রৌদ্রছায়া -১

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

এই নিয়ে সাফওয়ানের জন্য মেয়ে দেখা হল মোট পনেরো টা।কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও মেয়ে সাফওয়ানের পছন্দ হয় নি।পছন্দ না হওয়ার একমাত্র কারণ মেয়ে অস্বাভাবিক ফর্সা ও রূপবতী !

এর আগের দেখা চৌদ্দটি মেয়েও খুব তুচ্ছ ধরনের কারণে প্রত্যাখ্যান হয়েছে।প্রতিবারই দেখা যায় সব ঠিকঠাক, শেষে হঠাৎ সাফওয়ান বলছে মেয়েকে তার ভালো লাগে নি অথবা মেয়েটিকে সে আগে থেকেই চেনে,মেয়েটির একাধিক পাণিপ্রার্থী রয়েছে।ফলাফল বিয়ে ভেঙে যায় এবং ফের মেয়ে দেখা হয়।

এই সমন্ধটা এনেছিল সাফওয়ানের বড়বোন সায়মা।সায়মা ও সাফওয়ান বাবা-মায়ের দুইমাত্র সন্তান। সায়মার বাবা এই অঞ্চলের বিশিষ্ট আইনজীবী সোবহান আজিজ। আইনজীবী হলেও বাস্তবে সোবহান সাহেব রসিক মানুষ।সায়মাকে বাবা কখনোই খুকুমণি ছাড়া ডাকেন না।

বাড়িতে যতক্ষণ তিনি থাকেন স্ত্রীর সাথে তার নটখট লেগেই থাকে।কোহিনূর উষ্ণ মেজাজের মানুষ অল্পতেই রেগে যান।তবে সোবহান আজিজ মেজাজ সর্বদাই শীতল ।স্ত্রী কে বাপের বাড়ি নিয়ে দু'একটা খোঁচা দিয়ে তিনি চুপ হয়ে যান।এরপর সেই বিষ কোহিনূর সারাদিন ধরে পুরো সংসারের ওপর ঢালেন শুধু সাফওয়ান কে বাদ রেখে ।

মায়ের মতে সাফওয়ান হল এই ধরিত্রীর সবচেয়ে নিঃস্পাপ ও অবুঝ ছেলে।যে গুছিয়ে কোন কাজ করতে পারে না, এক গ্লাস পানি পর্যন্ত নিজে নিয়ে খেতে পারে না,বাইরে বের হবার সময় চুল আঁচড়াতে ভুলে যায়। নিতান্ত অসহায় এক যুবক! সাফওয়ানের জন্য তাই মা কোহিনূর আরা সর্বদাই আহ্লাদিত বোধ করেন।দিনরাত বলতে থাকেন, 'আহারে!আমার সোজা সরল ছেলেটা। এই জটিল পৃথিবীতে ও কিভাবে বেঁচে থাকবে!ওর মুখের খাবার কেড়ে নিলেও তো ও কিছুই বলতে পারবে না।

আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটার ভেতর এত পেঁচ দিলা, ছেলেটাকে কেন এত সোজা বানাইলা ? ছেলেটার একটু বুদ্ধি থাকলে তো আমার আর চিন্তা ছিল না।'

মায়ের কথা শুনে সায়মা ভুরু কুঁচকে মুখে ভেঙচি কাটে, রাগে ফোসফাস করতে থাকে।

সায়মার মন মেজাজ আজ বিক্ষিপ্ত। মেয়ে দেখতে আসার আগে মাকে গলা উঁচিয়ে সে বলে এসেছে, 'শোন আম্মা,এই মেয়ে হল নিখুঁত রূপবতী। একেবারে ফার্স্টক্লাস। আগে যে মেয়েগুলোকে দেখেছিলাম ওরা এর সাথে দাঁড়াতেই পারবে না।দাঁড়ালে এর রূপের আগুনে এমনিতেই ভস্ম হয়ে যাবে।বুঝলে?

এরপরও যদি তোমার গুনধর পুত্রের পছন্দ না হয় তাহলে আমিও বলে দিলাম সায়মুমের বাবার সাথে ঝগড়া করা আমি চিরজীবনের মতো ছেড়ে দেব। এই আমার এক জবান, হুহ্ ।'

সায়মা জবান দিয়েছিল ঠিক। অথচ এখন মনে হচ্ছে জবানটা সে রাখতে পারবে না।কারণ এই সীমাতিক্রান্তি রূপবতীকেও নাকি সাফওয়ানের পছন্দ হয় নি!

মেয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সাফওয়ানের কানে ঠোঁট তুলে সায়মা হিসহিসিয়ে বলল,

'তুই শুধু দেখ আমি কি করি।বাড়ি গিয়ে আজ যদি আমি কুরুক্ষেত্র না বাঁধাই তবে আমার নামও সায়মা আজিজ না।হুহ্। '

সাফওয়ান গুরুতর অপরাধের আসামির মতো শুকনো ঢোক গিলল।তার ফর্সা মুখটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারন করছে।মিন মিন করে সে বলল,'আমি কি বেশি কিছু বলেছি? শুধু বললাম যে মেয়েটা ভুতের মতো সাদা।এত সাদা যে রাত-বিরেতে হঠাৎ দেখলে ভয় পেয়ে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম করে হলেও নাইনটি পার্সেন্ট। '

সায়মা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো।সে তাকানো দেখে মনে হল চোখের চাহনির দ্বারাই সাফওয়ানকে সে ভস্ম করে দেবে।

সারা রাস্তা সাফওয়ান আর কথা বলার সাহস পেল না। বাড়ি ফিরতেই কোহিনূর আরা আহ্লাদিত হয়ে বললেন, 'তোরা এসেছিস? মেয়ে কেমন দেখলি?

তারপর হঠাৎ সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন, 'ওকি! বাবু, তোর মুখটা ওমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে? '

-'কি আবার হবে আম্মা।তোমার ছেলের এই মেয়েকেও পছন্দ হয়নি।আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আমি ভাই মাফও চাই,দুয়াও চাই।তোমার ছেলের জন্য তুমি নিজেই মেয়ে দেখ।আমাকে আর ডাকবে না।'বলে সায়মা মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল।

কোহিনূর সন্দিহান গলায় বললেন, 'সায়মা কি বলে বাবু? তোর কি সত্যিই মেয়ে পছন্দ হয়নি। এই মেয়ের যে তবে এত প্রসংশা শুনলাম.....! '

মায়ের মন ভেজাতে সাফওয়ান তার গুপ্ত কৌশল প্রয়োগ করল।কোহিনূরের কাছে এসে অসহায় বালকের মতো বলল,'জানো মা,কাল রাতে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি।স্বপ্নটা দেখে তো আমি ভীষণ..... '

কোহিনূর আতঙ্কিত হয়ে বললেন-'সেকি! তুই আমাকে জানাস নি কেন? কি দেখেছিস বাবু ?'

-'বুঝলে মা, স্বপ্নে দেখলাম একটা ডাইনি আমার গলা চেপে ধরেছে। ডাইনির পুরো মুখ চুলে ঢাকা।তাই মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। একসময় সে নিজেই চুলগুলো সরালো।

কি আর বলব মা, ডাইনির মুখটা ভয়াবহ রকমের সাদা।ভয়ে একেবারে আমার ঘুমটাই ভেঙে গেল।

তারপর আজ ওবাড়ি গিয়ে দেখি কালকে রাতে স্বপ্নে দেখা ডাইনিটাই লাল শাড়ী পরে ভুতনির মতো সেজে বসে আছে।এই মেয়েকে বিয়ে করলে নিশ্চিত এ আমার রক্ত চুষে খাবে।তাই আমি বলেছিলাম পছন্দ হয়নি।

তারপরও যদি তুমি বল......।'

কোহিনূর আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,'হায় আল্লাহ! এইসব তুই কি বলিস! আমাকে আগে কেন জানালি না বাবু? তাহলে তো তোকে আমি ওই ডাইনির বাড়ি পাঠাতামই না।তোকে যে কিছু করেনি সেই তো আমার ভাগ্য। আমি আজই পাঁচটা দেশি মুরগি সদকা দেব।আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, আজ আমাকে এতবড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন।'

সেদিনের মতো ঘটনা এখানেই সমাপ্ত হল।সায়মার কুরুক্ষেত্র বাঁধানোর কথা থাকলেও সে কুরুক্ষেত্র বাঁধালো না।রাগ করে মানুষ বাপেরবাড়ি যায়, আর সে রাগ করে নিজের মেয়েকে নিয়ে শশুড়বাড়ি চলে গেল।

কোহিনূর এবার নিজেই মেয়ে দেখার তোরজোর শুরু করলেন। দু-তিনটে মেয়ে দেখাও হল।তবে কোনটিই বেশিদূর এগোলো না।কারণ সাফওয়ানের কাউকেই বিশেষ পছন্দ হচ্ছে না।কারো বা নাক বেশি চোখা,কারো আবার মুখটা বেশি লম্বা!

