৩.
সুবিমল ফিরল পরদিন সকালে।সবাই তখন নাস্তার টেবিলে প্রাতরাশ সারছিল।
দারোয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে খোরাতে খোরাতে সুবিমল এসে হাজির হল।তার হাতে, মাথায় বিশাল ব্যান্ডেজ।সে দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে।
নেহাল চৌধুরী সবে রুটিতে একটা কামড় বসিয়েছেন।সুবিমল কে দেখে তিনি পানি দিয়ে রুটি টুকু গিলে ফেললেন।কঠিন চোখে সুবিমলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সুবিমল কে দেখে রুবিনার কফির মগ ছলকে কিছুটা কফি টেবিলে পরে গেল। তিনিও স্বামীর মতোই কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন।
কাল রাত থেকে সুবিমল ও গাড়ি উভয়ই উধাও ছিল।থানায় জিডিও করা হয়েছে। এখন এই হাঁদারাম সাতসকালে হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে এসে হাজির ।
চর চর করে রুবিনার রাগটা বাড়তে লাগলো। তিনি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। নিজেকে বোঝাতে চাইলেন এখন কোনভাবেই রাগটা প্রকাশ করা যাবে না।সামনেই নেহাল চৌধুরী বসে আছেন।
রুবিনার কাছে নেহাল চৌধুরী একটা ছোট খাট আতঙ্কের নাম। স্বামী কে তিনি বাঘের মতো ভয় পান।এই পুরো বাড়ি জুড়ে তার একছত্র অধিপত্য, তবে সেটা নেহাল চৌধুরীর আড়ালে ।নেহাল চৌধুরী যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন রুবিনা ততক্ষন ভেজা বেড়াল হয়ে থাকেন।তার খবরদারি শুরু হয় স্বামী বাড়ির বাইরে পা রাখার পর।
নেহাল চৌধুরী গম্ভীর হয়ে হাতের ইশারায় সুবিমল কে কাছে ডাকলেন।খুব স্বাভাবিক গলায় তাকে পাশের চেয়ারে বসতে বললেন।সুবিমল কোনো কথা বলল না। চুপচাপ চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
নেহাল চৌধুরী গমগমে গলায় ডাকলেন, 'মঞ্জুরী...।'
মঞ্জুরী প্রায় উড়ে এসে হাজির হল।
-'সুবিমল কে নাস্তা দাও।' গম্ভীর গলায় বলে নেহাল চৌধুরী আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলেন।তার দুটো চেয়ার পরে বসে রুবিনা রাগে দাত কিড়মিড় করতে লাগলেন।
নেহাল চৌধুরী বেড়িয়ে যাওয়া মাত্রই সবাই সুবিমল কে ঘিরে ধরল কাল রাতে কি ঘটেছিল বলার জন্য। সুবিমল অপ্রতিভ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ মাথানিচু করে বসে থেকে অবশেষে অসহায় মুখ করে বলল কাল রাতে সাফওয়ান কে পৌঁছে দিয়ে সে যখন বাজারে যাচ্ছিল পথে হঠাৎ দেখল একটা অসুস্থ ছেলে রাস্তার পাশে বসে আছে, হালকা গোঙাচ্ছে। হয়তো সাহায্য দরকার এই ভেবে সে গাড়ি থামাল। নেমে ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেল।তাকে কাছে আসতে দেখে ছেলেটা হঠাৎ গোঙ্গানো থামিয়ে মিষ্টি করে হাসল।সুবিমল হকচকিয়ে গেল।
তারপর হুট করেই ছেলেটা গায়ে জড়ানো আলোয়ান টা এক টানে খুলে ফেলল।তার ভেতর থেকে বেড়োল একটা ছুরি।
এই পর্যন্ত বলে সুবিমল থামল।বাকিটা বলার ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে পুরোটা না শুনে এরা কিছুতেই তাকে ছাড়বে না।
সবাই উত্তেজিত হয়ে ভুতের মতো চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
অগত্যা সে আবার বিরস মুখে বলতে শুরু করলো নিজের মূঢ়তার কাহিনী।
ছেলেটার হাতে যখন ছুরি দেখল সুবিমল ভীষণ ঘাবড়ে গেল ।তাই আগে পিছে কিছু না ভেবে গাড়ি ফেলে গাঢ় আঁধারের মধ্যেই দিল এক দৌড়। কোন পথে যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে কিছুই খেয়াল করল না।ফলাফল যা হবার তাই হল।পাহাড়ি রাস্তায় উল্টে পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল,পাথরে মাথা ঠুকে গেল।
সুবিমলের কেচ্ছার সমাপ্তি এখানেই। কথা শেষ করে সে মাথা নিচু করে বসে বেরোনোর অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো।
নেহাল চৌধুরীর তৃ-তনয়া অর্থাৎ ইলু,নীলু,বিনু আর পুত্রবধু সায়মা এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে কাহিনী শুনছিল।এবার সুবিমল থামতেই তারা মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো।অট্টহাসি দেওয়া যাচ্ছে না কারণ সুবিমল ঠিক পাশেই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। বেচারার জন্য তাদের কিছুটা মায়াও হচ্ছে।
কিছু কিছু মানুষ থাকে, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়েও হৈচৈ না করে যারা থাকতে পারেন না। সেই কিছু মানুষের একটা বৃহৎ অংশের বাস এই বাড়িতে। সামান্য বিষয় নিয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে দিতে এদের জুড়ি নেই। সেখানে গতকাল সাফওয়ান ও আজকে সুবিমলের এক্সিডেন্ট ঠিক কি ধরনের উত্তেজনা নিয়ে আসতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
চৌধুরী বাড়িতে এখন আলোচনার একমাত্র বিষয়বস্তু হল কিভাবে সাফওয়ান কে সহিসালামতে তার মায়ের কাছে পাঠানো যায়? বোনের কাছে বেড়াতে এসে ছেলের এই আকস্মিক দুর্দশা কে কোহিনূর আরা কিভাবে নেবেন কে যানে!
তবে তিনি যে একেবারে নির্লিপ্ত থাকবেন না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
_______________
সাফওয়ান বিরস মুখে বিছানায় শুয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে এই জানালা দিয়ে কোনো ভাবে পালানো যায় কিনা!
তার মন এখন একই সাথে ভীষণ খারাপ এবং প্রফুল্ল।
মন খারাপ কারণ কালকে রাতের পর থেকে এই ঘরে সে বন্দী। কেউ তাকে বেরোতে দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পর কেউ না কেউ আসছে এবং কিছু লাগবে কিনা জানতে চেয়ে ফের চলে যাচ্ছে।তাদের এই অতিরিক্ত সৌজন্য এখন তার অসস্থির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।এভাবে একঘেয়ে সময় কাটানোর কাজ টা খুবই কঠিন।
আবার মন প্রফুল্ল হবার কারণ হল বৃষ্টি নামতে আর বেশিক্ষণ বাকি নেই।
সন্ধ্যা মিলিয়ে যেতে এখনো হয়তো কিছু সময় আছে। তবে ঘর এখনই তমসাচ্ছন্ন। আবহাওয়া খারাপ ।আকাশ মেঘৈ...মৈ।সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে 'মেঘেতে মেদুর আকাশ'।যেকোনো সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে।এই পাহাড়ি এলাকায় আবছায়া সন্ধ্যায় যখন আকাশ ফুঁড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে সে দৃশ্য দেখতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে?
সাফওয়ান কি সেই শুভক্ষণের অপেক্ষা করছে?
কে জানে!
দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে এল।আবছা আলোয় সাফওয়ান তাকে চিনতে পারল না। বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে সায়মা বিছানায় তার পাশে এসে বসল।সেদিকে তাকিয়ে সাফওয়ান মিষ্টি করে হাসল।সায়মার দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু স্বরে বলল-'বুবু.....সরি।আমি এসেই তোকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম। '
অন্য সময় হলে সায়মা মুখে ভেঙচি কেটে দু'একটা কথা শুনিয়ে দিত।তবে এখন কিছু বলল না। শান্ত দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।তাকে খুব বিষন্ন মনে হল। হঠাৎ ভেজা গলায় সে বলল, 'তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে বাবু?'
সাফওয়ান ফের হেসে ফেলল।সায়মা ওপর ওপর তার সাথে যতই রাগ দেখাক না কেন সে আসলে জানে বুবু তাকে কতটা ভালোবাসে।
কাল সন্ধ্যায় হোচট খেয়ে পড়ে তার পায়ে একটা মরচে ধরা ছোরা ঢুকে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কিছু হয়নি। অথচ এতটুকুতেই সায়মার রকমসকম পাল্টে গেছে। সে আবেগে দুর্বল হয়ে গেছে।
-'বাবু, মঞ্জুরী বলছিল কাল রাতে সে যখন বাড়ি এল তখন নাকি তুই একাই সদরদরজার সামনে বসে ছিলি।নড়তে চড়তে পারছিলি না।
তাহলে তুই কাটা পা নিয়ে একা এতটা পথ হেটে এলি কিভাবে? '
সায়মার কথা শুনে সাফওয়ান চমকে উঠল।হঠাৎ তার মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেল। পুরো একদিন কেটে গেছে এরমধ্যে একবারও সেই ছায়ামানবীর কথা তার মনে আসে নি। আচমকা সাফওয়ানের চোখের সামনে সেই ধোঁয়াশায় ঘেরা সন্ধ্যেটা ভেসে উঠলো।
তার মতো অক্ষম আর দুনিয়াতে একটাও নেই। মেয়েটা না থাকলে তার দ্বারা কখনোই একাপথে হেটে বাড়ি ফেরা সম্ভব হত না।
-'কিরে সাফওয়ান, কথা বলছিস না কেন?'
সাফওয়ান কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,'একটা মেয়ে সাহায্য করেছিল।'
সায়মা সোজা হয়ে বসলো। ভুরু জোড়া কুচঁকে বলল,'মেয়ে!একটা মেয়ে তোকে এতটা পথ নিয়ে এসেছে? ওই ভর সন্ধ্যায় তুই মেয়ে পেলি কোথায়?'
হ্যাঁ রে, মেয়েটি দেখতে কেমন?'
সাফওয়ান বোনের দিকে তাকালো। তার সেই নির্মল আর অর্থহীন হাসি হাসল।শান্ত স্বরে বলল,'কিভাবে বলব বুবু,আমি তো মুখ দেখি নি।'
-'দেখিস নি মানে? তোকে কে সাহায্য করছে তাকে চিনে রাখবি না? বুদ্ধু কোথাকার !'
সাফওয়ান চিন্তিত হয়ে বলল,'ওটা মেয়ে না ছেলে আমি ঠিক শিওর না।শরীরে বড় চাদর জড়ানো ছিল।মেয়েও হতে পারে আবার অল্পবয়সী ছেলেছোকরাও হতে পারে।
তবে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক। চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর আর ধারালো। '
সায়মা অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো।তাকিয়ে তার ভীষণ মায়া হল।ভাইটা কেন যে এত সোজা আর কৌতুহল হীন!
যে তাকে এতটা পথ ধরে নিয়ে এসেছে সে ছেলে কি মেয়ে সেটুকু জানার আগ্রহও এই ছেলেটার নেই।
সে বলল, 'সে যাই হোক, পরশুই তো রাফসানের বিয়ে।তুই যেতে পারবি তো?'
-'পারব বুবু।'
সায়মা চিন্তায় পরে গেল। বলল,' পারলে তো ভালোই। কিন্তু পরে যদি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কিছু একটা ঘটে যায়?'
সায়মা চুপ থেকে কিছুক্ষণ ভাবল।তারপর বলল,'যদি যেতে নাই পারিস তবে সরোজ কে আমি এখানে রেখে যাব। মঞ্জুরীর কোন ভরসা নেই।সে থাকবে তার নিজের তালে।'
সাফওয়ান ধীরে ধীরে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসল।ভুরু কুচকে বলল,'সরোজ টা কে বুবু? এখানে আসার পর থেকেই শুনছি সবার মুখে এই নাম।'
-'আরে সরোজ কে চিনলি না? ওহ! তুই চিনবি কিভাবে সরোজ তো ছেলেদের সামনে যায় না।'
-'কে এই সরোজ বুবু? আর ছেলেদের সামনে যায় না কেন ?'
সায়মা হঠাৎ অপ্রতিভ হয়ে গেল।গম্ভীর গলায় বলল, 'সরোজ তো সবসময় কঠিন পর্দায় থাকে । পর্দা করলে কি ছেলেদের সামনে যাওয়া যায়?
যায় না তো।তাই ও কারো সামনে যায় না।
আমি এখন যাই বাবু। একটুপর আবার আসব।'
চলবে.......।