কোটের বাইরে গেটের সামনে আমার নিঃশর্ত মুক্তির জন্য কয়েকশো মানুষ ভিড় করেছে। আমি বুঝতে পারছিনা এরা কেন আমাকে বাঁচাতে চাইছে! আমি তো বাঁচতে চাইনা। যে পৃথিবীর বুকে আমার ছোট্ট মেয়ের জায়গা হল না সেই পৃথিবীতে আমিও থাকতে চাইনা।
জজ সাহেবা ছোট করে একটি নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন আপনি এই কেসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বার বার স্বীকার করেছেন আপনি সজ্ঞানে,নিজের ইচ্ছায় রাতুল নামের ছেলেটিকে হত্যা করেছেন। আমি মা হিসেবে আপনার কষ্ট বুঝতে পারছি , কিন্তু আপনি যেটা করেছেন সেটা কোন ভাবেই কাম্য নয়। আপনার উচিত ছিল আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে, আইনের উপর বিশ্বাস রাখা। যেহেতু আপনি নিজেই হত্যার কথা স্বীকার করেছেন তাই আমি আপনাকে মৃত্যুদন্ড দিতে বাধ্য হলাম।
উনার রায় পড়ে শুনানো শেষ হলে উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - আপনি আর কিছু বলতে চান? আমি উনার দিকে তাকিয়ে আকুল ভাবে বললাম - জজ সাহেবা আজ রাতেই আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দিন। একটু দয়া করুন এই পৃথিবীর আলো বাতাস আমার কাছে অসহ্য লাগছে। আমার মেয়েটি গত দুই মাস থেকে অন্ধকার ঘরে একা একা ভয় পাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি আমার মেয়েটির কাছে যেতে চাই। উনি ব্যাথিত চোখে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ মুছতে মুছতে নিজের চেয়ার ছেড়ে ভিতরে চলে গেলেন।
হাতকড়া পরানো অবস্থায় আমাকে এজলাস থেকে বাহিরে নিয়ে আসা হল। আমাকে দেখেই আমার পরিবারের সকলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এদের কারো জন্য আমার বিন্দু মাত্র খারাপ লাগছেনা । আমি তো এই দুই মাস শুধু এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। আমার মেয়ের বাবা আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন রাখি তুমি কোন চিন্তা করো না। যতো দ্রুত সম্ভব হাইকোর্টে আপিল করবো আমি কোন মতেই তোমাকে মরতে দিব না । আমি ঠাণ্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম তুমি,আমি আমরা কেউ কি 'রুপকথা' কে বাঁচাতে পেরেছি? পারিনি।
তুমি যদি আমাকে আর আমার মেয়েকে ভালোবাস তাহলে আমাকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা তুমি করবেনা। তোমরা সবাই কেন বুঝতে পারছোনা গত দুই মাস থেকে আমি একটি রাতও ঘুমতে পারিনি। যখনই আমি দুই চোখের পাতা এক করেছি তখনই আমার মেয়ের ক্ষতবিক্ষত ছোট্ট শরীরটা আমার চোখে ভেসে উঠেছে। আমি যদি বেঁচে থাকি কোন রাতে আমি ঘুমুতে পারবোনা। দিনগুলি আমার কাছে নরকের মত মনে হয়।
আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দেও,আমি আমার কাজ শেষ করেছি। এই পৃথিবীতে আমার আর কোন প্রয়োজন নেই। ও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য আর সুযোগ পেল না। সকলে আমাকে ঘিরে ধরল যদিও পুলিশ চারদিক থেকে আমাকে ধরে রেখেছে।
একেকজন আমাকে একেক প্রশ্ন করতে লাগলো। আমি কিছুক্ষন তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম- আমি আপনাদের আজ আমার জীবনের একটি ঘটনা বলি। সেটা শুনলেই আমার মনে হয় আপনারা আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।
আমার বিয়ের পাঁচ বছর পরেও যখন আমার কোন সন্তান হচ্ছিল না সেই সময় আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। আমার স্বামীর অনেক টাকা পয়সা । কিন্তু সেই টাকা ভোগ করার কোন মানুষ নেই। আমি আর আমার শাশুড়ি যে যেখানে বলছে সেইখানেই ছুটে গিয়েছি। ডাক্তার,কবিরাজের কতো ঔষধ আমি খেয়েছি তার কোন হিসেব নেই । কারো ছোট বাচ্চা দেখলেই আমি কাঁদতে থাকতাম। আমার শাশুড়ি আমাকে আগলে ধরলেন। নানা ভাবে আমাকে বুঝাতেন, বলতেন আল্লাহ্কে ডাকো বৌমা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ তোমার কোল ভরে দিতে পারবেনা। আল্লাহ্ মানুষকে অনেক জ্ঞান দিয়েছেন কিন্তু দুটি জিনিস তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন এক জন্ম, দুই মৃত্যু। এই দুইটি উনি ছাড়া কেউ করতে পারেন না। আমি রাত দিন নামায পড়ে আল্লাহ্র কাছে একটি সন্তানের জন্য কাঁদতে লাগলাম।
যাদের বাচ্চা হয়না এই কষ্ট শুধু তারাই বুঝবেন । অবশেষে আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করলেন। ডাক্তার আমাকে বললেন খুবই সাবধানে থাকতে হবে। যেহেতু আগে আমার সমস্যা ছিল তাই যেকোনো সময় আমার মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে। সেইদিনের পর থেকে নয় মাস পর্যন্ত আমি সারাক্ষন আতংকে থাকতাম, কি জানি কি হয় । শেষের দিকে এমন অবস্থা হয়েছে আমি ঘুমাতে পারতাম না টেনশনে। আমার প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছিলো। ছয় মাসের সময় আমার কোমরের হাড় এক ইঞ্চি পরিমান ফাঁক হয়ে গিয়েছিলো। কি পরিমান কষ্ট যে আমি এই নয় মাস ভোগ করেছি সেটা বলে বুঝাতে পারবোনা। অবশেষে আমার কোল আলো করে আমাদের একমাত্র মেয়ে 'রুপকথা' পৃথিবীতে এলো।
রুপকথার জন্মের পরে আমাদের ঘর আনন্দে ভরে গেল। এত সুখ, এতো সুখ আমার জীবনে ভরে গেলো। রুপকথার জন্মের তিন বছরের সময় আমার শাশুড়ি মারা গেলেন। আমাদের সংসারে আবারও শোকের ছায়া নেমে এলো। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা সেই শোক কাটিয়ে উঠলাম। রুপকথা কে পাঁচ বছরের সময় আমাদের বাসার পাশেই একটা স্কুলে দিয়ে দিলাম। আমিই ওকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেতাম নিয়ে আসতাম। আমার মেয়ের কথা শুনলে, ও দুষ্টুমি করলে, ওর হাসি দেখলে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ভাবতাম। কিন্তু আমার জন্য যে কি কঠিন সময় অপেক্ষা করছিল আমি সেটা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি।
সেইদিন ছিল সোমবার। মেয়ের বাবা যথারীতি সকালে অফিসে চলে গেলো, আমি মেয়েকে নিয়ে স্কুলে । মেয়ের বয়স তখন ছয়, আমি কখনো ওকে একা একা কোথাও যেতে দিতাম না। স্কুলেও সারাক্ষন বসে থাকতাম, যদিও স্কুল থেকে বাসা খুব কাছে ছিল। সেইদিন আমার স্কুলে বসে থাকাকালীন অবস্থায় শরীর খুব খারাপ করলো। আমি আর বসে থাকতে না পেরে বাসায় চলে আসলাম ভাবলাম ছুটির সময় গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো। কিন্তু ছুটির সময় হয়ে গেলো আমার শরীর ঠিক হল না । বাসার কাজের খালাকে বললাম খালা আপনি যাবার সময় রুপকথাকে কি একটু বাসায় এনে দিয়ে যেতে পারবেন? উনি রাজি হলেন। মেয়েকে স্কুল থেকে এনে উনি ফোন করে আমাকে বললেন খালাম্মা আপামনিরে লিফটে উঠাই দিছি আপনি দরজা খুলে দাঁড়ান। আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দাঁড়ালাম। কিন্তু পাঁচ -ছয় মিনিট পার হয়ে গেলেও মেয়ে উপরে আসলো না। আমাদের এই দশ তলা বিল্ডিং এর পাঁচ তলায় আমরা থাকি। লিফটে করে পাঁচ তলায় উঠতে এতো সময় লাগার কথা না । আমি তাড়াতাড়ি লিফটের সামনে গিয়ে দেখি লিফট নিচের দিকে নামছে। আমি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে দেখি লিফট খালি । দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করাতে ও বলল আপামনিরে তো কাজের মহিলা লিফটে উঠিয়ে দিয়েছে আমি দেখলাম কেন উনি বাসায় যায় নাই? আমি না বলাতে দারোয়ান আর আমি মিলে আবার উপরে গেলাম ও বাসায় গিয়েছে কিনা দেখতে। কিন্তু গিয়ে দেখি না আমার বাসা খালি। এই বার আমি ভয় পেলাম। সেই ভয় যে ভয় আমি রুপকথাকে পেটে রেখে নয় মাস পেয়েছিলাম, ওকে হারানোর ভয়।
আমি রুপকথার বাবাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলে এক তলা থেকে দশ তলার মোট বিশটি ফ্লাটের সব বাসায় মেয়েকে খোঁজ করলাম কিন্তু কেউ আমার সোনামণির কোন খোঁজ দিতে পারলনা। আমি পাগলের মত ছোটাছুটি করতে লাগলাম। আশেপাশের কিছু মহিলাও আমার সাথে মিলে ওকে খুঁজতে লাগলো। দারোয়ান বার বার বলতে লাগলো আপা এই বিল্ডিং এই আছে। আমি গেটের থেকে কোথাও যাই নাই । মেয়ের বাবা পুলিশ নিয়ে আসলেন। পুলিশ এসে নানা প্রশ্ন করতে লাগলো। হটাৎ করে আমার মনে হল ছাদে তো দেখলাম না । আমি এক দৌড় দিয়ে ছাদের দিকে ছুটে গেলাম গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলো, আমার রুপকথা, আমার আদরে মানিক, আমার কলিজার টুকরা ছাদের ফ্লোরে পড়ে আছে। ওর মাথার এক পাশ থেঁতলানো সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত। সমস্ত মুখে,শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঁচড়ের দাগ। আমার সোনার ছোট্ট শরীরে কোন কাপড় নেই। সারা শরীর লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি আমার মেয়েকে টেনে কোলে তুলে নিলাম। তখনো আমার সোনার শরীরে প্রান আছে ও আমাকে দেখেই অনেক কষ্টে বলে উঠল আম্মু অনেক ব্যাথা ,অনেক ব্যাথা।
এই ছিল আমার অনেক সাধনার ফসল,আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান, আমার আদরের একমাত্র মেয়ের বলা শেষ কথা । আমি পাথর হয়ে গেলাম। আমি চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছি আমার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হয়নি। আমার চোখ দিয়ে কোন পানি পড়েনি। ওর বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে আর বার বার বলেছে রাখি একবার কাঁদো, একটু খানি কাঁদো। রাখি তুমি যদি এমন করো তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচব? আমি কাঁদতে পারিনি। কিছুক্ষন পরে পুলিশের একজন এসে বলল রহমান সাহেব আপনাদের বিল্ডিং এর তিন তলার ডান পাশের ফ্লাটের একটি ছেলেকে আটক করেছি। মনে হচ্ছে ওই এই কাজ টা করেছে। আমার শরীরে যেন বিদুৎ খেলে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল ডাক্তার দম্পত্তির বড় ছেলের মুখ। রুপকথাকে যখন আমি খুঁজছিলাম এই ছেলেটি দরজা খুলে বলেছে না আমি তো আপনার মেয়েকে দেখিনি। আসলে ঐ সময় আমার মেয়েটি ঐ বাসায় ছিল । মেয়ের বাবা পুলিশের সাথে নিচে গেলেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে আমার রুমে গেলাম। বড় নামাযের ওড়নাটা দিয়ে সারা শরীর ঢেকে নিলাম। তারপরে রান্না ঘরের বটিটা সেই ওড়নার নিচে নিয়ে তিন তলায় নেমে আসলাম। দেখি ওইখানে অনেক ভিড়। আমি ওদের ঠেলে সামনে গেলাম ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা-মা দুইজনই ওকে দুই পাশ থেকে ধরে রেখেছে। আমার মেয়ের বাবা ছেলেটিকে বেশ কয়েকবার থাপ্পড় দিল। ওর মা আমাকে দেখে বলে উঠল ভাবি জানেন তো ও নেশা করে কিন্তু এই রকম একটা কাজ করবে ভাবতেও পারিনি। বলেই হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। আমি ছেলেটির সামনে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম মেরে ফেললে কেন? তোমার যা করার তা তো করেছো, আমার মেয়েটিকে মারলে কেন? জানো ওকে পৃথিবীতে আনার জন্য আমি কতো কষ্ট করেছি?ওকে জন্ম দিবার সময় আমার কতো কষ্ট হয়েছে? এই ছয় বছর থেকে তিল তিল করে আমি ওকে বড় করেছি। ওকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখেছি। তুমি মাত্র দশ মিনিটের লালসার জন্য আমার এতো বছরের সব স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দিলে ?কেন মেরেছ ওকে? ছেলেটি মিনমিন করে উত্তর দিল ও বার বার বলছিল আমি যে ওর সাথে এমন করেছি সব কথা ও আপনাকে বলে দিবে। তাই আমি ওকে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়েছি। আমি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। কেউ কিছু বলার আগে আমি বঁটি দিয়ে এক কোপে আমার কাজ শেষ করে দিয়েছি। চারপাশে হৈ চৈ পড়ে গেলো আমার মেয়ের বাবা বলে উঠলেন কি করেছো রাখি!! আমি বললাম আমার মেয়েকে আমি জন্ম দিয়েছি। আমি এতো কষ্ট করে মেয়ে বড় করেছি। সেই মেয়েকে যে নরপিশাচ এমন নিশংসভাবে মেরেছে আমি তাঁর বিচার করলাম।
আমার আমার কথা বলা শেষ করে তাকিয়ে দেখি সবাই তাদের চোখের পানি মুচছেন । আমি বললাম আপনারা ঘরে ফিরে যান আমি বাঁচতে চাইনা । আপনাদের কাছে শুধু আমার একটি অনুরোধ থাকবে। আপনার আদরের মেয়েকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করবেন না। কারন সবখানেই মানুষরূপী জানোয়ারগুলো ঘাপটি মেরে বসে আছে। সুযোগ পেলেই ওরা আমার রুপকথার মত আপনার রুপকথাকেও খুবলে খুবলে খাবে।