========
মাসুদ ভাই ছিলেন আমাদের সিনিয়র রুমমেট। দেখতে সুদর্শন। ভাল ডিবেট করতেন। কবিতা আবৃতি করতেন। গল্প বলায়ও উনি ছিলেন খুব পারদর্শী। বিশেষ করে তার ১৮+ গল্প শুনে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যেত। মজা করে আমরা উনাকে ডাকতাম সুপার স্টোরি টেলার। মেয়েদের ব্যাপারে ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য । একটা মেয়ের চেহারা দেখেই ভাল-মন্দ,বিবাহিত-অবিবাহিত,চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে দিতে পারতেন।
.
একবার প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকেটা করতে আমি, সাত্তার আর মাসুদ ভাই নিউমার্কেট গিয়েছিলাম। হটাত অসাধারণ রুপবতী এক মেয়ে দেখে সাত্তার বলল, "ভাই মালটা দেখছেন? জটিল না?"
কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মাসুদ ভাই বলল, "বাট ম্যারিড।"
আমি বললাম, "ইমপসিবল ভাই এই মেয়ে ম্যারিড হতে পারেনা।"
সাত্তার ও গলা মেলাল--"ভাই আমারও মনে হয় এই মেয়ে ম্যারিড হতে পারেনা।"
মাসুদ ভাই হাল্কা গলায় বলল, "বাজি?"
" হ বাজি।" সাত্তার পাল্টা গলায় বলল।
মাসুদ ভাই বলল, "যদি ম্যারিড হয় তাহলে তোরা আমাকে নীলক্ষেতে তেহারি খাওয়াবি। আর যদি আনমেরিড হয় আমি তোদের খাওয়াব।"
"ওকে রাজি।" আমি আর সাত্তার সমস্বরে বললাম।
সাত্তার আমার চেয়ে সাহসি। আমি আর মাসুদ ভাই একটু দূরে সরে গেলাম।
সাত্তার মেয়েটির দিকে আগ বাড়িয়ে গেল।
"এক্সকিউজ মি। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?"
মেয়েটি বলল, "জী বলুন।"
"আমার এক বড় ভাইয়ের জন্য মেয়ে খোজছিলাম। আপনি কি..?"
"স্যরি ভাইয়া আমি ম্যারিড।" বলেই মেয়েটি নিজের কেনাকেটায় মনোযোগ দিল।
সাত্তার মাথা নিচু করে ফিরে এলো।
মাসুদ ভাই বলল, " কিরে কি খবর?"
সাত্তার চুপ করে রইল।
বাজিতে হেরে মাসুদ ভাইকে তেহারি খাওয়াতে নীলক্ষেতের ছোট একটা হোটেলে ঢুকলাম।
খেতে খেতে বললাম, "ভাই আপনি কেম্নে বুঝলেন মেয়েটা ম্যারিড? "
মাসুদ ভাই তাচ্ছিল্যর হাসি হাসলেন। "এটা সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র।"
মনে মনে ভাবলাম, "শালাত মেয়েদের ব্যাপারে শুধু পণ্ডিত না, মহাপন্ডিত।"
খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে শুনি মাসুদ ভাই আগেই বিল দিয়ে দিয়েছেন।
বললাম, "ভাই এটা কি হইল?"
"তোদের সাথে ফান করছি। বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই দিবে কেন? তোরা আরেকদিন খাওয়াইস। পাওনা রইল।"
আরেকবার বুঝলাম ভাই শুধু অনেক গুনের অধিকারী না। অনেক বড় মনের অধিকারীও।
.
রাতে ঘুমানোর আগে মাসুদ ভাইয়ের সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস। আগে ভাই সারাদিনে গুনে গুনে ৩টা সিগারেট খেত। কিছুদিন ধরে দেখছি চেইন স্মোকারদের মত রাত দিন সিগারেট টানে। বিশেষ করে রাতে শোয়ে শোয়ে একটানা সিগারেট টানে। অনেক দিন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও দেখি ভাই নীরবে সিগারেট টানছে।
একদিন বললাম, "ভাই ইদানীং আপনি অনেক সিগারেট খাচ্ছেন। কোন ডিপ্রেশনে আছেন নাকী?"
মজা করে বলল, "আরে না। এই সিগারেট কোম্পানিতে আমার এক দুলাভাই চাকরী করে। কোম্পানি যাতে দেউলিয়া না হয়ে যায় তাই একটু বেশি বেশি খাই আরকি!"
আমি আর সাত্তার প্রচণ্ড শব্দে হেসে ফেললাম।
.
রাতে ঘুমানোর আগে অন্যদিনের মত আজও মাসুদ ভাই সিগারেট টেনে যাচ্ছিলেন।
দিনের প্রসঙ্গটা রাতে আবার উঠাল সাত্তার।
ভাই সত্যি করে কনতো, "আপনি কেম্নে বুঝলেন মেয়েটা ম্যারিড?"
আমিও বললাম, "আসলেও ভাই--আপনি কেম্নে বুঝলেন?"
মাসুদ ভাই বলল, "তোরা দেখি এখনো সেই ঘটনা ভুলতে পারিস নি।"
"হ ভাই এখনো ভুলতে পারি নাই। সিরিয়াসলি
কনতো কেম্নে বুঝলেন?" সাত্তার বলল।
"বাদ দে এসব। অন্য কথায় আয়--"
"ভাই জাস্ট কিউরিসিটি। প্লিজ বলেন না।" আমি অনুনয় করে বললাম।
কিছুক্ষন চুপ থাকলেন মাসুদ ভাই। "আসলেই তোরা শুনতে চাস?"
আমি আর সাত্তার সমস্বরে বললাম, "হ ভাই শুনতে চাই।"
মাসুদ ভাই সিগারেটে শেষ টান দিয়ে এস্ট্রেতে রাখলেন। "সত্যি শুনতে চাস?"
"আরে ভাই কি শুরু করলেন? আমি আর সাত্তার বিরুক্তি নিয়ে বললাম।"
"উত্তর শুনে আবার মন খারাপ করবি নাতো?"
বিরুক্তি আমাদের চরমে উঠল।
বুঝতে পেরে মাসুদ ভাই বলল, "শোন তাহলে--আসলে আমার পাণ্ডিত্য বলতে কিছু নাই। যা সত্যি তাই বলছি। মেয়েটা আমার পুর্ব পরিচিত। ইন্টারে কিছুদিন ওকে পড়িয়েছিলাম। এখন নর্থ সাউথে পড়ে। বলেই মাসুদ ভাই একটু থামলেন।
সাত্তার বিড়বিড় করে বলল, শালা আবাল কোনহানের।
আমিও মনে মনে বললাম- ফাউল কোনহানের।
একটু থেমে মাসুদ ভাই আবার বলতে শুরু করল--
"ওর নাম ঊর্মি । ওর সাথে আমার তিন বছরের রিলেশন ছিল। মাস দুয়েক আগে এক এএসপি ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়। ওকে আমি পাগলের মত ভালবাসতাম। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। নিজেকে ব্যর্থ, অথর্ব মনে হয়।" বলতে বলতে উনার গলা ধরে আসলো। চোখ জলে ভিজে উঠল।
পরিবেশটা মুহুর্তে ভারী হয়ে গেল। আমি আর সাত্তার অস্বস্তিতে পরে গেলাম। ঠিক কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। উনাকে সব সময় হাসি খুশি দেখেছি। আমাদের সব সময় গল্প শুনিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। অথচ তার ভিতরে এমন চাপা কষ্ট ছিল-কখনো বুঝতে পারিনি। ভালবাসার মানুষের জন্য এভাবে কাউকে ভেঙ্গে পরতে অনেকদিন দেখিনি।
কোন শান্ত্বনা খোজে পাচ্ছিলাম না। কাধে হাত রেখে শুধু বললাম, "মাসুদ ভাই যা গেছে ভুলে যান ভাই- "
মাসুদ ভাই চোখের পানি আড়াল করতে দু'হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষন বসে রইল।
তারপর হটাত হাত সরিয়ে বলল, "ভুলতে পারি নারে, অনেক চেষ্টা করেও ভুলতে পারিনা। যতোই ভাবি ভুলে যাব ততোই মনে পড়ে যায়। কষ্টের এই অনুভূতি অন্যরকম। বলা যায় কিন্ত কাউকে বুঝানো যায় না।
আমি আর সাত্তার নিজেদের মধ্যে একবার দৃষ্টি বিনিময় করি । মাসুদ ভাইয়ের কস্ট বুঝার চেষ্টা করি। কিন্তু বুঝতে পারি না..
আমারও একবার মনে হলো--সত্যি এই অনুভূতি অন্যরকম। বলা যায় কিন্তু বুঝানো যায় না..