রৌদ্রছায়া ২.

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

২.

বিভ্রান্ত সাফওয়ান আরো বিভ্রান্ত হল সায়মার শশুড় নেহাল চৌধুরী কে দেখে।

সন্ধ্যায় এসে ফ্রেশ হয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়ে সে নিচে লিভিং রুমে এসে বসেছিল।ম্যাগাজিনের দিকে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারছিল অনেক গুলো চোখ আঁড়াল থেকে তার ওপর নজর রাখছে।মাঝেমাঝে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথাও বলছে।এরা সবাই এবাড়ির কাজের লোক।তারা লুকিয়ে দেখছে কারণ বাড়ির কর্ত্রী রুবিনা অর্থাৎ সায়মার শাশুড়ীর কড়া নিষেধ আছে বিনা কারণে সাফওয়ানের সামনে এসে ঘুরঘুর করা যাবে না।

তাই বলে কি তারা থেমে থাকবে!এত সুন্দর কোন পুরুষ মানুষ কি তারা আগে দেখেছে কখনো? শুধু যে দেখতেই সুন্দর তাও তো নয়।ধবধবে ফর্সা মুখটায় মায়া মায়া ভাব। যেন অসম্ভব রূপবান একজন যুবা পুরুষ বালক বালক চেহারা নিয়ে বসে আছে।

সাফওয়ান যথাসম্ভব নিরব থাকার চেষ্টা করল।এভাবে নির্নিমেষ বসে থাকতে থাকতে একসময় তার ঝিমুনি ভাব এসে গেল।সে সোফায় হেলান দিয়েই ঝিমিয়ে পড়ল। তখনই হঠাৎ গমগমে গলায় কেউ একজন বলে উঠল,'Hey young man! কি খবর? '

সাফওয়ান প্রায় লাফিয়ে উঠে বসলো।নেহাল চৌধুরী তার বিপরীত দিকের সোফায় বসে মৃদু হেসে যাচ্ছেন।তার অভিজাত গম্ভীর চেহারার সাথে যা একেবারে বেমানান।

-'জ্বি.....জ্বি, ভালো আছি আঙ্কেল। '

নেহাল চৌধুরী হাসি থামিয়ে এবার গম্ভীর গলায় বললেন, 'শুনলাম আজকাল নাকি সব মেয়ের মাঝেই তুমি ডাইনি-পেতনি দেখতে পাচ্ছো? '

তারপর মাথা নেড়ে বললেন -'লক্ষণ তো ভালো নয়।এমন চলতে থাকলে তো একসময় দেখা যাবে তোমার জন্য মেয়েই পাওয়া যাচ্ছে না ।শেষে অন্য গ্রহ থেকে মেয়ে আনাতে হবে।'

সাফওয়ান মাথা নিচু করে হঠাৎ কাশতে শুরু করলো।

নেহাল চৌধুরী আড়চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে বললেন, 'তা Young man এসেছ যখন আশেপাশে একটু ঘুরাঘুরি করো।সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরো।আমি সুবিমল কে বলে রাখব। কেমন?'

সাফওয়ান ইতস্তত করে হেসে বলল,'জ্বি আচ্ছা আঙ্কেল। '

নেহাল চৌধুরী চোখ বুজে আয়েস করে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। পা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,'বুঝলে সাফওয়ান, আমার ছিল জাহাজের নাবিকের চাকরি। কত দেশবিদেশ ঘুরে বেরিয়েছি।কোথাও স্থির থাকিনি। সেই স্বভাব এখনো রয়ে গেছে।নিজে গর্তে বসে থাকতে পারি না, কেউ গর্তে বসে আছে সেটাও সহ্য করতে পারি না।

তাছাড়া তুমি তো আর আমার ছেলেগুলোর মতো গর্তজীবি নও।Strong young man । যাও ঘুরেফিরে এসো।'

সাফওয়ান বাধ্য ছেলের মতো হেসে মাথা নাড়লো।

নেহাল চৌধুরীর পূর্বপুরুষেরা একসময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন।বাহ্যিক ভাবে যদিও সেসব কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই কিন্তু কিছুটা জমিদার জমিদার ভাব এখনো তাদের মধ্যে রয়ে গেছে।তার অন্যতম প্রমাণ হল এরা চট করে রেগে যায়। বাড়ির প্রতিটি মানুষ ভীষণ রাগী। এদের সাথে থেকে সায়মারও রাগের ক্ষেত্রে উন্নতি লক্ষনীয়!

এখানে রাত নটার মধ্যে সান্ধ্যভোজ সারতে হয়।এটা নেহাল চৌধুরীর দেয়া নিয়ম। আগেপিছে হলে সেদিন অনাহারে থাকা ছাড়া আর পথ নেই ।

রাতে খাওয়ার পর পরই সাফওয়ান ঘরে চলে এলো। তাকে থাকতে দেয়া হয়েছে দোতলার উত্তর দিকের একটি ঘরে।পুরনো আমলের বড় ঘর। হাত লাগানো মাত্রই কাঠের দরজায় মর মর শব্দ হচ্ছে।ঘরটা সাফওয়ানের মোটামুটি পছন্দ হয়েছে।

বিছানার ঠিক পাশেই গরাদ দেয়া বড় কাঠের জানালা।সে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো ।

হিম শীতল খরশাণ হাওয়া বইছে। শুল্কপক্ষের চাঁদের আলোয় দূর পাহাড়ের চূড়া গুলো পুঞ্জিভূত মেঘের মত দেখাচ্ছে।জানালার পাশে হেলান দিয়ে সে 'দ্য এ্যালকেমিস্ট' বইটি নিয়ে বসল।

এ শুধু বইয়ের ক্ষণ

এ লগন বই পড়বার!

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দরজায় ঠকঠক কড়া পড়ল।সাফওয়ান হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলতে এগিয়ে গেল।দরজা খুলে দেখা গেল ওপাশে সায়মা দাঁড়িয়ে আছে।সাফওয়ান কে সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে সায়মা নির্বিকার ভঙ্গিতে হেটে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল।বিরক্তির স্বরে বলল,'তোর ড্রামা কুইন মাকে জলদি ফোন লাগা।কল করে বাবু বাবু বলে চেচিয়ে আমার কানের পোকা গুলো একেবারে নাড়িয়ে ফেলেছে।

যেন তার ছেলেকে আমরা গুম করে রেখেছি।হুহ্। '

সাফওয়ান বোনের কথা শুনে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। সিথান থেকে ফোনটা নিয়ে মাকে কল করল।রিসিভ করেই কোহিনূর আরা একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।ঠিক মতন পৌঁছাতে পেরেছে কিনা,এরা ঠিক ভাবে যত্নআত্তি করছে কিনা।

তারপর হঠাৎ আতঙ্কিত গলায় বললেন, 'বাবু, একটা কথা তো তোকে বলতে একদম ভুলে গেছি।পাহাড়ে কিন্তু অনেক জিন-পরি থাকে। সুন্দর ছেলেমেয়েদের কে দেখলেই টুপ করে নিয়ে চলে যায়।কেউ টেরও পায় না।

বাবু,তুই কিন্তু ভুল করেও বাড়ি থেকে বের হবি না,এই আমি বলে রাখলাম।কথাটা মনে থাকবে তো? '

মায়ের কথা শুনে সাফওয়ান হাসতে শুরু করলো ।সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে সায়মা ভেংচি কাটল।

______________

সাফওয়ান ডাইনিং এ বসে আছে। সে ছাড়াও ডাইনিং এ আরো জন দশেক লোক আছেন। তারা সবাই বিয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে ব্যাস্ত ।সাফওয়ানের সামনে সাহেবি প্রাতরাশ সাজানো। ধোঁয়া ওঠা গরম কফি,চিকেন সসেজ,ব্রেড -বাটার,অরেঞ্জ জুস।কফির কড়া সুবাস পুরো বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরি বাংলো বাড়িতে পৌষের একটি মিষ্টি সকাল।

নাস্তার পরই সাফওয়ান সুবিমলের সাথে বেরিয়ে পড়লো। মায়ের নিষেধ অমান্য করে সারাদিন সে বাইরে ঘুরল।সবকিছু ঠিক-ঠাকই ছিল তবে বিপত্তি বাধল সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে।সুবিমল তাকে বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বাজারে চলে গেল।তাই বাকিটা পথ সাফওয়ান একাই ফিরছিল।সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে পথে চলা দুষ্কর, তার ওপর লোডশেডিং ।আঁকাবাকা রাস্তায় হাটতে গিয়ে সাফওয়ান হঠাৎ হোচট খেয়ে পড়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ে হাত রেখে সে বুঝতে পারলো খারাপ কিছু একটা ঘটে গেছে। পা থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে।সাফওয়ান দিশাহারা হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে যে সে মহাবিপদে পড়েছে।প্রথমত রক্তে তার ফোবিয়ার মতো আছে।রক্ত দেখলেই শরীর ঝিমঝিম করা সেই সাথে মাথা ঘোরানো শুরু হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত তার মনে হচ্ছে সে হেটে বাড়িও ফিরতে পারবে না। কারণ পায়ের চোটটা মোটেই সাধারণ নয়।এই চোট নিয়ে আর এক পা সামনে এগোনোও তার পক্ষে অসম্ভব!

সাফওয়ান কোনমতে পা টাকে টেনে হিচড়ে এনে সরু রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে বসে পড়ল।চারিদিকে নিকষ আঁধার। এখান থেকে নেহাল চৌধুরীর বাংলো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে।কারণ একমাত্র ওই একটি বাড়িতেই আলো জ্বলছে।অথচ আর এক পা সামনে যাওয়ার শক্তিও তার নেই।

ক্লান্ত সাফওয়ানের ঝিমুনি ভাব এসেছিল। হঠাৎ নাকে একটা হালকা ফুলের সুবাস এসে বাড়ি খেল। সাফওয়ান ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। সামনে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় আঁধারের জন্য তার মুখ টা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।তবুও সে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। তীব্র যন্ত্রণা আর আতঙ্কে তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, সে ঘন ঘন ঢোক গিলছে।

হঠাৎ রুক্ষ অথচ স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে সেই ছায়ামূর্তি বলে উঠল,'এইযে, কি হয়েছে আপনার?'

এই অনমনীয় কণ্ঠেও কোথায় যেন একটু প্রশ্রয় ছিল।সাফওয়ান ভরসা পেল।সে মৃদু কণ্ঠে বলল,'আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন? '

বিপরীত দিক থেকে সেই নিরস কণ্ঠ আবার বলল,' কি হয়েছে আপনার?'

-'আমি.....আমি, আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না। পায়ে বোধহয় খারাপ ধরনের চোট লেগেছে।'

নেহাল চৌধুরীর বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে সে বলল,'ওই বাড়িতে একটা খবর দিয়ে আসুন। প্লিজ।'

ছায়ামূর্তি মূহুর্তের জন্য সেদিকে তাকাল।তারপর বলল,'খবর দিয়ে লাভ নেই। বাড়ি ফাঁকা।কেনাকাটা করতে সবাই শহরে গেছে। '

তারপর একটা মোটা কাপড়ের অংশ সাফওয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,'আপনি এটা ধরে উঠে আসুন। কি,পারবেন না?'

সাফওয়ান অসহায় চোখে তাকাল।বলল,'আমি পারব না। আপনি প্লিজ কাউকে ডাকুন। '

ছায়ামূর্তি আশেপাশে একবার তাকিয়ে বলল,'এখানে তো কেউ নেই। '

খানিক নিরব থেকে ইতস্তত করে ফের বলল,'আপনি বরং আমার হাত ধরেই উঠে আসুন।'

সাফওয়ানের মাথা ততক্ষণে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এই ছায়ামানবী কিভাবে ওবাড়ির ভেতরের খবর জানতে পারল সেসব নিয়ে সে আর ভাবল না।হাত বাড়িয়ে দিল।'

কাল রাতের মতো আজও বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেছে।বাড়ির সদস্যরা সবাই সাংঘাতিক উত্তেজিত। কিভাবে এমন হল,বেহাইকে এবার কি জবাব দেওয়া হবে? চিৎকার, চেচামেচি, বিচার-বিশ্লেষণ........ একেবারে হুলুস্থুল কান্ড।

অন্যদিকে মার্কেট থেকে ফেরার পর থেকেই সায়মা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে।চিৎকার, চেচামেচি বাদ দিয়ে মাঝে মাঝে কেউ কেউ আবার অবাক হয়ে সে-ই দৃশ্যও দেখছে। সায়মা সাফওয়ানের জন্য কাঁদছে এ যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এরথেকে সায়মা তার বরের সাথে ঝগড়া করা বন্ধ করে দেবে সে কথাও যেন বেশি বিশ্বাসযোগ্য হত!

ফেরার পর থেকেই রুবিনা সুবিমল কে নিরন্তর কল করে যাচ্ছেন। বাড়ি ফিরলে আজ তার কঠিন বিচার হবে। অথচ সুবিমল এখনো গাড়ি নিয়ে লাপাত্তা! ফোন বন্ধ।

রুবিনা কঠিন কিছু গালি দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন।

তবে এখন কোন একটা অপকর্ম না করলে এই রাগ কমার নয়।সেকথা রুবিনা জানেন।

তিনি গটগট করে হেটে নিজের ঘরে চলে গেলেন।হাতদুটো নিশপিশ করছে।কিছু একটা অনর্থ করতেই হবে। হাতের একটু সুখ তো করে নেয়া যেতেই পারে।

হঠাৎ বিকট শব্দে একটা কিউরিও ভেঙে পরল।ভাঙা কাঁচের টুকরো গুলো মূহুর্তেই পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।সেদিকে তাকিয়ে রুবিনা স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন।তার রাগ একদম পরে গেছে।

চলবে.......

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments