#প্রতীক্ষা
লেখায়: #সাদিক_হাসান
পর্ব: 03
অনেকে তাসীনের সাথে সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন ভাবেই সফল হয়ে ওঠেনি।
কারণ সে কাউকে কিছু বলতে চায়না। তার জবাব হলো তার বই।
এইদিকে তার মা তাকে হুকুম দিয়েছে রাতকে নিয়ে বাহিরে বের হওয়ার জন্য। বিয়ের আগে নাকি দুজন দুজন কে ভালোভাবে চেনা দরকার।
তাসীনের একটুও ইচ্ছা নেই সেখানে যাওয়ার জন্য। আর রাতের সাথে তো সে যাবেই না। কিন্তু মায়ের হুকুম কোন ভাবেই ফেলে দিতে পারেনা সে।
তাই একরকম বাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়লো।
বিকেলে পার্কে দেখা করার কথা রাতের। তাসীন ভেবেছিল রাত শাড়ী পরে আসবে। আর রাত যেহেতু জানে তাসীনের পছন্দ নীল শাড়ি, সেই জন্য সে নীল শাড়ি পড়ে আছে এইরকম কাউকে খুঁজছিল।
হঠাৎ করে সে পেয়ে যায় নীল শাড়ি পরা একজন কে।
তাসীন নিশ্চিত হয়ে যায় সেটা রাত। তাই সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার দিকে আর তার ঘাড়ে হাত রেখে যাওয়ার জন্য বলে।
যখনই সেই মেয়েটা পিছনের দিকে ফিরে তাকায় তখন তাসীন অবাক হয়ে যায়। এর কারণ হলো সেইটা রাত ছিল না।
সেটা ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী মিস রেখা খান।
আগেরবার তাসীন ভালো করে খেয়াল করে দেখলে বুঝতে পারতো রেখা খান ঠিক কতটা সুন্দরী।
হয়তো সুন্দরী বলেই তার বই আরো বেশি বিক্রি হয়। কিন্তু এইসব ভাবনা তাসীনের কাছে গুরুত্বহীন।
রেখা খান পড়ে এসেছিল নীল শাড়ি। সাথে সব কিছু ম্যাচিং করে পরিধান করা।
আসমান থেকে নেমে আসা কোন পরীর থেকে কম লাগছিল না তাকে।
কিন্তু তাসীন ইতস্তত বোধ করছে কেনো জানি তার সামনে।
কেননা যার জন্য তাকে দিন রাত খেটে মাথা ঘামিয়ে বই লিখতে হচ্ছে সে এখন তার সামনেই। কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না।
ঠিক তখনই মুখ খোলে রেখা খান,
-"কী ব্যাপার মিস্টার আবরার তাসীন! হঠাৎ পার্কে ।নিশ্চয় ভালোবাসার মানুষের সাথে এসেছেন। আপনার বিষয় তো সেটাই। আসলেই কী এইরকম লেখার জন্য কাউকে ভালোবাসা প্রয়োজন?"
রেখা খানের কথায় অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যায় তাসীন।
তাকে এখন কিছু জবাব দিতে হবে সেটা মনে মনে রেডি করে জবাব দেয়,
-" মিস রেখা খান। সাইকো কিলার গল্প লেখার জন্য তো আর পার্কে আসার দরকার হয়না। লাশ কাটা ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাশ কাটা দেখলেই তো হয়। নাকি সেই গল্প লেখার জন্য পার্কে এসে কাউকে খুন করতে হয়! আর হরর গল্প লেখার জন্য নিশ্চয় পার্কে আসতে হয়, বাচ্চারা বিভিন্ন মুখোশ পরে সেটাই আপনার গল্পের ভূত। আপনি নিশ্চয় খুন করার জন্য শাড়ি পরে পার্কে আসেননি! আর হ্যাঁ, যদি এইসব আপনি না করে থাকেন তাহলে আমিও পার্কে সেই কারণে আসিনি। আর শুদ্ধ ভালোবাসা সেটা এক ধরণের অনুভূতি। সেটার জন্য কোন মেয়েকে ভালোবাসতে হবে তারপর পরীক্ষা করে দেখতে হবে সেইরকম কোথাও লেখা নেই।"
তাসীনের রসিকতা ভরা জবাবে ভরকে যায় রেখা খান। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।
হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ একজন তাসীনের ঘাড়ে হাত রাখে।
সে পিছনে ফিরে দেখে সেটা আর কেউ নয়! রাত ছিল সেটা ।
মার্জিত পোশাকে মাথায় একটা হিজাব পরিধান করে এসেছে।
তাসীনের সব ধারণা যে এইরকম করে উল্টে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি কখনো।
কিন্তু একদিক দিয়ে রাতকে দেখে সে মনে মনে খুশি। কারণ আর যাই হোক রাত মার্জিত পোশাক পড়েছে।
তাই তার রাগ নিমেষেই গায়েব হয়ে যায়।
সেই সময় রেখা খান তাসীনের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
-"তাহলে আমার ধারণাই ঠিক ছিল!"
তাসীন আবারো একটা ভালো জবাব খুঁজে বের করে রেখা খানের দিকে ছুড়ে দেয়। সেটা ছিল,
-"যাকে দেখে আপনি এইসব বলছেন তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর শুধু চোখের দেখায় এতকিছু বলা মনে হয় না ঠিক। কারণ সে আমার বোন অথবা যে কোন আত্মীয় হতে পারতো। আর তাকে দেখুন। তার পোশাক দেখুন। মুখে কোন মেকআপ নেই তার। পুরো কার্যত পোশাকে ভদ্র ঘোরের একজন মেয়ে। আপনার মত সারাদিন বিউটি পার্লারে বসে থেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে এত সাজগজ করে পার্কে আসার কোন মানে নেই। যাই হোক, এখানে হয়তো খুন হতে চলেছে কোন সেটা আপনি দেখতে এসেছেন আমি নয়। আশা করি দেখা হবে শীঘ্রই। আপনার সেদিনের কথা গুলো ভালো লেগেছে অনেক। এবং.."
থেমে যায় তাসীন। একটু হেসে আবার আগের কথা ধরে বলে,
-"সেটা পরে না হয় অন্য একদিন বলবো। আজ আসি!"
কথাটা বলেই রাতের হাত ধরে সোজা চলে গেলো।
এতক্ষণ রাত সেখানে শুধু ছিল নীরব একজন দর্শক।
পার্কে যেতে যেতে তার দেরি হয়ে গিয়েছিলো অনেক।
যখন পার্কে যায় তখন সেখানে গিয়ে দেখে রেখা খানের সাথে দাঁড়িয়ে আছে তাসীন। তাই সেখানে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখে।
কিন্তু তাসীন যখন তার প্রশংসা করছিলো তখন রাতের মনে কতটা খুশির জোয়ার বয়ে গেছে সেটা একমাত্র সেই জানে ।
আর হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে আসার ব্যাপারটা সে এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।
শপিংমলের একটা ফুড কোর্টে বসে আছে রাত এবং তাসীন।
তাসীনের মনোযোগ তার হাতে থাকা কফি শেষ করার দিকে আর রাতের নজর তাসীনের দিকে।
-"হঠাৎ করে এইরকম পোশাক পড়ে আসার কারণ?"
তাসীনের এইরকম আচমকা প্রশ্নে চমকে ওঠে রাত।
কিন্তু তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-"আমি একজন মুসলমান ঘরের মেয়ে। আমি এইসব কিছু তেমন মানি না। কিন্তু আমার কর্তব্য হলো বাহিরে গেলে পর্দা করা তাই আমি করি। এটাতে আমার ভালো লাগা আছে। মডার্ন ড্রেস আমার পছন্দ নয় সেটা না। কিন্তু আমি কেনো জেনে শুনে আমার কর্তব্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিব। তাই বাড়ির ভিতরে নিজের ইচ্ছা মতো চলি এবং বাহিরে আসলে নিজের কর্তব্য পালন করি। এতে তো আমার কোন ক্ষতি নেই!"
সবটা শুনে তাসীন শুধু মাথা কাত করে বললো,
-"হুম বুঝলাম। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? তোমার অনেক বন্ধুরা তো আছে যারা তোমার এইরকম পোশাকে নানা রকম কথা শোনায়। তখন তোমার কী মনে হয়?"
-"হাহা! আমার অনেক বন্ধু আছে যারা আল্ট্রা মডার্ন। তারা মনে করে তারা নিজেদের ইচ্ছা মতো চলবে সব জায়গায়। এইটা তাদের অধিকার। আসলেই সেটা তাদের অধিকার। আমি তাতে বাধা দেওয়ার কে। কিন্তু পোশাকটা যে নিজের পরিচয় বহন করে সেটা তারা বোঝে না। তাদের যতো বুঝান তারা ঠিক তার উল্টো বুঝে থাকবে। তাই আমাকে কেউ কিছু বলতে আসলে সহজ একটা জবাব দেই আমি। জবাব বললে ভুল হবে। একটা সহজ প্রশ্ন করি তাদের। সেটা হলো,
আমার কর্তব্য আমি করছি। আমার লজ্জা আছে তাই আমি বাহিরের কাউকে নিজের শরীর দেখাতে চাই না। তোমাদের কী লজ্জা আছে?" বলে উঠলো রাত।
তখন তাসীন বললো,
-"ছেলেদেরও তো নিজেদের দৃষ্টি সংযত করা উচিত তাই নয় কী!"
-"এই কথাটাই কেউ কেউ বলে। অবশ্যই ছেলেদের নিজের চোখের দৃষ্টি সংযত রাখা উচিত। সেটা তাদের কর্তব্য। তাই বলে কী আমি আমার কর্তব্য ছেড়ে দিব?" জবাব দিলো রাত।
তাসীন আর কোন প্রশ্ন করলো না। কারণ তার যা জানার সে জেনে নিয়েছে। আজ অনেক বড় একটা শিক্ষা রাত তাকে দিলো। এতদিন গল্প লিখেছে এই জিনিসটা কখনো সে ধরতে পারেনি। মানুষের নিজের প্রতি একটা বিশ্বাস আছে। কারো বিশ্বাস তার ভালো করে আবার কারো বিশ্বাস তাদের খারাপ। এই ভালো খারাপের মধ্যেই জন্ম নেয় ভালোবাসা নামক বস্তুটা। মানুষ যখন তার প্রতিদিনের কাজ কর্ম গুলো বিশ্বাসের সাথে করে তখন সেই কাজের প্রতি একটা ভালোবাসা এসে যায়। আর তখনই সেই মানুষটা একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিনত হয়।
এটার একটা খারাপ দিক আছে সেটা হলো, অনেকে খারাপ কাজ করে গভীর বিশ্বাসের সাথে। সেটা যখন সে করতেই থাকে তখন সেটাকে ভালোবাসা নয়। সেটাকে নেশা বলে। যেমন সিগারেট। সেটা মানুষের ভালোবাসা নয়। সেটা হলো এক ধরণের নেশা।
অনেকে বলে থাকে ভালোবাসাও এক ধরণের নেশা। কিন্তু ভালোবাসা মোটেও কোন নেশা নয়। সেটা হলো পবিত্র বিশ্বাস।
বিশ্বাসের কোন ভালো জিনিসের প্রতি মনোযোগ দেওয়াই হলো ভালোবাসা। এখানে শুধু একজন ছেলে মেয়ের মধ্যে ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। পৃথিবীর প্রতিটা জিনিস একে অপরের প্রতি ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে।
হঠাৎ করে তাসীনের মনে রাতের বলা সেই কথাটা পড়ে গেলো।
তার লেখায় কিছু জিনিসের কমতি আছে। তাসীন সেই কথাটার অর্থ ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে।
মনে মনে একটা মুচকি হাসি দিয়ে রেখা খান কে কল্পনা করলো। একটা উচিত জবাব তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা তাসীন খুব ভালো করেই জানে।
শপিংমল থেকে কিছু কেনাকাটা করে রাতকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তাসীন সোজা চলে গেলো তার বাড়িতে এবং কী বোর্ডের খটখট আওয়াজ তুলে সৃষ্টি করতে লাগলো নতুন কিছু অধ্যায়ের।
তাসীনদের যাওয়ার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেখা খান।
তার হাতে একটা বিশাল ব্যাগ ছিল। সন্ধ্যা হতে শুরু করে দিলো। পার্ক থেকে মানুষ জন ধীরে ধীরে চলে যেতে লাগলো।
ঠিক সেই সময় পার্কে প্রবেশ করতে শুরু করে দিলো বেশ কিছু বাচ্চা কাচ্চা। তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো লেখিকার দিকে।
এসেই ঘিরে ধরলো তাকে।
রেখা খান তার ব্যাগ থেকে বেশ কিছু প্যাকেট বের করে সবার হাতে একটা করে ধরিয়ে দিলো।
সেগুলো পেয়ে সেই শিশু গুলোর চোখে যে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো সেটা বর্ননা করার মতো নয়।
এরপর প্রত্যেকের হাতে একটা করে চকলেট ধরিয়ে দিয়ে একটা বেঞ্চে বসে তাদের খাওয়া দেখতে লাগলো যুবতী লেখিকা।
ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে সেখানে বসেই লিখতে শুরু করে দিলো,
-"প্রত্যেকটা শিশু হলো নরম মাটি। নরম থাকতেই তাদের যে আকৃতি দেওয়া হবে সেটাই হবে তাদের ভবিষ্যতের কাজের ক্ষেত্র।। ঠিক এইরকম করেই একটা বাচ্চা বড় হয়েছে কপালে গরিবের লেখা নিয়ে। সমাজের নিষ্ঠুরতা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। আজ সে অনেক বড় একজন লোক। সব ধরণের মানুষের সাথে তার ওঠা বসা।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে শহরে শুরু হয়ে যায় এক নির্মম খুনের খেলা। খুন হতে থাকে সমাজের মুখোশধারী কিছু মানুষ। যাদের মুখোশ খুললে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত সাপ। তাদের সেই মুখোশ খুলে সেই সাপের মাথা কেটে তারপর শান্তি পাচ্ছে খুনি।"
এইটুকু লেখার পরেই হাসি ফুটে ওঠে লেখিকার মুখে। সেও তার গল্পের জন্য পেয়ে গেছে একটা অস্ত্র। শিশুদের মুখের সেই হাসির সামনে যে কোন ভালোবাসা গলে যেতে বাধ্য সেটা সে খুব ভালো করেই জানে। আবরার তাসীনকে সে একটা ভয়ানক জবাব দিবে সেটা ভেবেই আনন্দ পায় যুবতী লেখিকা রেখা খান।
চলবে.......
আগের পর্বের লিঙ্ক
https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/847424829396348/