#মুক্তির_ওপারে
#পর্ব-২
#ইশিতা আদনিন
ইরার আসতে লেট দেখে নাফিসা চৌধুরী বকাবকি শুরু করে দিলো।
"একটা পাউডার আনতে পাঠালাম, তাতেই উনার এত দেরী হচ্ছে, সুযোগ পেয়ে না জানি কোন নাগরের সাথে গিয়ে গল্পে মেতে আছে। "- মিসেস চৌধুরী কথাটা বলেই শুনে কলিংবেল বাজছে। নীরাকে গিয়ে দরজা খুলতে বললো
।
নীরা এসে দরজা খুলে বিশাল বড় ধাক্কা খেলো। দেখে ইরাকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে একটা হ্যান্ডসাম ছেলে, ছেলেটি গায়ে কালো ব্লেজার, ভিতরে সাদা টি শার্ট, জিন্স , হাতে দামী ঘরি, পারফিউমের ঘ্রান। তার কোলে ইরা শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ। নীরা অবাক হয়ে গেলো আর কিছুটা ভয় ও পেলো।
- "আজ কপালে শনি আছে রে বোন। না জানি কি করে মা তোমাকে আল্লাহ জানে! "
"দাড়িয়ে না থেকে দরজা থেকে সরুন প্লিজ। উনাকে শুইয়ে দিতে হবে। উনি খুব অসুস্থ।" - কথাটি বলে মাশফিক নীরাকে উপেক্ষা করে ভিতরে ঢুকে গিয়ে ইরাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
পুরুষ কন্ঠ পেয়ে নাফিসা চৌধুরী নীরাকে ডাক দিলো।
- কে এসেছে নীরা! পুরুষ মানুষের গলা শুনলাম।
"মা, ইরা আপু অজ্ঞান হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি এদিকে এসো? কেনো তুমি মেয়েটার সাথে এমন করো বুঝিনা আমি! " - মায়ের কাছে গিয়ে বললো নীরা।
নীরার কথা শুনে ওর মা ড্রয়িংরুমে এসে চমকে গেলো।
মাশফিক নীরার দিকে তাকিয়ে বললো, " আপনি প্লিজ এক গ্লাস পানি নিয়ে আসুন। উনি অনেকক্ষন হলো জ্ঞান হারিয়েছে।"
নীরা গিয়ে পানি নিয়ে আসলো কিন্তু নাফিসা চৌধুরীর চোখে মুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট। উনি ইরার কাছে না গিয়ে মাশফিক কে প্রশ্ন করলো,
- আপনি ওকে কোথায় পেয়েছেন? আর আপনি ই বা কে?"
মাশফিক মনে মনে ভাবলো, "মেয়েটার সাথে উনি এমন আচারন করছে কেনো? অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, আর মহিলার কথার কি ধরন! কাজের মেয়ে বলেতো মনে হয় না। অনেক মানুষ আছে যারা কাজের লোকদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু তাতো মনে হয়না। তাহলে উনি এত নির্দয় আচারন করছে কেনো!"
তাই সে কোন কথার উত্তর না দিয়ে ইরার মুখে পানি ছিটিয়ে দিতে লাগলো । অনেকক্ষন পানি ছিটানোর পরে ইরার জ্ঞান ফিরে এলো। ইরা চোখ মেলো দেখলো ও ঘরে শুয়ে আছে। একটু সামনেই চক্ষু লাল করে তাকিয়ে আছে ইরার খালা। উনাকে দেখেই ইরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। উঠেই প্যাকেট খুঁজতে লাগলো।
"এই আপনি উঠছেন কেনো? আর কি খুঁজছেন? আমাকে বলুন!"- মাশফিক বলে উঠলো।
এতক্ষণে ইরার খেয়াল হলো, ওর পাশেই একটা ছেলে বসে আছে, ছেলেটির গায়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া। তাড়াতাড়ি গায়ের কাপড় চোপড় ঠিক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
মাশফিক ইরার খালাকে যা যা হয়েছে বললো। নাফিসা চৌধুরী খুব কষ্ট করে মুখে হাসি এনে বললো,
- ধন্যবাদ। কষ্ট করে নিয়ে আসার জন্য। বসুন আপনাকে চা দেই।
- না, না । আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি প্লিজ উনাকে দেখেন। ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যান। এটা বলে মাশফিক বেড়িয়ে গেলো। নাফিসা চৌধুরী তার সাথে আলাপ করার সময়টুকু পেলেন না। কে এই ছেলে তাও জানা হলো না।
........
মাশফিক বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নাফিসা চৌধুরী ইরার কাছে এসে দাড়ালেন।
" এই মাইয়া নাটক তো ভালোই জানোস তুই। যেই দেখলি সুন্দর পুরুষ মানুষ সামনে আইছে, তখনই পড়ে যাওয়ার নাটক করলি? ভাব ধরস যে কিছুই বুঝোস না, পেটে পেটে এত শয়তানি তোর? একেবারে কোলে চড়ে বসলি! এতটুকু পথ গিয়েই তুই পড়ে যাওয়ার নাটক করলি? মানুষ দেখাতে এসব করেছিস! আমি তোকে ভালো পাই না, সেটা বুঝাতে গেছস! নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে। পরের উপর বসে বসে খায়,আবার তাদেরই অপমান করে! বাপ মা তো মরে গিয়ে বাঁচছে। এখন আমাদের মান সম্মান খাওয়ার ধান্দা। যত্তসব।"- চিৎকার দিয়ে বললো ইরার খালা।
- মামনি, তুমি ভুল বুঝতেছো। আম্মু আব্বুকে নিয়ে কথা বলিও না প্লিজ! আমার শরীর সত্যিই খুব খারাপ ছিলো.....
" মা, প্লিজ! তুমি একটু চুপ করো। ইরাপু সত্যিই শরীর খারাপ ছিলো। তুমি আমাকে বলতে পারতে! আর ঐ লোক তো বলেছে যে ইরাপু উনাকে দেখতে ও পায় নি।" - মায়ের অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুনে সহ্য করতে না পেরে উত্তর দিলো নীরা। এতে বিপত্তি আরো বাড়লো।
-" এই মেয়ে, তুই তো আমার মেয়েটাকে বশ করেছিস? আমারই মেয়ে আজ আমার মুখের উপর কথা বলে! তোর কারনে আমার সংসারে যত অশান্তি। এসেছিসই তো সংসারের শান্তি নষ্ট করতে। কেনো যে তোকে আনতে গেলাম!"-
নাফিসা চৌধূরী এসব কথা শুনে নীরা চলে গেলো। পরে ওর মা চলে যাওয়ার পর লুকিয়ে লুকিয়ে ঔষধ এনে দিলো ইরাকে।
........
মাশফিক ইরাদের বাসা থেকে বের হয়ে জুতা ঠিক করতে নিল। তখনই শুনলো বাসার ভিতর থেকে চিৎকার চেচামেচি। তখন সে দাড়িয়ে ওদের সব কথা শুনলো কিন্তু ভিতরে গিয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই। রাগে নাক মুখ লাল হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
-"উনি কি মানুষ নাকি পশু? পশু ও তো অসুস্থ প্রাণীর প্রতি দয়া দেখায়। আর কি! ছি! কত কষ্টে মেয়েটা আছে কে জানে!"
মেয়েটা যে ওদের আপন কিছু হয়না সেটা সে স্পষ্ট বুঝে গেলো।
এর মধ্যে ড্রাইভার চলে এলো ব্যাগ নিয়ে। বললো,
- স্যার কোন সমস্যা? দাড়িয়ে আছেন যে?
- না কাকা, চলুন, উপরে যাই।
মাশফিক বাসার কলিং বেল চেপে দাড়িয়ে রইলো। নিশাত এসে দরজা খুলে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলো আনন্দে।
-ভাইয়া, তুমি কেমন আছো ভাইয়া। সেই কখন থেকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি বলতো, এত দেরী কেনো করলে?
- সোনা বোনটা আমার। একটু কাজ পড়ে গেছিলো রে। রাগ করিস না বোনটি। এখন থেকে ভাইয়া তোকে অনেক সময় দিবে।
- আসতে না আসতেই তুমি কাজ শুরু করে দিলা ভাইয়া!
ওদিকে মাশফিকের মা এসে দুই ভাই বোনের খুনসুটি দেখছে। কতদিন পরে ভাইকে কাছে পেয়ে মেয়েটা যেনো আনন্দে আত্মহারা।
-হয়েছে, হয়েছে। আর আল্লাদ করতে হবেনা নিশু। ভাইকে এখন ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে দাও। কত দূর থেকে এসেছে ছেলেটা।
- আসসালামুআলাইকুম আম্মু। কেমন আছো তুমি?
- ভালো আছি বাবা। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি।
-ওকে, আম্মু।
.................
ইরা ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সারাদিনে ওকে কেউ আর ডাকে নি। সন্ধ্যায় মঈন চৌধুরী বাসায় এসে ইরার খোঁজ নিলো কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। বাধ্য হয়ে ইরার রুমে গিয়ে দেখলো, ও গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।
-ইরা মা! এই সন্ধ্যায় শুয়ে আছিস কেনো মা? শরীর খারাপ নাকি?
ডাকশুনে ইরা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো, বাবাই দাড়িয়ে আছে। বাড়িতে এই মানুষটাই ওকে ভালোবেসে আগলে রেখেছে, ঠিক যেনো বাবার মতো। তাকে দেখলেই সব দুঃখ কষ্ট পানি হয়ে বের হয়ে যেতে চায় চোখ দিয়ে। পরের ছেলে হয়েও ওকে কত ভালোবাসে, অথচ নিজের খালাই ওকে সহ্য করতে পারে না। এ কেমন দুনিয়া! ইরা বহু কষ্টে নিজেকে সামলালো। বললো,
- না বাবাই। তেমন কিছু না। একটু খারাপ লাগছে। তুমি
বসো বাবাই।
ইরা শোয়া থেকে বসতেই, মঈন চৌধুরী খেয়াল করলো,ইরার মুখ শুকিয়ে গেছে, সুন্দর মুখখানা লাল হয়ে আছে। সে ইরার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলো।
- একি মা! তোর শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমাকে বলিস নি কেনো?
- বাবাই তেমন কিছু না। তুমি মিছামিছি চিন্তা করছো।
- আবার কথা বলিস তুই? এত জ্বর নিয়ে পড়ে আছিস আর বলছিস কিছু না! তোর মামনিকে বলিসনি?
ইরা জানে, ওর খালার আচারনের কথা বললে আবার অশান্তুি হবে। তাই ও মিথ্যা বলতে বাধ্য হলো।
- না বাবাই। তেমন জ্বর তো আসে নি। তাই বলিনি।
মঈন চৌধূরী জানে, তার স্ত্রী ইরার সাথে ভালো আচারন করে না। নিজের আপন বোনের মেয়ে হয়েও যে কেনো নাফিসা চোধুরী ওর সাথে খারাপ আচারন করে, সেটাই বুঝে আসে না। কিন্তু সংসারে অশান্তি হবে চিন্তা করে চুপচাপ থাকে।
- চল মা, তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।
ইরা যেতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে যেতে হলো। হাসপাতালে টেস্ট করে ধরা পড়লো ইরার টাইফয়েড হয়েছে। ঔষধ কিনে বাসায় নিয়ে এলো।
.......
মাশফিক ফ্রেশ হয়ে খেয়ে বোনের সাথে গল্প করতে বসলো। কিন্তু মন পড়ে আছে সেই অনিন্দ্য সুন্দর মানবীর কাছে। অস্থির হয়ে আছে সে, যেনো একবার না দেখলে শান্তি মিলবে না কোথাও। নিশাত তার কলেজের কথা, বন্ধু বান্ধবী সবার কথা বলছে। মাশফিকের সেদিকে মনযোগ নেই। সবশেষে ইরার কথাও বললো। ইরার কথা শুনে চমকে উঠলো মাশফিক।
- জানো ভাইয়া, আমাদের বাসার তিনতলায় একটা আপি আছে, ওর নাম ইরা। আপিটা উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। খুব ভালো মেয়ে। মেয়েটা খুবই মেধাবী, আর দেখতেও সুন্দর অনেক।
মাশফিক ভাবতে লাগলো, যার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করেছিলো, শুধু অপেক্ষা নয়, কল্পনায় আঁকতো, সেই প্রতীক্ষিত মানবীর নাম ইরাবতী! মাশফিক ভেবেই নিয়েছিলো, এমন কোন মেয়ের দেখা, সেই আকাঙ্ক্ষিত মুখশ্রীর দেখা সে এই ইহলোকে পাবে না কিন্তু ইরাকে দেখার পর তার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান পাল্টে গেলো। মনে হলো এই রহস্যময়ী, ঝড়নার মতো প্রাণোচ্ছল, শুভ্র, নিষ্কলুষ মানবীকে সে যুগ যুগ ধরে চিনে। যেনো তার হৃদয়ের গহীনে লুকানো ভালোবাসা গুলো তার জন্যই জমানো ছিলো এতকাল।আজ এই বালিকাকে দেখার পর সব সুপ্ত আবেগ ভালোবাসাগুলোর ঘুম ভেঙ্গে গেছে, বাঁধনহারা হয়ে গেছে তার অনুভূতিগুলো। ইতিহাসে যেসব নারীদের নাম আছে, যাদের সৌন্দর্যের কারনে রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ লেগেছিলো, তারা কেউ এই ইরাবতীকে দেখেনি । দেখলে এই ইরাবতীকে নিয়ে আর একটা যুদ্ধ নিশ্চই রচনা হতো। মাশফিক কল্পনায় হারিয়ে যাচ্ছে বার বার।
নিশাত মাশফিকের কাছে ইরার জীবনের করুন কাহিনী বললো। ইরার কষ্টের কথা শুনে ওর বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে মনে হয়। সব শুনে মাশফিক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,
- "ইরাবতী, তোমাকে ওই নরক যন্ত্রনা থেকে আমি উদ্ধার করবো। তোমাকে এত বেশি ভালোবাসবো যেনো তুমি অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাও। সব ব্যথা ভুলে যাও। তুমি এতদিন যে কষ্ট পেয়েছো, তার শতগুন সুখ আমি তোমায় এনে দেবো। তোমার ওই মায়া জড়ানো মুখে এক পৃথিবী হাসি এনো দেবো। তোমাকে আমি মুক্তি দেবোই ইরাবতী"
চলবে.........
পূর্ববর্তী পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/863804067758424/?app=fbl