সুতা দিয়ে শালিক পাখির পা বাঁধা হয়েছে। তার আগে পানিতে ভিভিয়ে সেই সুতা নরম করে নেয়া হয়েছে। এনায়েত মোল্লার ধারণা এতে পাখিটার কষ্ট কম হবে। তিনি বিরক্ত চোখে শালিকটার দিকে তাকিয়ে আছেন। আজ প্রায় সাত দিন ধরে তিনি পাখিটাকে কথা শেখানোর চেষ্টা করছেন। পাখি কথা বলা শেখেনি। চেষ্টার ফলস্বরূপ তার দুই আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ। সুযোগ বুঝে শালিকটা ঠোকর বসিয়ে দিয়েছে।
“বজ্জাত পাখি। কথা কইতে তোর সমস্যা কী? কথা ক কইলাম” এনায়েত মোল্লা ধমক দিলেন। ধমকে কাজ হলো। পাখিটার পায়ের দিক নোংরা হয়ে গেল সাথে সাথেই। অনেক কষ্টে তিনি খাঁচাটায় লাথি দেয়ার ইচ্ছাটা দমন করলেন। মনে মনে তার আফসোস হলো। পাখি না হয়ে মানুষ হলে তিনি এতক্ষণে মনের আনন্দে শালিকটাকে চড় লাগাতে পারতেন।
চড় দিতে না পেরে এনায়েত মোল্লা যখন আশাহত ঠিক সেই মুহুর্তেই পিয়ন এলো। প্রতিবারের মতো চিঠি ছুড়েই বিদেয় হলো না। এনায়েত মোল্লাকে সিগনেচার করে চিঠি রাখতে হলো। চিঠির উপরে একটা এরোপ্লেনের ছবি। এনায়েত মোল্লার শরীর কাঁপতে লাগলো। বিদেশি চিঠি। তার মেয়ে, মনিকা মেলবোর্ন থাকে। সে দেশ ছেড়েছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। এর মধ্যে বাবাকে চিঠি লেখার সুযোগ পায়নি।
এনায়েত মোল্লা চিঠি খুললেন না। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ, চিঠিটাতে খারাপ কোন খবর আছে। আজ থেকে এগারো বছর আগের কথা। এরকম এক দুপুরে তার বড় ছেলে, তুহিনের কাছ থেকে একটা চিঠি এলো। তুহিন অবশ্য চিঠি না লিখলেও পারতো। সে দেশের বাইরে থাকতো না। পড়াশোনা করার জন্য সে ঢাকা গিয়েছে। ঢাকা কতদূর এনায়েত মোল্লা জানেন না। তিনি কখনো ঢাকা যাননি। শুধু জানেন গ্রাম থেকে সহজেই ঢাকা যাওয়া যায়। সেই দূরত্ব কম। কিন্তু ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরে আসা কঠিনসাধ্য ব্যাপার। বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার সময় সেই দূরত্ব বেড়ে যায়। ছেলের চিঠি তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে খুললেন। চিঠি পড়ে জানতে পারলেন তুহিন কী একটা ঋণের ঝামেলায় ফেঁসে গেছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। দশ লাখ টাকা জোগাড় করতে না পারলে পুলিশ তাকে ছাড়বে না। এনায়েত মোল্লা সেই চিঠি পড়ে শান্ত হয়ে বসেছিলেন। তার ছেলেটা কলেজ পাশ করে ভার্সিটি ভর্তির হওয়ার জন্য ঢাকা যায়। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিও পেয়ে যায় সে। এর মধ্যে লোক মারফত তিনি জানতে পারেন তুহিন বিয়ে করেছে। তিনি না-কি দাদাও হয়ে গেছেন। এই রকম খুশির সংবাদ শুনেও এনায়েত মোল্লার চোখ ভিজে আসে। এই খবরটা জানিয়ে তুহিন একটা চিঠি তো লিখতে পারতো। অবশ্য ততদিনে তিনি জেনে গেছেন এসব আনন্দের সংবাদ জানিয়ে ছেলেরা বাবাদের চিঠি লেখে না। বাবাকে চিঠি লিখতে হয় বিপদের দিনে। এনায়েত মোল্লা জমি বিক্রি করে দিলেন। টাকা জোগাড় করে তিনি ঢাকা গেলেও তুহিনকে খুঁজে বের করতে পারলেন না। যেই ঠিকানা থেকে চিঠি এসেছে সেই ঠিকানায় গিয়ে জানতে পারলেন- তুহিন স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছে। স্ত্রীর ফ্যামিলি থেকে মামলা করার পর থেকেই তুহিন নিখোঁজ।
এনায়েত মোল্লা মনিকার চিঠি খুললেন। চিঠিতে কোন ধরনের সম্মোধন নেই। এমন ভাবে চিঠিটা লেখা হয়েছে যেন দু'জন মানুষ পাশাপাশি বসে গল্প করছে।
--------“জানো বাবা, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সুন্দর মাঝারি ধরণের বৃষ্টি। মফি-মগ হাতে আমি লনে চলে এসেছি। ছোট একটা ছাউনির তলে বসে বৃষ্টি দেখছি আর তোমাকে লিখছি। আজ প্রায় সাত মাস পর মেলবোর্নে বৃষ্টি হলো। সবাই খুব খুশি। যে যার মতো বৃষ্টিতে ভিজছে। মেলবোর্নের বৃষ্টি আসলেই খুব সুন্দর। মিনিট পাঁচেক বৃষ্টি হলেই রাস্তাগুলো চকচক করতে থাকে। ধুলোবালি কম বলে গাছগুলো গাঢ় সবুজ দেখায়। যারা সাব কন্টিনেন্টের বৃষ্টি নিয়ে বড়াই করে তারা হয়তো মেলবোর্নের বৃষ্টি দেখেনি। এই বৃষ্টি দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। তবে হ্যাঁ, একটা সমস্যা কিন্তু আছে। এখানে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনার কোন ব্যাবস্থা নেই। এজন্য আমার কিছুটা মন খারাপ। আমি একবার ভাবলাম শহর থেকে দূরে টেম্পারেট ফরেস্টের কাছাকাছি ছোট্ট একটা ঘর বানাবো। সেই ঘরের ছাদ দেয়া হবে টিন দিয়ে। একদম আমাদের দাক্ষিণ ভিটার ঘরটার মতো। বর্ষা এলেই আমরা দলবল মিলে সেখানে বর্ষাযাপন করতে চলে যাবো। তবে আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সিফাত রাজি হয়নি। এমন অদ্ভুত চিন্তা আমার মাথায় কী করে এলো সেটাই না-কি সে বুঝতে পারছে না।
তুমি তো জানোই বাবা- আমি ছোট থেকেই এমন অদ্ভুত সব চিন্তা করি। আমি খুব বেশি ভাবুক প্রকৃতির ছিলাম বলে তুমি আমাকে ‘ভাবুক রাণী’ ডাকতে। আমি তখন রাগের ভাণ করলেও তোমার এই ডাকটা কী যে ভালো লাগতো! অথচ তুমি সেটা বুঝতে পারতে না।
আচ্ছা বাবা তুমি কি আগের মতোই সবসময় একটা রাগ রাগ ভাব নিয়ে থাকো? আগে তো হুটহাট মানুষকে চড় লাগিয়ে দিতে। ভয়ে কেউ তোমার সামনে পড়তে চাইতো না। সবাই ভয় পেলেও আমি বুঝতে পারতাম, রাগটা তোমার বাইরের রূপ। তোমার ভেতরটা অন্যরকম। রাগের মাথায় কাউকে চড় দিয়ে তুমি নিজেই অনুশোচনায় ভুগতে। তারপর ছুটে গিয়ে সেই মানুষটার মন ভালো করার জন্য নানান কান্ড করতে। আমার ভাগ্য ভালো ছিলো যে তুমি আমার সাথে কোনদিন রাগ করোনি। এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় আমি গণিতে ফেল করে বসলাম। হেড স্যার তো রেগে আগুন। সে তোমাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে গেল আমাকে বকাঝকা করার জন্য। সে তোমাকে বলল, আমাকে কিছু কড়া কথা শোনানোর জন্য। তুমি কিছুই বলতে পারলে না। তুমি এমন ভাবে আমার দিকে তাকালে যে আমার হাসি পেয়ে গেল খুব অসহায় লাগছিলো তোমাকে। সেই কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায় আমার।
আজ ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ছে বাবা। তোমার কাঁধে চড়ে মেলায় যাওয়া, পশ্চিম পাড়ার ঝিলে মাছ ধরা, চকচকে দুই টাকার নোট দিয়ে মালা বানানো কিংবা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুড়ি উড়ানো- সবকিছুই মনে পড়ছে আজ। ইচ্ছা করছে কোন এক জাদুমন্ত্রবলে অতীতে ফিরে যাই। তোমার মনে আছে বাবা- যখন বর্ষায় প্রথম বৃষ্টি আসতো আমি আর তুহিন ভাইয়া দ্রুত উঠোনে নেমে যেতাম। তুমি শত হাক-ডাক দিয়েও আমাদের উঠোন থেকে তুলতে পারতে না। শেষমেশ তুমিও নেমে যেতে। তিন জন একসাথে ভিজতাম। তখন মা বেঁচে থাকলে কত ভালো হতো তাই না বাবা? মা'কে আমি দেখিনি। তোমার মুখে শুনেছি আমার জন্মের সময়ই মারা যান উনি। কাজেই মায়ের আদর-ভালোবাসা কেমন তা আমি বলতে পারবো না। তবে এটা নিয়ে আমার কখনোই কোনরকম অভাব বোধ হয়নি। সেই অভাব বুঝতে দাওনি তুমি। পৃথিবীর সকল বাবাই তাদের সন্তানদের ভালোবাসে। তবে যেই পরিমাণ ভালোবাসা তুমি আমাদের দুই ভাই-বোনকে দিয়েছো তা হাজারো সন্তানের ভাগে ভাগ করে দিলেও কারোরই এতটুকু কম পড়বে না। আমাদের দূর্ভাগ্য, তোমার এই প্রবল ভালোবাসার মূল্য আমরা বুঝতে পারিনি। তুমি আদর্শ বাবা হলেও আমরা আদর্শ সন্তান ছিলাম না। তুহিন ভাইয়া তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললো। নানান কান্ড ঘটিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল সে। আমরা ভাইয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করলাম। সে ফিরে এলো না।
দেখতে দেখতে আমিও বড় হয়ে গেলাম। ভালো ঘর দেখে তুমি বিয়ে ঠিক করলে আমার। তুমি সবসময় চাইতে আমাকে কাছাকাছি কোথাও বিয়ে দিতে। অথচ ভাগ্যের ফেরে বিয়ের দুই মাসের মাথাতেই আমরা এখানে চলে আসলাম।
এখানে আছি প্রায় পাঁচ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করিনি আমি। জানি তোমার মনে ক্ষোভের পাহাড় জমে আছে। সেই পাহাড় সরানোর সাধ্য আমার নেই।
এখানে আসার পরই আমরা একটা ঝামেলায় পড়ে যাই। সিফাত যেই কম্পানিতে জব নিয়ে মেলবোর্ন আসে সেটির মালিক, কোম্পানি বিক্রি করে দেয়। নতুন মালিক বেশ কিছু বিদেশি এমপ্লয়ি ছাঁটাই করে। এর মধ্যে সিফাতও ছিল। ও নতুন জব খোঁজা শুরু করে। সব কিছু স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুদিন চলে যায়। তারপর আমি চাইলেই তোমাকে চিঠ লিখতে পারতাম। তবে লজ্জায় লিখিনি। আমি জানি আমার সামান্য এই লজ্জার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। আমারও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাবা। ভীষণ কষ্ট।
বাবাকে চিঠি লিখলে সবাই শুরুতেই জিজ্ঞেস করে- বাবা, তুমি কেমন আছো? আমি তা করতে পারিনি। কারণ তোমাকে সেই প্রশ্ন করার যোগ্যতাটুকুও আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিভাবে তোমার কাছে ক্ষমা চাব আমি জানি না বাবা। শুধু জানি তোমার মনে আমার জন্য এখনো যেই ভালোবাসাটুকু রয়ে গেছে তা উপেক্ষা করার সাধ্য তোমার নিজেরও নেই। তোমার রাগের চেয়ে সেই ভালোবাসার পরিমাণ অনেক বেশি। তাই সাহস করে লিখতে বসে গেলাম।
ওহ হ্যাঁ, তোমাকে আসল কথাই বলা হয়নি বাবা। আমার একটা মেয়ে হয়েছে। তোমার নামের সাথে মিল রেখে ওর নাম রেখেছি- এনি।” তোমার নিশ্চয়ই ওকে দেখতে ইচ্ছা করছে তাই না বাবা?
তুমি ওকে দেখতে পারবে। সিফাত অফিসে ছুটির এপ্লিকেশন দিয়েছে। ছুটি মঞ্জুর হলেই আমরা চলে আসবো। এমনও হতে পারে এই চিঠি পৌছানোর আগেই আমরা চলে আসতে পারি। কারণ চিঠি পৌছাতে মাস খানেক সময় লাগবে। আমরা হয়তো এর মধ্যেই চলে আসবো। আমি ভেবে রেখেছিলাম যখন ভালো কোন সংবাদ দিতে পারবো তখনই তোমাকে চিঠি লিখবো। আর আমি জানি আমি দেশে ফিরে আসবো- তোমার কাছে এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ আর কিছু হতে পারে না। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছো বাবা? এতদিন পর ফিরছি, প্লিজ আমাকে বকাঝকা করবে না একদম। নিজের মেয়ের সামনে বকা শুনতে ভালো লাগবে না।
এলোমেলো চিঠিটা অনেক বড় হয়ে গেলো। আজ আর লিখবো না বাবা। দুয়া কর আমাদের জন্য যেন খুব দ্রুত চলে আসতে পারি।
ইতি,
তোমার আদরের ‘ভাবুক_রাণী’
পুনশ্চঃ বাবা, দুই টাকার নোটে দোয়েল পাখির ছবিটা কি এখনো আছে? কিছু চকচকে দুই টাকার নোট রেখো। আমার মেয়েকে উপহার দেবে তুমি।
#পরিশিষ্ট - চিঠি শেষ করে এনায়েত মোল্লা উঠোনে বসে রইলেন। দুই মাস আগের লেখা চিঠি। মনিকা ফিরলে এর মধ্যে চলে আসতো। হয়তো সিফাত ছুটির ব্যাবস্থা করতে পারেনি।
এনায়েত মোল্লা ক্লান্ত পায়ে পুকুর ঘাটে গেলেন। সময় নিয়ে ওজু করলেন তিনি। আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। ওজু শেষ করে উঠে আসবেন ঠিক এমন সময় তার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। তিনি চোখে ভুল দেখছেন। তার উঠোনে একটা বিদেশি বাচ্চা। টকটকে লাল জামা পড়া মেয়েটা উঠোন জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এনায়েত মোল্লা গামছা দিয়ে চোখ মুছলেন। আবার তাকালেন। তিনি নিশ্চিত হলেন তার মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। কারণ এবারে তিনি দেখছেন বিদেশি বাচ্চাটার পিছু পিছু মনিকা এসে ঢুকেছে। দূরে একটা গাড়ি রাখা। সিফাত গাড়ি থেকে লাগেজ নামাচ্ছে।
মনিকা প্রথমেই বাবার ঘরের দিকে গেল। ঘরে বাবাকে না পেয়ে সোজা আসতে লাগলো পুকুর পাড়ের দিকে। এনায়েত মোল্লা অপ্রস্তুত বোধ করলেন। এখন তার ঠিক কী করা উচিত তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি কি মেয়েকে জড়িয়ে ধরবেন? না-কি এতদিন যোগাযোগ করেনি বলে মেয়েকে বকাঝকা করবেন! তিনি মনিকাকে পাশ কাটিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলেন। মনিকাও গেল তার পিছুপিছু।
মনিকা আদ্র বলল, “বাবা কথা বলবে না আমার সাথে?”
এনায়েত মোল্লা বললেন, “বুঝলি রে মা, পাখিটারে কথা শিখানের চেষ্টা করতেছি। এমন বজ্জাত পাখি, একটা কথাও কইতে পারে না।”
মনিকা বলল, “বাবা পাখিটাকে ছেড়ে দাও। কথা শেখাতে হবে না।”
এনায়েত মোল্লা সাথে সাথেই পাখিটাকে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। তারপর মৃদু স্বরে বললেন, “খুব বজ্জাত পাখি। এত চেষ্টা করলাম। একটা কথাও শিখে নাই।”
মনিকা বিস্ময় নিয়ে দেখলো তার বাবা কাঁদছে। তিনি গামছা দিয়ে চোখ মুছছেন ঠিকই। কিন্তু সাথে সাথেই চোখ জল দিয়ে ভরে যাচ্ছে। ( সমাপ্ত)