দিনটা শুরুই হয়েছিল একটু অন্যভাবে। নাশতা খেতে খেতে সিমিন বললো--
‘আজকে সব সাদা জিনিস ধোবো...সাদা কিছু থাকলে দাও।’
‘যা ছিল ওয়াশিং মেশিনে দিয়েছি। সাদা একটা মন ছাড়া আর কিছুই নেই।’
ভেবেছিলাম আমার কথায় সিমিন খুশী হবে কিন্তু হলো না। তাহলে কী আমার ভান সে বুঝতে পারে? হয়তো পারে। তা না হলে এ রকম হচ্ছে কেন? সেদিন রাতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ শুনতে পেলাম, সিমিন কার সাথে যেন কথা বলছে--
‘কী খুঁজছো?’
‘ভালোবাসা।’
‘পেয়েছো?’
‘না।’
‘কোথায় রেখেছিলে?’
‘তোমার মনের মধ্যে।’
‘তাহলে পাচ্ছো না কেন?’
‘জানি না, ওখানেই তো রেখেছিলাম...।’
রাত দুপুর। ডিম লাইট জ্বলছে। এদিক-ওদিক তাকালাম। দরজা-জানালা ভালো করে ঠেলে-ঠুলে দেখলাম। খাটের নীচেও উঁকি দিলাম। আলমীরা খুললাম। বারান্দায় গেলাম; কাউকেই তো দেখছি না। আমরা ছ’তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকি। আশেপাশে আর কোনো বিল্ডিংও নেই। তাহলে সিমিন কথা বললো কার সাথে? আমার নড়াচড়ার শব্দে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। একবার মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করি। আবার মনে হচ্ছে; আমার হ্যালুসিনেশান হয়নি তো? হতেও পারে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ ঘুমের ঘোরে কত কিছু দ্যাখে! কত কিছু শোনে! সকাল হলো কিন্তু সিমিনের ঘটনাটি আমার মাথা থেকে গেল না।
আমাদের বিয়ের বয়স দু’বছরের একটু বেশী। সিমিন অষ্ট্রেলিয়াতে এসেছে মাত্র এক বছর চার মাস। শুরু থেকেই বিবাহিত জীবনটা ভালো যাচ্ছিল না। একদিনের জন্যও নিজেদেরকে সুখী দম্পতি মনে হয়নি। কেন যে বাবা-মায়ের কথায় বিয়েটা করেছিলাম? এত দিন ভাবতাম সমস্যা শুধু আমারই; এখন দেখি সিমিনও নতুন সমস্যা তৈরী করেছে। রাত দুপুরে পরপুরুষের সাথে প্রেমালাপ করে। হাতে-নাতে ধরতে হবে; নইলে ‘তোমাকে বিয়ে করে জীবনটা মাটি হয়ে গেল’ টাইপ কান্নাকাটি জুড়ে দিবে। নিজেকে নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা করবে। ওৎ পেতে আছি।
চার/পাঁচ দিন পর হঠাৎ আবার সেই কথোপকথন। যথারীতি কাউকেই খুঁজে পেলাম না। কিন্তু সিমিন প্রায়ই আজকাল গভীর রাতে একটি ছেলের সাথে কথা বলে। ছেলেটির কণ্ঠ শুনতে পাই। কিন্তু তাকে খুঁজে পাইনা। মোবাইলে কথা বলে কিনা তাও চেক করলাম। না, তা না। এর মধ্যে একদিন ওদের কথোপকথন ছিল আমার আর ফিওনার গোপন সব বিষয়। ফিওনা আমার সাথে পড়ত, পরবর্তীতে এ্যাফেয়ার...সে অনেক কথা। সপ্তাহখানিক আগেও ডেইট করেছি। কিন্তু এসব তো কেউ জানে না। সিমিন জানলো কিভাবে? অনেক চিন্তা-ভাবনা করেও কোনো কুল-কিনারা পেলাম না। যখন নিশ্চিত হলাম যে ফিওনা কিছু বলেনি তখন ভয়ে-বিস্ময়ে হাত-পা ঠান্ডা হবার যোগাড়। সিমিনকে ‘রাতের বেলা কথা বলার’ ঘটনাটি জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম; তা বাদ দিলাম। না দিয়ে উপায় কি? আমার যে আরো গোপনীয় ব্যাপার আছে...। কি জিজ্ঞেস করতে কী বলে ফেলে ঠিক আছে? সিমিনকে ধরতে গিয়ে যদি নিজেই ধরা পড়ে যাই?
শুনেছি এসব নাকি প্যারাসাইকোলজিক্যাল বিষয়। পীর-ফকিরদের এই সব ক্ষমতা থাকে। ইংরেজীতে এদেরকে বলে মেন্টালিষ্ট। এরা নানা রকম অদ্ভুত কাজ-কর্মও করতে পারে। তাই বেশ কিছু বই-পত্র যোগাড় করলাম। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিন একটা পর একটা বই পড়ছি আর সিমিনকে খেয়াল করছি। রাতের বেলা সিমিন অন্য জগতের কারো সঙ্গী হয়ে যায়। সকাল হলেই স্বাভাবিক। কিছুই বলে না। এমনকি ফিওনা সম্পর্কেও না। আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। রাতের পর রাত জেগে শরীর মন কোনোটাই ভালো নেই। এ কোন শাস্তির মধ্যে পড়লাম? মানসিক শাস্তি যে এত ভয়ংকর হতে পারে; কোনো দিন চিন্তাই করিনি। সিমিন সেই অন্য মানুষটার সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে। ওদের একদিনের কথোপকথন:
‘...ছেলেটাকে সে অনেক ভালোবাসতো।’
‘মানে?’
‘মানে ভালোবাসতো।’
‘তুমি এটা কি বললে? ভালোবাসার কি অতীতকাল হয়?’
‘হয়।’
‘না, হয় না। ভালোবাসা আংশিক কিংবা অতীত হয় না। যে ভালোবাসে সে সবসময়ই বাসে। ভালোবাসা জীবনব্যাপী হয়।’
গভীর মনোযোগে আড়ি পেতে ওদের আলাপ শুনছিলাম। হঠাৎ ছেলেকণ্ঠটা নিরব হয়ে গেল। সিমিনও নিশ্চুপ। আমাকে চমকে দিয়ে সিমিন জিজ্ঞেস করলো--
‘ফিওনা প্রেগনেন্ট। আমাকে দেশে পাঠিয়ে ওকে বিয়ে করবে, তাই না?’
হতবাক হয়ে গেলাম। স্বীকার করতে সাহস পেলাম না।
‘ওর সাথে তুমি লিভ টুগেদার করতে, তাই তো?’
‘তুমি জানলে কীভাবে?’
‘মনের চোখ সবই দেখে।’
‘কিন্তু রাতের বেলা তুমি কথা বলো কার সাথে?’
সিমিন কোনো উত্তর দিল না। আমার মেরুদন্ডের ভিতর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। মনে হলো অদৃশ্য কিছু একটা আমাকে ঘিরে ফেলেছে। ভয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছি না। কিছুক্ষণ পর সিমিন আবার প্রশ্ন করলো--
তুমি কি জানো বিয়ের গয়নাগুলো দিয়ে আমি কি করেছি?’
‘না।’
‘একটা সোনার গ্লাস বানিয়েছি।’
‘কেন?’
‘ভেবেছিলাম, কোনো এক পূর্নিমা রাতে সোনার গ্লাসে বিষ খাবো...। কিন্তু না; তা করবো না। কঠিন কিছু একটা করবো; যাতে তোমার মতো মানুষের একটা জন্মের শিক্ষা হয়।’
[ 'অন্তরাক্ষী' নামে ২০১১ সালে দৈনিক প্রথমআলোতে আমার লেখা এই অনুগল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল]