প্রতি_বাসর

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

আজ আমার ছেলের বিয়ে। বউ হিসেবে তুষ্টি বেশ সুন্দর, স্মার্ট, আধুনিক। স্টেজ জুড়ে আলো করে বসে আছে ওরা। আজ বাইশে শ্রাবণ। কবি গুরুর প্রয়ান দিবস, আজ বাইশে শ্রাবণ, আমার আর বাবুর বাবার... থাক সে কথা। আজ আমার ছেলের বিয়ের দিন। বাবুটা এবার আর্কিটেক্ট ফার্ম দিয়েছে। চেনাশোনার বিয়েতে একটা লাভ হয়। খরচের বিষয়টা বেশ কমে যায়। একটা যৌথ অনুষ্ঠান, হাতে গোনা আত্মীয়, বন্ধু -বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী মিলে দু'পক্ষের আয়োজন।

বেয়াইন সাহেবা এক ফাঁকে আনন্দ জুয়েলার্স এর কয়েকটা বক্স দিয়ে গেলেন আমাকে। মেয়ের জন্যে বউ ভাতের দিন পরবার গহনা। আমার তরফ থেকে গহনা দিয়েছি গা ভরে। অনুরোধ ছিলো ও তরফ থেকে সামান্য দেবার, তবু বাবা - মায়ের শখ, মেয়েকে দেবেন। আমি বউ নয় বন্ধু চেয়েছি, তুষ্টি তেমনি হবে আমার বিশ্বাস। আজ আমার ছেলের বিয়ে, বাইশে শ্রাবণ, আকাশে মেঘ করেছে। জল চুইয়ে পড়ছে অবিরাম, শুনেছি বিয়ের দিনে মেঘ করলে বিবাহিত জীবন সুখের হয়। আমার বিয়ের দিনও এমন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি ছিলো, আজ আমার বাসর হয়েছিলো, বাবুর বাবার সাথে।

_ মা, সেল্ফী তুলব, তুমি ওদিক ঘুরে বেড়ালে হয়?

_ তোরা তোল, আমরা পরে।

_ তোমায় ছেড়ে তুলব না মা, প্রোফাইলে যাবে কিন্তু।

বেশ হাসিহাসি মুখে ছবি তুলে স্টেজ থেকে নেমে দাঁড়ালাম। কনে পক্ষের লোকজন কানাকানি করছে, আমায় নাকি বাবুর বড় বোনের মত দেখায়। দূরে সাদা পাঞ্জাবীতে বাবুর বাবাকে দেখতে পাচ্ছি। একহারা লম্বা লোকটা আজও পাঞ্জাবীর হাত গুটিয়ে রেখেছে, ঠিক বিয়ের দিনের মত। হাতের রুমাল দিয়ে ঘাম মুচছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। আমাকেই খুঁজছে নিশ্চিত। এমন বৃষ্টি হলে হোসেন শিশুর মত আমার কোলে মাথা রেখে গান শোনে। ভীষণ ঝড়ে আমি যেমন মুখ লুকাই ওর বুকে।

_ আপা, খাওয়া দাওয়া শুরু করে দেই। লোকজন চলে এসেছে সব।

_ আপনি যা ভালো বোঝেন ভাই, ছেলে - মেয়েকেও বসিয়ে দেয়া দরকার। তুষ্টির খাওয়া হয় নি মনে হয়, মুখটা শুকিয়ে গেছে মেয়েটার। আবার, কাল অনেক দূরের পথ যাবে ওরা।

রহমান সাহেব, বেয়াই খুব গুনী মানুষ। আমার অনুমতি নিয়েই দৌড়লেন ক্যাটারারের দিকে। বড় ভাইকেও যেতে দেখলাম। আমার বড় ভাই, হোসেনের বোন জামাই। রত্নাকে আমি ভাবী বলি। ও আমায় এখন খুব ভালোবাসে। বছর পনের আগেও আমি ওর দুশমন ছিলাম। এখন সব কাজে, আমাকে নিয়ে ভাবে। তুষ্টি ওর বাবা- মা'র প্রথম সন্তান। ওর ছোট, মিষ্টি খুব আনন্দ নিয়ে ঘুরছে, বোনের বিয়েতে বায়না করেছিলো, বোনের কাছাকাছি একটা শাড়ি পরবার। বেয়াইন সাহেবা রাগ করে নাকি কিনে দেননি। পরে হালকা কাজের একটা রানী গোলাপী শাড়ি কিনলাম ওর জন্য। ও বাড়ি নিজে বয়ে নিয়ে গেলাম শাড়িটা। হোসেনকে আবারো খুঁজে পাচ্ছি না। এই লোকটা সারাটা জীবন জ্বালালো।

সেদিন সকালে ও পক্ষের মেহেদী উৎসবের ঘরোয়া আয়োজন, সন্ধ্যায় আমার বাসার ছাদে - গায়ে হলুদ। বাবুকে হলুদ ছুঁইয়ে সে হলুদ নিয়ে যেতে হবে মেয়ের বাসায়। কিছু নিয়ম আমার মনঃপুত হয়নি। তাতে কি? মেনে নিয়েছি। মেহেদী দিয়ে সন্ধ্যার গায়ে হলুদে ছেলে- মেয়ে জোড় হয়ে নাচল। বেয়াই- বেয়াইনের খুশি দেখে আমি হোসেনকে ডাকালম। ও ছায়ার মত পাশে বসে দেখল। ভাবী এসে আমায় হাত টেনে নাচের আসরে নিতে চাইলো। আমি হোসেনের দিকে চাইতেই ওর চোখে মিনতি দেখলাম। এই পঞ্চাশেও আমি সুন্দর। আমাদের যুগের স্বামীরা কি চায় তার স্ত্রী ভর মজলিসে পরপুরুষের সামনে নাচুক? আমিও গেলাম না, বাবু - তুষ্টি মন খারাপ করল। তাতে কি? আমি হোসেনকে ভালোবাসি।

আমার নিজের মেহেদী আর গায়ে হলুদ দেবার সময় পায়নি মা। হোসানের বাবা মেয়ে দেখেই আংটি পরিয়ে ছেলেকে খবর পোস্টকার্ড দিয়েছিলেন,

"Your mother is ill, Come sharp".

সেটা পেয়েই হোসেন দৌড়ে এসেছিলো। আর রাজকন্যা বরণ করে ঘরে তুলোছিলো। ও নাকি একদম রাজি ছিলোনা বিয়েতে। পরদিন দুপুর বেলায় পুকুরপাড়ে ভেজা চুলের সদ্য স্নান সেরে চুল শুকোতে বকুল তলায় বসা মেয়েটাকে একনজর দেখতে এসে তারপর আর না বলতে পারেনি।

সেই পোস্টকার্ডটা এখনো আমার বিয়ের শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে গন্ধ শুঁকি। পুরাতন তবু আতরের গন্ধটা তাজা। হাসনুহেনা ফুল দিয়ে সাজানো চারপাশ। আতর ছাপিয়ে তাজা ফুলোর ঘ্রাণ নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। আতর হোসেনের পছন্দ। ও খুব সুগন্ধী ব্যবহার করে, আমি ওর গন্ধটাই গায়ে মেখে ঘুরি।

মোরগ পোলাও তুষ্টির প্রিয়। খাবারের মেনু কি হবে জানতে চেয়ে বেয়াইনের ফোনে,আমি হরদম বলে দিয়েছি, তুষ্টির প্রিয় খাবার হোক। আমার নিজের বিয়েতে খেতে পারিনি। হোসেনের বাবা, মানে বরপক্ষ ছেলে নিয়ে রাতে বাড়ি আসলেন, রাত আটটায় বিয়ে হয়ে গেলো। গরম দেশী মুরগীর ঝোল, পটল ভাজা, ঘি ভাত আর ছোলার ডালনায় বড় বড় গরুর গোসতের চর্বি সহ টুকরা আমার সেদিন গলা দিয়ে নামেনি। হোসেনের আব্বার প্রিয় খাবার ছিলো সব।

আমার বাবা বেয়াই বাড়ির প্রিয় সব আয়োজন কেমন করে যেন করে ফেলেছিলেন। রহমত ভাই এখন যেমন দৌড়োচ্ছেন তুষ্টির জন্যে। আমার একটু আলু ভাতে পোড়া মরিচ আর ভুনা ডালে আচারে পেট ভরে যায়। বিয়ের দিন আমি উপবাস ছিলাম। তুষ্টিটা আজ মন ভরে খাক।

বাবুর গ্রাজুয়েশন শেষে, হোসান আমি আর বাবু মিলে পাহাড় দেখতে গেলাম। বড় বড় মেঘ, আকাশটাকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। আমি অতশত বুঝিনা। হাসান সন্ধ্যে হলেই বাঁশি বাজিয়ে, আমার পায়ে নুপুর বেঁধে , পা দুটো বুকে চেপে রাখে, ঠিক বাসর রাতের মত। আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো বিয়ের একদিন পর। প্রথম দিন, হাসানের বাবা, ছেলে বিয়ে পড়িয়েই চলে গিয়েছিলেন। পরদিন দুপুরে হোসেন এলো। একহারা লম্বা গড়নের মানুষটার মুখে শিশুর সারল্য খেলা করে। মুখের স্মিত হাসিটায় প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে

হোসেন দূয়ার জুড়ে দাঁড়ায়। এখনো ঐতো কামিনীর ঝোপের কাছে চেয়ার পেতে বসেছে, আমি এত ইশারায় ডাকবার চেষ্টা করছি, দেখছেই না। ও বরাবর এমন, অভিমানী।

_ আপা, মেয়ের শুভদৃষ্টির রসম শুরু হবে, আপনায় দরকার যে।

_ আমি দূর থেকে দোয়া করছি। ওসব কম বয়সীদের কাজ, ওরা আনন্দ করুক।

_ মুনিয়া, চলো, বাবু তোমায় ছাড়া বউ এর মুখ দেখবে না।

ছেলের দিকে এগোতে এগোতে ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিলাম, শাপলা ফুলটা ঠিক আছে কিনা। দূর থেকে দেখছি বাবুর হাতখানি তুষ্টি কি নির্ভরতায় ধরে আছে। বাবুটাও চেপে রেখেছে বউ এর হাত, এত ভীড়ে যেন ছুটে না যায় প্রিয়তমার হাত। হোসেনের হাতটাও এমনি করে চেপে রেখেছিলাম, আজই, হা, এই দিনেই। আজ বাইশে শ্রাবনে সব গল্পটা মনে পরছে।

_ জামাই - বউ, শরবত এর গ্লাস কই, এক গ্লাসে কেনো?

_ভালোবাসা বাড়বে!

_ লোকাল কালচার। প্রথম থেকেই মেয়ের ইচ্ছা বাদ দিচ্ছে?

_তুষ্টি আপা এঁটো গ্লাসে খায় না। বড় মামী ঠিক বলছে।

_ মিষ্টি, পাকনামো করিস না, বাবুকে দে গ্লাসটা।

মাঝ বয়সী আত্মীয়া , ছোট ছেলে মেয়েরা মিলে ঘিরে রেখেছে বাবুদের। মাথার উপর সামিয়ানার মত করো একটা কাতান কাপড় ধরা। আমি স্মৃতি হাতড়াই। কত বছর আগে! আঠাশ? খুব কি বেশী? হোসেনের হাসি এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি। ও খুব মজা পাচ্ছে বাচ্চাদের কাজ দেখে। বাবা হিসেবে হোসেন একশতে একশ। বাবুর সব কাজে ওর মত দেয়া থাকে। তুষ্টি এক গ্লাস থেকেই খেয়ে নিলো। মেয়েটা আমার মতই খুব ভালোবাসবে বাবুকে। আমি নিশ্চিন্ত। আমার, কেবল আমাদের কথা মনে পরে।

_ শরবত দেবে না? নাকি একলাই খাবে? দুটো গ্লাস দওলো তো আম্মা।

_আমি চিনির শরবত খাই। গুড় লেবুর শরবত ভালো লাগে না।

_ হলে গুড় দিয়ে বানিয়ে নেই, চিনিতে পিঁপড়ে ধরে। গুড়েও ধরে, তবে গুড় রাখার একটা টেকনিক আছে। তুমি শুনবে?

_ না, আমি আম্মার কাছে যাবো। সকালে কিছু খাই নি। গতকাল রাতে ও না। এখন ভাত খাবো, আর আপনি এলেন।

হোসেন নিঃশব্দে ভেজানো দরজা খোলে। কখন যেন দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলো, খেয়াল করিনি। বুক কাঁপে, সেই কাঁপনের মধ্যে দেখি কাসার থালায় গরম গরম ধোঁয়া ওড়ানো ভাতে, একটা সোনার বাটির মত ডিম ভাজা, তার গায়ে সরিষার তেল রোদ্দুর হয়ে ঝিকঝিক করছে। পাশেই আধ ফালি লেবু, মাঝে এক চামুচ ঘি। উপসী পেট নিয়ে আনমনে হাসানের দিকে এগিয়ে যাই। হাসান এক হাতে আমায় আঁকড়ে ধরে কপালে চুমু খায়। লজ্জায় লাল হবার আগেই দেখি এক লোকমা ভাত মেখে মুখের সামনে ধরেছে মায়ের মত।

পরের এক ঘন্টায় ওর হোস্টেলের গল্প শুনতে শুনতে আমি বন্ধু হয়ে যাই। হোসেন তখন মাস্টার্স করছে, বিসিএস দিয়ে অপেক্ষায় চাকরীর। পাতলা ডাল, হলের ফিস্ট, ফিস্টের পোলাও, মোরগের না ব্যাংঙের রান, রাতে হলের ছাদে গানের আড্ডায় গোপন প্রেমের না পাওয়ার ব্যাথা আমার মনে ঈর্ষা জাগায়। সেই অদেখা সহপাঠিনী কি আমার থেকে সুন্দরী? আমার প্রশ্নের উত্তরে ওর গজদাঁতের হাসি দেখি। আর সেই মুহূর্তেই আমার গোটা পৃথিবীর দখলটা আঠাশের হোসেন কিনে নেয় বিনা সুদে।

__ বাকি গল্প রাতে বলব। এখন ঘুমিয়ে নাও।

__ গল্প না শুনলে পেট ফেটে মরে যাবো।

__ গল্প শোনালে কিছু উপহার দিতে হয়, কি দেবে?

__ আমার কাছে বকুলের মালা আছে, নেবেন? একদম তাজা, সকাল সকাল কুড়িয়ে বানানো।

__ এখন ঘুমোও, রাতে জাগতে হবে কিন্তু। ফুলের মালা না আমার আস্ত ফুলটি চাই।

__ আমি রাত জাগিনা, জেগে থাকলেই ভুতের ভয় হয়।

__আজ জাগিয়ে রাখব, মস্ত ভুত হয়ে। ঘুমিয়ে নাও।

হোসেনের হেয়ালী বুঝি না, শুয়ে পড়তেই, গায়ে পাতলা চাদর টেনে দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দেয় ও। এখন যেমন তু্ষ্টির চোখে পরা বালি তুলে আনছে বাবু। খুব কাছাকাছি ওদের মুহূর্তটা ক্যামেরায় ফ্লাশবন্দী হচ্ছে। মানা করতে গিয়েও করলাম না। বাবু -তুষ্টি তো আনন্দ পাচ্ছে। বিয়েটা ওদের, একবারই হয়ে যাওয়া বিয়ের মধুর জীবন। হোসেন ও একই কথা ভাবছে, আমি জানি। ওর সামান্য ঝুঁকে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা আমার চেনা। আমি ওর সব বুঝতে পারি। অর্ধাঙ্গিনী যে!

বেয়াইন সাহেবা, রহমত সাহেব মিষ্টি, তুষ্টি, বাবু এক ফ্রেমে আটকালো। বাবু এখন ওদের পরিবারের অংশ। আমার ছেলেটা আর আমার রইল না। ওর একার জীবনে এখন আমার ভূমিকা হয়ে উঠবে সামান্য থেকে সামান্যতম। তুষ্টি খুব ভালো মেয়ে। ওরা আমাকে অসম্মান করবে না কখনো, তবে ওদের সীমায় যেন আমার অনধিকার প্রবেশ না হয় সে খেয়ালটা রাখব। তুষ্টির হাত ধরে বাবু বাইরে যাচ্ছে, হয়ত আরো কিছু ছবি তুলবে। হাসি হাসি মুখে দুপুরের রোদ পড়ে তুষ্টিকে রাজকন্যা লাগছে। তুষ্টির কাছে হোসেনকে এগিয়ে যেতে দেখলাম, বাবুকেও হয়ত ডাকবে। চোখের চাহনিতে মানা করে দিলাম। হোসেন মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকলো। আমার কিচ্ছু করার নেই। বাবুদের প্রিভেসী দরকার এখন। নিজেদের মনের মত করে ছবি তুলুক ওরা।

বিকেলের ঢের বাকি, আমি সুইমিং পুলের পাশে পেতে রাখা চেয়ারে হোসেনের পাশে গিয়ে বসি। বেয়াই গান বাজনার আয়োজন রেখেছেন। ঝাকড়া চুলের ছেলেটা মাথা নাচিয়ে বিকট আওয়াজে হিন্দী গান গাইছে। নরম রোদ হোসেনের কন্ঠদেশ চুমে ঘাড়ে পড়েছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম এমনি জমেছিলো আমার কপালে, সেদিনের বাইশে শ্রাবন রাতে।

সারা বিকেল আব্বা আম্মার সাথে জমিয়ে গল্প করল হোসেন। আম্মা তেলের পিঠা বানিয়ে, চিড়া ভেজে দিতেই হোসেন চা বানিয়ে আনল। আমি কেমন পর হয়ে যাচ্ছি, এই লোকটার জন্য আজকে আব্বা আম্মার কাছে! আমাকে ডাকছে না, অথচ আমার জন্যেই তো এসেছে। এটুকু ভাবতেই মন লজ্জা পেলো। দুয়ারে খিল আটকেই হোসেন বলল,

_ এবার গুড়ের বাকি গল্পটা শোনাবো। একটা বাটিতে গুড় রেখে তাকে সরার উপর রাখতে হয়, সরা ভরে জল দিয়ে সরাটা রাখবে আরেকটা জল ভর্তি থালায়। পিঁপড়ে গুলো পানিতে ভাসতে গিয়ে ডুবে যাবে।

_ পিঁপড়ে তো সাতার জানে, মিথ্যে কথা। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছেন, আচ্ছা আপনার বাবা জানলে রাগ করবেন না? অনুষ্ঠানের আগে এ বাড়ি আসার দরকার পরবে না, তাই বলে গেলেন।

__ আমার বউ, বিয়ের আগ পর্যন্ত আব্বার কথা শুনেছি। এখন মানব কেনো? তোমাকে দেখেই ভালোবেসেছি। গুড়ের মত মিষ্টি বউটা আমার, পিঁপড়ে হবার লোভে চলে এলাম আজ।

হোসেনের হেয়ালী বুঝবার আগেই ঠোঁট জোড়া বেদখল হয়ে গেলো, লজ্জাটুকুও, সে রাতের ঝড়ে অনেক কিছু এলোমেলো হয়ে গেলেও, হোসেনের পাগল পারা আদরে আমি লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম ভালোবেসে। প্রলয়ঙ্কর সর্বনাশের পর আমরা একে অপরকে মেঘ ভাঙা আলোয় দেখলাম। হেসেনের নিষ্পাপ চোখের তারায় আমি আমাকেই দেখে গেছি সেদিনের পর থেকে এতটা বছর। আর কেউ সেখানে দখল নিতে পারেনি। সকাল বেলায় নিরাভরন গলায় একটা ভারী হার চিরস্থায়ী দখলিস্বত্ব করে নিলো হোসেনের নিজ হাতে।

_ মা নেই আমার, হারটা মায়ের। মায়ের গলায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলো। আমি বাড়ি গেলেই হারটা দেখিয়ে বলত, এটা দিয়ে বউ আশীর্বাদ করবে।

গোসলের সময় হারটা খুলে দেখলাম। ছোট ছোট খাঁজকাটা শাপলা ফুল খোদাই করে গোটা মালাটা বানানো। কন্ঠের কাছটা জড়িয়ে থাকে। প্রতি ফুলের মাঝে একটা করে রুবী পাথর বসানো। গলায় পরে আয়নায় নিজেকে দেখলাম। কেমন আদর সোহাগ ভালোবাসা আশীর্বাদী অনুভবে শরীর চুঁইয়ে পড়া পানির ফোঁটা গুলো আমায় একে একে জানিয়ে দিলো, আমার সমস্তটা চুরি করে নিয়েছে - হোসেন।

বাবুর সেবার ক্লাস নাইনের পরীক্ষা শেষ হলো। হোসেনের গলার ব্যাথাটা চড়ে বসল খুব। ডাক্তার আর ঘর বাড়ি হাসপাতালে বদলে, শয্যা বদল করে সোহরোয়ার্দীর কেবিন হলো আমারদের নতুন সংসার। নার্সদের প্রিয় মানুষ হোসেন, হাসি মুখে কথা বলে। আমি প্রতিবেলা খাইয়ে দেই। যে হাত দুটো সমস্ত সংসারের ভার তুলেছে এত দিন, সে হাত আজ আমার ভরে বাঁচে। বাবু কোচিং থেকে ফিরে নিয়মিত হাসপাতালে আসে। বাবাকে বারান্দায় ধরে হাঁটায়। বাপ -ছেলে পাশাপাশি নামাজ পড়ে নেয়, ও শুয়ে, বাবু দাঁড়িয়ে। ওর মাথা ভর্তি থোকা থোকা চুল মুঠ জুড়ে উঠে আসে। হুইলে করে ওকে বারান্দায় ঘুরিয়ে আনি।আশেপাশের কেবিনের অত্যুতসাহী পুরুষের আনাগোনায় হোসেন বিরক্ত হয়। আঁচল টেনে আমি আরো কিছুটা বেশী ওকে ছুঁয়ে হাঁটি।

_ বাড়ি যাবো। হাসনুহেনার ঝাড়ে ফুল এসেছে। তোমাকে পাশে নিয়ে চাঁদ দেখব, মুনিয়া। তুমি হেমন্তের গান গাইবে, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুনব।

_ ঠান্ডা লাগানো যাবে না। পাগলামী করছো। বাবু আসলেই ডিসচার্জ নেবো। এখানে আমারো ভালো লাগে না আর।

রত্নাকে দেখতে পাচ্ছি। দূর থেকেও বেশ বুঝছি, রহমত সাহেবের সাথে কিছু একটা নিয়ে গোল করছে। আমার সাথে ঝামেলা করা বন্ধ হলেও মাতব্বরী করার অভ্যাসটা ওর যাবে না। ভাইয়াকে খুব আগলে রাখে, তাই পর প্রতি আমার অভিযোগ নেই। হোসেনের বাবা আব্বার হাত চেপে ভাইয়াকে রত্নার জন্য চেয়েছিলেন। আব্বা খুশী মনে রত্নাকে মেয়ের মর্যাদায় এনেছিলো। ননদিনী - ডাকাতিনী হলেও আব্বা আম্মার মায়ায় ও সেখানে আমার জায়গাটা নিয়েছিলো সহজে। হাসপাতাল থেকে ফিরে ডাক্তারের পরামর্শ মত সব চলে। রত্না খুব খবরদারী করে, আমি নাকি বেশী আদরে ওর ভাইকে নরম করে ফেলেছি।

_ ভাবী, এত নরম ভাত খেলে ভাইয়া শক্তি পাবে? আম্মাকে দেখতাম আস্ত দেশী মোরগের স্যুপ আদা দিয়ে খাওয়াতো।

_গলার সমস্যাটা মিটলে করব। তুমি নিয়মিত এসো। হোসেন মনে আনন্দ পায় তোমাদের দেখলে। দাদাই কে ফোন করে দাও, আজ রাতে খেয়ে যাও। পিয়ালকেও কোচিং থেকে এখানে নিয়ে আসতে বলো।

হোসেন সবটা স্যুপ খেলো। গলায় মাফলার পেঁচিয়ে দিলাম। একটা গ্লান্ড টিউমারে রূপ নিয়েছিলো। ওটা অপসারণের পর, তার চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মত নতুন করে দানা বেঁধেছে অসুখটা। ডাক্তারের ঔষধ চলছে, এ ক মাসে শুকিয়ে গেছে মানুষটা। হাসতে গেলেও ব্যাথা পায়। রাতে বুকের কাছে ওর মাথা নিয়ে ঘুমাই। ওর নিঃশ্বাস গুনি, ভয় হয়। যদি ফাঁকি দিয়ে চলে যায়?

হোসেন রাতে কালিজিরে চালের মোতি পোলাও আর হাসের মাংসের ঝোল খেতে চাইলো। বেরেস্তা ছড়িয়ে পোলাও নামাতেই, হাসের ঝোলটা লেগে গেলো নিচ দিয়ে, ও ঠিক ধরে ফেলবে। রান্নায় মনযোগ হারাচ্ছে কেবল। গা ধুয়ে একটা নতুন শাড়ি পড়ে গায়ে হালকা সুগন্ধী মাখলাম, কপালে টিপ দিয়ে হোসেনের পাশে বসতেই জড়িয়ে নিলো কাছে। একটা প্রলয়ঙ্কারী সুখে দুজনেই ডুবে যেতে লাগলাম দীর্ঘ বিরতির পর। এই চল্লিশেও প্রিয় পুরুষ কি গভীর করে ভেতর থেকে আদরে জাগিয়ে তোলে ভালোবাসা। প্রেমিক যে!

কল্পনার জগৎটা ভোজবাজির মত হারিয়ে গেলো। বাবু ডাকছে,

_ মা কনে বিদায়ের সময় হয়েছে। বাবা ডাকছেন, তোমরা এসো।

_ মুনিয়া, চ'। রত্না খুব কান্নাকাটি করছে, থামাতে পারছিনা।তুই ই পারবি। দেরী করা ঠিক না। আমার লোকজন অবশ্য গাড়ির সাথে যাবে। বউ এর বাড়ির লোকজন আসতে চাইছে সাথে। একটু সমস্যা হয়ে গেলো, মৌলভী সাহেব এতক্ষণ ওখানে থাকবে না কিন্তু।

বেয়াই, বেয়াইন খুব কাঁদছেন। হোসেনকেও চোখ মুছতে দেখছি। একটা মেয়ের শখ ছিলো। আমি যে কাকবন্ধ্যা। সামাজিক চাপে কথার পিঠে আমার হয়ে হোসেন কথা বলেছে। তুষ্টিকে আমি মেয়ের মত নয়, মেয়ে বলে ভাবি। রহমান সাহেবের মুখটা হাজী শাহীন আলী, আমার আব্বার মুখে বদলে যাচ্ছে, বাবুর মুখটা হোসেন। কন্যা সম্প্রদান হয় না, সন্তানের আবার ছেলে বা মেয়ে কি। তুষ্টির জীবনে নতুন পরিবার যোগ হলো আজ থেকে, বাবুর ও। বাবুকে তুলে দিলাম বেয়াইয়ের হাতে।

__ বাবুর ভালো মন্দ, দোষ গুনে আজ থেকে আপনি শাসনের অধিকার রাখবেন। বাবা- মা শব্দ দুটোর ভার শুধু ডাকে নয়, শাসন আদরে ও।

__ আমরা নিশ্চিন্ত, আপনার মত মা'র সন্তান কোন ভুল করবে না, বোন। চোখ মুছতে মুছতে বেয়াইন বলে উঠল।

বাড়ি পৌছেছি অনেকটা সময়। দোয়া খায়ের এর পর বাবুদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আগামীকাল তুষ্টির বাড়ির লোকেরা সকালে নাস্তা করতে আসবে। সাহায্যকারীদের পিঠা পুলির আয়োজন দেখিয়ে বারান্দায় এসে বসেছি। হোসেন অন্ধকারে বসে আছে। আলো জালাতে চাইলাম, মাথা নেড়ে নিষেধ করল। অবশ্য ওর সহ্য হয়ে গেছে। বাবু ছাদের চাবি চাইলো। বৃষ্টি জমছে আকাশে। ওর হাতে চাবির গোছা দিয়ে নিচে নামলাম। বাগানের পাশে কদম ফুলের গাছ, তার পাশেই আমার আপন স্থান।

একটা মানুষ আপন হয়ে ওঠার সহজ প্রণালী গুলো চিরায়ত আলাপনে বাবুর আর তুষ্টির শুরু হয়েছে। বাগান থেকে দেখছি, তুষ্টির গালে গাল ঠেকিয়ে বাবু ওর গলায় পড়িয়ে দিচ্ছে শাপলা হার। কানে কানে কি যেন বলতেই হাসিতে ভেঙে পড়ছে দুজন। বাবুর বুকে মাথা রেখে আকাশের চাঁদের দিকে চেয়েছে ওরা। ছাদের ঘরটা ফুল দিয়ে সাজিয়েছি। আজ ওদের বাসরটা ওখানেই হোক।

কামিনীর ঝাড়ের মিষ্টি গন্ধে, বেলী ফুলের সৌরভে ম'ম করছে সময়টা। আমি শেকল খুলে ধীর পায়ে বাঁধানো ঘরের দিকে এগোই। নাম ফলকটায় হাত বুলাই। সেদিন রাতে ওর বুকেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। নাকে পুড়ে যাবার গন্ধ লাগতেই দৌড়ে রান্নাঘরে এসে দেখি হাসের মাংস পুড়ে ছাই। ফিরে গিয়ে হোসেনকে বলব বলে ডাকতেই হলদে আলোয় ওর নিস্পন্দ বুকে কোন ওঠা নামা দেখি না। কান পাতি, চিৎকার করি, নাহ্ আর কোন ভোরে ও জাগেনি। হাত - পা ছড়িয়ে বসে থাকার সময়, গলা থেকে শাপলা হারটা খুলে ফেলি এক টানে। তারপর রত্নাও আর কোনদিন রাগ করেনি। গত পনের বছর হোসেন ছায়াসঙ্গী হয়ে আমার সাথেই থাকে। আমার অনুভব জুড়ে ওর সমস্তটা আমি প্রতি মুহূর্তে দেখি। এই তো ঘুমিয়ে আছে প্রাণের মানুষ, একলা করে আমায়, মাটির ঘরে।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মেঘের আড়াল থেকে জোছনা ভাঙছে। বাবুর গলার গানের মাঝে তুষ্টির গলা মিশেছে। দু চোখ বপয়ে বৃষ্টু নেমেছে আমারো, ওর কবরের ওপর জোছনা লুটাচ্ছে। এক বুক আনন্দ নিয়ে আমার সন্তানেরা সুখী হোক।

মওলা আমার সব নিয়া রে মওলা

শুধু আমার ভালোবাসার মানুষ ফিরায়া দে।

মওলা আমার সব নিয়া নে

ভালোবাসার মানুষ ফিরায়া দে।

সমাপ্ত।

1
$ 0.02
$ 0.02 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments