অনেক বছর পর কাল বিয়ে বাড়ির গান শুনলাম। সুখানুভব হলো। রাতে নির্জন নদের তীরে পৌঁছেই ওপার থেকে কোরাস গানের সুর ভেসে আসলো। মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম বিয়ের গান। অতীতে বিয়ে বাড়ীতে ৩/৪ দিন ধরে গান হতো। এখন বিয়ে বাড়ীতে উৎকট হিন্দি গান বাজে। এসবের ভীড়ে হঠাৎ শোনা খালি গলায় দলীয় বিয়ের গীত সত্যিই দোলায়িত করলো মন। তার উপর ছিল কোজাগরী(?) আকাশ, জোসনায় ভেসে যাচ্ছিল চারিধার। বিয়ে বাড়ীতে আলোকসজ্জাও দেখলাম। বর/কনে রোমান্টিক হলে এমন কোজাগরী(?) চন্দ্রালোকে নিশ্চয় নৌবিহারে বের হবে। আকাশে ভরা চাঁদ, স্রোতস্বিনী নদী, লাজুক নববর আর লজ্জাশীলা নববধূ তাদের প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটাবে এবং জোসনাস্নান করবে। সুন্দর।
বর কনে নৌবিহারে যাবে কিনা জানি না, তবে গত রাতে আমরা নৌকাভ্রমণ করেছি। খালাতো ভাই তুষার আর ওর বন্ধুদের বদৌলতে। বিরতিহীন অসুস্থতা আমার জীবন অনেক সংকুচিত করে ফেলেছে। তারপরও কাল কুমার নদের জোসনা দেখতে খালা বাড়ী গমন করলাম। আলহামদুলিল্লাহ প্রশান্তির মাত্রা অসুস্থতার কষ্টের চেয়ে বেশি ছিল।
আমাদের গাঁয়ে নদী নেই। ফলত নৌকা চড়ার অভিজ্ঞতা কমই হয়েছে। রাতের বেলা নৌকাভ্রমণ এবারই প্রথম। শরতের জোসনা সবচেয়ে উজ্বল হয়। এসময় শিশিরও পড়ে প্রচুর। গাছের পাতা রুপোলী আলোয় ঝিকমিক করে। রাত যতো গভীর হয়, পৃথিবী ততো শান্ত হয়, জোসনা ততো মায়াবী হয়।
অনেকদিন পর কাল রাতে বড় পেঁচার দেখা মিললো। আমরা স্থানীয়ভাবে বলি ধুইতুলি। নদীর ধারে গাছের ডালে বসেছিল।ধুইতুলি নির্জনতা প্রিয় পাখি। লাইট জ্বালতেই কিছুটা বিরক্ত হয়ে উড়ে গেল। বৈঠার শব্দে ঘুম ভাঙলো কয়েকটি পাতিহাঁসের। তারা ভয় পেয়েছে বোধহয়। ভীষণ গতিতে মাঝ নদীতে চলে গেল। ওরা বলল এসব হাঁস রাতে নদীতেই থাকে। স্রোতের বিপরীতে অনেকক্ষণ চলার পর বড় ব্রীজের দেখা মিলল। বাঘ আঁচড়া ব্রীজ নামে খ্যাত। নৌকা তীরে ভিড়িয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো, সাথে ছিল কিঞ্চিৎ আহারাদি।
বারোটারও কিছু পরে ব্রীজের ঢাল বেয়ে নামলাম। চমৎকার অনুভূতি। কেননা ব্রীজ বেশ উঁচুতে, কংক্রিটের ঢাল বেয়ে নিচে নামা অন্তত আমার জন্য রোমাঞ্চকর ব্যাপার! নৌকা চলল স্রোতের অনুকূলে। এবার আর বৈঠা চালানোর ঝামেলা ছিল না। স্রোতই যথেষ্ট ছিল নৌকাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের ফেরার তাড়া ছিল না, তাড়া ছিল সৌন্দর্য আস্বাদনের।
ফেরার পথে দেখা মিলল বর্তমানে বিরল হয়ে আসা আরেকটি প্রাণীর। প্রমাণ সাইজের এক বনবিড়াল।নদীর একেবারে তীরে দাঁড়িয়ে। জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা চোখ দুটো সমীহ জাগানীয়া। বনবিড়ালকে আমরা বনগাড়া বলি। বিড়াল গোত্রের যেকোনো প্রাণী স্বাভাবিক ছন্দে থাকে রাতের বেলা। বন বিড়াল ওরফে বনগাড়া পালালো না। আমাদের দিকে নিবিষ্টমনে চেয়ে রইল। নৌকা এগিয়ে চললো।
দূরে একাকী মৎস শিকারীর টর্চের আলো জ্বালছে নিভছে। চাঁদ আরও রুপসী হয়ে উঠছে। প্রকৃতির চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। আবার এই প্রকৃতিই হয়ে ওঠে রুক্ষ রুদ্র। জীবনেরই মতো...। বিকালে যখন খালাবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। বৃষ্টি ছিল, আকাশে ছিল কালো মেঘ । বাসের মধ্যে বসে দেখলাম একদল মানুষ লাশ নিয়ে এসেছে কবরস্থানে। দাফন করায় ব্যস্ত। মন খারাপ হয়েছিল তৎক্ষনাৎ। আবার এখন এই জোসনা, বিয়ে বাড়ীর আলোকসজ্জা ও গীত। আহা! জীবনের নানারূপ!
আমরা ফিরে এসেছি। বিয়ে বাড়ী ঘুমিয়ে গেছে। নদী তীরের খাটলায় বসা তাসারুরা ফিরে গেছে আগেই। পেশাদার মৎস্য শিকারী এবং নৌকার মালিকের নিদ্রাভঙ্গ হলো আমাদের আগমন ধ্বনিতে। এই খাটলাতেই বিশ্রাম নেয় সে। সাহসী যুবক। সারারাত মাছ ধরে। গভীর রাতে প্রয়োজনে ডুব দেয় পানিতে। আমরা কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম তার সাথে। সে একটু পর আবার শিকার শুরু করবে। আমরা বিদায় নিলাম। রাত বাড়ছে, বাড়ছে আলো। আমরা জোসনার মাঝে বাড়ীর পথ ধরলাম...