অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। নিউমার্কেটের দিকে যেতে হবে। কেনাকাটা আছে ছোটখাটো। আগামীকাল একটা বিশেষ দিন। আমাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী। তাই ভাবলাম নীলার জন্য একটা শাড়ি কিনে নিয়ে যাই। এমন একটা দিনে উপহার ছাড়া কি চলে? কিছু না নিয়ে গেলে নীলা সারাদিন গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তখন অভিমান ভাঙাতেই বেলা ফুরাবে আমার। তার ছেলেমানুষি আর গেল না।
নিউমার্কেটে ঢুকে একটা শাড়ির দোকানে গেলাম। বেশ সুসজ্জিত দোকান। নাম "দ্যা নিউ শাড়ি ঘর"। বাংলা এবং ইংরেজি শব্দের চমৎকার মিশ্রণ।দোকানে খুব একটা ভীড় নেই। কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছে। আমি দোকানে ঢোকা মাত্রই একজন কর্মচারী আমার দিকে এগিয়ে এলো। বললো,
“স্যার ভালো শাড়ি আছে। বসেন।”
আমি বসলাম। কর্মচারী প্রশ্ন করলেন,
“কতো দামের ভেতর শাড়ি দেখাব স্যার?”
“পাঁচ ছয় হাজারের ভেতর দেখান।”
যদিও মাসের শেষ। তবুও একটু বেশি দামের শাড়ি নেওয়া যাক। বউয়ের জন্য উপহার বলে কথা। কর্মচারী যখন শাড়ি দেখানো শুরু করছে সেই সময় আরেকজন মেয়ে দোকানে প্রবেশ করলো। বসলো আমার পাশে,একই সারিতে। প্রথমে তার চেহারা আমি লক্ষ্য করিনি। নিজ মনে শাড়ি দেখছিলাম। শাড়ি দেখার এক পর্যায়ে একবার মেয়েটার দিকে চোখ পড়লো। তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলাম মেয়েটাকে আমি চিনি। তার নাম তনু। আমার পূর্ব পরিচিত। শুধু পূর্বপরিচিত বললে ভুল হবে। তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বছর একসাথে কেটেছে আমাদের। খুবই ভালো বন্ধুত্ব ছিল দুজনের মাঝে। সেই বন্ধুত্বে ছিল অধিকার, রাগ, অভিমান, হাসি,ভালোবাসা। আমাদের পরিচয় পর্বটাও বেশ মজার ছিল। প্রথমদিন ক্লাসে এসেই তনু আমাকে ডেকে বললো,
“এই মোটা ছেলে, এদিকে শুনে যাও তো।”
কথাটা শুনে খুব আত্মসম্মানবোধে লাগলো। আরেহ, চেনা নেই জানা নেই মোটা বলে ডাকলো? আমি তার দিকে তেড়ে এসে বেশ কর্কশ কণ্ঠে বললাম,
“এই মেয়ে, নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছো কখনো? তুমি কি জিরো ফিগার?”
“বড় আপুর সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না?”
একথা শুনে আমি কিন্তু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। কয়েকবার ঢোঁক গিলে বললাম,
“ইয়ে মানে স্যরি আপু। আসলে.... ”
কথা শেষ করতে পারিনি। চেয়ে দেখলাম তনু হিহি করে হাসছে। অর্থাৎ সে আমার ব্যাচমেট। কী মিচকে শয়তান যে ও ছিল। বন্ধুত্বের শুরুটা এভাবেই হলো। আমরা দুজনই ছিলাম ক্যাম্পাসে প্রমাণ সাইজের মোটা মানুষ। তাই আমাদের বন্ধুত্ব আলাদা করে সবার নজর কাড়তো। আহা কী দিন ছিলো!
এখন তনুকে দেখলে চেনা যায় না। আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে সে। এখন আর প্রমাণ সাইজে স্বাস্থ্য তার নেই। হাহা। অনেক সুন্দর হয়েছে দেখতে। পরিবর্তন আমার মাঝেও এসেছে। এখন তনু চাইলেও আমাকে এই মোটা ছেলে বলে ডাকতে পারবে না। আচ্ছা তনুর সাথে কি কথা বলা উচিৎ হবে আমার? ও কি আমাকে চিনতে পেরেছে? এতদিন পর দেখা, খুব অস্বস্তি হচ্ছে কথা বলতে। ও কি সহজভাবে নিবে?
“স্যার, ও স্যার। কই হারায় গেলেন?”
দোকানের কর্মচারী ডাকে ঘোর কাটে আমার। সে বেশ কয়েকটা শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিভিন্ন রঙের শাড়ি। হলুদ, নীল, লাল, খয়েরী। আমার পছন্দ আগে থেকেই খুব একটা জুতসই নয়। তবুও অনেক ভেবেচিন্তে হলুদ রঙের একটা শাড়ি পছন্দ করলাম। কর্মচারীকে বললাম,
“এই শাড়িটা প্যাকেট করে দিন।”
“জি স্যার। ক্যাশ কাউন্টারে টাকা জমা দিন। আমি প্যাকেট করে দিচ্ছি। আপনার হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।”
আমি চুপচাপ উঠে গিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম। তনু তখনো শাড়ি দেখছে। ভাবখানা এমন যেন আমাকে সে চেনেই না। এতো নির্লিপ্ততা আসে কই থেকে? আমি দাঁড়ানোর মিনিট দুয়েক পরে তনুও এলো। তারও হয়তো শাড়ি পছন্দ করে কেনা শেষ। এখন ক্যাশ কাউন্টারে থেকে শাড়ি নেওয়া বাকি। দুজন দাঁড়িয়ে রইলাম আরও মিনিট পাঁচেক। এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছি যেন দুজনই একে অপরের অপরিচিত। এদিকে প্যাকেট আসছে না। ব্যাপার কী? দেরি হচ্ছে কেন? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বিরক্তিকর। অস্বস্তিও লাগছে। কিছুক্ষণের মাঝেই শাড়ির প্যাকেট ক্যাশ কাউন্টারে এলো। আমি আমার কেনা শাড়িটা নিয়ে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও কথা বলা হলো না। না হোক। আফসোস করে লাভ নেই।
পরেরদিন বিকাল বেলা। আমি বারান্দায় বসে সিগারেটে ধরিয়েছি। প্ল্যান হলো নীলাকে নিয়ে বাইরে খেতে যাবো। নীলা সাজগোজ করছে। মেয়েদের এই এক সমস্যা। সাজতেই ঘন্টা দুয়েক লাগিয়ে দেয়। সিগারেট শেষ না হতেই নীলা বারান্দায় চা নিয়ে এলো। বললো,
“তুমি একা বসে বোর হচ্ছো তাই চা দিয়ে গেলাম। আমার আর বেশি সময় লাগবে না।”
আমি নীলার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবো, কিন্তু পারলাম না। তাকে দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। নীলা একটা নীল রঙের শাড়ি পড়ে আছে। এই রঙের শাড়ি তো তার পড়ার কথা না। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি হলুদ রঙের একটা শাড়ি কিনেছিলাম। ব্যাপারটা কী? তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমি এক দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে নীলা প্রশ্ন করলো,
“কী ব্যাপার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলাম,
“তোমাকে নীল শাড়িতে অসাধারণ লাগছে।”
“হয়েছে, আর বলতে হবে না! হিহি। ”
সে মুচকি হেসে কথাটা বলে চলে যায় রুমে। তার সাজগোজ এখনো কিছুটা বাকি। আমি বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দেই। হঠাৎ করে বুঝতে পারি ঠিক কিভাবে শাড়ি হলুদ থেকে নীল রঙের হয়ে গেল। ক্যাশ কাউন্টার থেকে যে ব্যাগটা আমি নিয়ে এসেছি তা ছিল তনুর কেনা শাড়ি। আমাদের দুজনের ব্যাগ পরিবর্তন হয়ে গেছে। তনু গিয়েও হয়তো অবাক হয়েছে। হলুদ রঙের শাড়ি তো সে কেনেনি। তবে ব্যাপারটা নেহায়েত মন্দ হয় নি। একটু আগে নীলাকে যে বললাম, তোমাকে অসাধারণ লাগছে, কথাটা মিথ্যা নয়। আমার ধারণা হলুদ শাড়িতে নীলাকে এতটা সুন্দর মানাতো না।
এসব ভেবে এখন লাভ নেই। ভাবতে ইচ্ছা করছে তনুকে নিয়ে। তনুর সাথে কথা বলতে পারলে ভালো লাগতো। আমি আসলে প্রচণ্ড রকম ভীতু একজন মানুষ। অতীতেও এর প্রমাণ দিয়েছি। গতকাল যখন তনুর সাথে দেখা হলো তখনো দিলাম। যখন মাস্টার্সে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি তখন তনুর বিয়ে ঠিক হয়। আমি দেখেছিলাম কী গভীর দুঃখ তাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। বিয়ের দুইদিন আগে তনুর ফোন আসে। সে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“মারুফ, আমি কিছু ভাবতে পারছি না।”
“কেন কী হয়েছে?”
বোকার মতো প্রশ্নটা করেছিলাম আমি। উত্তরে তনু বলেছিল,
“তুই কি বুঝতে পারছিস না, আমি এই বিয়েটা করতে চাই না। তোর কি মনে হয় না আমরা দুজন একসাথে থাকলে খুব ভালো থাকবো সারাজীবন?”
“না মানে ইয়ে, আমি তো এভাবে ভেবে দেখি নি। এখন কী করবো তবে?”
“কিচ্ছু করতে হবে না। বাদ দে এসব কথা। রাখি রে। নিজের যত্ন নিস।”
এই ছিল আমার আর তনুর শেষ কথা। খুব অভিমান করে কথাগুলো বলেছিল তনু। আহারে অভিমান। সেই অভিমান এখনো পুষে রেখেছে সে। এজন্যই হয়তো দেখেও না দেখার ভান। অপরিচিত হওয়ার এই সূক্ষ্ম অভিনয়। এতে দোষের কিছু নেই। ভালোবাসার তো অনেক রূপ। দুঃখ, আনন্দ, সুখ, হাসি, কান্না, অভিমান সবই ভালোবাসার একেকটা রূপ। তনু এবং মারুফ নামের এই ভীতু মানুষটার মাঝে হয়তো এখনো ভালোবাসা বেঁচে আছে অভিমান রূপে। এর থেকে বেশিই বা আর কী চাওয়ার আছে? এই ভালোবাসা মনের আকাশে কালো মেঘে করে ভেসে বেড়াক আমৃত্যু। এই ভালোবাসা বেঁচে থাক আজীবন। এই অভিমান বেঁচে থাক চিরকাল।
“অভিমান বেঁচে থাক”
আদিল মাহফুজ রনি
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়