সালফার_৫৯

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

এক রাতের মধ্যেই সিফাতের উচ্চতা প্রায় ১ ফুট কমে গেছে। হঠাৎ করে খাটো হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটেছে ঘুমের মধ্যে। কাল রাতে সিফাতের বিছানায় যেতে দেরি হয়। পড়াশোনা শেষ করে সে শুতে গিয়েছে রাত একটার পর। বিছানায় শোয়া মাত্রই চোখে রাজ্যের ঘুম। গভীর ঘুম ছিলো বলে ভোর রাতেই ঘুম ভেঙে যায় তার। ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য খাট থেকে নামতে যাওয়ার সময়ই সিফাতের মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। সে খাটে বসা অবস্থায় পা দিয়ে মেঝে ছুঁতে পারছে না। সিফাত ভ্রূ কুঁচকে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। পা জোড়া কেমন যেন ছোট ছোট লাগছে।

ফার্মেসীর নাম ‘দাওয়াই খানা’। নামটাতে কবিরাজি ভাব প্রকট হলেও ফার্মেসিটা বেশ আধুনিক। দোতলা একটা বিল্ডিং এর পুরোটা জুড়েই এই ফার্মেসি। যেন ছোটখাটো কোন ক্লিনিক। শহরের অপর প্রান্ত থেকেও লোকজন প্রায়শই এখানে ছুটে আসে প্রয়োজনীয় ওষুধের খোঁজে। স্থানীয় ডিসপেনসারিগুলোতে কোন ওষুধ খুঁজে পাওয়া না গেলে মানুষ তেমন একটা চিন্তিত হয় না। কারণ তারা জানে- দাওয়াই খানায় গেলেই ওষুধ পাওয়া যাবে। কেউ দাওয়াই খানায় অষুধ কিনতে এসে খালি হাতে ফিরে গেছে এমনটা কখনো শোনা যায়নি। কাজেই কেউ কেউ ধারণা করে বসে আছেন- এই ফার্মেসিতে নেই এমন কোন ওষুধ সম্ভবত তৈরিই হয়নি।

রাত এগারোটা। দাওয়াই খানার মালিক ডা. মানিক বাবু নিচতলা থেকে দোতলায় চলে এলেন। এখন তেমন একটা ভীড় নেই। তবে তিনি জানেন এমনটা থাকবে না। রাত বাড়ার সাথে সাথে ওষুধ কিনতে আসা ক্রেতার সংখ্যাও বেড়ে যাবে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন- রাতের বেলাতেই রোগীদের যন্ত্রণা বেশি হয়। সারা দিন ঘুমন্ত থেকে রাত হলেই যেন অসুখেরা যেন জেগে ওঠে। রোগীর কাছের মানুষকে ছুটে যেতে হয় ওষুধের খোঁজে।

দোতলায় মানিক বাবুর নিজের একটা রুম আছে। এই রুমে অন্য কেউ আসে না। তিনি রুমে না থাকলে সেটি তালাবদ্ধ থাকে। মানিক বাবু রুমটা তালাবদ্ধ করে চাবি নিজের কাছেই রাখেন। “দাওয়াই খানায়” অতিরিক্ত একজন ডাক্তার এবং পাঁচ জন সেলসম্যান থাকলেও তারা কখনোই এই রুমটিতে ঢুকতে পারেনি। দালানের ভেতরে হলেও মানিক বাবুর এই রুমটা যেন অগম্য কোন জায়গা। সবার ধারণা মানিক বাবু রুমটাতে গোপনীয় কিছু করেন। সেটা নিয়ে সুযোগ পেলেই সবার মধ্যে আলোচনা হয়। বরাবরই সেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে সমালোচনায়। কেউ কেউ অভিযোগ তোলে মানিক বাবুর হয়তো মেয়েলি কোন ব্যাপার আছে। কারণ তার রুমের পেছন থেকেই একটা লোহার সিড়ি সোজা নেমে গেছে রাস্তায়। সেই সিড়ি দিয়ে সহজেই কোন মেয়ে মানুষ উপরে নিয়ে আসা সম্ভব। যদিও কেউ কোনদিন এমনটা দেখেনি, তবু সন্দেহের তীর ছুড়তে কারোরই কোন রকম দ্বিধা সংকোচ হয় না। এই গুপ্তকক্ষ নিয়ে কোন প্রশ্ন করা হলে, মানিক বাবু হেসে জবাব দেন। স্বাভাবিক ভাবে বলেন, “পড়াশোনা করি। বিদেশি ডিগ্রি আছে বলেই আমি যে চিকিৎসা বিদ্যার সব জেনে বসে আছি এমন তো নয়। অনেক পড়াশোনা করতে হয়। নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরাতন বইও পড়ি।”

মধ্যবয়সী এই লোকটার কথা সবাইকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। কেউ তার কথা বিশ্বাসও করতে পারে না। আবার অবিশ্বাসও করারও কোন কারণ নেই তাদের কাছে। নিরিবিলিতে বই পড়ার জন্য নিজের একটা রুম থাকতেই পারে। তবে তিনি কাউকে তার রিডিং রুমে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন- এই প্রশ্নটাই ভাবিয়ে তোলে সবাইকে।

দোতলায় এসেই মানিক বাবু নিজের রুমে ঢুকে গেলেন। ভেতরে ঢুকেই সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলেন তিনি। সেই উচ্চশব্দ উপরে কর্তব্যরত সেলসম্যানের ভাবনার কারণ হলো না। সে এহেন দৃশ্য দেখে মোটামুটি অভ্যস্ত।

ভেতরে খুব বেশি সময় রইলেন না ডাক্তার। একটু পরই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তিনি। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন নিচ তলায়। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কোন কুষ্ঠ রোগী এসেছিলো ওষুধ কিনতে?”

সেলসম্যানরা এই প্রশ্নে অবাক হলো। দেশ থেকে অনেক আগেই কুষ্ঠরোগ বিদায় নিয়েছে। আর রোগী থাকলেও তারা চলে যাবে কুষ্ঠ হাসপাতালে। এখানে আসবে কেন? তাদের বিস্ময়ভরা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মানিক বাবু বুঝে গেল এমন কোন রোগী আসেনি। তিনি দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়লেন, “গরিলার মতো মোটা কোন রোগী কি এসছিলো আজ?”

কর্মচারীদের বিস্ময়বোধ আরও বাড়ল। এমন অযাচিত প্রশ্ন কেন করা হচ্ছে তারা বুঝতে পারছে না। অথচ মানিক বাবু এমনভাবে প্রশ্ন ছুড়ছেন যেন গরিলার মতো দেখতে কোন রোগী সত্যিই আসার কথা ছিল। এবারেও জবাব না পেয়ে মানিক বাবু বুঝে গেলেন এমন কোন রোগীও আসেনি। তিনি কিছু সময় নিচ তলাতেই পায়চারি করলেন। তারপর হন্তদন্ত হয়ে ফিরে গেলেন দোতলায়। এবারেও সশব্দে দরজা লাগানো হলো।

সিফাত নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার একবার মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। সে নিজ গায়ে চিমটি কাটল। ব্যাথা পেল সাথে সাথেই। এতেও সে নিশ্চিত হতে পারলো না যে এটা স্বপ্ন কি-না। সিফাত দ্রুত জুতা থেকে মোজা বের করে নাকে ধরলো। উৎকট গন্ধটা ভুরভুর করে চলে গেল মস্তিষ্ক পর্যন্ত। সিফাত জানে স্বপ্নে কোন কিছুর ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। এবারে সে নিশ্চিত হলো এটা স্বপ্ন নয়। সে সত্যিই সত্যিই এক ফুট খাটো হয়ে গেছে। তাও আবার এক রাতের মধ্যেই। আতঙ্কে জমে গেল সে। মানুষের জীবনে অলৌকিক ঘটনা ঘটে। তাই বলে এমনটাই হতে হলো তার সাথে!

সিফাত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শুধুমাত্র তার চুল দেখা যাচ্ছে। মুখের পুরো অংশটাই আয়নার নিচে পড়ে গেছে। অথচ আগে মাথা থেকে বুক পর্যন্ত দেখা যেতো। সিফাতের উচ্চতা এমনিতেই অল্প। যদিও সে কখনো মেপে দেখেনি তবে তার ধারণা সেটা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির বেশি ছিলো না। এখন সেটা গিয়ে ঠেকেছে চারফুটে।

সিফাত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো। শোকেজের গ্লাসটা কালো হওয়াতে এটা আয়নার মতো কাজ করে। সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। সিফাত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার সারা শরীর দেখতে লাগলো। বুঝতে চেষ্টা করল, শুধু কি উচ্চতাই কমেছে না-কি আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে নিশ্চিত হলো – অন্য কোন শারীরিক পরিবর্তন হয়নি। হাত,পা, নাক-মুখ আগের মতোই আছে।

সিফাত প্রথমে ভেবেছিলো তার পা দুটোই বোধহয় ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু সে বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করলো পা আগের মতোই আছে। কোমড়ের উপরের অংশেরও মনে হচ্ছে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। তাহলে উচ্চতা কমে গেল কিভাবে?

ফাঁকা বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর সিফাত বিষয়টা ধরতে পারলো। তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই সমানুপাতিক ভাবে ছোট হয়ে গেছে। এজন্য সে পার্থক্যটা চট করে ধরতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে হাত,পা আগের মতোই আছে।

এই ধারণা ঠিক কি-না পরীক্ষা করার জন্য সিফাত চোখে সানগ্লাস বসালো। তারপর মাথা সামান্য নিচু করতেই সানগ্লাসটা নিচে পড়ে গেল। অর্থাৎ তার ধারণাই ঠিক। তার মুখের আকৃতিও কিছুটা ছোট হয়ে গেছে। সেটা এতটাই সূক্ষ্ম যে চট করে বোঝা যাবে না।

সিফাত দ্রুত ঘরের সমস্ত জানালায় পর্দা টেনে দিল। পাশের বাসার ছাদটা ঠিক তার জানালা বরাবর। অতি উৎসাহী কেউ জানালা দিকে উঁকি দিলেই তার চারফুট উচ্চাতার শরীরটা দেখতে পাবে। দরজা জানালা সব বন্ধ করে সিফাত বেড রুমে ফিরে গেল। ব্রেকফাস্ট করার কথা তার মনে রইলো না।

ধীরে-সুস্থে খাবার খাওয়ার মতো অবস্থায় সে নেই। সে কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না। এক ধরনের অস্থিরতা তাকে তাড়া করতে লাগলো। ভাগ্য ভালো এই ফ্ল্যাটে সে একা থাকে। নইলে হুট করে কেউ চলে আসলে বিপদ ঘটতো।

এই মুহুর্তে কেউ এসে যদি তার এই অবস্থা দেখে ফেলে সে নিশ্চিত ভয় পাবে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলবে, “তুমি ছোট হয়ে গেলে কিভাবে?”

তখন সিফাত কী জবাব দেবে! তার জানা নেই।

সিফাত সেলফোন তুলে নিল। শবনমকে একটা ফোন দেয়া যায়। ওর সাথে কথা বলে যদি কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়।

ফোন ধরেই শবনম বলল, “কী ব্যাপার স্যার, আজ এতো সকালেই মনে পড়লো যে?”

“এমনি, সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলাম তোমাকে ফোন দেই।”

“জ্বর কমেছে তোমার?”

“হ্যাঁ জ্বর নেই।”

“সত্যি করে বলো। ওষুধ খেয়েছো তো? তুমি তো আবার অষুধ খেতে চাও না।” শবনমের কন্ঠে উৎকন্ঠা প্রকাশ পায়।

সিফাত বলল, “কাল দুপুরেই খেয়েছি ওষুধ। জ্বর নেই। ঠিক আছি আমি।”

“বাট তোমার গলা কেমন ভার শোনাচ্ছে। কী হয়েছে বলোতো?”

“কিছু হয়নি। বললাম তো ঠিক আছি আমি।”

“নাহ, কিছু একটা হয়েছেই। তোমার গলা কাঁপছে। সত্যি করো বলো তো কী হয়েছে?”

“তোমার হাইট যেন কত?”

এমন প্রশ্নে শবনম চমকে উঠলো। অবাক হয়ে বলল, “এসব কী উল্টাপাল্টা প্রশ্ন। আমাদের তিন বছরের রিলেশনশিপ। তুমি তো জানোই আমার হাইট কত।”

“ভুলে গেছি। বলো।”

শবনম বুঝে গেল সিফাত কী চাচ্ছে। সে কথাবার্তা অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাবে এখন। হাইট দিয়ে শুরু করলেই একে একে অন্যকিছু জানতে চাবে সে।

যতটা সম্ভব গলায় মধু ঢেলে শবনম বলল, “পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। এখন আর কী জানতে চাও?

সিফাত বলল, “আচ্ছা ধরো কোন কারণে আমার হাইট চার ফুট হয়ে গেল। তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?”

“মানে কী? সকাল সকাল এসব আবোল তাবোল বকছ কেন? তোমার কী হয়েছে হঠাৎ?”

“নাহ কিছু না। আচ্ছা ফোন রাখি। পরে কথা হবে।” শবনম আর কিছু বলার সুযোগ পেল না।

ফোন রেখে সিফাত ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে, ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগ মুহুর্তে সে আবারও আয়নার দিকে তাকালো।

এবারে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রবল বিস্ময় নিয়ে সে দেখতে পেল, এখন তার পুরো চুলও দেখা যাচ্ছে না। আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁকি দিলেই কেবল চুলের অংশ দেখা যাচ্ছে। এটার অর্থ এই দাঁড়ায়- এই অল্প সময়ের মধ্যেই সে আরও খানিকটা খাটো হয়ে গেছে। সিফাত দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো।

হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর কান্নার আওয়াজ কমাতে হলো তাকে। নইলে পাশের ফ্ল্যাটের মানুষ ছুটে আসবে। কেউ আসলে সে তার সমস্যার কথা বলতে পারবে না। সে এমন সমস্যায় পড়েছে সেই সমস্যার কথা কাউকে বলা যায় না।

সিফাত আবারও ফোন তুলে নিল। বাবা গ্রামে থাকে। বাবাকে সে তার সমস্যার কথা বলবে। বাবার কাছে নিশ্চয়ই এই সমস্যার কথা বলা যায়। সে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবে।

“আব্বা, আমি অনেক বড় একটা বিপদে পড়ে গেছি।” কান্নার ফাঁকে ফাঁকেই কথাগুলো বলল সিফাত।

টেলিফোনে ছেলের কান্না মাখা কন্ঠস্বরটা তীরের মতো বিধে গেল মফিজ উদ্দিনের বুকে।

সে কাতর গলায় বলল, “তোর কী হইছে বাপজান? কান্দোস ক্যান।”

“অনেক বড় বিপদে পড়ছি আব্বা।”

“কী বিপদ। ক আমারে।”

সিফাত কিছুই বলতে পারলো না। মফিজ উদ্দিনের বুকের ব্যাথাটা বাড়তেই থাকল। সে লজ্জা ভুলে বলে ফেলল, “কী বিপদ ক আমারে। পলায়া বিয়া কইরা ফেলছোস? না-কি পুলিশ তোরে খুঁজে? যাই হোক চিন্তা করিস না। আমি ঢাকা আসতাছি। সব ঠিক হইয়া যাইবো।”

“এইসব কিছু না আব্বা।”

“তাইলে কান্দস ক্যান? হইছে টা কী?”

“আমি ছোট হইয়া যাইতাছি আব্বা।”

এবারে কান্নার স্বর আবারও বেড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর কান্নার বেগ কমলে সিফাত সবকিছু খুলে বলল। মফিজ উদ্দিন ছেলের সাথে কথা বলে ধাঁধায় পড়ে গেলেন। যদিও ঘটনাটা অসম্ভব কিন্তু কোন ছেলে বাবার সাথে এমন বিষয় নিয়ে রসিকতা করবে না।

মফিজ উদ্দিন শহরের উদ্দেশ্য রওনা দিলেন। ( চলবে)...

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments