-মিলিটারি ক্যাম্পে আছিন(ছিলো) এমুন কুনো মাইয়্যা মাইনসের এই গেরামে জাগা(জায়গা) অইবো না। আইজ সুরুজ ডুবুনের আগে তুই তর পেটের পাপ লইয়্যা গেরাম থেইক্যা বাইর যাইবি।
জমির আলী ভুবনপুরের গ্রাম-প্রধানদের পক্ষ থেকে গ্রামের ছোট-বড় সকলের সামনে আয়েশা আক্তারকে কথাগুলো বলে। আয়োশা দৃষ্টিটা দৃঢ় করে গ্রাম প্রধানদের মুখগুলোর দিকে তাকায়। মিলিটারি ক্যাম্পে থাকার সময় এদের মধ্যে কয়েকজকে দেখেছিলো তাই চেহারা চিনতে পারে। এরা প্রায়ই ক্যাম্পে যেতো মুক্তিবাহিনীর খবর নিয়ে।
আয়েশার খুব ইচ্ছে করচ্ছিলো চিৎকার করে বলতে,
-আমি ইচ্ছা করে পাকিস্তানি মিলিটারির কাছে যাই নাই। জমির আলী তুই আমার বাড়ি দেহাইয়্যা দিছিলি। জোর কইরা মিলিটারির গাড়িতে তুইল্যা দিছিলি। যে গেরাম আমার ইজ্জতের বদলে স্বাধীন অইছে আইজ হেই গেরাম থেইক্যা তুই আমারে কেমনে বাইর করস? রাজাকারের বাইচ্যা।
কিন্তু হায়! সে কিছু বলতে পারলো না। বলার মতো মুখ তার নেই। ছয় মাস মিলিটারি ক্যাম্পে ছিলো আয়েশা। এই সময় প্রতিদিন ঐ হায়েনাগুলো তার শরীর খুবলে খেয়েছে। তার পরিণতি হিসেবে আজ একটা অনাগত জীবন তার পেটে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। একথা আশ্রয় কেন্দ্র চিকিৎসাধীন থাকাকালীন সময়ে জানতে পেরেছে।এক দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে যখন নিজের ঘরে ফিরে আসে তখন পরিবার তাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
আয়েশার পায়ের নিচের মাটিতো তখনই সরে যায় যখন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসা করে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে দেখে তার সেখানে কোন স্থান নেই। তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ কলঙ্কিনী বউ নিয়ে তো ঘর করা যায় না। যতই হোক-না সে বীরাঙ্গনা।
তাই আয়েশা বিচার নিয়ে এলাকার প্রধানদের কাছে এলো। কিন্তু সেখানেও দেখা মিললো হতাশার। উল্টো তাকে গ্রাম ছাড়া হওয়ার রায় শোনানো হয়।
রায় শুনে মাথা ঘুরে পড়ে যায় আয়েশা।
একটা মেয়ে দৌড়ে আয়েশাকে ধরতে কয়েক পা বাড়াতেই হুংকার দিয়ে উঠে জমির আলী,
-দূরে থাক বেউকুফ মাইয়্যা মানু! এইটা একটা নষ্টা নরকের কীড়া! এই নষ্টারে ছুঁইলে তোরে আর তোর বাড়ির হগলতেরে(সবাইকে) এক ঘইরা করমু।
হুংকার শুনে মেয়েটা ভয়ে দশ পা পিছিয়ে যায়।
যেখানে আয়েশার কোন স্থান নেই সখানে তার অনাগত সন্তান কি করে স্থান পাবে? তাও আবার এমন বাচ্চা যার নির্দিষ্ট কোন পিতৃপরিচয় নেই।
-ঘটনাটা ১৯৭২ সালের।
ষোল-সতের বছরের এক নিরপরাধ নারী তার নিজের ও অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অথৈই অন্ধকার ডুবে যাচ্ছিলো। বলতে পারেন অফিসার আয়েশা আক্তার নামে ঐ বীরাঙ্গনার সাথে এরপর কি হয়েছিলো?
জোড়া খুনের আসামী হিসেবে যাকে ধরে এনেছে তার মুখে স্বাধীনতা যুদ্ধের কাহিনী শুনতে বেশ অবাক লাগছে অঙ্কুর মাহমুদের । অপরাধী বা নিরপরাধ সবাই এ সময় একটাই কথা বলে,
-বিশ্বাস করুন আমি কিছু করি নি আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।
কিন্তু এই ভদ্রমহিলার কথা শুনে অবাক আর সাথে সাথে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে অঙ্কুর। আর এই মহিলা এতো সুন্দর করে কাহিনী বলছে যে অঙ্কুরের মনে হচ্ছ সম্পূর্ণ ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। এই প্রথম খুনের তদন্ত আগে আয়েশার কি হলো সেটা শোনার ইচ্ছে হচ্ছে । তাই আবেগ প্রবণ হয়ে অঙ্কুর বলেই ফেলে,
-কি হয়েছিলো?
একটা ধূর্ত নেকড়ের মতো হেসে মহিলাটি বলে,
-সে তো আপনার মতো আইনের রক্ষকরা ভালো বলতে পারবেন। দেশের ইতিবৃত্ত আর মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস মুখস্থ না পারলে সরকারি চাকুরি হয় না। তো আপনিই বলুন দেখি কি হয়েছিলো আয়েশার মতো বীরাঙ্গনা সাথে? আর এখন কী হচ্ছে আপনার সোনার বাংলায়?
মহিলাটির হেয়ালি কথা আর হাসির মানে ইন্টারোগেশন রুমে থাকা কেউই বুঝতে পারলো না। অঙ্কুর নেহাতই কৌতুহলে জিজ্ঞেস করে,
-আপনি কি বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।
ঝিলের মতো গভীর কালো চোখে ভদ্রমহিলা একটা স্থির বিষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অঙ্কুরের দিকে। সাহসী পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও সামনে বসা আসামীর অদ্ভুত দৃষ্টিতে গা হিম হয়ে যায় অঙ্কুরের।
মহিলাটি কর্কশ গলায় বলে,
-আমি তো স্পষ্ট করেই বলছি স্বাধীনতার উনপঞ্চাশ বছর পরেও যে দেশে সাত মাস থেকে সত্তর বছরের নারী ধর্ষিতা হয়। শাস্তির বদলে শুধু ফেসবুকে প্রতিবাদ হয় সেই দেশে আপনি আমার মতো নিরপরাধ একজনকে খুনের আসামী বানাচ্ছেন এ আর নতুন কি? তা সত্যি করে বলুনতো কার কাছ থেকে টাকা খেয়ে আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন?
এক মহিলা অফিসার রেগে ঠাস করে গাল বরাবর থাপ্পড় দিয়ে বলে,
-Bitch.
-নাফিসা! নিজেকে সামলাও। তোমাকে কে বলেছে গায়ে হাত দিতে?
অঙ্কুর ধমক উঠে নাফিসার উপর।
নাফিসার শুরু থেকেই এই মহিলাকে অসহ্য লাগছে। তার প্রথম কারণ হলো মহিলার অসহ্য রূপ আর দ্বিতীয়ত ব্যক্তিত্ব। মানে খুনের আসামী দেখতে হবে বিদঘুটে আর এই মহিলা!
অত্যাধিক সুন্দরী, হলিউড সিনেমার ডাইনির মতো। শুধু মাথায় টুপিটা নেই।
উহ অসহ্য!
মানে এতো নিঁখুত সুন্দরী হওয়াটা কও খুব প্রয়োজন ছিলো? সোজা কোমড় অব্দি লম্বা কালো চুল, ফর্সা গাল কালোহরিণীর মতো চোখ। নাফিসার অবাক লাগছে এই ভেবে যে এতো গরমে এই কালো কাপড় পড়ে সে বসে আছে কিভাবে? তার উপর সে এতোটাই পরিপাটি মনেই হচ্ছেনা রিমান্ডে আছে বরং মনে হচ্ছে সে কোন রূপকথার রাজ্যের রাজকন্যা আর এখন নিজের রাজসভায় বসে আছে । নাফিসা তো ধরেই নিয়েছে ডাইনীটা কালোযাদু জানে। আর সে নিজের রূপ দেখিয়ে অঙ্কুরকে ফাঁসাতে এসেছে। যদিওবা রূপে পাগল হওয়ার মতো পুরুষ অঙ্কুর না কিন্তু নাফিসা মেয়ে হয়ে এর আত্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানে কতটা মনোমুগ্ধকর অভিব্যক্তি থাকলে খুনের দায়ে গ্রেফতার হওয়ার পর রিমান্ডে বসে অফিসারকে কাহিনী শুনানো যায়? আর সেখানে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকে আগ্রহী হয়ে তার কথা শুনতে থাকে। নাহ নাফিসা আর ভাবতে পারছিলো না তাই থাপ্পড়টা লাগিয়ে দেয়। কিন্তু অঙ্কুরের ধমক খেয়ে আমতা আমতা করে বলতে থাকে,
-I am sorry sir. Actually she is insulting you.
তাকে ইশারায় থামিয়ে অঙ্কুর বলে,
-আমি খুবই দুঃখিত । আসলে নাফিসা মাথা গরম করে..
থাপ্পড়ের চোটে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করে, নিজের গালে হাত বুলাতে বুলাতে ভদ্রমহিলা শান্ত গলায় বলে,
-আআ! আপনার দুঃখ পাওয়া উচিত। তবে বিনা ওয়ারেন্টে আমাকে রিমান্ডে নেওয়া কিংবা আমার গায়ে হাত তোলার জন্য না বরং এইজন্য যে আপনার থানার মহিলা পুলিশ এখনো বাংলা বলতে পারে না। সত্যিই ব্যাপারটা দুঃখজনক উনি দেশে থেকে বাংলা বলতে পারেন না অথচ আমি দশ বছর আমেরিকার মতো দেশে কাটিয়ে আসার পরও বাংলা ছাড়া ঠিকমতো কথা বলতে পারি না।
অঙ্কুর কিছু বলার আগেই অন্য একজন অফিসার এসে বলে আসামীর উকিল জামিন নিয়ে এসেছে।
মহিলাটি শয়তানের মতো হেসে অঙ্কুরকে বলে,
-তখনই বলেছিলাম আমাকে এক ঘন্টার বেশি থানায় আটকে রাখা আপনার ক্ষমতার বাইরে। মাঝখান থেকে আমার সময় নষ্ট। একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাওয়ার ছিলো। একটা পরামর্শ দেই ভবিষ্যতে এমনটা করবেন না আমার বিরুদ্ধে সত্য প্রমাণ বের করার চেষ্টা করুন ; কে জানে হয়তো আমি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে দিলাম।
সে চলে যাওয়ার আগে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলে,
-তুমি আমাকে আমার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলে। আমার ভাল ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে স্কুলের সবাই আমাকে Bitch বলেই ডাকতো।
নাফিসা বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে চলে গেলে নাফিসা পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে আর জোরে জোরে বলে,
- দেমাগি! Crazy! Bitch!
অঙ্কুর নাফিসার রাগ দেখে হেসে বলে,
-I agree she is। তবে ত্রিশ হাজার কোটি টাকার একমাত্র উত্তরাধিকারীণির দেমাগ থাকা স্বাভাবিক।
রুমে থাকা সবাই চরম বিস্ময়ে বলে উঠে,
-ত্রিশ হাজার কোটি!
অঙ্কুর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
-হুম। ভদ্র মহিলার নাম জান্নাতুল বিনতে আজিজ মুক্তি। আজিজ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের সম্ভাব্য মালিক।
একজন অফিসার বলে,
-এই তাহলে সে যে নিজের বাবার উপর কেস করেছে সমস্ত সম্পত্তির জন্য? কয়দিন আগে খবরটা ফেসবুকে বেশ ভাইরাল ছিলো।
অঙ্কুর মাথা নাড়িয়ে বলে
-হুম এই হলো সেই। গত দশ বছর বিদেশে ছিলো মায়ের এক্সিডেন্টের খবর শুনে দেশে ফিরে। সবাই ভেবেছিলো মায়ের মৃত্যু শোকে ভেঙে যাবে কিন্তু না মাকে কবর দেওয়ার আগেই মামলা মোকদ্দমা শুরু করে।
নাফিসা রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলে,
-I am absolutely right. She is a bitch. মানে কোন মেয়ে মায়ের মরার পর দোয়া-দরুদ বাদ দিয়ে মামলা করে তাও সম্পত্তির জন্য।
অঙ্কুর খানিকটা হেসে বলে,
-কে জানে সে আসলে কি? তবে আপাদত সে জোড়া খুনের প্রধান আসামী। তার সম্পত্তির প্রধান দুই অংশীদার এক চাচা আর ফুফাতো ভাই গতকাল খুন হয়। কিন্তু অদ্ভুদ ব্যাপার হলো প্রধান আসামি হিসেবে তাকে গ্রেফতার করার জন্য আমি ওয়ারেন্ট পাই নি। তাই আইজি সাহেবের সাথে আলোচনা করে এমনি তুলে এনেছিলাম। কিন্তু লাভ হলো না টাকার জোর। এক ঘন্টাও থানায় রাখতে পারলাম না। আর ইনি এতো ধূর্ত যে খুনের ব্যাপারে টুঁশব্দটিও করলো না।
নাফিসা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে,
-স্যার ভাববেন না। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আপনি চেষ্টা চালিয়ে যান আমি নিশ্চিত এই শয়তান মহিলা বাঁচতে পারবে না।
অঙ্কুর দৃঢ়তার সাথে বলে,
-ঠিক বলেছো। আমি এতো সহজে দমে যাবো না। অপরাধীকে খুনের সাজা দেবোই। সবচেয়ে বড় কথা অপরাধের কারণটাও বের করতে হবে। এত নৃশংসভাবে কেউ কেন খুন করলো?
-তা যা বলেছেন। লাশ দুটো দেখে আমার বমি পাচ্ছিলো। পুরো শরীরের চামড়া ছাড়ানো। কতটা ঘৃণা মনে পোষণ করলে কেউ কাউকে এভাবে খুন করতে পারে ভাবা যায়?
-হুম এই ঘৃণার কারণটাইতো বের করতে হবে। চলুন কাজে নামা যাক। আপনি আর নাফিসা মুক্তি আর তার ফ্যামিলি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত খোঁজ নিন। প্রতিটা তথ্য আমাকে জানাবে। ফোনে না পেলে মেসেজ অথবা ওয়াটাসঅ্যাপ করবেন। আমি মুক্তির উপর নজর রাখবো। একে গ্রেফতারের পর পরই আইজি স্যার ফোন করেছিলো অনেক বেশি হাই প্রোফাইল কেস তাই খুব তাড়াতাড়ি আর গোপনীয়ভাবে তদন্ত করতে হবে। নাফিসা আমার হয়ে আর একটা কাজ করো। খোঁজ নিয়ে দেখো আয়েশা নামে কোন বীরাঙ্গনা নারীর খোঁজ পাও কি না।
নাফিসা কিছুটা বিরক্ত আর অবাক হয়ে বলে৷
-স্যার আপনি ঐ মেয়েটার কথা এতো সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছেন?
-কারণ আমার মন বলছে ওর বলা কাহিনীর সাথে এই কেসটার মিল রয়েছে।
তখন অঙ্কুটের ফোনটা বেজে উঠে। রিসিভ করতেই মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।
আনমনেই বলে উঠে,
-নিজের বাড়ি না গিয়ে কোথায় ঐদিকে কোথায় যাচ্ছে?
এরপর সে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলে নাফিসা জিজ্ঞেস করে,
-কি হলো?
চিন্তিত হয়ে অঙ্কুর বলে,
-যতটা সহজ ভেবেছিলাম কেসটা ততটা সহজ নয়। তোমাদের যা বললাম তা করো।
এরপর সে বের হয়ে যায়।
।
।
-কি নিষ্ঠুর নিয়তি! দেখো না আমার নাম মুক্তি কিন্তু তারপরও দশ বছরের জন্য একরকম জেলখানায় বন্দী ছিলাম। জানো, দেশের মাটিতে পা রাখতেই প্রথম মাথায় যে নামটি এসেছিলো তা হলো নীলয়। চেয়েছিলাম ছুটে তোমার কাছে চলে আসতে কিন্তু পারে নি কারণ তুমিতো নিজেকে দশ বছর আগেই গুটিয়ে নিয়েছিলে। এই ইন্টারনেটের যুগেও যে কাউকে খুঁজে পাওয়া এতো দুষ্কর হবে তা আমার কল্পনাতীত।
সামনে দঁড়ানো যুবকটির দুহাত শক্ত করে ধরে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে কাঁদতে থাকে মুক্তি। কিন্তু যুবকের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে নিজেকে খানিকটা সামলে জিজ্ঞাসু নয়নে মুক্তি নীলয়ের দিকে তাকায়।
দশ বছরের অনেকটা বদলে গেছে নীলয়। এখন সে আর হালকা পাতলা ছিপছিপে গড়নের স্কুলের সেই অবুঝ বালক নেই । আজ সে সুঠামদেহী আকর্ষণীয় সুপুরুষ। যেমন উচ্চতা তেমন গড়ন। চেহারাতেও কঠোর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। কিশোর বয়সের ভাললাগার ব্যাপার না থাকলেও মুক্তি নিশ্চিত আজ নীলয়ের সুদর্শন চেহারায় ঘায়েল হতো।
মুক্তি ভেবেছিলো নীলয় তার কান্না সহ্য করতে পারবে না, হয়তো আবেগী হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরবে কিংবা তার চিবুক ধরে অশ্রু মুছে দেবে। তার কপালে ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে নিজের প্রশস্ত বুকে মুক্তিকে টেনে নিবে। দশ বছরের জমানো দুঃখের জোয়ালাকে শান্ত করে দিবে। কিন্তু সে এসব কিছুই করলো না। নীল চোখের যুবকটি যেন সময়ের সাথে সাথে নিজের সব কোমলতা বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে।
নীলয় হাত সরিয়ে নেয়।
কঠিন আর দৃঢ় গলায় বলে,
-বের হয়ে যাও। না হলে বাধ্য হবো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে।
নিজের প্রতীক্ষার তেতো ফল কেউ মেনে নিতে পারে না। মুক্তির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। নীলয়ের কঠোরতা সহসা তার চোখে পড়লো না। সে ভাবলো হয়তো নীলয় তাকে চিনতে পারে নি। তাই এমন বলছে।
তাই সে দু'হাতে নীলয়ের বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
- আমি.. আমি মুক্তি, আমাকে তুমি চিনতে পারছো না?
নিজেকে ছাড়িয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নীলয় বলে,
-মানুষ যতই চেষ্টা করুক নিজের জঘন্য অতীতের ছায়া থেকে কখনোই মুক্ত হতে পারে না। তুমি আমার সেই অতীত, তাইতো দেখা মাত্রই তোমাকে চিনতে পেরেছি। তবে এখন অতীতের মতো ভুলটা আর করবো না। কারণ তুমি দশ বছর আগে যা ছিলে এখনো তাই আছো। বাইরে থেকে রূপবতী আর ভেতরে কুৎসিত-কদাকার জঘন্য। একটা নরকের কীট!
নরকের_কীট পর্বঃ১