সারাদিন এর ডিউটি শেষ করে বাসায় আসতেই দরজা খুলে দিয়ে আম্মা শুরু করল-
আম্মাঃ নাসিমা ভাবির পিচ্চি মেয়েটার ও আজকে বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেলো, আর তোর বিয়ের মতিগতি ই দেখি না,
আমিঃখাইতে দাও,
আম্মাঃ পারতাম না নিয়ে খা
আমি আর বেশি কথা বললাম না,হাত মুখ ধুয়ে ভাত নিয়ে টিভির সামনে বসতেই আম্মা আবার শুরু করলেন,
আম্মাঃআগে বলতি অনেক টাকা হলে বিয়ে করবি,এখন তো তোর কত টাকা,নিজের বাড়ি নিজের জায়গা,সব শখ পূরণ করলি এইবার তো বিয়ে করে আমারে মুক্তি দে।
আমিঃ আম্মা কালকে বিরিয়ানি রান্না কইরো
আমার এমন কথা শুনে আম্মা রাগে ফুলতে ফুলতে ঘরে চলে গলেন।
আমি নিলিমা রহমান, সরকারি নার্স,আগে কোয়াটার এই থাকতাম, ১ বছরের মতো হলো বাড়ি করেছি।আমার জীবনে নিজের শখ গুলো পূরণ করা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেই।
খাবার শেষ করে রুমে যেয়ে ফোন টা হাতে নিতেই দেখি অচেনা নাম্বার থেকে ২টা কল আর ১ টা ম্যাসেজ,ম্যাসেজ টা অন করলাম-
ডিয়ার,
নিলিমা রহমান(S.S.C ব্যাচ ২০০৭ বিজ্ঞান বিভাগ)
আসছে রোজ শুক্রবার তোমার প্রিয় বিদ্যালয়ে ১টি মিলনায়তন অনুষ্ঠান হবে।উক্ত অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা হিসেবে তোমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।তুমি যথা সময় উপস্থাপক থাকিবে।
ইতি,
প্রধান শিক্ষক,
বিকাশ সাহা।
স্যার এর ম্যাসেজ দেখে মাথায় নষ্ট আবার সেই স্কুল,
কিন্তু স্যার নাম্বার পাইলো কই আর চিনেই বা কেমনে?
গেলাম আম্মার রুমে
আমিঃ আম্মা স্যার রে আপনি নাম্বার দিছেন,এই সব আপনার বুদ্ধি?
আম্মাঃ তোর মামা ও হেল্প করছে
আমি রাগে কিছু বলতেও পারলাম না।
আমার স্কুলে আমার আম্মা ছিল বাংলা ম্যাডাম আর মামা কম্পিউটার স্যার। আমি চাকরি পেয়ে আম্মাকে জোর করে রিজাইন দিয়ে নিয়ে আসছি স্কুল কোয়াটার থেকে এর পরে এই ৫ বছরে আর যায় নি।
কিন্তু এইবার নিলিমা তোর যাইতেই হবে।
স্কুল এর কথা মনে হতেই আবির এর কথা মনে পড়ে গেলো।
সাল ২০০৫,
একদিন হেড স্যার( হাজী মোহসীন প্রধান)
ডাক দিয়ে বলল- নিলিমা এইটা আমার বোনের ছেলে+ তোদের নতুন রসায়ন স্যার এর ছেলে, নতুন আসছে,একটু ভাল বেশি,তুই দেখে রাখিস।
স্যার এর এই দেখে রাখার কথাটাই এক সময় আমার কাছে কেয়ার হয়ে গেলো,ভাল লাগতো আবির কে। দেখতে দেখতে ২ বছর চলে গেলো।
সেদিন S.S.C এক্সাম এর ফাইনাল টেস্ট এর লাস্ট এক্সাম দিয়ে বের হতেই আবির সামনে এসে দাঁড়ালো
আবিরঃ সকালে যে আমার কলিজা টা হাতে রেখে ভেবলাকান্তের মতো প্রপোজ করলাম উত্তর তো দিলি না?
আমিঃ সকালে প্রপোজ করলি তার পরে এক্সাম দিলাম এখন তুই উত্তর চাইলি আমার ভাবার সময় কই দিলি?
আবিরঃ নিলি এত ভাবিস না রাজি হয়ে যা, ২ জন মিলে কোয়াটারের নতুন ফ্যামিলি হবো
আমিঃ লাভ ইউ টু
এর পর থেকে শুরু প্রেম করা,এক্সাম শেষে এক সাথে কত আড্ডা,তার পরে এক কলেজে ভর্তি। সেই সময় জীবন টা স্বপ্নের মতো ছিল,সব ভালই চলছিলো কিন্তু জীবনের দ্রুতগামী সময় এর ভেতরে কলেজ লাইফ অন্যতম চোখের পলকে কেটে গেলো ২ বছর।
H.S.C exam এর ঠিক ১৫ দিন আগে আবির এর আব্বু ছাদের থেকে পড়ে মারাত্মক ভাবে আহত হয়,ওনাকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়,মানুষ টাকে বাচানোর তাগিদে ব্লাড ব্যাংক থেকে পরীক্ষা না করেই রক্ত দেয়া হয়।
সে যাত্রায় মৃত্যুর হাত থেকে বেচে গেলেও পরে জানা যায় উক্ত রক্তে H.I.V ভাইরাস ছিল যা এখন উনার শরীরে বিরাজমান।এতে আবির এর বাবার/ পরিবার এর কোনো দোষ ছিল না কিন্তু কিছু মানুষ সুযোগ পেলে অপমান করতে ছাড়ে না আবির এর পরিবার এর সাথেও এমন হলো,H.S.C এক্সাম এর ৩ দিন আগে আবিররা কোয়াটার ছেড়ে চলে যায়,সাথে হেড স্যার ও।
আম্মুর কাছে শুনেছি স্কুল থেকে অনেক খোজা হয়ছিল স্যার কে।
এর পরে এই ১১ বছরে আবির এর সাথে আর যোগাযোগ হয় নি,কি অদ্ভুত যে আবির কে ছাড়া আমার একটা দিন যেতো না সেই আবির কে ছাড়া ১১বছর কেটে গেছে।
না পুরাতন স্মৃতি গুলো ভেবে বাজে লাগছে জানালা খুলে বুঝলাম ভোর হতে আর একটু বাকি
"আর একটা ঘুমহীন রাত আবির এর নামে"
সকালে নাস্তার টেবিলে যেয়ে দেখি আম্মা খুব মনোযোগ সহকারে ব্রেডে বাটার লাগাচ্ছে তো লাগাচ্ছে,আমার উপস্থিতি তে তার হের ফের নাই--
আমিঃ আম্মা ব্রেড টার আর বাটার লাগবে না
আম্মাঃ(একটু চমকে যেয়ে) হয়, শোন অনুষ্ঠান এর এক দিন আগে যাবো,মানে শুক্রবার অনুষ্ঠান আমরা বুধবার যাব,তুই কিছু বলবি না।
আমিঃআচ্ছা আমরা কালকে সকালের গাড়িতে যাব।
আম্মাঃ আজকে শপিং করব,
আমিঃ আচ্ছা,আমার ৮ টাই ডিউটি শেষ, তার পরে বাসায় এসে তোমারে নিয়ে যাব,
আম্মাঃআচ্ছা।
আমিঃ সাবধানে থাইকো আর স্মৃতি গুলারে কম মনে কইরো,আসি।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমি রোগীদের ইম্প্রুভ লিস্ট চেক করছি,আচমকা আম্মা হাজির,আম্মারে দেখে আমার চোখ চড়কগাছে, যে মহিলা এতদিনে একদিনে আমি কই কাজ করি দেখতে আসে নাই,সে আজ সোজা আমার ক্লিনিকে!
আসলে নাড়ীর টানে ফিরে যাওয়ার আনন্দ টাই এমন
আম্মাঃ হেবলার মতো তাকাই না থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে আই,আমি অনেক শপিং করবো, ৮ টাই বের হলে হবে না।
আমিঃ ওকে, তুমি বসো আসতেছি।
ম্যাডাম এর সাথে কথা বলে ছুটি নিয়ে বের হলাম শপিং এ।আম্মা নিজের জন্য আমার জন্য মামার বাড়ির সবার জন্য শপিং করলেন ৩ ঘন্টা নিয়ে,শপিং শেষে
আম্মাঃ আমি আজকে বাসায় রান্না করি নাই
আমিঃ ওকে বাহিরে খেয়ে যাব
বাহিরে খেয়ে,টিকিট করে বাসায় আসতে আসতে রাত ১২ টা।বাসায় এসে দেখি আম্মার ব্যাগ গুছানো শেষ।আমিও ব্যাগ গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম।সকাল ৮ টাই টিকিট মানে আমার ৬ টাই ঘুম থেকে উঠতে হবে
সকাল ৫.৩০ এ আম্মার ডাকে ঘুম ভাঙলো
আম্মাঃ এত ঘুমাস কেন ওঠ,নামায তো তুই পড়বি না,তাও একটু রেডি হয়ে নে।
আমিঃ ওকে,আম্মা রুটি বানিয়ে নাও
আম্মাঃ এতটুকুই পথ রুটি কেন
আমিঃ রাজশাহী থেকে নারায়ণগঞ্জ এতটুকু পথ?
সকাল ৮ টাই গাড়ি ছেড়ে দিল রাস্তা ফাকা থাকাই বিকাল ৫ টাই চাষাড়া( নারায়ণগঞ্জ এর মেইন পয়েন্ট) আসলাম।
গাড়ি থেকে নামতেই মামা এগিয়ে এলেন।
মামা আর আম্মা কে কোয়াটারে পাঠিয়ে দিয়ে আমি গেলাম চাষাড়া শহীদ মিনারে,এই শহীদ মিনার টা নারায়ণগঞ্জ এর প্রাণ কেন্দ্র বলা চলে,আমি আর আবির কত আড্ডা দিছি এখানে অব্যশ তখন এত প্রাণময় ছিল না,মিনার থেকে বেরিয়ে হাটা দিলাম কলেজ রোডের দিকে,শহরে ভীড় বেড়েছে আর হারিয়ে গেছে চেনা মুখ গুলো তা ছাড়া সব আগের মতোই আছে।পুকুর পাড়ে যেয়ে আলামিন স্যার এর সাথে দেখা করে মসজিদ এর পেছনে পুরান বিল্ডিং এ যেয়ে নাজির স্যার এর সাথে দেখা করলাম,এই ২ জন ছাড়া আর কোনো পরিচিত স্যার নেই এখন।
সব আগের মতোই আছে শুধু যে আবির এর হাত ধরে প্রথম কলেজ রোডে আসা সেই আবির টা আজকে নেই,জানি আর কখনো দেখাও হবে না।
ইচ্ছে ছিল কলেজে যাবো কিন্তু আবির কে মনে হয় আর গেলাম না।অটো নিয়ে সোজা লাক্সমি নারায়ণ কোয়াটারে চলে আসলাম,মেইন গেটে দাড়াতেই অজানা এক ভাল লাগা ছুঁয়ে গেলো।
যাওয়ার-ই কথা,জন্ম-বেড়ে ওঠা- প্রথম স্কুল-প্রথম প্রেম-প্রথম কলেজ সহ জীবনের অনেক প্রথম অনূভুতি তো এখানেই শুরু।ল।অনেক বাজে অভিজ্ঞতা ও আছে- বাবার মৃত্যু - আবির কে হারানো।
এ সব ভাবতে ভাবতে আমি-আম্মা-বাবা যেয়ে কোয়াটারে থাকতাম তার সামনে চলে আসলাম,আগের থেকে পুরাতন হয়ে গেছে,ইচ্ছে করছিল ভেতরে যায় কিন্তু এখন যে আছে সে কি ভাব্বে ভেবে গেলাম না।ল।একটু সামনেই আবিরদের কোয়াটার,আবিরদের কোয়াটার টাও কেমন হয়ে গেছে,যে বারান্দায় বসে আমি আর আবির আড্ডা দিতাম সেটাই কেমন শ্যাওলা পড়ে গেছে,হয়তো এখন যে আছে সে খুব একটা গোছানো না।
এবার শেষ গলির ৫ নং কোয়াটার টা মামার ওখানেই গেলাম। আমাকে দেখেয় কাজিন জান্নাত বলে উঠলো
জান্নাতঃ আপু এতক্ষণ কই ছিলা?
আমিঃ চেনা শহর টা ঘুরে আসলাম
জান্নাতঃ নিয়ে গেলেও পারতা আমারে
মামাঃ ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে কালকে অনেক কাজ
আমিঃ উপস্থাপনা কি আমি একাই করবো
মামাঃনা তুই আর আবির করবি
আমিঃকোন আবির??
মামাঃ তোর বেস্ট ফ্রেন্ড আবির+ আমাদের প্রাক্তন ছাত্র আবির + বর্তমান রসায়ন স্যার আবির।
আমিঃ কোন কোয়াটারে আছে?
মামাঃ ৩ নং গলির ৮ নং বাড়ি।
আমি আসতেছি বলে এক দৌড়ে আবির এর কোয়াটারে।দরজায় নক করার সাথে সাথে এক মহিলা গেট খুলে দিল
মহিলাঃ কাকে চাই??
আমিঃ(হাপাতে হাপাতে) আবির স্যার কে বলেন নিলিমা আসছে।
মহিলা ভেতরে চলে গেলো,একটু পরে এক লোক আসলো,মুখ ভরা দাড়ি চোখে চশমা কিন্তু আমার চিনতে সমস্যা হলো না
আবিরঃ এত দেরি করলি যে আসতে
আমিঃ জানতাম না তোর কথা
আবিরঃ ভেতরে আই
আমিঃ ওই মহিলা বুঝি তোর স্ত্রী
আবিরঃ হ্যা,
এর পরে আর কথা বলি নাই,চলে এসেছি,
আবির ঠিক ই করছে ২ বছরের রিলেশন এর জন্য কেও সারা জীবন একা থাকে না,ল,নিজে কে বড্ড বোকা মনে হলো।
বাসায় এসে খেয়ে ঘুম দিলাম।ঘুম ভাঙলো মামার ডাকে
মামাঃ উঠ,স্কুলে অনেক কাজ আছে
আম্মাঃ ও ওর আব্বার মতো অলস হয়ছে ভাই।
উঠে রেডি হয়ে স্কুলে গেলাম
স্কুল এর গেটে পা রাখতেই আব্বার কথা মনে হলো।প্রথম আব্বার হাত ধরে স্কুলে আসা আজ কত বছর হলো আব্বা নাই,আম্মার চোখেও পানি। সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিলাম।
শুক্রবার সকাল ৯ টাই অনুষ্ঠান কিন্তু ৮ টাই স্কুল মাঠ ভরে গেছে,স্কুল ফ্রেন্ড গুলার সাথে দেখা হলো,আড্ডা হলো।চোখের পলোকে কেটে গেলো সময় টা।
অনুষ্ঠান শেষে আম্মা কে বলাম বাসায় যেয়ে ব্যাগ গোছান আমি আসতেছি।
চলে গেলাম কোয়াটারের পুকুর ঘাটে, মিনিট ১০ পরে পাশে আবির এর অস্তিত্ব টের পেলাম
আবিরঃ একা একা ঘাটে কি?
আমিঃ বলতে বাদ্ধ না
আবিরঃ এখনো ভালবাসো?
আমিঃ বলতে বাদ্ধ না
আবিরঃএকটাই তো জীবন হোক না পথ টা ভিন্ন
আমি তো আমার মতো খারাপ থাকা টা খুঁজে নিয়েছি
তুমি না হয় তোমার মতো ভাল থেকো।
কি থাকবে তো?
আমিঃ বলতে বাদ্ধ না
এর পরে মামার কোয়াটারে ফিরে আসি। আম্মার আবদার কিছু দিন থাকবে,আমিও কথা বাড়াই নি,একাই চলে যাব বলেছি।
মেইন গেট থেকে বের হওয়ার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম,এর পরে আর আসা হবে না।কারন- মামার চাকরির আর ৬ মাস আছে আর মামা চলে গেলে আমাদের অস্তিত্ব টাও থাকবে না এই কোয়াটারে।
[এভাবেই হারিয়ে যায় প্রিয় মুখ,প্রিয় জায়গা ,শুধু রয়ে যায় স্মৃতি,এই স্মৃতি গুলাতে ধুলা জমে না,আসলে প্রাক্তন গুলো( প্রাক্তন প্রেমিক,প্রাক্তন স্কুল,প্রাক্তন বন্ধু,প্রাক্তন বাড়ি) অনেক আদোরের হয়,এদের ভুলে থাকা যায় কিন্তু ভুলে যাওয়া যায় না]