতো মাটির গেলাসে। লুচি বা কড়াইশুঁটির কচুরি, কুমড়োর ছক্কা, ডাঁটি সমেত বেগুনভাজা,মাছের মাথা দেওয়া ডাল, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস। দই, ক্ষীর, সন্দেশ। নিতান্ত অভাবের সংসারেও মেয়ের বিয়েতে ভাত, ডাল, ভাজা, শুক্তো, ডালনা, মাছের ঝোল খাওয়ানো হতো গ্রামের বাড়ির অতিথিদের।
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝিতে মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাঙালি বিয়ের ভোজের বর্ণনা পাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায়:
‘কলাপাতায় বড় বড় লুচি আর কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে একটু নুন। মাসকলাই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর এইসব সরায় থাকিত। আর চার রকম সন্দেশ থাকিত। গিন্নিরা নিজেরাই রাঁধিতেন। একদল লোক খুঁত ধরে ভোজ পণ্ড করে দিতো বলে মেয়েরা আর রাঁধিতেন না। ’
পঁচাশি বছর আগে লীলা মজুমদার তাঁর নিজের বিয়ের অভিজ্ঞতাতে লেখেন:
‘বিয়ের রাতে সাড়ে সাতশ লোক চিংড়ি মাছের মালাইকারি, রাবড়ি ইত্যাদি ভালো ভালো জিনিস খেয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন’
সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। বাঙালি জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। একালের বিয়ে-বউভাতের ভোজেও তার ছায়া পড়েছে। এখন বাঙালির বিয়েতে ভাড়া বাড়িই ভরসা। আর খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব পড়ে কেটারিং এর ওপর। অর্থ-ক্ষমতার গৌরব সেকালের মতো একালেও আছে। নামি কেটারিংয়ের বিরিয়ানি, মোগলাই, চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল খানা পরিবেশন করে তাক লাগিয়ে দেয়া হয় অতিথিদের।
সনাতন বাঙালি খাবার যেমন লুচি, কড়াইশুঁটির কচুরি, মাছের মাথা দেওয়া মুগের ডাল, রুই মাছের ভুনা ভোজ্য তালিকা থেকে এখন অদৃশ্য। অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে চিংড়ির কাটলেট। দেখা যায় না আর কলাপাতা, মাটির থালা ও মাটির গ্লাস। দেখা যায় না লুচি, লম্বা ডাঁটি সমেত বেগুনভাজা আর কুমড়োর ছক্কা। আসনের বদলে জায়গা করে নিয়েছে চেয়ার টেবিল অথবা বুফে। নিজেই পছন্দমতো খাবার তুলে গল্প করতে করতে দাঁড়িয়ে খাওয়া। ক্ষীর, দই, রাবড়ির জায়গা নিয়েছে নানা রকমের আইসক্রিম বা কুলফি।
আমিষ পদে এখন বড় জায়গা জুড়ে আছে চিকেন। যা পঞ্চাশ বছর আগেও বাঙালি ঘরে ছিল ব্রাত্য। চিরাচরিত পদ লুচি, কচুরির জায়গা কেড়ে নিয়েছে নান বা লাচ্ছা পরোটা। পুরনো দিনের কাজু কিশমিশ, ঘি-মেশানো ভাতের জায়গা কেড়ে নিয়েছে বিরিয়ানি, জিরা রাইস বা নিম্বু রাইস।
একালে বিয়ে বাড়ির বুফেতে সাজানো থাকে হরেক রকমের রঙবেরঙের স্যালাড। আর দেখা যায় না সেই সব ‘খাইয়ে মানুষদের’। যারা বিশখানা মাছের টুকরো বা পঞ্চাশটা রসগোল্লা অনায়াসে খেয়ে নিতেন বিনা ক্লান্তিতে। তাঁরাও হারিয়ে গিয়েছেন সেকালের বিয়ের ভোজের মতো।
এখন শীতের মরশুম। পশ্চিমবাংলায় বিয়ের সিজন। আজও পরিবারে কারো বিয়ে হলে এখানকার মানুষ আনন্দের সাথে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তাদের মনের স্মৃতির কুঠুরিতে আজো উঁকি দ্যায় বাঙালি বিয়ের সেকাল ও একাল।