গলায় দড়ি দিমু
=========
অনেকদিন অনেকবার অনেক ঘটনায় মনে হচ্ছিল গলায় দিয়ে মুক্তি পাই। লজ্জা অপমান ও আত্মগ্লানি থেকে রেহাই পাই। কিন্তু ভদ্রতার মুখোশপরা এই আমার খেয়েপরে ভালো থাকার মচ্ছবে গলায় দড়ি দেওয়া হয়নি। মনের অভিব্যক্তিটি মুখে উচ্চারণও করিনি কখনো। কারণ কেউ কেউ তেড়ে আসবে এই বলে, ‘ওকে ধর, ও পেনিক ছড়ায়।’ সর্বশেষ নোয়াখালির ঘটনাতেও এমন কথা ভাবতে হয়েছিল। আমার মনে গুমরে-মরা অর্ধবাক্যটি সেদিন উচ্চারণ হতে শুনলাম একজন রিকশাচালকের কণ্ঠে।
কিস্তির ঋণে আশি হাজার টাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাটি দিন পনেরো আগে কিনেছিল তরুণ চালক। সিটি কর্পোরেশনের আইন ও ট্রাফিকবিধি লঙ্ঘনের জন্যে তার রিকশাটি এক্সভেটরে করে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া। ট্রাকে উঠানোর আগে রিকশাটির চাকা বাঁকিয়ে অচল করা হয়। রিকশা চালকের কান্না ও আহাজারি যারা ভিডিওতে দেখেছেন তাদের সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কষ্ট ও অসহায়ত্বের একটা ভাষা আছে। সেটা সেই খেটেখাওয়া মানুষটির চেহারায় দেখা গেছে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে যাচ্ছিল তার। বুকের যন্ত্রণা কণ্ঠের কিনারায় এসে আটকে যাচ্ছিল। কষ্টনিংড়ানো গলায় সে বলছিল, আমি এখন কী খামু, কিস্তি কী করে দিমু?’ একজন গলাবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কী করবেন?’ বেদনারুদ্ধ মানুষটি প্রাণপণ চেষ্টা করে রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘গলায় দড়ি দিমু।’ বাক্যটি শুনে মনে হলো আমার অব্যক্ত কথাটিই তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো।
সম্প্রতি এর চেয়েও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে বগুড়া শহরে। জানজট নিরসনকল্পে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদ অভিযানদলে ছিলেন খোদ মেয়র। ১৭টি রিকশা জব্দ করে সেগুলিকে রাস্তার ওপর রোলার দিয়ে পিষ্ট করা হয়। কষ্টে গরিব চালকদের বুক পিষ্ট হয়েছিল রোলারে চাপা-পড়া রিকশার সাথে, কিন্তু আইনপ্রয়োগকারীদের বুক কাঁপেনি সামান্যও।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কিংবা বগুড়া পৌরসভা আইন প্রয়োগ করেছে, তাতে কিছু বলার নেই। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্যেই তারা অবৈধ রিকশা তুলে নিয়ে গেছে। ঢাকার ঘটনায় দেখা গেছে রিকশা রেকারে উঠানোর আগে এক ব্যক্তি শক্তি প্রয়োগ করে চাকা দুমড়ে দিয়ে কিশাটি বিকল করছেন বিকট উল্লাসে। সেই লোকটির অবিব্যক্তিতে ছিল দুর্বলের ওপর চড়াও হওয়ার পাশবিক উগ্রতা। এটা মনে রাখা দরকার যে, রিকশাগুলি অবৈধ হলেও তা মাদকদ্রব্যের মতো নয় যে ধ্বস করতে হবে। ব্যক্তিসম্পদের বিনাশ আইনসমর্থিত হতে পারে না। দেশে অবৈধ সম্পদ চিহ্নিত ও ধ্বংস করা হলে কয়টি দালান খাঁড়া থাকবে সেটি কি আমরা চিন্তা করব না?
আইনকে অন্ধ হতে হয় ন্যায় বিচারের স্বার্থে। কিন্তু এই অন্ধত্ব কেবল দুর্বলের বেলায় প্রদর্শিত হলে নানা প্রশ্ন জাগবেই। প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হলে আইন নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। যে চালক বেআইনি কাজ করছিল তার যে কোনো ধরনের দণ্ড হতে পারত কিন্তু তার সম্পদটি ধ্বংস বা বাজেয়াপ্ত করা মানবিক কাজ হতে পারে না। শহরের দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে ঐসব রিকশা। এগুলি রাস্তায় চলা নিষিদ্ধ হলে তার বিপণনও নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। কমলাপুর রেল স্টেশনের বুকিং অফিসের সামনে গেলে দেখা যায় এক নম্বর প্লাটফরম ভরা এই জাতীয় রিকশা। নিষিদ্ধ জিনিসের পরিবহন ও বিপণন প্রকাশ্যে চলে কীভাবে? সরকারি রেলই বা তা পরিবহন করে কীভাবে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ প্রশ্ন তুলছেন যে, যেসব গাড়ি রোড পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়া চলে সেগুলিকে কেন রোলারে পিষ্ট করা হবে না? ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে উলটো পথে বা রং সাইড দিয়ে চলার গাড়িগুলি আস্ত থাকে কীভাবে? মালেকদের মতো অবৈধ সম্পদের মালিকদের বাড়ি-গাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হয় না কেনো? রিকশাচালকরা গরিব বলেই তাদের বেলায় আইন নিষ্ঠুরভাবে প্রয়োগ করা হয়? আমাদের গ্রাম এলাকায় একটি কথা প্রচলিত—‘নরম কাঠে সুতার ডাটি।’ মানে কাঠ যদি নরম হয় তখন কাঠমিস্ত্রির শক্তি জাহির করা সহজ হয়ে থাকে। এটা আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হোক তা মোটেই কাম্য নয়।
করোনার এই মহামারীকালে রাস্তায় এমন অনেক রিকশা বা অটোচালক দেখা যাদের দেখলেই বুঝা যায়, এই এই পেশার লোক নন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা টিউশনি হারানো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিব শিক্ষার্থী। আপদকালে বিপথগামী না হয়ে পরিশ্রম করে টিকে থাকার এই প্রয়াস অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। ঢাকার অসহায় রিকশাচালকটিও তরুণ। জীবিকার অবলম্বন হারিয়ে কোনো রিকশাচালক যদি বিপথগামী হয়, ছিনতাই-ডাকাতি বা মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তার জন্যে দায় শুধু কি তার একার হবে?
লজ্জা, দুঃখ, অপমান ও অসহায়ত্বে ‘গলায় দড়ি দিমু’ কথাটি মনে যেন না আসে তেমন একটি সমাজ চাই। অসাম্য, অবক্ষয় ও অশুভশক্তিবিহীন একটি দেশ চাই। গলায় দড়ি দেওয়ার ভাবনাটি মন থেকে দূর করতে হবে। এমন ভাবনা যাতে মনে না আসে তেমন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে সবাইকে কাজ করতে হবে।