রৌদ্রছায়া

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

রৌদ্রছায়া

৫.

মঞ্জুরী হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।টিভিতে বাচ্চাদের একটা কার্টুন দেখাচ্ছে। মঞ্জুরী মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই কার্টুন দেখছে। মনে হচ্ছে তার মুখটা আরেকটু বড় হলে পুরো টিভিটাই সে গিলে ফেলত।কিন্তু আফসোস, মাঞ্জুরীর মুখটা টিভি গেলার পক্ষে যথেষ্ট বড় নয়!

রোদ্দুরে পিঠ জানালার ঠিক গা ঘেঁষে বসে মাথা নুইয়ে সরোজ বই পড়ছে।এমন পৌষের দুপুরে আদুরে রোদে বসে প্রিয় বই পড়ার মতো আনন্দ আর কিসে আছে?

তবে নানান কারণে বইয়ে সে ঠিক মতো মন দিতে পারছে না।তারমধ্য অন্যতম একটি হল মঞ্জুরী টিভির ভলিউম খুব বাড়িয়ে দিয়েছে । বাড়িতে লোকজন না থাকলে সে সবসময় এভাবেই টিভি দেখে।তাছাড়া ওপরের ঘরে একজন লোক রয়েছে। যদিও বেচারার পুরোপুরি সুস্থ নয়,এক পা অচল।তবুও বলা তো যায় না। হুট করে যদি এখানে চলে আসে!তখন তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।

এসব ভেবে সে বই পড়ায় মন দিতে পারছে না।

আবদুর রহমান তার হাতে বাড়ির চাবি তুলে দিয়ে চলে যাওয়ার পর হতে সে এবাড়িতেই আছে।

এবাড়ির ঠিক পেছনেই তাদের বাড়ি।তাই দু'বাড়ির মাঝে যাতায়াতের কোন অসুবিধা নেই । তবে সরোজ এখানে আসে খুব কম।এবাড়ির লোকগুলো একটু পাগলাটে ধরনের।কোনো এক অজানা কারনে রুবিনা তাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। দেখলেই কেমন ফোসফাস করতে থাকেন। তাছাড়া নেহাল চৌধুরীর মেয়ে তিনটির মাথাও বোধহয় হালকা গন্ডগোল আছে। কোনো রকম কারণ ছাড়াই এরা দিনরাত হাসে,আর হাসতেই থাকে ।তবে এবাড়ির বড় বউ টিকে তার খুব পছন্দ। ভারি ভালো মেয়ে। ভালো লাগার আরেকটি কারণ হলো একমাত্র সায়মা ভাবিই তাকে তার ঠিক নামটা ধরে ডাকে।

এছাড়া অন্য সবাই তাকে রুবিনার দেয়া নামেই ডাকে।এবাড়িতে যেদিন সে প্রথম এল, তখন সে খুব ছোট। রুবিনা তাকে কাছে ডাকলেন। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার নাম কি বাবু?'

সে তখন মাথা নেড়ে চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বলল,'আমার নাম সরোজ।'

রুবিনা ভুরু কুঁচকালেন।,'সরোজ! নামটায় কেমন যেন একটা ছেলে ছেলে ভাব আছে। এমন ছেলে ছেলে নাম শুনে বড় হতে থাকলে একসময় আপনাতেই স্বভাব ছেলেদের মতো হয়ে যাবে।

শোন বাবু,তোমাকে আজ থেকে আমি সরোজু ডাকব,আর কেউ ডাকুক বা না ডাকুক।আমি ডাকব, কেমন? '

সরোজ সেদিন বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে ছিল।

তারপর এই নামই বিশেষ ভাবে অনুমোদন প্রাপ্ত হল সকলের কাছে।

সরোজ বইয়ে মন দিতে চেষ্টা করলো। তার পড়নে হালকা আকাশী রঙা ফুলহাতা জামা।এই নির্জন দুপুরেও তার মাথায় বড় করে ঘোমটা দেয়া।যখনই বেখেয়ালে মাথার কাপড় টা খসে যাচ্ছে সাথে সাথেই সে আবার জড়িয়ে নিচ্ছে।

বারবার এই একই কাজের পুনরাবৃত্তি দেখে মঞ্জুরী একবার বিরক্ত হয়ে বলল,'আফু,আপনে মাথার কাপড় সরান না কেন? এইখানে তো আমি আর আপনে ছাড়া আর কেউ নাই।মাথায় কাপড় না দিলে সমস্যাটা কি?

মাইয়া হয়া মাইয়া লোকের সামনে আবার কিসের পর্দা? '

সরোজ ছোট একটা নিশ্বাস ফেললো।সব কথা সবাইকে বোঝানো যায় না।মঞ্জুরীও সেই সবারই দলে।সরোজ খুবই ক্ষীণ স্বরে বলল,'তুমি বুঝবে না মঞ্জুরী।'

মঞ্জুরী কিছু বলল না। সে বোধহয় কথাটা শুনতেও পায় নি।কারণ সরোজু কে প্রশ্ন করেই সে আবার টিভি দেখায় মন দিয়েছে।

বা-পা টা বিছানায় তুলে ডান-পা নিচে ঝুলিয়ে সাফওয়ান বিছানায় বসে আছে।সে একইসাথে ভীষণ বিরক্ত ও রাগান্বিত।সবাই বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়োনোর পর পরই মাঞ্জুরীকে ডেকে সে বলেছিল কড়া লিকার দিয়ে এককাপ চা দিতে।অথচ এখন বাজে দুইটা সাইত্রিশ। এখন পর্যন্ত মঞ্জুরীর কোন দেখা নেই!

সকাল থেকেই তার মাথাটা ধরেছে।বুবু ভীষণ ব্যাস্ত ছিল তাই বুবুকে জানায় নি।পরে হয়তো দেখা যাবে এই এক কারণে বুবু আর বিয়েতেই যাচ্ছে না।এমনিতেই সাফওয়ান যেতে পারছে না বলে সে খুব মন খারাপ করেছে।

বুবু বলেছিল কোন এক সরোজ না আরোজ কাকে যেন রেখে যাবে। তারও কোন পাত্তা নেই। এরা সব করছে টা কি?

এখন এই খোড়া পা নিয়ে বিছানায় বসে থেকে সে কি করতে পারে ? অন্য কেউ হলে হয়তো এখান বসেই গলা উঁচিয়ে মঞ্জুরী... মঞ্জুরী বলে চেচাঁত।কিন্তু চেচাঁমেচি করা সাফওয়ানের স্বভাবে নেই।সে চাইলেও কারো সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারে না।সে কথা বলে শান্ত গলায়, নম্র স্বরে।

তবে এখন কি করা যায়?এরা কি তাকে দুপুরে খেতেও দেবে না ?

পড়া থামিয়ে সরোজ হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে মঞ্জুরীর দিকে তাকালো।আতঙ্কিত হয়ে বলল,মঞ্জুরী....।'

মঞ্জুরী টিভি থেকে মুখ ফেরাল। এদিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে দায়সারা ভাবে বলল,'কি হইছে আফু? চিল্লান কেন? এতদিন পর শান্তিতে একটু টিভিডা দেখতাছি......হের মদ্যেও ডিসটাব।'

-'মঞ্জুরী, তুমি দুপুরের খাবার ওপরে পাঠিয়েছো তো?' সরোজ ফের আতঙ্কিত স্বরে বলল।

মঞ্জুরী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সে শুকনো ঢোক গিলল।, 'হায় আল্লাহ! আমার তো খেয়াল নাই।ভাইজান তো ঠিক দুইটায় দুপুরের খানা খায়।এখন কি হইবো, আফু?'

সরোজ ততক্ষণে রান্নাঘরে ছুট লাগিয়েছে।রান্নাঘরে গিয়ে সে তাড়াহুড়ো করে খাবার বাড়তে লাগলো। মাথার কাপড়টা কখন খসে পড়েছে সে টের পায় নি। হঠাৎ সে শুনতে পেল একজোড়া পায়ের শব্দ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। সরোজ বিশেষ ভাবলো না। এই নির্জন দুপুরে মঞ্জুরী ছাড়া আর কে এখানে আসবে?

সে আরকিছু ভাবার সময় পেল না। হঠাৎ রান্নাঘরে সেই দীর্ঘদেহী সুদর্শন যুবা পুরুষটি এসে দাঁড়ালো। একদম মুখোমুখি চোখেচোখ রেখে।

সরোজর শরীরে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল।ভীত হরিণির মতো অস্থির হয়ে সে এদিকওদিক চাইতে লাগলো।সে এখন পালাবে কোথায়? পালানোর পথেই যে লোকটা দাঁড়িয়ে!

হাত থেকে পানির গ্লাস টা পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে চারিদিকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল।সে অস্থির হয়ে মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা হাতে মাথার কাপড় টানতে লাগলো।

সাফওয়ান হঠাৎ কিছু বুঝে উঠতে পাড়লো না। ধীরে ধীরে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। মেয়েটা বিদ্যুৎের গতিতে বেড়িয়ে গেল।

সাফওয়ান স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।নিচে তাকিয়ে দেখল পুরো মেঝেতে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এবং এক জায়গায় কয়েক ফোটা রক্ত।রক্ত দেখে সাফওয়ানের মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো না মেয়েটা এতো মরিয়া হয়ে ছুটল কেন?

সে কি এমন বিপদজনক কেউ যাকে দেখে ভাঙা কাঁচের টুকরোর ওপর পা দিয়েই দৌড় পালাতে হবে?

-'ভাইজান, ভাইজান। 'গলা ফাটিয়ে চেচাঁতে চেচাঁতে মঞ্জুরী রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালো। চঞ্চল হয়ে বলল,'ওহ, আপনি এইখানে?

কাটা পা নিয়া আপনি বেড় হইছেন কেন? অক্ষণ ঘরে চলেন।ভাবি জানলে আমার খবর আছে। আপনি অক্ষণি ঘরে যান।আপনার খাবার আমি দিয়া আসতাছি।'

সাফওয়ান কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। কিছু না বলে চুপচাপ হেটে নিজের ঘরে চলে গেল।

সরোজ দ্রুত পায়ে হেটে বাড়ি ফিরে এল।শীতের দুপুরে তাদের রৌদ্রমাখা ছোট্ট বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে।ঘরে এসেই সে দরজাটা শক্ত করে বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়লো। ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো। একটা ছেলে তাকে দেখে ফেলেছে। তার তো অনেক গুনাহ হয়েছে।এখন সে কি করবে।সরোজ দু'হাতে নিজের মুখ খামচে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।তারপর হঠাৎ দু'হাতে মুখ জড়ো করে বলতে লাগলো, 'আল্লাহ, আমাকে মাফ করে দাও,আমাকে মাফ করে দাও।'তারপর অনবরত বলতেই লাগলো।

______________

পুরো ঘর জুড়ে নিকষ আঁধার।থমথমে ভাব।মাঝে মাঝে শুধু আরামকেদারা টায় হালকা শব্দ হচ্ছে।

দরজায় হঠাৎ একটা মরমর শব্দ উঠল।তারপর সেটা ধীরে ধীরে খুলে যেতে লাগলো। কে এসেছে ঠিক বোঝা গেল না।

সাফওয়ান শূন্য দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।অবাক করা হলেও সত্যি যে,এই মূহুর্তে ঘরে কে এসেছে সে বিষয়ে সাফওয়ান বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করছে না। কেন করছে না তা সে নিজেও জানে না।হঠাৎ করেই নিজেকে তার ভীষণ অসুস্থ মনে হচ্ছে।শরীর ও মন দুই'ই ভীষণ রকমের খারাপ। খুব খারাপ কোন অসুখ কি তার হয়েছে? কিন্তু কি অসুখ?

সেই দুপুর-বিকেলের সন্ধিক্ষণের আগ পর্যন্তও তো সে ভালো ছিল। তারপর হঠাৎ কি হল?

নিজেকে এত অসহায় মনে হচ্ছে কেন? এতটা শূন্য, এতটা বিবশ কেন লাগছে?

কেউ একজন মাথায় হাত রাখল।রিনরিনে গলায় বলল, ' সাফওয়ান......, সাইফু...ঘুমিয়ে পড়েছিস?'

সাফওয়ান ভান করতে জানে না।সে বোনের হাতটা ধরে নিজের হাতের মধ্যে পুরে নিল।আদুরে গলায় বলল, 'বুবু, দেখ তো আমার কপাল জ্বর আছে কিনা? '

-'ওমা!কি বলিস এসব? হুটহাট কারণ ছাড়া জ্বর হতে যাবে কেন? তুই আমার হাতটা ছাড়।আমি বাতি জ্বালিয়ে আসছি।'

-'বাতি জ্বালাতে হবে না বুবু।তুই পাশে বসে থাক।'

-'কিরে বাবু,কি হয়েছে তোর।শরীর খারাপ লাগছে? '

-'উহু।'

সায়মা হঠাৎ মুচকি হাসলো। বলল,'মায়ের জন্য মন কেমন করছে?'

সাফওয়ান ঝুম হয়ে রইল।

-'মন খারাপ করাই তো স্বাভাবিক। তুই কি কখনো মাকে ছাড়া কোথাও থেকেছিস একা?

মা তো ভাবছিল তুই আরো আগেই যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠবি।এখনো কেন কিছু বলছিস না, সেই ভেবে মা কালরাতে কল করে খুব কাঁদল।'

সাফওয়ানের সাড়া না পেয়ে সায়মা এবার কথা থামিয়ে চুপ করে ভাইয়ের শিয়রের কাছে বসে রইল।

সে ভাবতে চেষ্টা করলো, 'কিছু কি ঘটেছে? তার সহজ সরল ভাইটার হঠাৎ করে এমন বিমর্ষ হয়ে যাবার কারণ কি ?'

___________

কাল বৌভাত। এঘরে নিভৃতে বসে থেকেও পুরো বাড়ির উৎসবের আমেজ টা সাফওয়ান টের পাচ্ছে।সে জানালার পাশে বসে আছে। বাইরে কি অপুর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা দৃশ্য ।পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়ি।দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন একটা স্থির বিন্দু।সে তাকিয়ে আছে। কাল সারারাত সে এখানে বসেই কাটিয়েছে। অসুস্থ মন নিয়ে কি সুস্থ থাকা যায়?

সাফওয়ান ঠিক করেছে সে এখন নিচে যাবে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। এর মধ্যে খুঁজলে ওই মেয়েটাকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে!

পেয়ে গেলে সে কি করবে?

নাহ! বেশি কিছু নয়।শুধু একটু কথা বলবে। সাফওয়ানের ধারনা একবার খোলাখুলি কথা বলতে পারলেই তার ভেতরের এই অস্বস্তিজনক অবস্থাটা কেটে যাবে।

চলবে........

অদ্রিজা আহসান

আগের পর্বের লিংক :

https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/852075352264629/?app=fbl

1
$ 0.00
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments