মহাভারতে ভীষ্মপর্বের ২৩ অধ্যায়ে সঞ্জয় রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “হে রাজন, শ্রীবাসুদেব দুর্যোধনের সৈন্যদের যুদ্ধ উদ্যত দেখে অর্জুনের কল্যাণ কামনায় বললেন, 'হে মহাবাহু অর্জুন, শত্রুদের পরাজয়ের নিমিত্ত পবিত্র ও সংগ্রাম অভিমুখ হয়ে দুর্গার স্তব কর।”
অর্জুন তখন শ্রীবাসুদেবের বাক্য অনুসারে রথ থেকে নেমে কৃতাঞ্জলিপুটে দুর্গা স্তোত্র আরম্ভ করলেন- “হে কৃষ্ণপিঙ্গলে, কাত্যায়নী, শিখিপুচ্ছধ্বজ ধরে, হে গােপেন্দ্রানুজে, নন্দগােপকুলােদ্ভবে, হে পীতবাসীনি, হে কৃষ্ণে, হে কৈটভনাশিনি, আপনাকে প্রণাম। হে ভগবতি দুর্গে, আপনি স্বাহা, স্বধা, কলা, কাষ্ঠা, সরস্বতী, সাবিত্রী বেদমাতা ও বেদান্ত। আমি বিশুদ্ধ অন্তরে আপনাকে স্তব করছি। আপনার কৃপায় এই মহারণক্ষেত্রে যেন জয়লাভ করতে সমর্থ হই। আপনি ভক্তদের রক্ষার নিমিত্ত দুর্গম পথে, ভয়স্থানে, দুর্গম স্থানে, পাতালে নিত্য বাস করে থাকেন, আর যুদ্ধে দানবদের পরাজিত করে থাকেন। আপনি জৃম্ভনী, মােহিনী, মায়া, হ্রী, শ্রী, সন্ধ্যা প্রভাতী, সাবিত্রী, জননী, তুষ্টি, পুষ্টি, ধৃতি, চন্দ্রসূর্যবিবর্ধিনী, দীপ্তি ও সম্পন্নদের সম্পত্তি। সিদ্ধচারণগণ যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাকে দর্শন করে থাকেন।"
হে রাজন, অর্জুনের ভক্তি দেখে ভগবতী দুর্গা অন্তরীক্ষে দর্শন দিয়ে বললেন---
স্বল্পনৈব তু কালেন শত্রুন্ জেষ্যসি পাণ্ডব।
নরস্তমসি দুর্দ্ধর্ষ! নারায়ণসহায়বান্।
অজেয়স্ত্বং রণেহরীণামপি বজ্ৰভূতঃ স্বয়ম্॥
(মহাভারত, ভীষ্মপর্ব ২৩.১৮)
“হে বীর পাণ্ডব, তুমি অল্পকাল মধ্যেই শত্রুদের পরাজিত করবে। কারণ, স্বয়ং নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ তােমার সঙ্গেই রয়েছেন। অতএব, অন্য শত্রুর কী কথা! স্বয়ং বজ্রধারী ইন্দ্রও তােমাকে পরাজিত করতে সমর্থ হবে না।”
একথা বলে দেবী দুর্গা অন্তর্হিত হলেন। পাণ্ডুপুত্র অর্জুন বর পেয়ে জয়লাভে কৃতনিশ্চয় হয়ে রথে আরােহণ করলেন। তারপর কৃষ্ণের শঙ্খধ্বনির সঙ্গে নিজের শঙ্খ ধ্বনিত করতে লাগলেন।
সঞ্জয় বললেন, “হে রাজন, আমি শ্রীব্যাসদেবের কৃপা প্রভাবে জেনেছি, এই অর্জুন ও কৃষ্ণ পূর্বযুগে নর-নারায়ণরূপে ধরাতলে প্রকাশিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুষ্টচিত্ত ক্রোধের বশবর্তী আপনার পুত্ররা মােহবশত তাঁদের জানে না। হে রাজন, ব্যাসদেব, নারদ মুনি, কণ্ব মুনি, শ্রীপরশুরাম আপনার পুত্র দুর্যোধনকে অর্জুন ও কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আপনার কোপন-স্বভাব দুরাত্মা পুত্ররা কালপাশে বদ্ধ হয়ে মােহগ্রস্ত হয়েছে, তাই তাঁদের সময়ােচিত নির্দেশ তারা গ্রহণ করেনি। আমি পরিষ্কার দর্শন করছি যে, যেখানে ন্যায়, তেজ, কোমলতা, লজ্জা, বুদ্ধি ও ধর্ম থাকে, সেখানেই কৃষ্ণ থাকেন; যে স্থানে কৃষ্ণঃ, সেই স্থানেই জয়- যতাে ধর্মস্ততঃ কৃষ্ণ যতাে কৃষ্ণস্ততো জয়।"
এখানে অর্জুনকে দুর্গা নিজেও বলছেন- যেহেতু, স্বয়ং নারায়ণ তথা শ্রীকৃষ্ণ বিদ্যমান (নারায়ণসহায়বান্), সুতরাং অর্জুনের জয় সুনিশ্চিত। কিন্তু শাক্তরা কৌশলে এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। শ্রীমদ্ভগবদগীতাও সর্বশেষ শ্লোকে (১৮.৭৮) বলা হয়েছে---
যত্র যােগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়াে ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম॥
অর্থাৎ, “যেখানে যােগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্ৰী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত।”
সুতরাং, বিজয়ের জন্য অর্জুন কর্তৃক দুর্গাস্তবের কোনাে আবশ্যকতা বা বাধ্যবাধকতা ছিল না। তাছাড়া, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জয়-পরাজয়ের তথা কর্মফলের আশা ত্যাগ করে কর্তব্যবােধে ও তাঁর (কৃষ্ণের) সন্তুষ্টিবিধানের জন্য যুদ্ধ করতে বলেছেন। তবুও শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তা করতে বলেছেন।
প্রশ্ন হলাে, ভগবান তাে স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে পারতেন। আমার স্তুতি করাে। তা না বলে ভগবান কেন অর্জুনকে দুর্গাম্ভতি করতে বললেন? “আমার স্তুতি করাে”, “আমার শরণাগত হও" - এ ধরনের কথা গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বহুবার বলেছেন। যেমন, মন্মনা ভব মদ্ভক্ত মদযাজী মাং নমস্কুরু।
অর্থাৎ “তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত করা, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা করাে এবং আমাকে নমস্কার করাে।” তবুও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাধীন দুর্গাদেবী যেহেতু এ জড়জগরূপী দুর্গের অধিকর্ত্রী, পরম বৈষ্ণবী এবং সেই সাথে অসুরনাশিনী, তাই মহাভারতের যুদ্ধের মতাে এমন মহৎ কর্মযজ্ঞে দুর্যোধনাদি কৌরবদের মতাে অসুরদের বিনাশের পূর্বে, জড়জগৎরূপী দুর্গের) অধিকর্ত্রী হিসেবে দুর্গাদেবীকে মর্যাদা দান এবং পরম বৈষবী হিসেবে অর্জুন যেন তাঁর আশীর্বাদ লাভ করতে পারে, সেজন্যই অর্জুনকে তিনি দুর্গাদেবীর স্তুতি করতে বলেছিলেন। এখানেও প্রণিধানযােগ্য বিষয় হচ্ছে, এখানে উল্লিখিত দেবী দুর্গা ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি মহামায়া নন, বরং যােগমায়ারূপে পরিচিত ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি, যিনি নন্দপত্নী যশােদার কন্যা (গােপেন্দ্রানুজে, নন্দগােপকুলোদ্ভবে) তথা শ্রীকৃষ্ণের ভগিনীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
তাছাড়া, কারো স্তবস্তুতি করার অর্থ এই নয় যে, তিনিই তার আরাধ্য। ভগবানের ভক্তরাও দেবতাদের শ্রদ্ধা, পূজা নিবেদন বা স্তুতি করেন। তাতে তাদের ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা বা সমর্পণের কমতি হয় না। তাই অর্জুন দুর্গাদেবীর স্তুতি করলেও তা দোষনীয় নয়।
দেবদেবীগণ যেহেতু ভগবানের প্রতিনিধি, তাই তাঁদের পূজা করা পরােক্ষভাবে ভগবানেরই পূজা করা হলেও তা যথার্থ বিধিসম্মত নয়- অবিধিপূর্বকম্। কারণ, সাধারণত অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন সকামকৰ্মীরাই জড় বিষয় লাভের বাসনায় দেবদেবীদের পূজা করে থাকে। প্রকৃত বিধান হলাে সরাসরি ভগবানের পূজা করা। দেবদেবীদের পূজা যদি কেউ করতেও চান, তবে তার উদ্দেশ্য কোনাে জড়বিষয় লাভের পরিবর্তে কেবল ভগবানের প্রতি ভক্তিলাভ বা তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই করা উচিত; ঠিক যেমন, ব্রজগােপিকারা কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য কাত্যায়নীর পূজা করেছিলেন। শুধু তাঁরাই নন, অর্জুনও শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্যই দুর্গাস্তব করেছিলেন। কৃষ্ণ সন্তুষ্টি এই অর্থে, যেহেতু কৃষ্ণ তা চেয়েছিলেন। আর উপরে উল্লেখিত কারণেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা চেয়েছিলেন। যদিও শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, শত্রুদের পরাজয়ের জন্য দুর্গাস্তব করাে, কিন্তু এটা ছিল অর্জুনকে গীতাজ্ঞান দানের পূর্বে, যখন অর্জুন জানতেন না যে, শ্রীকৃষ্ণই পরমব্রহ্ম, যিনি দুর্গাদেবীরও আরাধ্য। সাধারণত জড়বিষয় সুখ লাভের জন্য মানুষ দুর্গাপূজা করে। অর্জুনও সেখানে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকায় উপনীত ছিলেন, তখনও শ্রীকৃষ্ণের ভক্তরূপে তাঁর প্রতি পূর্ণ শরণাগত হননি। তাই গীতাজ্ঞান দানের পূর্বে দুর্গার শ্রীমুখ থেকেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশের সূচনা করলেন যে, পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়ের তথা সমস্তকিছুর তিনিই মূল কারণস্বরূপ স্বয়ং নারায়ণ। তাই সর্বতােভাবে শ্রীকৃষ্ণেরই শরণাপন্ন হওয়া উচিত। শক্র পরাজয়ের জন্য শ্রীকৃষ্ণের কৃপা-সান্নিধ্যই যে মূল প্রয়ােজন, তা দেবী দুর্গাই বলেছেন। তাই ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের অন্তিম উপদেশ ছিল---
মন্মনা ভব মদ্ভক্ত মদযাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়ােহসি মে॥১৮.৬৫॥
"তােমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত করাে, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা করাে এবং আমাকে নমস্কার করাে। তাহলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। এজন্য আমি তােমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।"
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মােক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ॥১৮.৬৬॥
“সর্ব প্রকার জড় ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও, আমি তােমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব, তুমি শােক করাে না।"