পরিণয়।

0 0
Avatar for Nipa1234
3 years ago

১.

আমি অনেক কষ্টে চোখের জলের বানে বাঁধ সাধলাম, আমার চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে তেজ নিয়ে বললাম, " আপনার সম্পদ আপনি নিয়ে যান, বাবা। আপনার মেয়েকে ছাড়াও আমার চলে এখন।"

পাশ থেকে সামিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমার সব রাগ, তেজ সামিরার কান্নার কাছে হেরে গিয়ে মাথা নত করার আগেই আমি আমার মাথাটা উঁচু করে সামিরার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও বললাম, "লাট খাওয়া মানুষ, বাবা। আমার মুখের কথায় আপনার সম্মান থাকবে না। "

বাবার বুকে সামিরা মুখ লুকিয়েছে। অথচ মেয়েকে জড়িয়ে ধরবার শক্তিটুকুও যেন এখন আর নেই। আমার চোখের দিকে আহত দৃষ্টি ফেলে অবাক হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায় ফুটিয়ে তুলেছেন। সামিরাকে উদ্দেশ্য করে আরেকবার মুখের কথায় আমি অতর্কিত আঘাত করে ফেলে বললাম, "ঐ বুকে মুখ লুকিয়ো না, তোমার লজ্জা ঢাকা পড়বে না বরং বেড়েই যাবে।"

সামিরাকে এভাবে তাচ্ছিল্য করে, সামিরার বাবার মুখের উপর কথার জবাব দিয়ে, সামিরার মনে আঘাত করে যেন আমিই নিজেই ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দে কুকিয়ে উঠলাম।

আমার চোখের সামনে সেই দিনগুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় আমি মরিয়া হয়ে গেলাম; যে দিনগুলোতে আমার পাশে কেউ ছিলো না।

২.

আমার আর সামিরার তখন ছয় মাসের নতুন সংসার। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারকে সঙ্গী করে সামিরার বাবা আমার দরজায় এসে উপস্থিত। বাবাকে দেখে সামিরার চোখে মুখে জোছনা ঝরে আর আমার মনে অমাবস্যা।

ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা হলো। পরিস্থিতির চাপে, বাবার মুখের দিকে চেয়ে সামিরা কাঁদলো।

শেষটায় এসে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সামিরার বাবা বললো, "কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।"

নিজেকে ৭১ এর হানাদার বলে মনে হলো।

আমি বললাম, "ভালোবাসা অন্যায়?"

উনি বললেন, "হ্যাঁ।"

আমি বুকে কষ্টের পাহাড় তুলে নিয়ে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুঁটিয়ে তুলবার বৃথা চেষ্টা করে বললাম, "তবে সামিরারও অন্যায় হয়েছে আমাকে ভালোবেসে। দিন ফাঁসি।

যুক্তিতর্কের খেলায় যোগ না দিয়ে সামিরার বাবা সামিরাকে নিয়ে গেলেন।

যাবার আগে সামিরা আমার শার্টের একপাশে ধরে রেখে কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে বলে গেল, "একদিন তোমার সব হবে সেদিন ঠিকই আমি তোমার কাছে ফিরবো।"

সেরাতে আর ঘুম হয়নি আমার। অনেক অভিমান আর দুঃখ নিয়ে ডায়েরির একটা পাতায় লিখে দিলাম, "আমার দুর্দিনেই যদি তোমায় পাশে না পাই তাহলে সুদিনেও তোমাকে আমার লাগবে না, প্রিয়।"

৩.

সামিরার হঠাৎ চলে যাওয়া মেনে নিতে না পেরে আমি ভেঙে পড়েছি যেমন; তেমন খুব সহজেই গড়েও নিয়েছি নিজেকে। বুঝেছি পৃথিবীতে ভাঙা গড়ারই খেলা চলে। রঙের সঙ্গে রঙ মেশালে নতুন রঙ পাওয়া যায়। আমি ভালোবাসার সঙ্গে ঘৃণা আর ক্ষোভ মিশিয়ে আমার দিন পাল্টালাম, নতুন দিন পেলাম।

নতুন সূর্য উঠলো। সূর্যের আলোয় আমি জ্বলে পুড়ে যাই। দু'হাত ভরে টাকা কামাই, আবার দু'হাত ভরেই খরচ করি।

প্রথম প্রথম মানুষের রূপ দেখে আতকে উঠতাম। সবচেয়ে বেশি ভড়কে গিয়েছিলাম সেদিন, যেদিন আমার পাড়ার জুনিয়র ছেলেটা এসে আমার গালে একটা চড় মেরে বলেছিলো, "ঠিকঠাক মতন কাজ না করলে এরপর আর বড় ভাই মানতে পারুম না; লাত্থি মাইরা বিদায় করমু। টাকা কামানো এত সহজ না।"

এরপর থেকে পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে আর চমকে তোলে না। লাট লাট খেতে খেতে সয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে সামিরা খোঁজ নিতো, চিঠি লিখে কান্না কাটি করতো। আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছি।

কষ্ট চাপা দিয়ে বলেছি, "আমি বেশ আছি। তুমি তোমার যত্ন নিও।"

সত্যি বলতে আমার কিছুই হয়নি। টাকা-পয়সা, মান-সম্মান যা এখন আছে এগুলো আমারই। পার্থক্যটা শুধু সময়ের ; তখন ছিলো না এখন আছে। আমারই হওয়ার ছিলো। কিছু জিনিস তো প্রকৃতিও নির্ধারণ করে দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনজনেরা ধৈর্যহারা হয়ে ছেড়ে চলে যায়। আমার আর সামিরার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।

৪.

আজ এই দিনটার জন্য সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা সামিরাই করেছে। যোগ্য স্বামীর কাছে একদিন নিজ মহিমা নিয়ে গর্ব করে ফিরবে বলেই হয়তো এতো অপেক্ষা।

সামিরা বাবার বুক থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

"আমাকে তুমি অস্বীকার করছো!" - সামিরার কণ্ঠে অসহায়ত্বের ছাপ ষোলকলা।

আমি নিরুত্তর রইলাম। সামিরা খানিকটা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আমার দিকে তিরস্কারের দৃষ্টি ফেলে বললো, " তুমি না আমায় ভালোবাসো? এই তোমার ভালোবাসা?"

সামিরার বাবার দিকে চেয়ে থেকে বললাম, "ভালোবাসা অন্যায়।

"তবে সেদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে কেন? স্বপ্ন দেখিয়েছিলে কেন?"

-"স্বপ্ন দেখিয়ে, ভালবেসে অন্যায় করেছিলাম। আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে তার শাস্তি তোমরা আমায় দিয়েছো।"

সামিরা আমার পায়ের তলায় মাটিতে গড়াগড়ি দিলো। আমি সামিরার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়ের কষ্টে চোখের জল ঝরাতে দেখলাম। দু'পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম, "আমার কিছু নেই, সামিরা। পায়ের তলা মাথা ঠুকে কী খুঁজছো?

সামিরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। জোর করে কণ্ঠে শক্তি ফেরানোর চেষ্টা করতে গিয়ে গলায় ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ তুললো প্রথমবার। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় বললো, " স্বামীর পায়ের তলায় যদি স্ত্রীর জান্নাত হয় তবে আমি জান্নাত খুঁজি।"

সমুদ্রের ঠেউ যেমন তীরে এসে ধাক্কা মারে সামিরার কথাতেও আমার ভেতরে যেন তেমন ধাক্কা লাগলো। কিন্তু সকল ঠেউয়ে তো আর গা ভাসানো যায় না। কিছু ঠেউয়ের ধাক্কার বিরুদ্ধে নিজেকে স্থির রেখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, নিজের শক্তির পরিচয় দিতে হয়। আমিও দিলাম। সামিরাকে মাটি থেকে টেনে তোলার বদলে শব্দ করে হেসে বললাম, "তোমাকে দেবার মতন কোনো জান্নাত আমার কাছে নেই।"

সামিরার বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে শান্তস্বরে বললাম, আমার যা আছে তা আমারই লাগবে। দু'মুঠো ডাল ভাত খেয়ে বাঁচতে চাই, সেগুলোর ভাগ আমি আর কাওকে দিতে পারবো না। আপনি বরং আপনার সম্পদ নিয়ে যান, বাবা। আপনার মেয়েকে ছাড়াও আমার চলে এখন। রূপে, সৌন্দর্যে কোনো অংশে কমে যায়নি। ভালো টাকা ওয়ালা কারো হাতে তুলে দিন সুখে থাকবে। শুধে- আসলে আপনার হিসেব মিলে যাবে। "

★পরিণয়।

1
$ 0.13
$ 0.13 from @TheRandomRewarder
Avatar for Nipa1234
3 years ago

Comments