এদিকে কোহিনূরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিন মাসের মধ্যে ছেলের বিয়ে তিনি দিয়েই ছাড়বেন।এই দৃঢ়তার পেছনে অবশ্য লম্বা ইতিহাস আছে..।

ছোট বোন হিরার মেয়ে রুমিকে তার মোটামুটি পছন্দ ছিল।হাতের কাছেই ভালো মেয়ে রেখে তিনি দূরে যেতে চাইছিলেন না।তাই প্রথমে রুমির সাথে সাফওয়ানের বিয়ের কথা তুলেছিলেন।ছেলের বিষয়ে তিনি সর্বদাই নিঃসন্দেহ।তাই বিয়ের দিন-তারিখ একেবারে পাকা করে তবে ছেলেকে জানালেন।

রুমিকে বিয়ের কথা শুনে সাফওয়ান একেবারে আকাশ থেকে পড়ল।

বলল রুমিকে সে নিজের আপন ছোট বোন ছাড়া আর কিছুই ভাবে না।তাছাড়া ছোট বেলায় রুমিকে সে কত কোলেপিঠে নিয়েছে, রুমি কতবার তার কোলে হিসু করেছে সে হিসাবও দিল।

অগ্যতা কোহিনূর হুট করেই সে বিয়ে ভেঙে দিলেন। সেই থেকে হিরার সাথে তার সম্পর্ক হল সাপে-নেউলে । হিরা সেদিন ভেংচি কেটে বললেন কোহিনূর বিয়ে না ভাঙলে তিনি নিজেই নাকি এ বিয়ে ভেঙে দিতেন।সাথে এও বললেন যে মায়ের আঁচল ধরা এই ছেলের কোনদিনও বিয়ে হবে না। পাল্টা আক্রমণ সরূপ কোহিনূর ঘোষণা করলেন তিন মাসের মধ্যেই তিনি ছেলের বিয়ে দেবেন এবং সেটাও অতি রূপবতী কন্যার সাথে।

সেই তিনমাসের দুইমাস ইতিমধ্যে শেষ।কিভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে ছেলের বিয়ে দেবেন সেই ভেবে ভেবে কোহিনূর দিনরাত অস্থির হচ্ছেন।তাছাড়া ছোট বোনের কাছে এভাবে হেরে যাবেন এও তিনি মানতে পারছেন না।

সকালে হঠাৎ সায়মার শাশুড়ী কল করলেন।কোহিনূর ভাবলেন সায়মা রাগ করেছে তাই হয়তো শাশুড়ী কে দিয়ে কথা বলাচ্ছে।পরে দেখা গেল ব্যাপার আলাদা।সায়মার বরের ছোট ভাইয়ের বিয়ে।বিয়ের দাওয়াত দিতেই তিনি কল করেছিলেন।

সাফওয়ানের বাবা সোবহান আজিজ সারাবছর বাতের ব্যাথায় ভোগেন। তাই তার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সে কারণে কোহিনূরের যাওয়াও মোটামুটি অনিশ্চিত।তাই ঠিক হল সাফওয়ান একাই যাবে দাওয়াত রক্ষা করতে।

সায়মার শশুড়বাড়ি সুসং দুর্গাপুর। পাহাড় ঘেঁষে ছোট সাদা বাংলোর মতো বাড়ি।কাছেপিঠে আরো কিছু বাড়ি রয়েছে। সামনে পেছনে উঁচুনিচু টিলা।কিছুটা দূরেই সোমেশ্বরী নদী।সাদা মাটির পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে গেছে অপরূপ নীলের স্রোতধারা। মনে ভালো করে দেয়ার মতো সমস্ত উপাদান এখানে একইসাথে বিদ্যমান।

সাফওয়ান সুসং এ এসে পৌঁছালো সন্ধ্যা নাগাদ। অপরাহ্নের ছায়া নেই, আকাশে খন্ড মেঘ ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে,বিকেলের সূর্যের আলো মরে ক্রমেই লালচে বর্ণ ধারন করেছে।ঝিরিঝিরি বাতাস আর দূর থেকে ভেসে আসা সোমেশ্বরীর কলকল ধ্বনি মিলেমিশে একাকার।

সাফওয়ান বাড়ির সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো।চারদিকে একবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মূহুর্তের জন্য তার শরীরে শিহরণ হল।প্রকৃতি কি তাকে বিমোহিত করতেই আজ হঠাৎ এত বিশেষভাবে সেজেছে? নাকি এই রূপ সর্বদাই এত স্নিগ্ধ!

সাফওয়ান ভেতরে যাওয়া মাত্র তাকে দেখে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। বেহাই বাড়ির কুটুম বলে কথা।তাছাড়া মায়ের চকলেট বয় যে এতদূর জার্নি করে এসেছে সেও এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সায়মার শাশুড়ী, ননদ,ভৃত্যরা মিলে একেবারে হুলুস্থুল কান্ড শুরু করে দিল।ঠান্ডা শরবত, গোসলের জন্য গরম পানি,চা-কফি........সাফওয়ান বিভ্রান্ত হয়ে গেল।

চলবে............।

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments