ভেজা চিরকুট -- ৬০তম পর্ব

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

১১১.

মোবাইলটা সাথে আনেনি অনু। হাতে ঘড়ি নেই। তবে হাসপাতালের ঘড়িতে সময়টা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট- সকাল সাড়ে ৯টা বাজে এই মুহূর্তে।

ভোরবেলা হঠাৎ করেই নুরুল ইসলামের বুকে ব্যথা শুরু হয়। ভীষণ ঘামতে শুরু করেন তিনি। শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। বমি হচ্ছিল। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল বাড়ির সবাই। বেশ ক'বার তো অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আবার নিজেই হাত দিয়ে বুক চেপে ধরছিলেন। শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ঝাপসা চোখে তিনি দেখেছিলেন, সবার আতঙ্কিত মুখখানি। মাথা খুব ঝিমঝিম করছিল সেসময়, তাই তাকিয়েও থাকতে পারেননি। বুকে চাপা ব্যথা, আর প্রচণ্ড ভার অনুভব করছিলেন। তিনি নিজেও এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলেন, এটাই বোধহয় শেষ সময়, শেষবারের জন্য আপনজনদের দেখা। তবে বাড়ির সবাই এটা বুঝেছিল, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে নুরুল ইসলামের। সেজন্য দেরি না করে এম্বুল্যান্স ডাকে, এবং গৃহকর্তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসে।

বাইরে থেকেই একনজর বাবাকে দেখল অনু। এখন কেবিনে আছেন উনি। পাশে মমতাজ বেগম বসে বসে চোখ মুছছেন। আবার নিঃশব্দে অশ্রু ঝড়াচ্ছেন। কেবিনের বাইরে অনু, বাঁধন সহ বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা আছে। মাথা নুইয়ে, গম্ভীরমুখে বেঞ্চিতে বসে আছেন সবাই। ডাক্তার নিজের রুমে আছেন। এখনো ডাকেননি। নুরুল ইসলামের শারিরীক অবস্থা এই মুহূর্তে অনেকটা ভালো। তবুও যতক্ষণ না ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারছে, নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কেউই। সবার মাঝেই একটা উদ্বেগ কাজ করছে।

কাঁধে হাত পড়ায় পাশে তাঁকালো অনু। শুভ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে৷ চোখ দু'টো আধভেজা। দুর্বলতার ছাপ দেখা যাচ্ছে। চোখের চারিপাশ সামান্য ফুলেছে। হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত শুভ্রকে এই অবস্থায় দেখে ভীষণ অসহায়বোধ করল অনু। মনটা কেঁদে উঠল আবার। কেউ দেখল না এই কান্না। কিন্তু এই অদৃশ্য কান্না তাঁর ভিতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। শুভ্র'র গলার আওয়াজ শুনে স্বাভাবিক হলো সে।

শুভ্র কান্না জড়ানো গলায় সান্ত্বনা দিলো বোনকে। বলল, "চিন্তা করো না, ঠিক হয়ে যাবে।"

শুকনো হাসি দিলো অনু। মুখে কোনো জবাব দিলো না।

শুভ্র আবার বলল, "তুমি বরং চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসো৷ তাহলে ফ্রেশ লাগবে।"

"তুমিও চলো।" ক্ষীণ গলায় বলল অনু।

শুভ্র জবাবে বলল, "তুমি যাও, আমি আসছি।"

ওঠে দাঁড়াল অনু। একবার বাঁধন আর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর শুভ্র-ও ওঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বলল, "ভাইয়া, আমি বরং কিছু খাবার কিনে আনি। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে সবার। মা-ও খায়নি।"

বাঁধন হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিয়ে বলল, "বাকিদের জন্য আন। আমি এখন খাবো না।"

"তুমি কি এখন অফিসে যাবে?" শুভ্র সরল গলায় জানতে চাইল।

বাঁধন বলল, "না। ফোন করে 'আজ আসবো না' বলেছি। খেতে ইচ্ছে করছে না এখন। আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলি, এরপর দেখা যাবে।"

শুভ্র বৃষ্টির দিকে তাকাতেই বৃষ্টি বলে উঠল, "আমি এখন কিছু খাবো না, ভাই। এখন থাক বরং। এইরকম চিন্তার মধ্যে কেউই খাবে না।"

"ঠিক আছে, আমি তাহলে চোখে-মুখে একটু পানি দিয়ে আসছি।" হেঁটে চলে গেল শুভ্র।

অনু ফিরে এলো প্রায় ১০ মিনিট পর। এসে আগের জায়গায় বসতেই একজন নার্স এসে সহসা বলল, "ডাক্তার সাহেব ডাকছেন।"

অনু ছুটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বাঁধন বৃষ্টিকে বসতে বলে অনুর পিছনে পিছনে গেল। দরজার বাইরে থেকে দেখল অনু বসে কথা বলছে ডাক্তারের সাথে। ভিতরে ঢুকল বাঁধন।

ডাক্তার বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বিনয়ী গলায় বলল, "আসুন, বসুন এখানে।"

অনুর পাশের ফাঁকা চেয়ারটাতে বসল বাঁধন। উদগ্রীব চাহনিতে তাকিয়ে রইল ডাক্তারের মুখের দিকে। অভিজ্ঞ ডাক্তার। বয়স আনুমানিক ৫০ উর্ধ্ব। বাঁধনের পরিচিত। ডাক্তার গলা খাঁকারি দিতেই শক্ত হয়ে বসল বাঁধন।

ডাক্তার বলতে লাগলেন, "বাঁধন সাহেব, আপনার বাবার হার্টের অবস্থা খারাপ। আগেও অ্যাটাক হয়েছিল।"

অনু ছটফটে গলায় বলে উঠল, "হ্যাঁ। তবে বেশ কয়েক বছর আগে। এরপর সবকিছু ঠিক ছিল। ভোরবেলা হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা শুরু হলো।"

ডাক্তার অনুর দিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ।"

বাঁধন হালকা স্বরে ধমক দিলো অনুকে, "অনু, একটু চুপ কর।"

অনু আর কথা বলল না। মুখ কালো করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকল।

ডাক্তার আবার বলতে শুরু করলেন, "আমাদের হৃদপিণ্ডে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তা হৃদযন্ত্রে আসে ধমনী দিয়ে। সেটি যখন সরু হয়ে যায়, তখন নালীর ভেতরে রক্ত জমাট বেধে যেতে পারে। ফলে নালীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রের পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যায়, ফলে আর সে অক্সিজেন প্রবাহিত করতে পারে না। হৃদপিণ্ডের ভেতর দিয়ে অক্সিজেন প্রবাহিত না হতে পারলেই হার্ট অ্যাটাক হয়।" (সোর্স: গুগল)

"বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?" ডাক্তারকে থামিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল অনু।

মুখ শক্ত করে বাঁধন আবার বলল, "চুপচাপ বসে থাক, না হয় বাইরে গিয়ে বৃষ্টির পাশে বোস। আমি কথা বলে আসছি।"

অনু মনোক্ষুণ্ণ হয়ে চোখ নামিয়ে নিলো নিচের দিকে। হাত দু'টো থাই এর উপর রেখে ঘন ঘন শ্বাস ত্যাগ করতে লাগল।

ডাক্তার অনুর দিকে তাকিয়ে বলল, "চিন্তা করবেন না। এখন সব ঠিক আছে। তবে ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা অনেকটা আপনাদের উপরও নির্ভর করছে। আপনারা উনাকে যতটা ভালো রাখতে পারবেন, উনি ততটা সচ্ছল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। হার্ট অ্যাটাকের অনেক কারণই আছে। উনি ব্যবসায়ী মানুষ ছিলেন। চিন্তাভাবনা বেশি ছিল। ফলে প্রথম অ্যাটাক হয়। এবারও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো খুব ভাবছিলেন উনি। রাতে ঘুমাতে পারেননি। বুকে চাপ পড়েছিল। চাপটা হার্ট নিতে পারেনি। যার ফলে এইরকমটা হয়েছে৷"

অনুর বুকের উপর যেন আস্ত একটা পাহাড় এসে পড়ল। বাবার টেনশনের কারণটা নিজের মতো করে ভাবতেই তাঁর সারা শরীর শিউরে উঠল। আনমনে বিড়বিড় করতে লাগল সে। "রাতে না ঘুমিয়ে কী ভাবছিল বাবা? মামুনের কথা? বিয়ের পর আমি কীভাবে থাকবো ওখানে, এইসব ভেবেই কি নির্ঘুমে রাত পার করেছেন তিনি? উনি কি মামুনকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি? বাধ্য হয়ে মামুনের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। আর সেই বাধ্য আমি করেছি। তাহলে কী বাবার এই করুণ অবস্থার জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে আমিই দায়ী? আমার জন্যই বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?" বিড়বিড় করে অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে অনু।

অনুর শেষের কথাগুলো একটু জোরেই শোনালো বলে বাঁধন আবার উচ্চস্বরে ধমকালো অনুকে। এবার অনুর হাত ধরে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, "আয় আমার সাথে।"

প্রতিরোধ করার সুযোগই পেলো না অনু। চট করে বাইরে এসে বৃষ্টির পাশে তাকে বসিয়ে দিলো বাঁধন। এরপর বিকট আওয়াজ করে বলল, "এখান থেকে এক পা নড়বি তো খবর আছে। চুপচাপ বসে থাক।" বৃষ্টির দিকে তাকালো বাঁধন। বলল, "ওকে ধরে রেখো, বৃষ্টি। ওর জন্য ডাক্তারের সাথে ভালোভাবে কথাও বলতে পারছি না।"

বৃষ্টি মাথা ঝাঁকিয়ে অনুর হাত ধরল বটে, তবে বাঁধন চলে যেতেই হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ বেঁকিয়ে অনুর উদ্দেশ্যে বলল, "সব জায়গায় গণ্ডগোল না করলে হয় না তোমার, তাই না?"

অনুর মুখ থেকে কোনো শব্দই বেরোলো না আর। নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে সে। নিজেকেই দোষারোপ করছে।

নুরুল ইসলামকে নিয়ে সবাই বাড়িতে ফিরল বিকেলে। বাঁধন আর বৃষ্টি নিজের ঘরে চলে গেল। মমতাজ বেগম গেলেন স্বামীর জন্য কিছু খাবার রান্না করতে। শুভ্র-ও নেই এখানে। ঘরে অনু আর নুরুল ইসলাম শুধু।

জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখছেন নুরুল ইসলাম। পড়ন্ত বিকেলে। ছন্নছাড়া কিছু মেঘ এদিক-সেদিক খেলা করছে। ক্লান্ত সূর্যটা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আকাশের রং হয়েছে তিন রকম। কোথাও ধূসর রঙের মেঘ, কোথাও নীল আবার কোথাও গাঢ় সাদা।

বাবাকে এমন নিস্তব্ধ দেখে অনু আহত গলায় বলল, "বাবা, তোমার শরীর এখন কেমন আছে?"

পাশ ফিরে মেয়ের দিকে তাকালেন নুরুল ইসলাম। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সহসা উজ্জীবিত ভাবে বললেন, "ভালো আছি, মা। বুকের ব্যথাটা এখন আর নেই।"

শ্বাস আটকিয়ে অনু জানতে চাইল, "বাবা, তোমার চিন্তার কারণ কী আমি? তুমি কি মামুনকে মন থেকে মেনে নিতে পারছ না? অর্ককে বিয়ে করব না বলে আমি কি তোমায় খুব আঘাত দিয়ে ফেলেছি?" একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো বাবার দিকে ছুড়লো অনু। জবাবের আশায় তাকিয়ে থাকল বাবার মুখের দিকে।

নুরুল ইসলাম প্রশ্নগুলো উপেক্ষা করে সামান্য আফসোস প্রকাশ করে বললেন, "ওহ্ হো! আজ তো মামুনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল আমার। হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল যে, সব এলোমেলো হয়ে গেল। ছেলেটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওকে ফোনে বলেছিস আমরা আজ আসতে পারব না?"

"তুমি আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও, বাবা।" অনু কণ্ঠে দৃঢ়তা এবং বেশ জোর প্রকাশ পেলো।

নুরুল ইসলাম বললেন, "তুই ভুল ভাবছিস। মামুনকে মেনে না নিলে আমি কখনোই ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে চাইতাম না। আর তোর কথায় আমি কষ্ট পাবো কেন? বরং তুই যদি আমার কথা ভেবে অর্ককে বিয়ে করতে বাধ্য হতি, এবং সেটা আমি পরে জানতে পারতাম, তাহলে আমার কষ্ট হতো। তুই নিজের মনের কথা, ইচ্ছের কথা আমাকে বলেছিস, এতে আমি খুব খুশি হয়েছি।"

অনু চিন্তামগ্ন হয়ে বলল, "তাহলে তোমার এত টেনশন কীসের? ডাক্তার বলল, খুব বেশি টেনশন থেকেই অ্যাটাকটা হয়েছে। তুমি কি রাতে ঘুমাওনি?"

হালকা শব্দ করে হেসে উঠলেন নুরুল ইসলাম। বললেন, "ঘুমিয়েছি, মা।"

"তাহলে হঠাৎ এইরকম হলো কেন?" অনুর কপালে ভাজ পড়ল।

নুরুল ইসলাম বললেন, "জানি না, হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল। এর আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্ন দেখেই ঘুমটা ভেঙে যায়।"

"কী স্বপ্ন?"

"একটা দুঃস্বপ্ন!"

"তাহলে বলতে হবে না।" অনু সচকিত হয়ে বাবার হাত চেপে ধরল। আবার বলল, "দুঃস্বপ্নের কথা না বলাই ভালো।"

মাথা ঝাঁকালেন নুরুল ইসলাম। মুখে বললেন, "ওকে।"

অনুর কৌতূহল হলো। দুঃস্বপ্নটা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ল মনটা। আকুল চোখে বাবার দিকে তাকালো সে।

নুরুল ইসলাম জানতে চাইলেন, "কী হলো?"

মুখ ভেজার করে অনু বলল, "আমি শুনবো। বলো তুমি।"

"এক্ষুনি তো বললি দুঃস্বপ্নের কথা বলতে হয় না।"

"হয় না, তবুও বলো। না শুনলে শান্তি পাবো না আমি।"

অগত্যা দুঃস্বপ্নটা বলতে শুরু করলেন নুরুল ইসলাম। "আমি দেখি, হঠাৎ করেই মরে যাই আমি। আমি মরে যাওয়ার পর সবকিছু কেমন পাল্টে যায়। মমতাজ, বাঁধন, বৃষ্টি, সবাই কেমন যেন হিংস্র হয়ে ওঠে; এমনকি শুভ্র-ও। সবাই এক হয়ে তোকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তুই পুরোপুরি একা হয়ে যাস। কেউ থাকে না তোর পাশে। নিঃসঙ্গ হয়ে পড়িস। একদিকে আমার মৃত্যু, অন্যদিকে সর্বহারা, এইসব কিছু তোকে পাগল করে দেয়। আঘাতটা সহ্য করতে পারিস না তুই। আর তখনই ভুলটা করিস।" বাকিটুকু বলতে পারলেন না নুরুল ইসলাম। হাঁপিয়ে উঠলেন আচমকা। কপালে ঘাম জমতে শুরু করল।

অনু চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। চেঁচাতে শুরু করল। "বাবা, কী হলো তোমার? শান্ত হও, কথা বলো না তুমি। মা, মা, বাঁধন ভাইয়া, শুভ্র। এদিকে এসো।"

অনুর গলার আওয়াজ পেয়ে একপ্রকার দৌড়ে এলো সবাই। মমতাজ বেগম এসে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। বাঁধন দেখল, বাবা আবার ঘেমে যাচ্ছে। হাঁপানি রোগীদের শ্বাস নিচ্ছে বড় বড় করে।

এগিয়ে এসে হাতপাখাটা তুলে নিলো বাঁধন। বাতাস করতে লাগল। অনু বাবার শার্টের বোতাম খুলে দিলো। বৃষ্টি ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো।

প্রায় মিনিট পাঁচেক পর শান্ত হলেন নুরুল ইসলাম। শ্বাসটাও স্বাভাবিক হলো তাঁর। ঘাম শুকিয়ে গেল; আর ঝড়ল না। সবার দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। অনু বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, "সরি, বাবা। আমার জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি।"

মমতাজ বেগম অনুকে ধাক্কা মেরে রাগান্বিত গলায় বললেন, "অলক্ষুণে মেয়ে কোথাকার, যা এখান থেকে। কী জিজ্ঞেস করেছিস তুই, যে মানুষটা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল।"

অনু নির্বাক থাকল। হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে বাবার থেকে দূরে সরে এলো।

শ্বাশুড়িকে সঙ্গ দিয়ে বৃষ্টিও কঠিন গলায় বলে উঠল, "অনু, তুমি যাও তো এখান থেকে। তুমি বাবার আশেপাশে থাকলেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই পরিবারটার আর কত ক্ষতি করবে তুমি? তোমার জায়গায় আমি হলে এতদিনে গলায় দড়ি দিতাম। নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে কোথাকার!"

প্রতিবাদ করতে পারল না অনু৷ গলার কাছে এসে কথাগুলো আটকে গেল। যেন গলা টিপে ধরেছে কেউ। চোখ দু'টো থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগল। নিঃশ্বাসটা প্রচণ্ড ভারী মনে হলো এই মুহূর্তে। বুকের ভিতর অসহ্যকর এক যন্ত্রণা। কেউ যেন ছুরিকাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করছে হৃদয়টাকে। বিছানা থেকে নেমে ধীর গতিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে।

বুকটা হালকা ভাবে চেপে ধরে খুব কষ্ট করে নুরুল ইসলাম বললেন, "মা, মামুনকে ফোন করে বল, কাল যেন আমার সাথে দেখা করে।"

অনু ফুঁপিয়ে উঠল। বলল, "বাবা, প্লিজ।"

"এটা আমার হুকুম।" গলায় জোর দিলেন নুরুল ইসলাম। "অবশ্যই বলবি, এক্ষুণি। আর আজকে যেতে না পারার জন্য ক্ষমা চাইনি।"

অনু কান্না জড়ানো গলায় বলল, "এখন এইসব বাদ দাও, বাবা। তুমি রেস্ট করো। তোমার থেকে আর কেউ বেশি না আমার কাছে। তুমি সুস্থ থাকলেই আমি খুশি। সুখে থাকার জন্য আর কাউকে দরকার নেই আমার।"

নুরুল ইসলাম বললেন, "আমার মনে হচ্ছে, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। দেখলি না, অল্পতেই কী অবস্থা হলো? এভাবে ক'দিন আর বাঁচবো? তাই আমি চাই, চলে যাওয়ার আগে তোকে একটু সুখে দেখতে। আমি চলে যাওয়ার পর এরা তোকে কতটা দেখবে, তা আমি জানি না। কিন্তু আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই যখন মামুনকে বিশ্বাস করিস, তাই আমিও বিশ্বাস করছি। তোর উপর আমার আস্থা আছে। তুই কখনো ভুল করবি না। আমি চাই, যত দ্রুত সম্ভব মামুনের সাথে তোর বিয়ে দিতে। অন্তত আমি চলে যাওয়ার পর এমন একজন তোর পাশে থাকবে, যে তোর একান্ত আপনজন।"

অনু জবাব না দিয়ে ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। নুরুল ইসলাম না থেমে বলতে লাগলেন, "আমার এই শেষ ইচ্ছেটা রাখ, মা। তুই মামুনকে ফোন করে বল, কালই যেন আমার সাথে দেখা করে। দেখা করতেই হবে ওকে। আমি একটু নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে চাই।"

বাবার কথাগুলো খুবই বিষাক্ত লাগল অনুর কাছে। মনে হলো এই বিষাক্ত কথাগুলো সে খেলো, এবং বুকে জ্বালা শুরু হলো। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল অনু। দরজাটা আটকে দিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো।

অনু চলে যেতেই মমতাজ বেগম গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন, "এই মামুনটা কে? তোমার বন্ধুর ছেলের নাম তো অর্ক। সত্যি করে বলো তো, তোমরা দু'জনে মিলে ঠিক কি করতে চাইছ।"

নিচের দিকে তাকিয়ে নুরুল ইসলাম বললেন, "কাল ও আসলেই সব জানতে পারবে।"

দীর্ঘক্ষণ কেঁটে গেল এভাবেই। কান্না থেমে গেছে আগেই। মেঘলা আকাশের মতো বিষণ্ণ মুখ করে শুয়ে ছিল অনু। সম্বিত ফিরল মোবাইলের রিংটোনের শব্দে। নিজেকে সামলে নিয়ে মোবাইল হাতে তুলে নিলো সে।

স্ক্রিনে চোখ পড়তেই মামুনের নম্বরটা ভেসে উঠলো। রিসিভ করার ইচ্ছে নেই, তবুও রিসিভ করল অনু। অন্তত একটা সরি বলা প্রয়োজন। গতকাল রাতেই মামুনকে ফোন করে নিজেদের যাওয়ার কথা বলেছিল সে। নিশ্চয়ই অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল মামুন।

ফোনটা কানে ধরে সালাম দিলো অনু। "আসসালামু আলাইকুম।"

ওপাশ থেকে মামুন উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠল, "ওয়ালাইকুমুস সালাম। অনু, কোথায় তুমি? সেই সকাল থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি, রিসিভ করলে এখন।"

কান্নাটা সামলে নিয়ে অনু বলল, "আসলে, ভোরবেলা হঠাৎ বাবার বুকে ব্যথা শুরু হয়। এরপর উনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। মোবাইলটা বাড়িতেই ছিল।"

"ওহ্! সরি, আমি জানতাম না।" মামুনের কণ্ঠে তীব্র দুঃখের ছাপ! চিন্তান্বিত গলায় প্রশ্ন করল সে, "উনি এখন কেমন আছেন?"

অনু বলল, "এখন ভালো আছে।"

"আমি কি আসবো একবার?"

ভাবান্তর গলায় অনু বলল, "উম, এখন আসতে হবে না। কাল এসো। বাবা বলেছেন তোমায় এসে দেখা করতে। কালকে যেকোনো সময় এসে দেখা করো বাবার সাথে।"

"ঠিক আছে।"

"আর সরি।"

"কেন?"

অনু ভার গলায় বলল, "আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তোমাদের। তবুও শেষমেশ আমরা যেতে পারলাম না।"

"এর জন্য তুমি ক্ষমা চাচ্ছ কেন? এখানে তো তোমার হাত নেই। যা হওয়ার ছিল, তাই হয়েছে। এর পরেও যা হওয়ার, তা-ই হবে। তুমি চিন্তা করো না। কাল আমি ঠিক তোমার বাবার সাথে দেখা করব।"

"থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।"

"এই ইংরেজির বাংলা অনুবাদ আমি জানি। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ মানে অনেক অনেক ধন্যবাদ।"

হেসে উঠল অনু। ম্লানমুখে হঠাৎ প্রসন্ন হাসিটা ভীষণ অদ্ভুত দেখালো! মামুনের এইরকম রসিকতা তাকে প্রতিবারই বিমোহিত করে আনন্দ দেয়।

মামুনও হালকা আওয়াজে হেসে বলল, "তোমার গলাটা কেমন যেন শোনাচ্ছিল এতক্ষণ। এবার ঠিক আছে। সবসময় হাসিখুশি থাকবে।"

মৃদুস্বরে অনু বলল, "হুম, থাকব। এবার রাখছি তাহলে।"

"ঠিক আছে।"

ফোন কেঁটে দিয়ে বালিশটা কাছে টেনে নিলো অনু৷ চোখ-মুখের বিষণ্ণতা কেঁটে গেছে ইতোমধ্যে। উজ্জ্বলতার দেখা মিলছে। মোবাইল হাত থেকে নামিয়ে রেখে বালিশে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে শুলো সে।

১১২.

অনু সকাল ৮টায় বাড়ি থেকে বেরোলো। অফিসে পৌঁছালো সাড়ে ৯টায়। রাস্তায় জ্যাম ছিল কিছুটা। তবুও সময়টা কমই লেগেছে।

রিসিপশনে একটা মেয়ে বসে আছে। বয়স ২২-২৫ এর মধ্যে হবে। অনুর থেকে খুব বেশি ছোট হবে না। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সদ্য প্রেমে পড়া তরুণীর মতোই মুচকি হাসি। অনু ডাকতেই কম্পিউটারের দিক থেকে চোখ ফেরালো। হাসিটা অব্যাহত রেখে ওঠে দাঁড়াল।

অনু বলল, "আমি ইন্টারভিউ দিতে এসেছি৷ এখান থেকে ফোন করা হয়েছিল আমাকে।"

উচ্ছল কণ্ঠে মেয়েটি জানতে চাইল, "আপনার নাম?"

"অনু।"

মেয়েটি আবার কম্পিউটারে তাকালো। অনুকে খুঁজতে লাগল। কিছু সময় পর ব্যর্থ হয়ে বলল, "এখানে তো অনু নামে কেউ নেই।"

আলতো করে নিজের মাথায় থাপ্পড় মারল অনু। হালকা শব্দ করে হেসেও উঠল।

রিসিপশনের মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে বলল, "কী হলো?"

ভুলটা শুধরে নিলো অনু। হাসি থামিয়ে বলল, "অহনা নাম।"

এবার আর কম্পিউটারের দিকে তাকালো না মেয়েটা। আগের মতোই প্রানবন্ত ভাবে বলল, "ডাক নাম বুঝি অনু? আমি আসলে সিভি দেখে অহনা নামটাই তুলেছিলাম। সেজন্য অনু নাম বলায় চিনতে পারিনি। আমি নিজেই আপনাকে ফোন করেছিলাম সেদিন।"

মেয়েটির সাথে তাল মিলিয়ে হাসল অনু। মাথাটা সামান্য দুলিয়ে বলল, "আসলে সবাই অনু নামে ডাকে। আমিও এই নামেই পরিচয় দেই। তাই এখানেও সেই অনু নাম বলে ফেলেছি।"

"কোনো অসুবিধা নেই। আমার নাম শ্রেয়সী। আমি কিন্তু আপনাকে অনু বলেই ডাকব।" শ্রেয়সী কথাটা শেষ করে আবারও হাসল। মুখটা উজ্জলতায় পরিপূর্ণ। বিষণ্ণতার ছাপ নেই কোত্থাও।

অনু প্রথমে ভেবেছিল, মেয়েটা বিশেষ কারণে মিটমিট করে হাসছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, মেয়েটার মুখশ্রীটাই হাস্যোজ্জ্বল। বিমুগ্ধ হয়ে শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে থেকে অনু জানতে চাইল, "আমি একাই কি ইন্টারভিউ দিতে এসেছি? আর কাউকে দেখছি না তো।" পিছনের ফাঁকা চেয়ারগুলোকে ইঙ্গিত করল অনু।

শ্রেয়সী বলল, "এইসময় আপনিসহ তিনজনকে আসতে বলেছিলাম। একজন এখনো পৌঁছায়নি। আর একজন ভিতরে আছে। ম্যাডাম কথা বলছেন উনার সাথে।"

"ওহ্। ইন্টারভিউ তাহলে ম্যাডাম নিচ্ছেন। উনি একাই, না আরও কেউ আছে?"

"ম্যাডাম একাই ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। এই কারণেই মূলত সবাইকে এক সময় আসতে মানা করেছেন ম্যাডাম। এখন তিনজন, আবার হয়তো লাঞ্চের পর তিনজন। কালকেও আছে। ম্যাডাম আমাকে বলেন, আমি সেই সময় অনুযায়ী ফোন করে আসতে বলি। যেমন আপনাকে বলেছি। ম্যাডাম আসলে ঝামেলা পছন্দ করেন না। তাঁর ধারণা, একসাথে অনেকজন পার্থী আসলে একটা গণ্ডগোল বাঁধবে। পার্থীরা যেমন দেরি হচ্ছে বলে বিরক্ত হবে, তেমনি ম্যাডামও একের পর এক ইন্টারভিউ নিতে বিরক্তি বোধ করবেন। সেজন্য এইরকম সিস্টেম। কাজের প্রতি খুব সিরিয়াস ম্যাডাম। যা করবেন, কোনো ফাঁকফোকড় না রেখে করবেন।"

শ্রেয়সীর কথাগুলো শুনে অনুর ভয় হলো কিছুটা। মুখটা মলিন হলো। অস্থিরতা কাজ করছে ভিতরে।

অনুকে দেখে মনে হলো, হঠাৎই জলন্ত আগুনটা নিভে গেছে। শ্রেয়সী খেয়াল করল ব্যাপারটা। ভ্রু কুঞ্চিত করে জানতে চাইল, "কী হলো?"

অনু ইতস্ততভাবে বলল, "ম্যাডাম কি খুব রাগী?"

শ্রেয়সী হেসে উঠল অনুর কথা শুনে। যেন খুব বড় হাসির কথা বলেছে অনু! হাস্যরত ভাবেই বলে উঠল সে, "মিস অনু, কাজের প্রতি সিরিয়াস মানেই রাগী হওয়া না। ম্যাডাম খুব ভালো একজন মানুষ।"

বিব্রত মুখ করে অনু বলল, "আসলে, আগে তিনটা অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, একটাতেও চাকরি হয়নি। রেজাল্টও আহামরি কিছু নয়, যে তাঁরা খুব ভেবেচিন্তে হ্যাঁ বা না বলবেল। তার উপর এমন সব প্রশ্ন করেন যে, আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। দেখা গেল, একটা হাস্যোকর প্রশ্ন করে তাঁরা খুব গম্ভীর, তেজি প্রতিক্রিয়া দেখালো। এইরকম করলে তো আমি বিভ্রান্ত হবোই। কেউ আবার ধুমসে ইংরেজি বলা শুরু করে। আরে ভাই, একটু আস্তে বল। আমাকে বুঝতে দে। গরুর মতো ইংরেজিতে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করলে হবে? আমি কি ইংরেজিতে ডক্টরেট, যে এত দ্রুত ইংরেজি বললে আমি সব বুঝতে পারব। মাত্র অনার্স পাস আমি। তোদের তো বুঝতে হবে।" কথাগুলো বলা শেষে আক্রোশে হাতের ফাইলটা মুচড়াতে লাগল অনু।

অনুর কথাগুলো মুখ 'হা' করে শুনছিল শ্রেয়সী; অনু থামতেই এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল সে। পাশ দিয়ে হাঁটছিল যারা, তাঁরা কৌতূহলী চোখে তাকালো একবার। তবে শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো, যেন শ্রেয়সীর এই হাসিটা অত্যন্ত স্বাভাবিক সবার কাছে।

শ্রেয়সীর সামনের টেলিফোনটা বেজে উঠায় হাসি থামিয়ে রিসিভার তুলে ওপাশের মানুষটার কথা শুনল; রিসিভারটা আবার নামিয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে বলল, "ম্যাডাম আপনাকে ডাকছেন। দু'তলায় গিয়ে ডান দিকে। দরজায় সামিরা নাম লেখা। শুভ কামনা।"

কৃতজ্ঞতা ভঙ্গিতে হেসে ফাইলটা ঠিক করে হাঁটতে শুরু করল অনু। দু'তলা পেরিয়ে ডান দিকে যেতেই একটা রুমের সামনে থেমে গেল। নামটা দেখে নিশ্চিত হয়ে নিলো৷ দেয়াল গ্লাসের। ভিতরের একজন মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। খুব ব্যস্ত হয়ে ল্যাপটপের কিবোর্ডে লিখছেন তিনি।

দরজাটা সামান্য ধাক্কা দিতেই ফিরে তাকালো সামিরা। অনু বিনয়ী সুরে সালাম দিলো। বলল, "আসসালামু আলাইকুম, ম্যাম।"

সামিরা সোজা হয়ে ল্যাপটপটা হালকা সরিয়ে রাখল পাশে। সালামের জবাব দিয়ে বলল, "ওয়ালাইকুমুস সালাম। এসো, অহনা।"

সরাসরি তুমি শব্দটা শুনে বেশ অবাকই হলো অনু। এইরকম আগে ঘটেনি। চেয়ারে যিনি বসে আছেন, তিনি বয়সে বড় বটে, তবে উনার থেকে বেশি বয়সী মানুষের সামনে বসে ইন্টারভিউ দিয়েছিল অনু, তাঁরা সবাই আপনি বলে সম্মোধন করেছিল। অবশ্য অনুর ভালোই লাগল ব্যাপারটা। উচ্চ পর্যায়ে কেউ তুমি করে বললে বেশ ভালো লাগে। মনে হয়, অপরপ্রান্তের মানুষ বুঝি আমাকে আপন ভাবতে চাইছে। অভিভূত হয়ে অনু দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল।

সামিরা আবার বলল, "এসো, ভিতরে এসো।"

আপাদমস্তক হেসে ভিতরে ঢুকল অনু। টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

সামিরা ল্যাপটপের দিকে একনজর তাকালো, আবার অনুর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট এবং দৃঢ় কণ্ঠে বলল, "তুমি আমার ছোট, তাই তুমি করেই বললাম। কিছু মনে করোনি তো?"

"না।" মৃদুস্বরে জবাব দিলো অনু।

সামিরা আবার বলল, "দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো।"

অনু 'ধন্যবাদ' দিয়ে বসল চেয়ারে। হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলো।

সামিরা ফাইলটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, "শ্রেয়সী মেয়েটাকে কেমন দেখলে?"

"হ্যাঁ!" সংকোচিত হলো অনু। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল সামনের মানুষটার দিকে। পরণে শাড়ী। সাজটা অনেকটা গৃহবধূর মতো। চুলগুলো খোলা। তবুও বেশ গোছানো, সুন্দর দেখতে। মুখশ্রী বেশ সিগ্ধ। অথচ এতবড় একটা পোস্টে চাকরি করছে। বেতন লাখ টাকা তো হবেই। বেশিও হতে পারে। নিজের দিকে একবার তাকালো অনু। পরণে থ্রিপিস। মুখটা ফেকাসে হয়ে আছে। এতটা পথ জার্নি করে আসায় চুলগুলোও একটু এলোমেলো। রাগ হলো অনুর। ভিতরে আসার আগে একবার ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসা উচিত ছিল। তাহলে অন্তত এখনকার মতো অস্বস্তি বোধ হতো না।

সামিরা চোখ উপরে তুলে বলল, "শ্রেয়সীর কথা বলছি। খুব ভালো মেয়ে, তাই না? অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। আপাতত চাকরিটা পার্টটাইম করছে। খুব কাজের। বিরক্ত হয় না, হাসিমুখে কাজ করে যায়। এই ধরনের মানুষকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। অনার্সটা কমপ্লিট হলেই ওর প্রমোশন হবে। আগেই নিশ্চিত করে দিয়েছি আমি।"

অনু মৃদুস্বরে তাল মিলালো, "হুম, খুব ভালো মেয়ে। মিশুক প্রকৃতির।"

"খুব হাসছিলে দেখলাম। সেজন্যই জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে।" ফাইলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে গেল সামিরা।

অনু আবার ভুরু কুঁচকে তাকালো। মনেমনে ভাবল, আমরা হাসলাম, সেটা উনি কীভাবে জানলো?

অনুকে কৌতূহলী দেখে সামিরা ডান দিকে তাকানোর নির্দেশ দিলো। সে নিজে তাকালো ল্যাপটপের দিকে।

অনু ডান দিকে তাকাতেই দেখল একটা বড় মনিটর। যেখানে বিভিন্ন স্থানের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠেছে। রিসিপশনের শ্রেয়সীকেও দেখা যাচ্ছে। এখানে এসে অবাকের পর অবাক হচ্ছে অনু। রিসিপশনে যে ক্যামেরা লাগানো আছে, সেটা তাঁর নজরেই আসেনি।

সামিরা বলল, "একটা জায়গা বাদে বাকি সব জায়গাতেই ক্যামেরা আছে।"

অনু সামনের লাগিয়ে বিড়বিড় করে জানতে চাইল, "কোন জায়গায় নেই?"

সামিরা বলল, "ওয়াশরুমে।"

লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে ফেলল অনু।

সামিরা হালকা কেশে নড়েচড়ে বসল। এরপর প্রশ্ন শুরু করল।

আজকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই জবাব দিতে পারল অনু। একেই সামনে একটা মেয়ে, তার উপর এমন ফ্রেন্ডলি। মনে হচ্ছিল পুরোনো কোনো বান্ধবীর সাথে অনেকদিন পর দেখা হয়েছে, এবং সে অনেক অনেক প্রশ্ন করছে। অজানা সবকিছু জানতে চাচ্ছে। প্রথমবারের মতো অনুর মনে হলো, যারা ইন্টারভিউ নেয়, তাতা সবাই পাগল না; কিছু সুস্থ মানুষও আছে। এই মানুষগুলোর মধ্যে সামিরা ম্যাম একজন। স্পষ্ট এবং বাংলাতে কথা বলেছে পুরো সময়টা। মাঝে মাঝে হেসেও উঠছিল। যেন সূর্যাস্তের সময় টং দোকানে দু'জনের একটা চায়ের আড্ডা বসেছে।

যদিও সামিরা এখনো নিশ্চিত করেনি চাকরির ব্যাপারে, তবে অনুর দৃঢ় বিশ্বাস, চাকরিটা তাঁর হয়ে যাবে। কেন না সবক'টা প্রশ্নের জবাব ঠিক ভাবেই দিয়েছে সে। কোনো জড়তা ছিল না। ত্রুটিও ছিল না। স্বাভাবিক, সচ্ছল ভাবে শেষ করেছে ইন্টারভিউ। গতকাল রাতেই নিজের পোস্টটা নিয়ে ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করেছিল অনু। যে যে তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, সেগুলো মাথায় নিয়ে নিয়েছিল।

নিচে নেমে এসে শ্রেয়সীর পাশে দাঁড়ালো অনু। বাঁ দিকের উপরে তাকাতেই দেখল ক্যামেরাটা। চট করে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে শ্রেয়সীর দিকে তাকালো সে।

শ্রেয়সী কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে বলল, "কেমন হলো ইন্টারভিউ?"

অনু উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, "বেশ ভালো। মনে হচ্ছে চাকরিটা হয়ে যাবে। কনফার্ম করেনি অবশ্য।"

শ্রেয়সী বলল, "আমিও চাই চাকরিটা হোক।"

"তুমি সত্যিই বলেছিলে, ম্যাডাম আসলেই খুব ভালো। তোমারও অনেক প্রশংসা করল। অনার্স শেষ হলেই নাকি তোমার প্রমোশন হবে।"

"ইয়েস। তখন আমরা দু'জন পাশাপাশি ডেস্কে বসে কাজ করব। পার্ট-টাইম না, একেবারে ফুল টাইম। সেজন্যই আমি আরও বেশি করে চাচ্ছি, আপনার চাকরিটা যেন হয়।"

"আপনি করে বলছ কেন? তুমি করে বলো।"

শ্রেয়সী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, "ওকে।"

আচমকাই পাশ ঘেঁষে লম্বাচওড়া একটা লোক পা দিয়ে গটগট আওয়াজ করে হেঁটে চলে গেল। সিড়ি দিয়ে উঠল প্রায় দৌড়ানোর মতো করে। মুখের একপাশটা দেখেই চিনে ফেলল অনু। সহসা মুখটা ফেকাসে গেল তাঁর। স্তম্ভিত হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

শ্রেয়সী বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল, "কী হলো, হঠাৎ 'থ' মেরে গেল কেন?"

শঙ্কিত গলায় অনু বলল, "এক্ষুনি যে লোকটা উপরে ওঠে গেল, সে এখানে কেন?"

শ্রেয়সী জবাবে বলল, "উনি মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে হেড। ভীষণ রাগী। আমার তো মাঝে মাঝে ভয় করে উনাকে। তবে এখন পর্যন্ত আমাকে ধমকায়নি। সামিরা ম্যামের সাথে আমার মেলামেশা বেশি বলেই উনি আমাকে ধমকানোর সাহস দেখায় না।"

রাগ নিয়ে একটুও চিন্তিত না অনু। তাঁর চিন্তা অন্যখানে। তবে এই ব্যাপারে শ্রেয়সীকে কিছু বলার মানেই হয় না। নিজেকে সামলে নিয়ে হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। এরপর শ্রেয়সীর উদ্দেশ্যে ম্লানস্বরে 'আসছি' বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।

৬০ পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

1
$ 0.02
$ 0.02 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments