ভেজা চিরকুট -- ৫৬তম পর্ব

0 1
Avatar for Nipa1234
3 years ago

প্রায় ২০মিনিট সময় পেরিয়ে গেল অনু স্থির হয়ে বিছানায় বসে আছে। কেউ ডাকেনি এখন পর্যন্ত। নিশ্চয়ই সবাই ভাবছে অনু ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় চেঞ্জ করছে, তাই এই মুহূর্তে ডাকাডাকি করছে না। আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই দরজায় টোকা দেওয়া শুরু হবে। অনু আরও দশ মিনিট একইভাবে বসে থাকল, যাতে পরে ওয়াশরুমে গিয়ে আরও আধ ঘণ্টা কাঁটাতে পারে। একজন উকিল, অন্যজন অতবড় সিনিয়র অফিসার, ওরা নিশ্চয়ই কাজ ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই বাড়িতে বসে থাকবে না। দু'জনেরই কর্মব্যস্ততা খুব বেশি।

যেমনটা ভাবা, কাজটাও তেমনই করল অনু। ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় জামা-কাপড় আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। দুপুরের উত্তপ্ত রোদে ঘাম আর রাস্তার ধুলোবালিতে শরীরের অবস্থা হয়েছে ভয়াবহ। তাই বেশ অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলো। এরপর শুকনো কাপড় পরে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো।

একটা হলুদ রঙের থ্রি-পিস পরল অনু। বিদেশ যাওয়ার আগে শুভ্র'র সাথে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করেছিল। বিদেশে গিয়েও কিছু কিনেছিল, তবে সেই জামাগুলো এখন পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়নি।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় পেঁচিয়ে রাখা তোয়ালেটা খুলে নিলো অনু। আধভেজা চুলগুলো পিঠের উপর দিয়ে এমন ভাবে নিচে নেমে গেল, যেন একটা ঝরনার রাস্তা তৈরি হলো। এখন বেশ স্নিগ্ধ দেখতে লাগছে তাকে। মুখটা মায়াবী।। শরীরের সাথে সাথে হৃদয়টাও শীতল। কিন্তু ড্রয়িংরুমে অর্ক আর ওর পরিবারের কথা মনে পড়তেই মনটা আবার বিষিয়ে গেল। মুখটা মলিন করে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে শুরু করল।

দরজায় করাঘাত হতেই অনুর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। অস্বস্তিকর একটা কম্পন শুরু হলো হৃদপিণ্ডে। ভীত গলায় অনু জানতে চাইল, "কে?"

"আমি, বৃষ্টি।" সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে জবাব দিলো বৃষ্টি।

অনু ভুরু কুঁচকালো। ধীর পায়ে বিছানা থেকে দরজার দিকে এগোলো কিছুটা। আবার জানতে চাইল, "কিছু বলবে, ভাবী?"

বাইরে থেকে আবার বৃষ্টি সুস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, "বাইরে অতিথি বসে আছেন, তুমি দরজা আটকিয়ে ঘরে বসে আছো কেন?"

অনু বলল, "দাঁড়িয়ে আছি এখন।"

"দরজা খোলো।"

অনু মিনমিন করে বলল, "গোসল শেষ হয়নি।"

অসন্তুষ্ট হলো বৃষ্টি। একপলক পিছনে তাকিয়ে আবার একরাশ ক্ষোভ নিয়ে সামনে তাকালো। দরজায় সামান্য জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল, "গোসল করতে এত সময় লাগে?"

অনু দরজার কাছে দাঁড়িয়েই ক্ষীণ গলায় বলল, "অনেকক্ষণ লাগে।"

"তুমি দরজা খোলো, তারপর আমি দেখছি।"

অগত্যা একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলে দিলো অনু। বৃষ্টিকে দেখল চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকতে। নিশ্চয়ই রেগে আছে ভীষণ। অনুও রেগে আছে বেশ; তাই বৃষ্টির রাগ প্রভাবিত করে তাকে দমাতে পারল না। বরং অনু রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল, "ভাবী, একটু আগেই এলাম। বিশ্রাম তো নিতে দিবে।" কথাটা স্বাভাবিকের তূলনায় জোরে বলল অনু। যাতে বাইরের লোকগুলো শুনতে পায়।

বৃষ্টি মুখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে বলল, "আস্তে কথা বলো। শখ করে এখানে আসিনি আমি। বাবা বললেন তোমাকে রেডি করে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যেতে।"

"আমি কি কাঠের পুতুল, যে আমাকে নিয়ে যেতে হবে? হাত-পা নেই আমার?"

"তুমি এইরকম আচরণ করছ কেন আমার সাথে?" বৃষ্টি ক্ষুব্ধ হলো। ভয়ঙ্কর চোখ করে অনুকে শাসাতে শুরু করল।

অনু ডোন্ট কেয়ার টাইপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলল, "রেডি-ফেডি হতে পারব না আমি। বাবা ডেকেছে যখন, দেখা করে আসবো শুধু।"

নেহাৎ-ই শ্বশুর মশাইয়ের হুকুম বলে এখনো নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বৃষ্টি। না হলে এতক্ষণে একটা তুমুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিতো। অনুর রূঢ় আচরণ কিছুতেই সহ্য করত না সে। পাল্টা আক্রমণ করে তবে খ্যান্ত হতো। এখন শ্বশুর মশাই বলেছেন, অনু নিয়ে যেতে। আর বাড়িতেও অতিথি। সুতরাং কাজটা সম্পন্ন করতেই হবে। দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করল বৃষ্টি। হাতটা বুকে রেখে হৃদয়টাকে স্থির করে বলল, "এভাবে যাওয়া যাবে না। ওরা তোমাকে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছে।"

অনু মুখ শক্ত করে বলল, "আমাকে না জানিয়ে আমাকে দেখতে এসেছে? ভাবলে কীভাবে এরপরও ওখানে যাব আমি?"

মুখ বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বৃষ্টি বলল, "তোমার সৌভাগ্য যে ওরা তোমায় দেখতে এসেছে।"

অনু হেসে উপহাস করল এমন সৌভাগ্যকে৷ কিছুটা সময় নিয়ে বলল, "এসেছে যখন, চলো একবার দর্শন দিয়ে আসি।"

গম্ভীর গলায় বৃষ্টি বলল, "চুলগুলো অন্তত আঁচড়ে যাও।"

বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে অনু বলল, "আজ থেকে ৪ বছর আগে আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রেমিক বলেছিল, চুল খুলে রাখলেই আমাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী দেখতে লাগে। মায়াবতী মনে হয়।"

"তুমি কি মজা করছ আমার সাথে? না পাগল হয়ে গেছ?" বিস্ময়ে বৃষ্টির মুখ 'হা' হয়ে গেল একেবারে। এই অচেনা অনু ক্রমাগত তাকে ভড়কে দিচ্ছে।

মুখ গম্ভীর করে 'ফলো মি', কথাটা বলে অনু বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অনুকে স্বাভাবিক বেশে দেখে একটু বিব্রতই হলেন নুরুল ইসলাম। মুখটা তাঁর ফেকাসে হয়ে গেল। তবে অনুর সামনে বসে থাকা তিনজনের মুখে হাসি দেখে তাঁর মলিনতা বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকলো না।

অনু সামনে এসে উকিল আর উনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আবারও বিনয়ী সুরে সালাম দিলো। অর্ক'র দিকে একনজরও তাকালো না। বসল বাবার পাশে।

অর্ক'র বাবা-ই শুরু করলেন। অনুর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, "অনু মা, তুমি তো আমাকে ভালো করেই চেনো। আমি যে তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভাবি, সেটাও নিশ্চয়ই জানো?" জবাবের আশায় নীরব হলেন উকিল।

অনু ভুরু সামান্য তুলে অর্ক'র বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে জবান দিলো, "জি আঙ্কেল। আমি জানি।"

সুপ্রসন্ন হেসে উকিল আবার বলতে শুরু করলেন, "তোমার জীবনে আগে কী ঘটেছে, সেসব আমরা জানি। তবে আমরা কেউই চাই না অতীতের ঘটনাগুলো পরবর্তীতে তোমার উপর কোনোরকম প্রভাব ফেলুক। এইসব মনে রাখতে চাই না আমরা। সেজন্যই আমাদের সবার ইচ্ছা, তুমি নতুন করে জীবনটা শুরু করো।"

অনু বলল, "জীবন একটাই। আর এই এক জীবন শেষ হবে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে।"

অনুর এইরকম স্পষ্ট কথা শুনে অপ্রস্তুত হলেন উকিল। তবে সেটা কাটিয়ে দিলেন নুরুল ইসলাম। তিনি বলে উঠলেন, "নতুন জীবন বলতে, ও বলতে চাইছে আগের সবকিছু ভুলে গিয়ে তুই জীবনটাকে সম্পূর্ণ নতুন রূপে সাজা। খারাপ স্মৃতিগুলো মুছে ফেল মাথা থেকে। এখন থেকে ভবিষ্যতের কথা ভাব। কীভাবে বাকি জীবনটা কাঁটাবি, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা কর।"

অনু মাথা নুইয়ে নিচের ঠোঁটটা আলতো করে কামড় দিয়ে বলল, "হুম, তাই করব।"

উকিল স্বস্তি অনুভব করতেই আবার বলতে লাগলেন, "আর সেজন্যই আমরা সবাই চাই, তোমার সাথে অর্ক'র বিয়ে হোক। এই বিয়েটা হলে আমাদের সম্পর্কটা শক্ত হবে। অর্ক সম্মতি দিয়েছে। আশা করি তোমার অমত নেই এই বিয়েতে।"

চোখ-মুখ শক্ত করে রাখল অনু। বিয়ের কথা শুনতেই কান জোড়া লাল হয়ে এলো তাঁর। সাথে এটাও মনে হলো, কান দিয়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কোনো কথাই বলল না সে। চুপচাপ বসে থাকল বাবার পাশে।

উকিল নিজে নিজেই বুঝে নিলেন সবকিছু। তাঁর মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল। ঝলকানিতে পরিপূর্ণ চোখ-মুখ। উজ্জীবিত মুখ করে তিনি বললেন, "বেশ, এভাবে বলতে অসুবিধা হলে তুমি পরে বাবাকে মতটা জানিয়ে দিও। এরপর না হয় আবার একদিন এসে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করব।"

উকিল ধরেই নিলেন অনু রাজি। উকিলের স্ত্রীও এমনটাই ভাবলেন। তিনিও খুশি বেশ। তবে অর্ককে খুব ভীতসন্ত্রস্ত, খুব নিরীহ দেখালো। এখন পর্যন্ত কোনো কথাই বলেনি সে। চুপচাপ বসেছিল। সে ভেবেছিল অনু তৎক্ষনাৎ অমানবিক প্রতিক্রিয়া দেখাবে, এতে তাঁর মা-বাবা অপমানিত হবে, সেজন্য একটু কাচুমাচু হয়ে ছিল শুরু থেকেই। এখন স্বস্তি পেলো। তবে অনুর নীরব রাগটা তাঁর চোখ এড়ালো না। এত সহজে যে অনুকে পাবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে।

অর্ক আর ওর মা-বাবা, সবাই চলে যাওয়ার পর অনু বাবার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ভাবে বলল, "বাবা, দয়া করে এখন আমার বিয়ের চিন্তা বাদ দাও। তোমার আজকের কাণ্ডে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি। আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজনবোধ করলে না তুমি।"

দৃঢ় গলায় নুরুল ইসলাম বললেন, "আরে মা, তুই ভুল বুঝছিস আমাকে। আমিও জানতাম না ওরা আসবে। সাভার এসেই আমাকে ফোন দিয়েছে। তোর কাছে তো মোবাইলও নেই, যে জানাবো। ভাগ্য ভালো একটু পরই তুই এসে গেলি।"

অনু বিড়বিড় করে বলল, "এটা আমার জন্য দূর্ভাগ্য। আরও দেরি করে এলে ভালো হতো।"

নুরুল ইসলাম ভ্রু কুঁচকে বললেন, "কী বলছিস?"

ঠোঁট ভিজিয়ে অনু বলল, "বলছি, তুমি আঙ্কেলকে জানিও দাও আমি বিয়ে করব না।"

"কেন?"

"আমি চাই না এই মুহূর্তে কারোর সাথে সম্পর্কে জড়াতে। যেভাবে আছি, বেশ ভালো আছি।" স্পষ্ট এবং দৃঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলল অনু। কোনো দ্বিধা নেই এখানে।

নুরুল ইসলাম মনোক্ষুণ্ণ হলেন। চোখ নামিয়ে নিয়ে কাতর গলায় বলতে লাগলেন, "আমি জানি তোর সাথে যে অন্যায় হয়েছিল, এর জন্য আমি দায়ি। ইনফ্যাক্ট কাজটা আমিই করেছিলাম। কিন্তু মা, এভাবে বাকি জীবন একা থেকে আমাকে কষ্ট দিস না। না হলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে নিয়ে অনুশোচনা হবে আমার। সবসময় মনে হবে আমি নিজের হাতে মেয়ের জীবনটা শেষ করেছি। মরার আগে তোকে সুখী দেখতে পারলে আমি শান্তি পাবো।"

"বাবা, এই কথাগুলো বলে আমাকে দুর্বল করার চেষ্টা করো না তুমি। এর আগেও মায়ের মৃত্যু নিয়ে আমাকে অনেক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছিলে তুমি। অনেক কাণ্ড করেছিলে। আবার ওইরকম কিছু করো না প্লিজ। তাহলে আমার অবস্থা হবে বেঁচে থেকেও মৃত প্রায়! তুমি আমার চিকিৎসা না করালে আমি যতটা কষ্ট পেতাম, তাঁর থেকেও বেশি কষ্ট পাবো যদি তুমি আমাকে ঠকাও, আমার সাথে ছলনা করো। আমি বড় হয়েছি, বাবা। আমি সব বুঝি। কখন কোন পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটা না হয় এবার আমার উপর ছেড়ে দাও।"

মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলেন নুরুল ইসলাম। এরপর কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে চলে গেলেন তিনি। অনু একবার মায়ের দিকে তাকালো। রাগে কটমট করে তাকিয়ে আছেন মমতাজ বেগম। বৃষ্টি আবার মিটমিট করে হেসে মজা নিচ্ছে। অনু বৃষ্টির দিকে ধারালো চোখ করে তাকিয়ে বলল, "খুব সেয়ানা মাল।"

অনু জানে, তাঁর বাবাকে আড়াল থেকে উস্কানি দিচ্ছে এই বৃষ্টি। মেয়েটা মনপ্রাণ দিয়ে চায়, অনুর বিয়ে হোক। এই চাওয়াটা অনুর ভালোর জন্য নয়, অনু যাতে বাড়ি থেকে বিদেয় হয়, সেটার তাঁর চাওয়া। অনু বিদেয় হলেই এই বাড়িতে তাঁর প্রমোশন হবে। মমতাজ বেগম এখন অনেকটা নীরব; অনুকে বিদেয় করে নিজের জায়গা উপরের নিয়ে যাওয়ার এটাই সুযোগ।

অনুর শেষ কথা শুনে বাকরুদ্ধ বৃষ্টি। হতবিহ্বল মমতাজ বেগমও। তাঁরা কিছু বলার আগেই ঝড়েরবেগে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল অনু।

১০৭.

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট এর সময় টেবিলের কাছে এলো অনু। চেয়ার টেনে বসতেই মায়ের চওড়া গলা কানে ভেসে এলো।

টেবিলের কাছে আসতে আসতে মমতাজ বেগম বললেন, "এবার তো আর অসুস্থতার অজুহাত দিতে পারবি না; তা এবার থেকে বাড়ির কিছু কাজকর্ম কর। বসে বসে খেতে লজ্জা করে না?"

অনু মনেমনে হেসে বলল, "দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলে আল্লাহ পাপ দিবেন, মা। এটা জানো না? সবসময় বসে বসে খেতে হয়।"

মেয়ের এমন রসিকতা দেখে গর্জে উঠলেন মমতাজ বেগম, "ফাজলামি করিস আমার সাথে? আমি বলছি কাম-কাজ না করে মহারানীর মতো বসে বসে খেতে লজ্জা করে না?"

অনু আগের মতোই কৌতুকের সুরে বলল, "মহারানী'রা যখন লজ্জা পায় না, তখন আমার লজ্জা পাওয়াটা কি উচিত? তাছাড়া এই পদটা অনেক সম্মানের।"

"হায় খোদা!" মাথায় হাত দিয়ে অনুর পাশে এসে দাঁড়ালেন মমতাজ বেগম। চেঁচিয়ে উঠলেন আবার, "এই মেয়ে দেখি পুরাই পাগল হয়ে গেছে। সমস্যা কী?" ভয়ঙ্কর চোখ করে মেয়েকে দমাতে চাইলেন মমতাজ বেগম।

বৃষ্টি সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। শ্বাশুড়িকে সঙ্গ দিতে এগিয়ে এলো এবার। এসেই উচ্চস্বরে বলে উঠল, "বিদেশের হাওয়া গায়ে লাগছে না, তাই সোজা কথা বাঁকা করে বলতে শিখেছে।"

অনু বৃষ্টির দিকে কটমট করে তাকালো একবার। বৃষ্টি নিভে যেতেই আবার মায়ের দিকে তাকালো।

মমতাজ বেগম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, "তা কীকরে হয়? বিদেশ থেকে আসার পর তো সব ঠিকই ছিল। কালকের পর থেকেই তো এইরকম করছে।"

অনু বলল, "দোষটা বিদেশ বা বিদেশের আবহাওয়ার না। দোষটা হলো এক বিজ্ঞানীর। মনোবিজ্ঞানী সে। কাল আমি তাঁর সাথে দেখা করেছিলাম। সে-ই বলেছে, সবসময় উদাস থাকা উচিত না। এটা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সুস্থ থাকতে হলে হাসিখুশি থাকতে হবে। মাঝে মাঝে বাড়ির লোকদের সাথে বিটলামি করতে হবে। তাহলে মন, শরীর, সব ঠিক থাকবে। উনার পরামর্শেই তোমাদের সাথে একটু বিটলামি করছি। আর তোমরা ভাবছ আমি সোজা কথা বাঁকিয়ে বলছি।"

অনুর কথা শুনে বৃষ্টি থতমত খেয়ে গেল। মমতাজ বেগম মুখ 'হা' করে বললেন, "তুই তো বলেছিলি বান্ধবীর বাড়িতে গেছিস।"

"আরে ওই বান্ধবীই তো মনোবিজ্ঞানী। বিরাট এক বিজ্ঞানী। তেমন নাম-ডাক নেই, তবে দারুণ। উনার পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হলে একটু হাসিঠাট্টা করতেই হবে। আর বাড়িতে তোমাদের ছাড়া আর কার সাথেই বা হাসিঠাট্টা করব?"

বৃষ্টি ফোঁস করে উঠল, "তুমি কি আমাদের জোঁকার ভাবছ?"

অনু হতাশ হয়ে বলল, "সোজা কথাকে উল্টিয়ে অর্থটাই পাল্টে দিলে। ধ্যাত!"

বৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বলল, "আচ্ছা, সহজ কথাই বলছি। মনোবিজ্ঞানী যদি তোমার বান্ধবীই হয়ে থাকে, তাহলে আপনি করে বলছ কেন?"

অনু চমকালো হঠাৎ। এই বিষয়টি খেয়াল করেনি সে। মামুনের সাথে সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে এতদিনে, তবুও দু'জন দু'জনকে আপনি বলে সম্মোধন করে। এবার অন্তত তুমিতে আশা উচিত। বৃষ্টিকে মনেমনে ধন্যবাদ দিয়ে অনু প্লেটে ভাত নিলো। আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "বাবা কোথায়?"

ঝাড়ি মারার মতো কণ্ঠস্বর করে মমতাজ বেগম বললেন, "আল্লাহ জানে আর তিনিই জানে। আমি কীভাবে জানবো? সকালবেলা শার্ট-প্যান্ট পরে বেরিয়ে গেল। মানুষটা কাল সারারাত ঘুমায়নি। যে লোকটা তোর জন্য নিজের সর্বস্ব ব্যয় করল, সেই মানুষটাকে এভাবে অপমান করলি।"

অনু ব্যথাতুর গলায় বলল, "আমি বাবাকে অপমান করিনি, মা। শুধু আমার মতামত জানিয়েছি। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। বাবা ভাবছে, এতে আমার ভালো হবে। কিন্তু আমি জানি, এই বিয়ে করলে আমার জীবনটা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। বিয়ের পর কিছুই আর মেয়েদের হাতে থাকে না। ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হয়। আমি আগে নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত করি, এরপর বিয়ের কথা ভাবব; যাতে কোনো অঘটন ঘটলে দিশেহারা হতে না হয়। তুমিই বলো, এবার বাড়ি থেকে বেরোলে কি আর আমাকে ঢুকতে দিবে? মন থেকে বলো, দিবে?"

মমতাজ বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। বৃষ্টি মুখ বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গ করল। বিড়বিড় করে নিজের মনে বলল, "সেই বান্ধবীর প্রসঙ্গটাই পাল্টে দিলো। একেই তো সেয়ানা বলে। কে বলবে, ওই বিজ্ঞানী বন্ধু বা বান্ধবী।"

খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাড়ি থেকে বের হলো অনু। গেইটের আসতেই দারোয়ানকে দেখল। মামুন বলেছিল, ওর খবর দারোয়ান জানতো। অনু এখানেই ভুল করেছে। একবার যদি দারোয়ানের কাছে মামুনের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতো, তাহলে মামুনকে খুঁজে বের করা সহজ হতো। টানা সাত দিন পাগলের মতো ঢাকা শহর ঘুরে-বেড়াতে হতো না। অনু মনেমনে বলল, "দারোয়ান একটা আহাম্মক! নিজে থেকে একবার বলবে না মামুনের কথা!"

দারোয়ানের হাতে খবরের কাগজ দেখে অনু খপ করে নিয়ে নিলো। এরপর কয়েকটা পাতা উল্টাতেই দেখল মামুনের লেখা। উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল অনুর মুখ-চোখ। তাঁর মন বলছিল মামুন আর ঘরে বসে থাকবে না। আবার লেখা শুরু করবে। এবং সেটাই হয়েছে।

কাগজটা নিতে চাইলে দারোয়ান বলে উঠল, "আপা, স্ট্যাণ্ডে গেলেই কাগজ পাইবেন। এইডা নিয়েন না।"

অনু ভাবল কয়েক মুহূর্ত। এরপর মাথা ঝাঁকিয়ে কাগজটা দারোয়ানের হাতে দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ দেখল পরিচিত এক মুখ। স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, তাঁর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অনু মুখটা শক্ত করে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। নাকের নরম দুই পাশ সামান্য ফুলিয়ে ফুঁসতে লাগল।

৫৬ পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments