রৌদ্রছায়া

0 1
Avatar for Nipa1234
3 years ago

৪.

বৃষ্টি থেমে গেছে।বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।ঝিঁঝিঁ পোকার ক্রমাগত ডাক শোনা যাচ্ছে।আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে , সেখানে এখন কোটি তারার মেলা বসেছে।সাফওয়ান সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ।জানালা দিয়ে হিম শীতল বাতাস আসছে।পুরো ঘর জুড়েই কেমন যেন থমথমে ভাব।

সে ধীরে ধীরে জানালা থেকে চোখ সরিয়ে তার বা-পায়ের দিকে তাকালো।পায়ে সেই অসহনীয় যন্ত্রণাটা এখন আর নেই। তবে নাড়াচাড়া করলেই একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা টের পাওয়া যাচ্ছে।

সায়মা যদিও যাওয়ার আগে বলেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আবার আসবে তবে সে আর আসে নি।আজ রাতে বোধহয় আর আসবেও না।

বাইরে খুব শোরগোল শোনা যাচ্ছে।পরশু রাফসানের বিয়ে, তার দুদিন পর বৌভাত।বৌভাতের আয়োজন চলছে।এখনই সবার ব্যাস্ততা শুরু হয়ে গেছে।বাইরের হৈচৈ সে সবেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে ।

বিকেলের পর থেকে বাড়িতে একের পর এক লোক আসছে।প্রথমে এলো ডেকোরেটর,বাড়ির আলোকসজ্জার জন্য। তারপর এলো একে একে ভ্যান ভর্তি বাজার।এবং সবশেষে দুটো গরু আর চারটে খাসি বাড়ির সামনে বাগানের একপাশে বাঁধা হল।সেখানে বাতি দেয়া হয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েরা সেই আলোর বৃত্তের কাছাকাছি উৎসুক হয়ে ঘোরাফেরা করছে।

সাফওয়ান বিছানা থেকে নামলো। ডান পায়ে ভর ধীরে ধীরে হাটার চেষ্টা করলো। হেটে সে দরজা পর্যন্ত এগুলোও। কিন্তু দরজার কাছে এসেই সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছু একটা ভেবে খোরাতে খোরাতেই দরজা খুলে বেরিয়ে অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। নাহ! এখানে তো কেউ নেই। তবে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে যে সেই সন্ধ্যায় পাওয়া ফুলের সুবাসটা এখনই সে পেল?

সাফওয়ান দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। পায়ের সেই তীক্ষ্ণ ব্যাথা টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।

সে বুঝতে পারলো না কেন এই সামান্য কারণে সে এভাবে ছুটে এল।আশেপাশে অনেক গাছপালা আছে। তারমধ্যে কোন একটা ফুল গাছ থেকেই হয়তো সুবাসটা আসছে।এতে এতো ভাবাভাবির কি আছে!

রুবিনা ডাইনিং এ বসে গভীর মনযোগে তার হাতে থাকা ছোট নোটবুক টির দিকে তাকিয়ে আছেন। সেখানে চকলেট কেক তৈরির রেসিপি খুব সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে। তবে রুবিনা ঠিক বুঝতে পারছেন না। কোন উপকরণ টা আগে দিতে হবে আর কোনটা পরে কিছুতেই তিনি মেলাতে পারছেন না।ফলাফল ভ্রু জোড়া কুচঁকে মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তিনি বসে আছেন।

পেছন থেকে কেউ একজন নরম স্বরে তাকে সালাম জানালো।রুবিনার ভ্রু জোড়া আরো কুচঁকে গেল, প্রবল বিরক্তি নিয়ে তিনি পেছন ফিরে তাকালেন।দরজায় মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ছিপছিপে গড়নের শ্যাম বর্ণের মেয়ে।মেয়েটার পুরো মুখ জুড়ে নিরিহ একটা ভাব কিন্তু চোখ জোড়া ভীষণ ধারালো।সে পূর্ণ দৃষ্টিতে রুবিনার দিকে তাকিয়ে আছে।

রুবিনা সালামের জবাব দিলেন। তারপর কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফের নোটবুকের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করলেন।

কাল রাতে ঘুমোনোর আগে তিনি একবার সাফওয়ানের ঘরে গিয়েছিলেন। এত শত ব্যাস্ততার মাঝে ঠিক মতো ছেলেটার খেয়াল রাখা হচ্ছে না।মায়ের আদরের ছেলে কিনা! সব খাবার আবার সে খেতে পারে না। তার জন্য বাড়িতে সবসময় হালকা তেলমশলা দিয়ে আলাদা খাবার রান্না করা হয়।এবাড়িতে আসার পর সেই রান্নার দায়িত্ব টা রুবিনাই নিয়েছিলেন। তবে ব্যাস্ততার জন্য এই দুদিন তিনি রাধতে পারেন নি।রেধেছে মঞ্জুরী।সে খাবার নাকি সাফওয়ান মুখেই তুলতে পারেনি। মুখে দেওয়া মাত্রই ঝালে বেচারার অবস্থা কাহিল।মুখ লাল হয়ে, চেচিঁয়ে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে ফেলেছে।বেচারা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে মাকে এসব জানাবে। রুবিনার ইজ্জত আর এবাড়ির আথিতেয়তার যে সুনাম এবার ধুলোয় লুটোপুটি খাবে।

তাই অপমানের হাত থেকে বাঁচতে গল্পের ছলে নানার কথার ফাঁকে, কাল রাতে সাফওয়ানের কাছে ফন্দি করে তিনি জেনে নিয়েছেন সে কি কি খেতে ভালোবাসে।রাতে বসে সেসবের একটা লিস্টও তৈরি করেছেন।

সকালে হতেই ঘোষণা দিয়েছেন আজ বাড়িতে সাফওয়ানের সব প্রিয় খাবার রান্না হবে এবং রাধবেন তিনি একা!

সেজন্যই এই সাতসকালে চকলেট কেকের রেসিপি নিয়ে বসা।সাফওয়ান নাকি চকলেট কেক খেতে ভীষণ ভালোবাসে।

প্রথমে রুবিনা ভেবেছিলেন কেক বানানো কাগজের ফুল বানানোর মতই সহজ। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে গোরাতেই গন্ডগোল। কিভাবে কি শুরু করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।

আবার কারো সাহায্যও চাওয়া যাচ্ছে না। কারণ প্রথমেই তিনি সবাই কে জানিয়ে দিয়েছেন আজ তিনি একা হাতে সবকিছু করবেন।

এখন দেখা যাচ্ছে মহা মুশকিল। রুবিনা চোখ বুজলেন। এই ঘোর বিপদের সময় রেগে অস্থির না হয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। এই মেয়েটাকে কোনভাবে কাজে লাগলো যায় কিনা তাই দেখতে হবে।

রুবিনা খানিক পর পেছন ফিরে তাকালেন।মেয়েটা এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।তিনি ইশারায় তাকে ডেকে পাশে বসতে বললেন।মেয়েটি দ্বিরুক্তি করল না নিশব্দে পাশে এসে বসল। রুবিনা নিজের মনের সাথে মত কষাকষি করছেন।মনকে জিজ্ঞেস করলেন ,'একে দিয়ে কাজটা করানো কি ভালো হবে?

মন বলল,'অবশ্যই ভালো হবে। এ হল আমাদের কেয়ার টেকার রহমানের মেয়ে।বাড়ির চাকর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। কাজ করাতে অসুবিধা কোথায়? '

রুবিনা মনে মনে মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন,'তাও ঠিক। কথা অতি সত্য। কাজের মেয়ে কাজ করবে সেখানে আবার ভালো মন্দ কি?'

রুবিনা পানসে মুখে বললেন, 'সরোজু, তুমি কেক বানাতে জানো তো?'

সরোজু চোখমুখ উজ্জ্বল করে মাথা নাড়লো, 'জ্বি চাচি।'

-'ওহ, জানো তাহলে। আচ্ছা শোন,আমি এখন কেক বানাচ্ছি।তুমি আমাকে হাতে-হাতে সবকিছু এগিয়ে দিয়ে একটু সাহায্য করোতো।'

সরোজু মৃদু কণ্ঠে বলল,'জ্বি চাচি।'

রুবিনা বিরক্ত হয়ে বললেন,'উফফ কথায় কথায় এমন জ্বি চাচি,জ্বি চাচি করবে না তো। কানে অসহ্য ঠেকছে। '

কেক বানানোর প্রক্রিয়া চলছে।রুবিনাকে খুবই উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। তিনি ব্যাটারে পানি ঢালছেন তো ঢালছেনই।সরোজু এতক্ষণ আড়চোখে ব্যাপারটা দেখছিল।এবার আর চুপ থাকতে না পেরে বলল,'চাচি,পানি দিলে ব্যাটার পাতলা হয়ে যাবে। তখন কেক........'

রুবিনা কঠিন চোখে তাকালেন। বললেন, 'এই মেয়ে, কেক কিভাবে বানাতে হয় সেটা আমি তোমার কাছ থেকে শিখব?

তুমি কি ভেবেছ তুমি একাই সব জানো?

আমি কিছু জানি না? তুমি আসলে ছাই জানো।কেকের 'কে' টাও তুমি জানো না। হুহ্। '

সরোজু মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে রইলো । মনে মনে বলল,'কেক বানান 'কে' দিয়ে নয় চাচি।কেক বানান 'সি' দিয়ে।'সি' 'এ' 'কে' 'ই' কেক।বুঝেছেন? '

সরোজু ঈষৎ হেসে ফেললো।

ব্যাটারে পানি মেশাতে মেশাতে রুবিনা সরোজুর দিকে তাকালেন।তাকিয়ে বললেন।,'এই, এই মেয়ে তুমি হাসছ কেন?'

মূহুর্তেই সরোজুর মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল।

-'এই মেয়ে, তুমি আমার সাথে ফাতড়ামি কর।হু? আমার সাথে ফাতড়ামি?

এখান থেকে যাও এক্ষুণি।এক্ষুনি যাও।'

সরোজু মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে নিলেই রুবিনা ফের বললেন,'এই মেয়ে কোথায় যাচ্ছো? যেতে বলেছি বলেই কি সাথে সাথে চলে যেতে হবে ?

আগে কেকটা ঠিক কর তারপর যেখানে খুশি যাও।'

সরোজু ফিরে এল।সবকিছু আবার ঠিকঠাক করে কেক ওভেনে দিল।

রুবিনা সেদিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন।রাগটা একেবারে মাথায় চড়ে গিয়েছে।

সরোজু চৌধুরী বাড়ির সদরদরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে অপেক্ষা করছে তার বাবা আবদুর রহমানের জন্য। মেয়ের হাতে বাড়ির চাবি দিয়ে তিনি গিয়ে গাড়িতে উঠবেন।তবেই গাড়ি ছাড়বে।কিন্তু তিনি এখনো আসছেন না।

সরোজু চঞ্চল দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে।তার মাথায় কালোরঙা বড় একটা ওড়না জোড়ানো। ওড়নার রঙ আর তার গায়ের রঙের মাঝে তফাৎ টা খুব বেশি নয়।আবার খুব কমও নয়।মনে হচ্ছে তার গায়ের রঙটা আরেকটু ফর্সা হলে কিংবা আরেকটু কালো হলে তাকে আর মানাতো না বরং খুবই বাজে দেখাতো। এই গৌরবর্ণটাই যেন তার সাথে একেবারে মানানসই।

ওড়নার ফাঁক দিয়ে লালচে বর্ণের কিছু চুল বেরিয়ে তার ঘামার্থ মুখে লেগে আছে।নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম । সে শঙ্কিত হয়ে বাবার আসার অপেক্ষা করছে।এই ক্লান্ত দুপুরে, শঙ্কা ভরা প্রতীক্ষায় রত মেয়েটাকে যে কি ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটি যদি একবার জানতে পারত!এতো ভালো লাগার কারণ হল'মেয়েরা তাদের অর্ধচেতন রূপেই বেশি সুন্দর, কারণ সে সৌন্দর্য তাদের অজানা থাকে।কোনোরকম অহং সেখানে মিশতে পারে না, তাই সেই সৌন্দর্য হয় পুরোপুরি বিশুদ্ধ। '

সরোজু কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ নিয়ে এদিকওদিক চাইতে লাগলো।মধ্যদুপুর তো হয়ে এল বলে। এরা বিয়ে বাড়ি যাবে কখন?

-'আম্মাজান।' মুখে সরল হাসি ফুটিয়ে ধীর পায়ে আবদুর রহমান মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

বাবার এই নির্মল হাসিকে সরোজু কখনোই উপেক্ষা করতে পারে না। আজও পারল না। সে বাবার দিকে একপলক তাকালো।কি নিরীহ আর শান্ত একটা মুখ।এই মুখ দেখলে বাবাকে সরোজুর খুব অসহায় মনে হয়। তখন ইচ্ছে হয় বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে পাশে বসে থাকতে।আর বলতে,'বাবা,তুমি একদম ভেবো না। আমি তো আছি।আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব।তোমার জীবনের সব দুঃখগুলো ইরেজার দিয়ে মুছে খুব সুন্দর স্বপ্নের মতো দিন নিয়ে আসব।তোমার অত ভাবনা কিসের ? আমি আছি না!'

চলবে...........।

অদ্রিজা আহসান

আগের পর্বের লিংক:

https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/850255292446635/?app=fbl

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments