প্রোজাপতি
দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব..
জ্যোতির কথা শোনার পর আমার মাথা থেকে আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।আমি তাড়াহুড়ো করতে শুরু করলাম।উল্লেখ্য,যখন মানুষের ব্রেন খুব দ্রুত কাজ করে তখন বাকি সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আবোলতাবোল কাজ করে।আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।তখন আম্মু আমার রুমে এসে,"কিরে কি হয়েছে?"
"মিরা তো জ্যোতির বাসায় যায়নি!"
"বলিস কি?তাহলে কই যাবে?"
"আমি জানি না।"
বলে আমি সোফায় বসে মোজা পড়তে শুরু করলাম।তখন আমার টেবিলের সামনের পত্রিকা নজরে এলো।বড় হেডিংয়ে লিখা,"গর্ভবতী মহিলাকে বেধে ধর্ষণের পর হত্যা"।এখনি কেন এই জিনিসটা আমার চোখের সামনে এলো।আমি রাগে কাপতে কাপতে পত্রিকাটা ছুড়ে ফেলে দিলাম।সেই শব্দে আম্মু দৌড়ে এলেন।কিছু বললেন না,তিনিও বুঝতে পেরেছেন। কারণ আজকের পত্রিকাটা তিনি পড়েছেন।
তাড়াতাড়ি সোফা থেকে উঠে আমি জুতোজোড়া পড়ে বের হয়ে এলাম।মিরা কোথায় যেতে পারে?শপিংমলে আগে যাই। সেখানের আশেপাশে সে থাকবে?আবার নাও থাকতে পারে। এত সময়!প্রায় তিন ঘন্টা হয়ে গেছে।মিরাকে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম কিন্তু পরে দেখি সে বাসায় ফোন রেখে গেছে।বিপদ যখন আসে সব কিছু ফেলেই আসে!
রিক্সায় উঠলাম আমি।গাড়ি চালিয়ে যাবার মতোন অবস্থায় আমি নেই।আমার কল্পনায় শুধু মিরার ছবি আসছে।এই মুহুর্তে মিরার একটা সুন্দর হাসিমাখা মুখের ছবি আসলো।তারপর মিরা আমাকে দৌড়ে এসে ধরল।কিন্তু মুহুর্তেই মিরাকে কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে।কি বিশ্রীভাবে টানলো!এভাবে তো কেউ টানে না।মিরাকে একেবারে রাস্তায় ফেলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।লোকটার মুখে সিগারেট,আর মুখে শত্রুর হাসি।আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি;নিজেকে একটুও নাড়াতে পারলাম না।মন থেকে চিৎকার করে উঠলাম,"মিরা মিরা মিরা।"
আমার মুখ থেকে ফুপিয়ে শব্দ বের হয়ে গেলো।রিক্সাওয়ালা মামা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন,"কি হয়েছে ভাই?খুব চিন্তিত লাগছে?"
"না কিছু না।"
ততক্ষণে আমার মাথার সিলেটে ঘটে যাওয়া সেই মুমূর্ষু ঘটনা ভেসে উঠছিল।আমার ভাবতেই এত কষ্ট লাগছে,আর যার সামনে হয়েছে এসব সে কিভাবে এখনো বেচে আছে?
শপিংমলের সামনে এসে দাড়লাম।চারপাশে সব পুরুষ মানুষকে দেখে কেমন যেনো লাগছে।আমি নিজেও পুরুষ;তারপরও মেয়েদের কথা ভেবে নিজেকে নিয়ে নিজেই লজ্জিত হচ্ছি।
চোখের সামনে দেখলাম হকার ব্যবসায়ীরা বসে বসে হাসছে আর এক একটা মেয়ের দেহের গড়ন নিয়ে আলোচনা করছে।খুব ভিড়ের কারণে তাদের নাকের কাছে মহিলাদের ওড়না এসে লাগছে তারা ভাল্লুকের মতো গন্ধ নিয়ে শুকে শুকে হাসছে। একটা বাঘ হরিণের মাংস যেভাবে খুবলে খুবলে খায় সেরকম।
পাশে তাকালাম দেখলাম সবার নজর ঠিক সেরকম!স্কুলের,কলেজের এমনকি বিবাহিত চাকরিজীবী পর্যন্ত। সবারই ভেতর সেই হিংস্র চাহনী।
ততক্ষণে আমার চোখ দিয়ে দুই এক ফোটা পানি পড়া দেখে রিক্সাওয়ালা আমাকে ডেকে বললেন,"মামা পঞ্চাশ টাকা দিবেন না?"
অহ আমি টাকা দিতে ভুলে গেছি।টাকা দিয়ে আমি সামনে এগোলাম।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা পনেরো বাজে।সামনে গেলাম,পেছনে গেলাম,পুরো শপিংমলটা একবার চক্কর দিয়ে খুজতে খুজতে ঘড়ির কাটা পয়তাল্লিশ মিনিটে চলে গেল।
আমি হতাশ হয়ে একদম সিড়িতে বসে গেছি।মোবাইলটা বের করে মিরার ছবি দেখছি একটার পর একটা।আমার চোখের পানি যেন কিছুতেই থামছে না।
মোবাইলের হোমস্ক্রিনে এসে আমি একটা জিনিস দেখে বুঝে গেলাম আমার এখন কোথায় যেতে হবে।রিক্সা নিয়ে খুব দ্রুত সেই জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।মনে মনে আল্লাহর কাছে একটাই আকুতি আল্লাহ মিরা যেন সেখানেই থাকে।
সকাল থেকে খুব জ্বরে ভুগছিলাম।এখন এসে সবকিছু কিছুটা ঠিক হয়েছে।
আমি আমার আসল গন্তব্যে এসে অনেক খুজলাম। কিন্তু মিরাকে খুজে পেলাম না।আমি একদম ব্যর্থ হয়ে মাথা নিচু করে সেখান থেকে বের হচ্ছি এখন।আমার গন্তব্য হয়তো সেইখানে হওয়ার উচিত ছিলো যেখানে হাজারো মানুষের অভিযোগ প্রতিদিন এসে জমা হয়।হ্যা,আমি এখন পুলিশ স্টেশনে যাব।
পিছন থেকে একজন আমার কাধে হাত দিল।
"কি ভাই?ভাবিরে না নিয়ে কই যাচ্ছেন গা?ভাবির সাথে ঝগড়া নাকি?"
এতিমখানার কর্মচারী মকবুল আমাকে এই কথাটা বললো।
"মিরা এখানে এসেছিল?"
"জ্বি!এখনো এখানেই আছেন।"
"কই!আমি তো খুজলাম।পাইলাম না।"
"আপনি মনে হয় ওই রুমের কথা ভুইল্লা গেছেন যেখানে নতুন এতিম বাচ্চাদের আনা হয় প্রথম।"
"অহ!অহ!"
আমি দৌড়াতে শুরু করলাম।আমার সব প্রাণ যেন ফিরে আসছে।হাপাতে হাপাতে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি মিরা বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে।সব মেয়ে বাচ্চারা সেখানে।
তার মধ্যে একটা মেয়ে স্টেথোস্কোপ মিরার পেটে লাগিয়ে হাসছে আর বলছে,"বাবু ফুটবল খেলছে।"
পেছনে ফিরে মিরা আমাকে দেখলো।দূর থেকে ইশারা দিয়ে ক্ষমা চাইলো।তার মনের কথা আমি বুঝতে পারছি।ফোন ভুলে রেখে যাওয়ার জন্য ক্ষমা চাচ্ছে।আমি মোবাইলের হোমস্ক্রিনের যেই জিনিসটা দেখে আন্দাজ করেছিলাম মিরা এতিমখানায় সেটা হচ্ছে আজকের তারিখ।
হ্যা,আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী।
সমাপ্ত।
-নাজমুস আলভী।
Nazmus Alvee