▪
— আম্মা পা টিপে দেই?
— থাক আর ঢং করন লাগবে না
— আম্মা ঢং করতেছি না তো
— বৌমা আমার সাথে বেয়াদবি না করলে, তোমার ভালো লাগে না!
— আম্মা কী বেয়াদবি করলাম!
— এই যে অহনো তো মুখে মুখে তক্কো করতেছো।
অহনার খুব কষ্ট হয়। ওড়নার এককোণায় মুখ চেপে শাশুরির রুম থেকে বের হয়ে আসে। শুনতে পায়, শ্বশুরকে অভিযোগের সুরে তিনি বলছেন,
— দেখছ দেখছ, কতবড় বেয়াদব মাইয়াটা। মুখের উপর মুখ ঝামটা দিয়া চইলা গেল।
শ্বশুরের কণ্ঠও শুনতে পায়,
— আরে বাদ দাও তো জেবুন্নেছা। পর কি কখনো আপন হয়!
এবারে অহনার কষ্ট তীব্র হয়। উনিও আজ এই কথা বললেন! এই বাড়ীতে একমাত্র শ্বশুর সাহেবকেই যৌক্তিক মানুষ বলে মনে করত সে। আজকাল তিনিও শাশুড়ির সব কথাতেই তাল মেলাচ্ছেন কোনোকিছু না জানতে চেয়ে, না শুনতে চেয়েই!
গতকাল সন্ধ্যায় হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। দেয়াল ধরে ধরে কোনোমতে বিছানায় গিয়ে শুয়েছে। তারপর কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছে, সকালও হয়ে গেছে একবিন্দুও টের পায়নি। সাধারণত এমন কখনোই হয় না তার। চার বছরের সংসার জীবনে এমন হয়নি যে শ্বশুর শাশুড়ির জন্য রান্না করে, তাদেরকে রাতে না খাইয়ে, নিজে খেয়েছে। বিয়ের দুবছর পরই রোমেল ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকা চলে গেল। বলতে গেলে তারপর থেকেই এই দুইটা মানুষের সব দায়-দায়িত্ব একহাতে সামলাচ্ছে সে। ননদ ইমা যদিও ঢাকাতেই থাকে, কিন্তু একটা কলেজে চাকরি করায় একদমই সময় পায় না। আর ওর বাচ্চাদুটোও ছোট। রাস্তার এপার ওপার বাসা যদিও, সেভাবে আসার সুযোগ সময় পায় না। তবে যেদিন আসে, অহনা একটু তটস্থই থাকে। কোথায় কি দোষ ধরবে, খুব টেনশন হয়। দেখা গেল সমস্যা তেমন কিছুই না, কিন্তু ইমা বিষয়টাকে টেনেটুনে এত বড় করবে, সেটা হেঁটে হেঁটেই আমেরিকাতেও চলে যায়। একবার সে এসে আম্মার পরনের শাড়িটা খানিক অংশ ছেঁড়া দেখল। অহনার চোখে আগে পড়েনি সেটা। সেটা নিয়েই তুমুল হয়ে গেল। নিজের মেয়ে বলেই চোখে পড়েছে, পরের মেয়েরা কি আর তাকায়েও দেখে... পর পরই... পর কি কখনো আপন হয়! ছেলে বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকে কষ্ট করে কাজকম্মো করে টাকা পাঠায়, সেই টাকা দিয়ে কী বাপ মার কপালে ভালো কাপড়ও জুটবে না! ইত্যাদি ইত্যাদি।
অহনা সেদিন কোনো কথা বলেনি। কথা বলেনি কেন, সেটাও হয়েছে বিশাল এক অপরাধ। সে দেমাগী, অহংকারের চোটে মুখ দিয়ে কথাই বেরোয় না, নানান কথাবার্তা। তাকে এখন এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তেই ভীষণ আতংক লাগে! পা বাড়ানোর আগে একবার ভাবে, ফেলার পর আরেকবার ভাবে, একটা কথা বলার আগে একবার ভাবে, বলার পরে একবার ভাবে— কোনো ভুলই হয়ে গেল নাকি! সে মন থেকেই চায় বয়স্ক এই মানুষ দুটোকে শান্তিতে রাখতে, একটু ভালো রাখতে। নিজের বাবা মাকে হারিয়েছে আরো কয়েক বছর আগেই। উনাদেরকে মন থেকেই বাবা মা জ্ঞান করে অহনা। এ নিয়েও কথা শুনতে হয়েছে,
'বৌয়ের নিজের বাপমা নাই, অন্যের বাপ মারে আর কেমনে নিজের মনে করব!পর কি কখনো আপন হয়!'
সবচেয়ে কষ্ট হয় রোমেলও যখন ভুল বুঝে। টানা সাতবছর প্রেম করে তবেই বিয়ে করেছে। অহনাকে সে তো রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনে। সে কেন আম্মার কথাতে তাকে ভুল বুঝবে, তাকে পড়শ্ন করবে কিছুতেই মানতে পারে না। একদিন যে কোনো কারনেই হোক বাড়িতে কোনো বাজার ছিল না। হাতের কাছে যা পেয়েছে রান্না করে দিয়েছে, পটলের ভর্তা আর ডাল। সে নিয়ে পারলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই যেন বেঁধে যায়। রোমেল ফোনের মধ্যেই অহনাকে রিমান্ডে নিল,
প্রতিমাসে আমি যে টাকা পাঠাই সেগুলো কই যায়! বাপ মাকে পটল দিয়ে ভাত খাওয়ানোর জন্য আমি কষ্ট করি! টাকাগুলো যায় কোথায়!
রাতের বেলায় ইমা এলো। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে মুরগির মাংস, ইলিশ মাছ, তিনরকম ভর্তা সাথে। শাশুড়ি সে দেখেই বলে উঠল,
'পর কি কখনো আপন হয়!'
কয়েকদিন আগে শাশুড়িসহ নিউ মার্কেটে গিয়েছিল অহনা। ফেরার পথে তিনিই বললেন,
— বৌমা চলো ইমার বাড়ীত যাই। হের কলেজ ছুটি, বাড়ীতই আছে, দুপুরে ওইখানেই খাব। তোমার আব্বারে ফোন কইরা বইলা দাও। মোমেনায় ফ্রিজ থিকা খাবার বাইর কইরা গরম কইরা দিব।
ইমা জানত না, তারা যাবে। দুপুরে তেমনকিছু রান্নাও করেনি। বাবুদের জন্য আগের দিনের রান্না করা চিকেন ছিল, সেটা দিয়েই খাইয়ে দিবে, আর নিজের একবেলা খাওয়ার জন্য একটা কাঁকরোল ভেজে রেখেছে। অহনারা যখন সেখানে গেছে, আম্মার প্রচন্ড খিদে লেগেছে। ডায়াবেটিকের রোগী, খিদে সহ্য করতে পারেন না তিনি। ইমা অন্যকিছু রান্না করতে চাইলেও, আম্মা কাঁকরোল ভাজি দিয়েই ভাত খেল। অহনার খুব টেনশন হচ্ছিল, যেহেতু সে জানে পৃথিবীতে এই একটা পদের তরকারীই শাশুড়ির খুব অপছন্দ। শেষমেশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আম্মা সেটা দিয়ে ভাত খাওয়া শেষে বলল,
— আলহামদুলিল্লাহ্ শান্তি কইরা খাইলাম। বৌমা বুঝছ তরকারি-মরকারি কিছুই না, নিয়তটাই হইল আসল।
অহনা শুধু মিটিমিটি করে হেসেছিল, কোনো কথা বলেনি। সেদিনের কথা কেন জানি মনে পড়ছে তার আজ। মনে মনে ভাবছে, তার নিয়ত তো শতভাগ শুদ্ধ। গতরাতে কিছু রান্না না করে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে সত্যিই সত্যিই সে অপরাধবোধে ভুগছিল। সেটা থেকেই শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলেছিল, আম্মা পা টিপে দেই। নিশ্চিত সে, তার নিয়ত একশভাগ খাঁটি। খুব চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান, চাওয়া পাওয়া, সুখ সাধনা, আহ্লাদ বাসনা সবকিছু এখন ওই একটা লাইনের মধ্যে এসেই কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যেভাবেই হোক, যা করেই হোক, সে আর বয়স্ক ওই মানুষদুটোর মুখে সেই লাইনটা একটিবারের জন্যেও শুনতে চায় না,
'পর কি কখনো আপন হয়!'
▪▪
অহনার হঠাৎ করেই আচার খেতে ইচ্ছে করছে খুব। এই জিনিসটা ছোটবেলা থেকেই ভীষণ প্রিয় তার। মনে পড়ে, ছোটবেলায় কেবল তারজন্য বাবা বাজার থেকে বস্তা বোঝাই বড়ই নিয়ে আসত। মা সেগুলো অনেক যত্ন করে, সময় নিয়ে রোদে শুকাতে দিত। বড় ভাইয়ার দায়িত্ব ছিল সকালবেলা চটের বস্তাটা নিয়ে ছাদে উঠা, বস্তা খুলে বড়িগুলো একটা বেতের পাটিতে মেলে দেয়া। আবার সন্ধ্যার আগ দিয়ে সেগুলো গুছিয়ে ছাদ থেকে নামানো। মাঝখানে বৃষ্টি হলে পড়িমরি করে ছুট। বড় ভাইয়া মুখে খুবই বিরক্তি দেখাত। অহনাকে বলতও মাঝে মাঝে,
— তোর জন্যই প্রতিবছর আমাকে এই এক্সট্রা পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
যদিও মুখে বহু হিল্লিদিল্লি কথাবার্তা বলত, কিন্তু ভাইয়ার জান অহনা। সেও সেটা জানে। মেঘ কালো হলে মার বলতে হতো না। নিজেই ছুটে ভাঙা প্রাচীর বেয়ে নিমেষেই ছাদে উঠে যেত বড়ইগুলো গুছিয়ে ফেলতে। বড় ভাইয়া জীবনেও একটি দানা আচার খায়নি। ছোটবেলা থেকেই টক জাতীয় কিছু সে আসলে সহ্য করতে পারে না। মা যখন সন্ধ্যায় সব এন্তেজাম করে আচার বানাতে বসত, হঠাৎ মনে হতো কানিকটা তেঁতুল দিলে ভালো হয়। সাথে সাথে ভাইয়ার ডাক পড়ত,
— শফিক, কয়ডা তেঁতুল আইনা দিবি বাবা!
ভাইয়ার তখন এসএসসি পরীক্ষার টেস্ট চলে। সবকিছু ফেলে ভাঙ্গা সাইকেল নিয়ে আধাঘন্টা পথ দূরত্বের বাজার আয়না বিবির হাটে চলে যেত। তেঁতুল আনতে আনতে ততক্ষণে বাবাও অফিস থেকে চলে আসে। তারপর বাবা, মা, বড় ভাইয়া, অহনা সবাই একসাথে চুলোর উপরে বসানো বড় পাতিলটার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকত, যেন গরুর মগজ রান্না হচ্ছে।
গরুর মগজের কথা মনে হতেই অহনা ফিচ করে হেসে ফেলে। এই একটা জিনিস, বছরে হয়তো দুই চারবারই রান্না হতো। কিন্তু যেদিন রান্না হতো সেদিন ভাইয়া আর বাবা যেন আবাহনী মোহামেডান। এমন ঝগড়া বেধে যেত অহনা নিজের পাতের থেকে একটু বাবাকে একটু৷ ভাইয়ার পাতে তুলে দিত। মাও তাই করত। সেই থেকেই মা আর তার বলাও শুরু,
— মগজ খাইতে পারি না। কেমব একটা কাঁচা কাঁচা গন্ধ। এএ্
অহনার এখন বেশিরভাগ সময়েই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। আর সেসব মনে পড়লেই চোখ থেকে রাজ্যের জল নামে। তার চোখে এত জল কবে জমল টেরই পায়নি অহনা।
এমন সময়ই জেবুন্নেসা কোমড়ে হাত দিয়ে হুট কটে ঘরে ঢুকে।তড়িঘড়ি করে চোখ মুছার চেষ্টা করে। কোমড়ের ব্যথা আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লে কি হবে, মাশাল্লাহ আম্মার চোখের পাওয়ার এখনো টনটনা। দেখে ফেলে বৌয়ের চোখে জল। এই শুরু হলো আরেক মুছিবত।
জেবুন্নেসা শুনবেই কী কারণে সে কান্না করছিল। এই কথা না শুনা পর্যন্ত কেউ তাকে শান্ত করতে পারবে না।
— বৌ কি হইছে গো। কানতাছো কেন। কও আমারে
— আম্মা না, এমনিতেই।
জেবুন্নেসা খেঁকিয়ে উঠে,
— ওই মিয়ে বেয়াদবে মতো মিছা কথা কও কেন! আমারারেও কিছু কওন যায় না। আমরা তোমার কিছুই না।
অহনার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিম্তু সে কাঁদেও না, কিছু বলেও না। শাশুড়ির কণ্ঠ এবারে কিছুটা নরম হয়,
— কে গো মিয়ে, রুমেলের জন্য মন পুড়ে? কালকাই ত কথা কইলা, নাকি কও নাই। কাইলকা ফোন করছোল না গো।
— না আম্মা কালকে ফোন করছে তো। অনেকক্ষণ কথাও হইছে।
শাশুড়ি গজগজ করে,
— পুলাডাও একটা আস্তা বডমাইস। ক্যারে তুই যদি অমন ফুটফুটে একখান বউরে ঘরে রাইখা বিদেশই যাইবি। বিয়া বইলি ক্যা। দুইটা বছর গেল। মিয়েডা এক্কেরে একলা। কাহাতক তার আর ভাল্লাগবো।
এবারে অহনা ভয় পায়। আল্লাহই জানে আম্মা ভুল বুঝতেছে কিনা! শেষমেষ দেখা যাবে, বিষয়টা এমনই জলঘোলা হয়েছে, রোমেলের কানে যাবে আর সে ভীষণ মন খারাপ করবে! রোমেলের মন কোনোভাবেই খারাপ করিয়ে দিতে চায় না। সে জানে ওখানে সেও খুব ভালো নেই। সারাক্ষণই তার কথা ভাবে। তাছাড়া রোমেল খুব চেষ্টা করছে এ বছরের শেষে এসে তাদেরকে নিয়ে যাবেও হয়ত। অবশ্য অহনা যদি একা যেতে চাইত, গতবছরেই আমেরিকায় চলে যেতে পারত। কাগজ পত্র ভিসা সবই রেডি ছিল। শ্বশুর শাশুড়িও পইপই করে বলেছে,
— যাও বৌমা যাও। আমরা দুইটা বুড়া মানুষের দেখতে দেখতে ঠিকই দিন চইলা যাইব।
অহনা মন থেকে সাড়া পায়নি। মানুষদুটোর উপর কেমন একটা মায়া জন্মেছে। যতদিন যায় উনারা যেন ছোট বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। একটুতেই গাল ফুলায়, একটুতেই রাগ করে, একটুতেই মুক হাউপ, কথা বন্ধ। অহনা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে, পা টিপে দিলে সাথে সাথে সব শেষ। যদিও শাশুড়ির রাগ ভাঙানো অতটা সহজ না, তবু হাল ছাড়ে না অহনা। সে আমেরিকায় চলে গেলে এই দুটো বু্ড়োবুড়ি সত্যিসত্যিই ভীষণ একা হয়ে যাবে। নিঃসঙ্গতার কষ্ট সহ্য করার মতো মানুষ এরা নয়। অহনা মাঝে মাঝে কষ্ট পায়, ভাবে সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে। চলে গেলেই, তাকে উনাদের কাছে আর এত কষ্ট পেতে হতো না।
অহনা রিস্ক নিতে চায় না। শাশুড়ির কাছে সত্য ঘটনা খুলেই বলে।
— আম্মা, ওগুলো কিছু না। রোমেল ভালো আছে। ইনশাআল্লাহ আমাদের এই বছরের শেষে নিয়েও যাবে, ও নিয়া এেমনশন কইরেন না তো আম্মা। হঠাৎ করে ছোটবেলায় মায়ের আচার বানানো দিনগুলার কথা মনে হইল। এইজন্য খারাপ লাগতেছিল আম্মা।
জেবুন্নেসা আর কিছু বলে না। বৌ কে যা বলতে এসেছিল ভুলে গেছে। অহনার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল কেবল। আবার কোমড়ে হাত দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে তার ঘরে চলে গেল।
ঘরে গিয়েই জেবুন্নেসা দারোয়ান আতিককে ফোন দিয়ে উপরে আসতে বলে। আতিকের হাতে একটা লিস্ট আর ৩হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়। তাকে শক্ত করে বলে দিল,
— লিস্টে যা যা লিইখা দিছি একটাও যান বাদ না পড়ে। আন্ধার মতো আবার যাই ধরায় দিব নিয়া চইলা আইবি না। একটু চোখ দুইটা খুইলা, হাত দুইটা দি দেইখা দেইখা সদাই আনবি। খারাপ কিছু আনলে তোর মাথায় ভাঙ্গব।
আতিক বলে,
— জে আচ্ছা আম্মা।
এই বুড়ি কাজ দিলে খুশিই হয় সে। সারাক্ষণই গজগজ করবে, খটমট বাঁধাবে কিন্তু বকসিস দেয়ার বেলায় অত্র বিল্ডিংয়ে এই আম্মাই সবচেয়ে বেশি দেয়। তাছাড়া ভালো কিছু রান্না হলেও ডাকে। প্লেট ভর্তি তরকারি খাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে,
— দুধ কলা দিয়া একটা কালসাপ পুষতাছি। ল, ধর। আরো লাগলে আইসা নিয়া যাইস। খাওনের সময় নয়া বৌয়ের মতোন লইজ্জা কইরা কোনো লাভ নাই।
আতিক একমাত্র চারতলার এই আম্মার বাজার করার সময়েই খুব ভালো মতো দেখেশুনে সদাই করে। এবং আরো আশ্চর্যের বিষয় যেটা আতিক নিজেও ভাবে, সবার বাজার করতে গেলে যেখানে দশ বিশ ত্রিশ যত পারা যায়, হাপিস করে দেয়, সেখানে এই চারতলার আম্মার একটা পয়সা এদিক সেদিক করতে পারে না। মনে আসলেও, নিজে নিজের গালে চড় মেরে মনকে ঠান্ডা করে।
অহনার শ্বশুর রহমান সাহেবের শরীরটাও আজকে অতটা ভালো না। সকালে নাস্তা করা থেকেই বিছানায়। এর মধ্যে একবার জেবুন্নেসাকে ঘরে ঢুকে আলমারির উপর থেকে কাগজ কলম নিয়ে কিজানি লেখতে দেখল। দেখে মনে হলো কোনো ফর্দই তৈরী করছে। রহমান সাহেব ঠিক মনে করতে পারে না, শেষবার কবে জেবুন্নেসাকে নিজ হাতে বাজারের ফর্দ লিখতে দেখেছে। একটা শব্দ লেখতে হলেও যে মহিলা বৌরে ডাকে, সে কী এমন বিষয় এত মনোযোগ দিয়ে নিজ হাতে লিখছে! রহমানের খুব আগ্রহ হয়। গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কি গো, কি লিখতাছো! দলিল দস্তাবেজ নাকি!
জেবুন্নেসা কাগজে লিখতে লিখতেই বলে,
— তোমার সব বিষয়ে এত আগ্রহ কেন বুঝিনা। একটা মানুষ হারাটা দিন কেমনে এইভাবে বিছানায় শুয়া বইসা কাটায় বুঝি না বাবা। আইলসার আইলসা মানুষ আমার দুচক্ষের বিষ।
রহমান সাহেব যতটা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ততটাই চুপসে যায়। ইদানিং বলে না, সবসময়ই জেবুন্নেসার মাথায় রাগ যেন বসে থেকে অপেক্ষাই করে। কোনোকিছু মনমতো না হলে সাথে সাথে সেটা ঝাঁপিয়ে বের হয়। রহমান আগেও তার রাগকে যমের মতো ভয় পেত, এখন ভয় পায় যমের থেকে বেশি।
দুঘন্টা পরেই আতিক এসে হাজির। দরজা খুলেছে অহনাই। হাতে বাজারের ব্যাগ দেখে কিছুটা বিষ্মিত। হঠাৎ আম্মা আবার কী আনাল! দুদিন আগেই আম্মাসহ গিয়ে সুপার শপ থেকে বাজার করে এনেছে। ফ্রিজে একফোঁটা জায়গা বাকি নেই। এখন কিছু ভরাতে হলে পাশের বাড়ির ভাবির ফ্রীজেই রাখতে হবে। অহনা বাজারের ব্যাগদুটো নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে। শাশুড়িও সেই সময়ে রানাঘরে ঢুকল।
— বৌমা তুমি ঘরে যাও। হালিমার মা আইসা এগলা গোছ করবে।
— এগলা কি আম্মা?
— মরো জ্বালা। তোমাগো সব বিষয়ে এত প্রশ্ন ক্যা গো। আমার কিছু মনে চাইতে পারে না।
বলতে বলতেই ব্যাগের ভেতর থেকে সদাইগুলো নামাতে শুরু করেছে অহনা। একটা করে জিনিস নের করে, আর তার চোখ বিস্ফারিত হয়,
শুকনা বড়ই, গুড়, আচারের মসলা, কালো জিরা, সরিষার তেল, বিট লবন, দুই দলা তেঁতুল...
— আম্মা এগলা কি?
— বউ, চউক্ষে দেখো না তুমি? এগলা আচার বানানির সারঞ্জাম। আমার জিব্বা আচার খাওনের লাইগা টগবগ করতাছে। তাই এইগুলান আনাইছি। এখন আমি নিজ হাতে এগলা দিয়া আচার বানাব। ক্যা তোমার কোনো সমস্যা আছে, ও ওই!
আকাশ ভেঙে অহনার চোখে পানি আসছে। সে জানে তার বড় ভাই আর শাশুড়ি একই গোত্রের। টক জাতীয় জিনিস তাদের শত্রু। আম্মার আচার খাওয়ার সাধ জেগেছে, মরে গেলেও বিশ্বাস করে না সে। মুখে ওড়না চাপা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের বিছানায় গিয়ে মুখ চাপে অহনা। চোখের পানি আটকে রাখার বিন্দুমাত্র শক্তি তার আর নেই। এমনকি সেটাকে আটকে রাখতে ইচ্ছেও করছে না অহনার...
▪▪▪
— আম্মা আমি কিন্তু এবার আর কোনো কথা শুনব না
— ঢং কইরো না তো বউ।
— ঢং হইলে হোক। একশ বার ঢং করব।
— দেখছ, তোমার ছেলের বউ কত বড় বেদ্দপ। আমার মুখের উপর কথা বলে।
— শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে অহনা এবার বলে,
জ্বি আব্বা আমি একটা বেশাল বেদ্দপ। এখন আপনাদের কিছু করার নাই। ছেলের বউ করে যখন আনছেন। নো ওয়ে।
রহমান সাহেব মিটিমিটি হাসে। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে এবার আলটিমেটাম দেয়ার মতো করে বলে অহনা,
— আম্মা, আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে নিবেন। কোনো কথা হবে না। আর যদি নিজ থেকে না যান, টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাব। কোনো কথা হবে না।
বলেই গটগট করে রূম থেকে বেরিয়ে নিজের রূমে যায়। পেছন থেকে শুনতে পায়, জেবুন্নেসা গজগজ করছে,
— কপাল আমার কপাল। আমার কপালেই এমন দজ্জাল একটা বৌ জুটল।
অহনা হাসে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি এখন থেকে পুরোপুরি রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে। আপন মেয়ে না পরের মেয়ে এইসব কথা তারা বললে মুখের উপরে ধমক দিবে। বহু সহ্য করেছে, আর না। মুখে মুখে কথা তো বলবেই, গালিগালাজ করলে কেঁদে ভাসাবে না বরং গালি খেয়ে সবকটা দাঁত একযোগে বের করে কেলিয়ে হাসবে। চারবছরে মুখ বুঁজে অনেক সহ্য করেছে। সম্মান দিয়েছে। কোনো একটা কথার প্রতিবাদ করেনি, যা বলেছে বাধ্য বাচ্চার মতো মেনে নিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে সেটা খুব বড় ভুল হয়ে গেছে, বিশাল ভুল।
রোমেল সবসময়ই বলে তার বাবা-মা মন্দ মানুষ না। আসলে মা একটু বদমেজাজি। উনার প্রথম সন্তান রোড এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর থেকে, আরো বেশি মেজাজ হয়েছে উনার। আর বাবা কখনোই মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে না৷ মা যা বলে যেভাবে বলে সবই সুড়সুড় করে মেনে দেবে। তবে উনার জিদ উঠলে আবার খবর আছে৷ পৃথিবী উল্টে গেলেও তিনি তার জিদে অটল থাকবে।
মানুষ দুটো জীবনে বহু কষ্ট করে, খেয়ে না খেয়ে দুই ছেলে আর এক মেয়ে পড়াশোনা করিয়েছে, মানুষ করেছে। রোমেলের বড় ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। রামপুরা থেকে একটা পাবলিক বাসে উঠতে গেলে, বাসের হেল্পার তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। অমনি পেছনের বাস তার মাথার উপর। কী যে এক বিভৎস দৃশ্য, মনে হলে রোমেল এখন কুঁকড়ে যায়। সেই ভাইয়ের মৃত দেহের আঁকড়ে মা সেদিন একটি কথাও বলেনি। একফোঁটা চোখের পানি ফেলেনি। শুধু ছেলের রক্তাক্ত মাথাটা কোলে নিয়ে বসে ছিল। আর বলছিল ছেলেকে কোনোভাবে কোথাও নিতে দিবে না। সে ওভাবেই মায়ের কোলে শুয়ে থাকবে। সেদিন মায়ের হাতে যেন অসুরের শক্তি। দুচারজন মিলেও তাকে সরানো যাচ্ছিল না। তারপর থেকেই মা স্বাভাবিকভাবে কারো সাথেই কথা বলতে পারে না। অহনা সব ঘটনাই শুনেছে রোমেলের কাছে। সে নিজে প্রথমবার শোনার পর খুব কেঁদেছিল। খুব মন খারাপ হয়েছিল। সবই ঠিক আছে কিন্তু শাশুড়ি মাঝেমাঝে এমন চ্যাটাং করে কিছু কথা বলে, গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। তারপর সে মন খারাপ করে বসে থাকে৷ খালি নেগেটিভ কথা মনে হতে থাকে।
অহনা দেখেছে একটুকু মন খারাপ হলে, শ্বশুর শাশুড়ির উপর একটু বিরক্ত হলে, তখন আরো আরো বেশি করে মন খারাপ আর বিরক্তিরা এসে তাকে চেপে ধরে। অহনার মনে হচ্ছে, সেগুলো খুব বলদের মতো কাজ হয়েছে। প্রথম থেকেই যদি সে শক্ত হতো, তাহলে জেবুন্নেসা বেগম এতরকম কথা বলার সুযোগ পেত না। নিজেকেই দোষারোপ করে অহনা। ঘরের একটা পাপোষ কিনবে অথবা ডাইনিং টেবিলের জন্য লবণদানি কিনবে সেখানেও যখন শাশুড়ির বাগড়া পেয়েছে, মেজাজ খুব খারাপ হতো। একসময় মনখারাপ করে নিজের মতো করে কিছু কেনা এই বিষয়গুলোই বাদ দিল। তাছাড়াও একটা কিছু কিনতে যাবে জেবুন্নেসা বলে উঠত,
— আমার পোলায় বিদেশ গিয়া দিনরাত্র পরিশ্রম কইরা টাকা কামাইতেছে, আর তুমি সেগুলান খালি নষ্ট করো। স্বামীর টাকারে পরের টাকা মনে কইরা যা ইচ্ছা তাই করো তোমরা।
অথচ অহনা কখনোই ভাবেনি রোমেলের পাঠানো টাকা তার নিজের টাকা না। সে যা কিছু করেছে, করতে চেয়েছে সেটা তো এই সংসারের জন্যই করতে চেয়েছে। সেটা কী করে নষ্ট হয়, এমন কথা শুনলে খুব বেশি মন খারাপ লাগত।একটা ভালো চাকরি পাবার শিক্ষা যোগ্যতা দুটোই আছে অহনার। শ্বশুর শাশুড়ি মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সে ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়েছে৷ উনারা অপছন্দ করে, ঘরের বউ বাহিরে গিয়ে কাজ করবে।মনে মনে খুব কষ্ট হলেও সংসারের শান্তির জন্য সেটা মেনে নিয়েছে। ভেবেছে স্যাক্রিফাইজটা নাহয় সে-ই করল। কিন্তু এখন তার মনে হয়, শাশুড়ি বা রোমেল কেউই এটাকে কখনো স্যাক্রিফাইজ হিসেবে একবারই ভেবেছে। এ জায়গায় অহনার দুঃখটা সবচে বেশি।
সব নিয়ন্ত্রণ, নাটাই সূতো সবই তার হাতেই ছিল। অথচ সে ঘুড়ি হয়ে গিয়েছিল। তারা যেভাবে যখন আকাশে তুলেছে, সে শুধু উড়েছে। রোমেল অবশ্য বলত,
— তোমার শ্বশুর শাশুড়ি হলো পুরনো দিনের মানুষ৷ আর তুমি শিক্ষিত, আধুনিকা। দুজন বৃদ্ধ মানুষকেও তুমি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো, তাহলে কিসের তুমি আধুনিক, কিসের শিক্ষা। তুমি একটু চেষ্টা করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, অহনা যখনই রোমেলকে সংসারের যেকোনো বিষয় বলতে গিয়েছে, ওসব মেয়েলি ব্যাপার, আমাকে টাইনো না বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। অথচ সে ইচ্ছে করলে, একটু দায়িত্ব নিয়ে শাশুড়ি আর তার মধ্যে সংযোগ সেতু তৈরি করে দিতে পারত। এটা তারই কাজ ছিল। সারা দুনিয়ার কাজকর্ম করতে পারে আর ঘরে এসে বৌ-শাশুড়ির কোনো বিষয় শুনলেই সেটাকে মেয়েলি ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেয়। এই বিষয়টা মানতে পারে না অহনা, রোমেলের উপর ভীষণ রাগ হয়।
অহনা যে চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু যখনই সে মানুষ দুজনের সাথে শক্ত হয়েছে, তারা এমনভাবে নিত বিষয়গুলো, নিজেরই মন খারাপ হয়ে যেত। বাবামার কথা মনে পড়ে। শক্ত ভাবটা ধরে রাখতে পারে না। রাজ্যের যত মন খারাপের সাথেই এতদিন যেন তার সখ্যতা ছিল। বিরক্তিরা ছিল তার প্রিয়তম সখী। ছোট খাটো মাঝারি সবরকম ব্যাপারেই অহনা তাদেরকে নেমন্তন্ন করে ঘরে ডেকে আনে, তারপর তাদের উপর চড়ে বসে বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করে। অহনা প্রতিজ্ঞা করেছে, পাল্টে ফেলবে তার পুরাতন মুখশ্রী।
আধাঘন্টা পর শাশুড়ি ঘরে গিয়ে দেখে, যেভাবে বলে গিয়েছিল সেভাবেই গা এলিয়ে বিছানায় শোয়া৷ কোনো কথা না বলে, সোজা গিয়ে শাশুড়িকে জাপটে ধরে বিছানা থেকে দাঁড় করাল অহনা। দাঁড় হয়ে গেছে যখন, আর বাধা দিতে পারে না জেবুন্নেসা। কোনো রকম জবরদস্তি ছাড়া অনুগত বাচ্চার মতো অহনার হাত ধরে ওদের ঘরের বড় বাথরুমটায় ঢুকল। আগে থেকেই পানি কুসুম গরম করে বালতিতে রেডি করে রেখেছিল। শাশুড়িকে সাবধানে একটা পিড়ির উপর বসাল। আজ আটদিন হলো জেবুন্নেসা গোসল করেনি। আগেও ঠান্ডা পানির প্রতি একটা ভীতি ছিল, ইদানিং সেটা যেন বহু মাত্রায় বেড়েছে। আছরের ওয়াক্তে একবার ওজু করে, পারলে সেটা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পর্যন্ত চালিয়ে দিতে চায়। পনেরদিনে এক-আধবার কোনোমতে গায়ে পানি ঢেলে গোসল সারে। অথচ ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছে, এই বয়সে প্রতিদিন গোসল করতে হয়। তাহলে শরীর ঝরঝরে থাকে, অন্য রোগবালাই সহজে কাছে আসে না।
গডকাল রাতে এই গোসল করা নিয়েই একদফা কথা চালাচালি হয়েছে। জেবুন্নেসা তাকে ধমক দিয়ে বলেছে,
— এটা আমার বাড়ী, এখন আমার নিয়ম অনুযায়ী সবকিছু হবে। তুমি পরের মেয়ে পরের মেয়ের মতো থাকো।
ব্যাস যাবে কই! অহনা এবার আর ছাড়েনি। সেও প্রায় খেঁকিয়েই উঠেছে,
— এ্যাহ্, আপনি বললেই হবে, আপনার নিয়ম অনুযায়ী সব চলবে। আম্মা এইসব মাতবরি জীবনে বহু করছেন। এখন আপনার দিন শেষ৷ একদম শ্যাষ। এটা আপনার বাড়ী হোক অথবা দারোয়ান আতিকেরই বাড়ী হোক, এখন থেকে এই বাড়িতে সকল কিছু চলবে আমার কথা মতো।
জেবুন্নেসা অহনার কথা শুনে রহমান সাহেবের দিকে তাকায়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
- শুনছ, শুনছনি। বেদ্দপ মাইয়াটার কথা বলার ধরণ দেখছ। আল্লাহগো এইও আমার দেখতে হইলো।
রহমান সাহেব খুব নিরীহ ভঙ্গিতে বলে,
- কই, কি দেখলা গো
- ও, কিছুই চোখে পড়ে নাই তোমার। চোখের ছানি কাটাও। এই মাইয়ার কথা শুনে আমি পুরা আকাশ থেকে পড়ছি, আর উনি কিছুই দেখলেন না।
রহমান সাহেব এবার ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে জেবুন্নেসার দিকে এগিয়ে যায়,
— কই কই, আকাশ থেকে পড়ছ, আল্লাহ গো এই বুড়া বয়সে কই না কই ব্যথা পাইলা, দেহি দেহি।
শ্বশুরের কথা বলার ধরণ দেখে অহনা খিলখিল করে হেসে উঠে৷ হাসিটা জেবুন্নেসার গায়ে শুকনো মরিচের ডলা লাগা জ্বালা ধরিয়ে দেয়। হুৎকার দেয় সে,
— আমি থাকব না। শত্রু নিয়া একঘরে থাকা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
অহনা ফোঁড়ন কেটে বলে,
— আচ্ছা আম্মা যায়েন। কবে যাবেন ঠিক করেন। আমি ব্যবস্থা করে রাখব। সে যেদিন যাবেন দেখা যাবে, কিন্তু কালকে সকালে আপনার গোসল করা কেউই ঠেকাইতে পারবে না।
রাতে খাবার পর শাশুড়ি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। রহমান সাহেব ডাইনিং টেবিল থেকে না উঠে বসেই রইল। অহনার মনে হলো উনি বুঝি কিছু বলতে চায়। নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে,
— আব্বা কিছু বলবেন?
— বৌমা বুঝছ, এই দুনিয়াতে যা কিছু সবই আরসি'র খেলা।
অহনা বুঝতে পারে না আরসি কি,
— আব্বা আরসি কি? RC cola?
শ্বশুর হো হো করে হেসে উঠে,
— আরে না। আর সি হইলো, রেগুলেটরি ক্যাপচার। এই পৃথিবীতে যত ব্যবসা বাণিজ্য যুদ্ধ বিগ্রহ রাজনীতি প্রেম ভালোবাসা সম্পর্ক যা কিছুই বলো সবই চলে এই আরসি'র উপর। দুপক্ষের মধ্যে একজন আরেকজনের মনোজগতকে প্রভাবান্বিত করা, অপর পক্ষের উপর আধিপত্য বিস্তার করা, সেটাই ক্যাপচার। আর রেগুলেটরি হইলো, রেগুলেট করা, কে আগে রেগুলেট করতে পারল, অন্যের মনে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারল। বুঝছ!
— অল্পবিস্তর মনে হয় বুঝছি আব্বা। একটু উদাহরণ দিয়ে বলেন।
— আচ্ছা বলি শোনো। পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটনা ঘটে ঘটবে সবকিছুর জন্যই দুটা পক্ষ থাকা লাগে। একপক্ষ থাকলে সেখানে কোনো ঘটনা ঘটবে না। ধরো আমেরিকা যদি একাই এই বিশ্বের রাজা হইত তাহলে তাদের ইরাকের সাথে, ইরানের সাথে যুদ্ধ করা লাগত না। ধরো তোমার শাশুড়ি আর তুমি, দুইজনে যদি সবকিছু একভাবে দেখতা, ভাবতে পারতা তাহলে সেটা হইত একপক্ষ। কিন্তু দুজন মানুষ দুইরকম ভাবনা হলেই দুইটা পক্ষ হয়ে যাবে। এখন এই দুইপক্ষের মধ্যে যে আরেকজনের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সে-ই বিজয়ী হবে। বৌমা সর্বক্ষেত্রে এই বিষয়টা মাথায় রাখবা। জেবুন্নেসা বেগম, তার পুত্র দুজনরেই আরসি থেরাপি দিবা। এই থেরাপি একেকরকম ক্ষেত্রে হবে একে আমি যে ভুল করছি তুমি সেইটা কইরো না মা।
অহনা শ্বশুরে কথার মানে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। পরের ঘরের মেয়েকে আপন হতে হলে রেগুলেটরি ক্যাপচার চালাতে হবে। শাশুড়িকে ওন করতে হবে। এই পৃথিবীতে আপনাতে কেউ কাউকে আপন করে নিতে পারে না। বিষয়টা সব জায়গাতেই একই, দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে।
অহনা খুব বুঝতে পারছে, এই দুইটা মানুষের জন্য এই বয়সে আসলে সোহাগ মাখা শাসন দরকার। এমন মানুষগুলো মন থেকেই চায়, ঘরের বৌ নিজের মেয়ে হোক৷ কিন্তু শুধু মনে মনে চাইলেই তো হয় না। ইচ্ছে থাকলেও চিরাচরিত কিছু সামাজিক ইগোর কারণে বাঙালি বউ বা শাশুড়ি কেউই নিজের জায়গা ছেড়ে একটু এগিয়ে আসে না। অথচ বিষয়টায় ছোটখাটো খানিক বনিবনা না থাকলে, সেটা দুপক্ষরই মনঃপীড়া কারণ হয়। জীবনকে অশান্তিময় করে তুলতে, এই সম্পর্কগুলোতে একটুখানি ভুল বুঝাবুঝিই যথেষ্ট। এমন সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব কে একবার যদি সৃষ্টি হবার সামান্যতমই সুযোগ দেয়া হয়, সেটা কেবল বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। কিন্তু অহনা বিশ্বাস করে, ভালো কিছু শুরু করতে চাইলে সেটা যেকোনো মুহূর্ত থেকেই করা যায়। এতদিন করেনি বলে এখন করা যাবে না, সে তো নয়। শ্বশুর শাশুড়ি বয়স বেড়েছে, আর তারা বেশি বেশি নাবালকের মতো আচরণ করে। অহনা মনে মনে নিজেকে দূরছাই করে, আসলে তারা তো বয়স বাড়ার সাথে নাবালকই হয়ে উঠে। জীবনের কত বোঝা, কত অশান্তি, কত টানাপোড়েন পার করে তারপরই তো মানুষ বয়সের কাছে পৌঁছায়। এই পর্যায়ে গেলে প্রতিটি মানুষই চায় তার জীবন অতীতের থেকে ভালো হবে। সারাজীবন জীবনের সাথে যুদ্ধ আর যুদ্ধ করে, সেই বয়সে পৌঁছেছে তারা। খুব স্বাভাবিকভাবেই, যুদ্ধের প্রতি তাদের একটা অনীহা তৈরি হয়, জীবনের প্রতি হয়ত কিছুটা বিরক্তিও। খুব ছোট ছোট বিষয়গুলো মানতেও কষ্ট হয় তাদের। অহনা বুঝতে চেষ্টা করে, তার যখন বয়স হবে, যখন কারো শাশুড়ি হবে, তার পুত্রবধূকে সে কিভাবে চাইবে! হিসেব করে দেখে সে, সেই চাওয়াটা খুব বেশি কিছু না, খুব বড় কিছু না। পুত্রবধূ তার খোঁজখবর নিবে, খানিকটা আদর করবে, সেবাযত্নের ক্ষেত্রে আন্তরিক হবে, তার কাছে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। খুব ছোট ছোট চাওয়া, কিন্তু মুখ ফুটে এসব বলা যায় না, নিজেও হয়ত তার পুত্রবধূকে বলতে পারবে না, আমি তোমার কাছে এগুলো চাই। এটা বলার কোনো বিষয়ও না। অনুভব করতে হয়।
বিষয়টা গতকাল রাতে খুব হঠাৎ করেই অহনার অনুভবে এলো। ভেবে দেখল, আসলেই তো সে পরের মেয়ের মতোই থেকেছে, বকা শুনে দূরে চলে গেছে, মন খারাপ করেছে। অথচ যেভাবে নিজের মায়ের ক্ষেত্রে করেছে, শাশুড়ির ক্ষেত্রেও তা এককানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে পারত! মা যখন তাকে বকত, মন খারাপ হতো ঠিকই কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সব ভুলে গিয়ে আবার মায়ের গলায় ধরে আদিখ্যেতা করেছে, আব্দার করেছে। মা অন্যায় কিছু করলে কী শাসনই না করেছে। এই বাড়ীতে এসেছিল যখন অহনা তেমনই ভেবেছিল, শ্বশুর শাশুড়িকে নিজের বাবামার মতো করেই দেখবে। কিন্তু কোথাও যেন, কী একটা আড়ষ্টতা! ইচ্ছে হতো সবকিছু সামলে নিবে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, তার কী ঠেকা পড়েছে। মানুষ এমন এক জীব, নেগেটিভ বিষয়কেই সবসময় সর্বক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। নেগেটিভ চিন্তার দৌড়ের গতিবেগ ভালোকিছু চিন্তা করার গতি থেকে কয়েকশো গুণ বেশি। অহনাও তাই বারবার নেগেটিভ ভাবনার কাছেই ধরা পড়েছে। নিজেকে শক্ত করেছে এবার, যত নেগেটিভ মনের মধ্যে আসুক, ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে। পজিটিভলি জীবনটাকে দেখবে। এখন থেকে শাশুড়িকে সে শাসন করবে, আদর করবে। সে নিজের সাথে চ্যালেঞ্জ করেছে, শাশুড়ি জীবনে আর কখনো একটিবারের জন্যেও যেন বলার সুযোগ না পায়, সে পরের ঘরের মেয়ে, এভাবেই সে সম্পর্কটাকে গড়বে।
পিড়িতে বসিয়ে সাবান দিয়ে ডলে শাশুড়িকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে অহনা। জেবুন্নেসার মনে পড়ে, ছেলের বউ হয়ে ঘরে আসার আগে থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে মনের মধ্যে একটা অজানা দ্বন্দ্ব বিরাজ করছিল। বিষয়টা এমন না, অহনা বলেই তার এমন মনে হতো। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েটাকেও রোমেল যদি বউ করে আনত, জেবুন্নেসার মনে সেই একই অজানা আশংকাই বিরাজ করত।
জেবুন্নেসা সংসার জীবনের হিসেব মেলায়, দেখতে পায় দোষ আসলে অহনার না, দোষটা হয়ত তারো না। মূল দোষ এই সম্পর্কটার প্রকৃতিতে, এর নামেই- সেটা হলো মনোজগতে ধারণ করা বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক। এটা যে জেবুন্নেসার মনে আপনা থেকে এসেছে তাও না। পুরো সমাজটাই যেন একসাথে বলেছে, বলছে, পুত্রবধূ মানেই পরের ঘরের মেয়ে। টেলিভিশন পেপার পত্রিকা নাটক সবাই মিলে জেবুন্নেসাকে ধরে বেঁধে যেন শাশুড়ি বানিয়ে দিয়েছে। নিজের আত্মীয় স্বজন, এমনকি ছেলেমেয়েদের ভাষাও ছিল একই, তুমি শাশুড়ি। কেউ বলেনি, কেউ দেখিয়ে দেয়নি একটিবারের জন্যও জেবুন্নেসা তুমি কিন্তু মেয়েটির শাশুড়ি না, তুমি অহনার মা। নিজের দোষের কথা মনে পড়ে জেবুন্নেসার। যতকিছুই করেছে অহনা, সবকিছুতেই আশংকা করেছে সেটা মন থেকে করছে না, ছেলেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে, তাদেরকে পছন্দ করে না— এই ভাবনাগুলোই ঘুরেফিরে মাথায় এসেছে। জেবুন্নেসার খুব কষ্ট হচ্ছে ভেবে, সে জানে, খুব ভালো করেই জানে, মেয়েটা এই ঘরে আসার পর কোনো একটি মুহূর্তের জন্যেও তার সাথে মা হয়ে কথা বলেনি, কাছে ডাকেনি; যেই জেবুন্নেসা অহনার সাথে যা কিছুই করেছে, আসলে সে ছিল একজন শাশুড়ি, কেবল শাশুড়িই।
অহনা খুব যত্নে তার গায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে। কুসুম কুসুম সেই গরম পানির সাথে জেবুন্নেসার চোখ বেয়ে টপটপ করে পড়তে থাকা চোখের পানিও মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
(সমাপ্ত)